(১)
“We have but faith: we cannot know;
For knowledge is of things we see
And yet we trust it comes from thee,
A beam in darkness: let it grow.

Let knowledge grow from more to more,
But more of reverence in us dwell;
That mind and soul, according well,
May make one music as before,” – In Memoriam, by Alfred Tennyson

আর্থার হেলামের মৃত্যুকে মানতে চাননি টেনিসন-বন্ধু জীবনে অনেক আসে। কিন্ত যার চিন্তাধারা নিয়ে অহরহ নিজের সাথে, সমাজের সাথে এমনকি তার সাথেও বিতর্ক- সেই মানুষটি হঠাৎ করে জীবন থেকে হারিয়ে গেলে, অপূর্নতার বোঝাটা কিছুতেই হাল্কা হয় না জীবন থেকে।

মৃত্যু জীবনে খুব বেশী দেখেছি -তা না। দাদু দিদা, ঠাকুমা, ঠাকুর্দা-সবাই পরিণত বয়সেই মারা গেছেন।

মৃত্যুকে প্রথম খুব কাছ থেকে দেখা-আই আইটির সেকন্ড ইয়ারে। ইন্দ্রজিত ব্যানার্জি ওরফে ঝিকুর অকাল মৃত্যু। ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে আড্ডার একটা ছোট গ্রুপ ছিল-সৌগত ওরফে বুম্বা ( লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), অনুপম ( ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক), ঝিকু আর আমি। সবারই তখন প্রথম ভালোবাসা ফিজিক্স-আমরা নতুন কিছু শিখলে চায়ের টেবিলে গ্রুপ আড্ডা হত। প্রকৃতির অপার রহস্যে মুগ্ধ প্রাণ সব-হঠাৎ ঝিকু তিনতলা থেকে পড়ে মারা গেল। খবর পেয়ে যখন হাঁসপাতালে ছুটলাম-ওর নিথর দেহ দেখে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আগের রাতেই ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্সের একটা প্রবলেম নিয়ে ওর সাথে তুমুল বিতর্ক হয়েছে। আজ ওর নিথর দেহের সামনে দাঁড়িয়ে। এর পরের কয়েকটা মাস- ক্যান্টিন, লাইব্রেরী-আড্ডা -সবই চলছে-কোন পূর্নচ্ছেদ নেই-কিন্ত তবুও কিছু একটা মিসিং।

ঠিক একবছর আগে-২৬ শে ফেব্রুয়ারী-অফিসে যাচ্ছি- জামান ফোন করে জানাল অভিজিতকে মেরে দিয়েছে। বন্যা বাঁচবে কি না ঠিক নেই।

না অভিজিতেদের সেই নিথর দেহকে শুধু ফটোতেই দেখেছি-কিন্ত বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল- অভিজিত নেই। প্রায় একদশকের ওপরে মুক্তমনাতে ওর সাথেই বিতর্ক হয়েছে সব থেকে বেশী-বিতর্কের চেয়ে ভাবের আদান প্রদানটাই ছিল মুখ্য। কিছু বিতর্ক তিক্ততাতেও পরিণত হয়েছিল-কিন্ত আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল মধূর। কারন আমরা দুজনেই জানতাম-আমাদের বেস ন্যাচারিলিজম। অর্থাৎ বিজ্ঞানের দর্শনকেই জীবন দর্শন হিসাবে মানা। তবে জীবনে কি করিতে হইবে, তার সমাধান বিজ্ঞানে নেই-সেখানে পার্থক্য আসবেই-এবং ছিলও। এবং তাই নিয়ে বিতর্ক হয়েছে।

গত এক বছরে যখনই লিখতে বসি-হঠাৎ হঠাৎ করে মনে হয় কিছু একটা জীবনে মিসিং। কিছু নেই। কিছু একটা বাদ যাচ্ছে। কোথাও কোন একটা অপূর্ণতা।

(২)

অভিজিত রায়কে বিজ্ঞান লেখক বলে ছোট করতে চাই না। বাংলা ভাষায় আরো অনেকেই বিজ্ঞানের বই লিখেছে-তাদের সাথে এক কাতারে ফেলে অভিজিতকে বিজ্ঞান লেখক বললে, অভিজিতের প্রতিভা এবং অবদান, দুইএর প্রতিই অসন্মান করা হবে। আবার অভিজিত রায়কে শুধু সেকুলার লেখক, ইসলাম ব্যাশার-ইত্যাদি এঙ্গলে দেখলেও ছোট করা হয়।

অভিজিতের সব থেকে বড় অবদান-বাংলায় ক্রিটিক্যাল রাইটিং এর প্রচলন। যা আমেরিকাতে স্বাভাবিক-কিন্ত বাংলায় এবং ভারতে বিরল। ক্রিটিক্যাল রাইটিং এর অর্থ-একটি বিষয়কে সম্পূর্ন “ফ্যাক্ট” ভিত্তিক ভাবে দেখে-ভাল খারাপ দুটোদিকই দেখতে হবে। অভিজিত রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ , হজরত মহম্মদ, কার্ল মার্ক্স-সবাইকে সমালোচনা করে অনর্গল লিখে গেছে। কমিনিউজম, বিবেকানন্দ বা হজরত মহম্মদের বিরোধিতায় আমি আর অভিজিত এক পক্ষেই লিখেছি। কিন্ত রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে আমি ওর লেখার তীব্র বিরোধিতা করেছি। কিন্ত সাহিত্য সমালোচনায়, এগুলো খুব উপভোগ্য বিতর্ক ছিল। বিশেষত রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর পত্র এবং ল্যাবেরাটরি নিয়ে অভি আর আমার ব্যপক মতান্তর হয়েছে- ও আমাকে রবীন্দ্র পুজারী বলে গালাগাল দিয়েছে-আমি ওকে সাহিত্যে নাবালক ইত্যাদি নানান বিভূষনে বিঁধেছি। কিন্ত এগুলো মোটেও আমাদের সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব নষ্ট করে নি। হিন্দুত্ববাদি, ইসলামিস্ট বা কমিনিউস্টদের বিরুদ্ধে আমরা একসাথেই লড়েছি।

এটাই ওর আর আমার বিশ্বাস ছিল-সৎ ভাবে তর্ক করি শেখার জন্য। মুক্তমনা প্ল্যাটফর্ম আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। ও বিশ্বাস করেছে-তর্ক করি অন্যের কাছ থেকে শেখার জন্য-শেখা এবং জ্ঞানার্জন -নিজেকে সমৃদ্ধ করাটাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। তর্ক করে নিজের জ্ঞান প্রদর্শন না-শ্রেফ শিখতে চাই, নিজেকে তর্কের মাধ্যমে আরো সমৃদ্ধ করতে চাই- এই তীব্র বিশ্বাস ছিল ওর প্রতিটা নিঃশ্বাসে।

ধর্ম বিরোধি লেখক -শুধু এই তকমাতে অভিকে আবদ্ধ রাখাটাও ওকে অপমান করা। ও কি নিয়ে লেখেনি? ভিক্টরিয়া ওকাম্পোর সাথে রবি ঠাকুরের প্রেম থেকে , মহাজাগতীয় ইনফ্লেশন-সেখান থেকে বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, মহম্মদ, তিতুমীর -জৈব বিবর্তন-সব কিছু নিয়েই লিখে গেছে।

অভিজিতকে যখন কেউ শুধু মাত্র ধর্ম বিরোধি, বিজ্ঞান লেখক ইত্যাদি তকমায় বাঁধতে চায়-তারা ভীষন ভুল করে। অভি একজন নাস্তিক-যে জানত তার জীবন একটাই। তাই পরিপূর্ন ভাবে এই একটা জীবনেই সব মহাজাগতিক রহস্যকে জানতে চেয়েছে-নিজেকে প্রতিটা মুহুর্তে সমৃদ্ধ করতে নিয়োজিত করেছে- সমভাবাপন্ন লোকেদের সংগঠিত করেছে।

জ্ঞানার্জনের অপার আনন্দই ছিল অভিজিতের মোক্ষ-আর ও সেই জ্ঞানকে দুহাতে বিলিয়ে দিয়েছে বাঙালীদের মধ্যে। ওর প্রতিটা লেখাতেই কঠিন পরিশ্রমের ছাপ-প্রায় প্রতিটা লেখাই বাংলা ভাষায় মাইলস্টোন।

(৩)

অভিজিতের সমালোচনা না করলে, ওর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য সম্পূর্ন হবে না। কারন ও সারা জীবন একটা জিনিসই চেয়েছে-বাঙালী মন আরো বেশী ক্রিটিক্যাল হৌক-সব দৃষ্টিকোন থেকে দেখা শিখুক বাঙালী। কোন ব্যক্তিই সমালোচনার উর্দ্ধে না-এটাই অভি রায়ের মূল বক্তব্য।

অভিজিতের দুর্বল জায়গা ছিল রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দর্শন। অভি ধর্মগ্রন্থ এবং তাদের সমালোচনাতে যতটা দক্ষতা অর্জন করেছে-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ওর লেখাগুলি ততটা পরিণতি পায় নি।

আর সমালোচনার ক্ষেত্রে ও ছিল কনটেক্সচুয়াল-ফলে ব্রড পিকচারটা অনেক ক্ষেত্রেই মিস করেছে।

এবং অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মে বিশ্বাসী লোকেদের হৃদয় ব্যপারটা বোধ হয় অভিজিতের রাডারে ছিল না। লিব্যারেশন থিওলজি ও একধরনের ভাববাদ-তাই পরিতজ্য- সুতরাং ধর্মের সবটাই ফেলে দিতে হবে-এই লাইন নেওয়াতে অভিজিতের বিচ্ছিন্নতা আরো বেড়েছে। ওর ধর্ম বিরোধিতাতে লিব্যারেশন থিওলজির ব্যাপারটা আসে নি-ফলে অভি রায়ের ধর্ম বিরোধি লেখাগুলোতেও ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিভংগীর কিছুটা অভাব আছে।

ধর্মের সাথে রাজনীতি এবং আর্থসামাজিক অবস্থানের গভীর যোগের ব্যপারটাও অভিজিতের লেখাতে অনেক ক্ষেত্রেই মিসিং।

কিন্ত সব থেকে বড় কথা হচ্ছে- ও নিজের লেখার এই দুর্বলতা গুলো ভালোই জানত। ওকে জানালে বলত এর জন্য তোমরা আছ। আমি একাই সব লিখব না কি? আমি আমার লাইনে থাকব!

(৪)

মৃত্যু অভির মতন মানুষের পূর্নচ্ছেদ না। ওর মুক্তমনার জন্যই আজ বাংলাদেশের চূড়ান্ত রক্ষনশীল মুসলমান সমাজ থেকে দুনিয়া কাঁপানো নাস্তিকদের আমরা পাচ্ছি। ওর সাংগঠনিক প্রচেষ্টার জন্যই, আমাদের বাঙালীদের যে নিজস্ব একটা ধর্ম আছে- আমরা এক মহান লিব্যারাল ট্রাডিশনের উত্তরাসূরী -ইসলাম এবং হিন্দুত্বের আগ্রাসনের মধ্যেও আমাদের লিব্যারাল চিন্তাধারাকে ধরে রাখতে পেরেছি। শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর থেকে আহমেদ ছফা- বাঙালীর বুদ্ধিচর্চার যোগ্য উত্তরাসূরী অভিজিত রায়।

গুরুদেবকে স্বরণ করেই লিখি ঃ

এই মৃত্যু? এ তো মৃত্যু নয়।
কিন্তু রে পবিত্র শোক যায় না যে দিন
পিরিতির স্মিরিতিমন্দিরে,
উপেক্ষিত অতীতের সমাধির ‘পরে
তৃণরাজি দোলে ধীরে ধীরে,
মরণ-অতীত চির-নূতন পরান
স্মরণে করে না বিচরণ–
সেই বটে সেই তো মরণ!