ছাব্বিশ তারিখ ওখানে ছিলাম না আমি। ওখানের সামনে দিয়ে আমি হেঁটে গেছি তখন কিংবা তার কিছু পরে। তখনো সেখানে জটলা চিৎকার এবং রক্ত। হয়ত যাদের রক্ত তাদেরই কারো চিৎকার ছিল সেখানে। হয়ত যাদের রক্ত তখনো তারা সেখানে ছিল। আমরা সেদিকে তাকিয়ে রাস্তার উল্টোদিক ধরে শাহবাগের দিকে হেঁটে গেছি আমাদের কমন এক সিনিয়র পুলিশ বন্ধুর উপদেশ স্মরণ করে- সিকিউরিটির পয়লা পদক্ষেপ হলো জটলা এড়িয়ে চলা। গ্রেফতারের কোটা পূরণ করতে পুলিশ জটলা থেকেই দর্শক ধরে নিয়ে আসামী বানায়…
হয়তাবা একসিডেন্ট। হয়ত ছিনতাই। হয়তবা অন্য কিছু। টুটুল রুনা তারেক আর আমি। হাঁটতে হাঁটতে যখন ছবির হাটে গিয়ে চায়ে চুমুক দিয়েছি তখনই টুটুলের ফোনে আরিফের ফোন। আরিফ জেবতিক- অভিজিৎ রায় কি আপনাদের সাথে? টিএসসিতে একটা এ্যাটাক হয়েছে এক পুরুষ আর এক নারীর উপর। সন্দেহ হচ্ছে তারা অভিজিৎ আর বন্যা…
আরিফ শাহবাগের মোড়ে। সেখানে গণজাগরণ মঞ্চের অনেকেই তখন জড়ো হয়ে গেছেন। কেউ একজন বলল আক্রান্তদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে ঢাকা মেডিকেলে…
ছবির হাটেই একবার ফোন করেছে টুটুল। আবার চেষ্টা করছে। ফোন বন্ধ কিংবা ধরছে না কেউ। হঠাৎ মনে হলো রায়হান আবীর জানতে পারে অন্য কোনো নম্বর। রায়হান আবীরকে ফোন করলাম। না অন্য কোনো নম্বর তার কাছেও নেই। কিছুক্ষণ পর আগের ফোনে ট্রাই করে রায়হানেরর ফিাতি ফোন- ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না তাদের…
শাহবাগের কেউ কেউ ঢাকা মেডিকেলে পরিচিত নম্বরে যোগাযোগ শুরু করেছে। নাট্যকর্মী সজল কাজ করে ঢাকা মেডিকেলে। ফোন করলাম- টিএসসি থেকে ইমার্জেন্সিতে নেয়া দুইজন মানুষের নামগুলা আমাকে জানা। সজল ছুটিতে সেদিন। কিছুক্ষণ পর সহকর্মীদের কাছে সন্ধান নিয়ে সজলের ফিরতি ফোন- একজনের নাম বন্যা আর আরেকজনের কী যেন একটা হিন্দু নাম…
ততক্ষণে অন্য সোর্স থেকে বাকিরাও নিশ্চিত হয়ে গেছে। টুটুল-তারেক আর রুনা রিকশায় উঠে রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে ঢাকা মেডিকেলে। শাহবাগের একদল তরুণ শুরু করেছে মিছিল…
সিএনজি থেকে নেমে বাসার নীচে মেয়ের অষুধ নিয়ে মানিব্যাগে হাত দিতে যাব এমন সময় তারেকের ফোন। তারেক রহিম- অভিজিৎ দা আর নেই…
তারেকের ফোন কেটে দৌড়ে বাসায় ঢুকতেই দিনা কিছু বুঝে ফেলে। কিছু বলি না আমি। পানি মিশিয়ে সাসপেনশনটা বানিয়ে মেয়েকে খাওয়াই। দিনা এখনো অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে। আমি শুধু বলি- অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে। শাহবাগে। একটু আগে…
দিনা ঝিম মেরে বসে থাকে। তারপর একটা অদ্ভুত চিৎকার বের হয়ে আসে তার গলায়। দিনার কান্না দেখে দেড় বছরের মেয়েটাও কেঁদে উঠে চিৎকার দিয়ে। আমি দিনাকে কাঁদতে দিয়ে মেয়েকে কোলে করে বারান্দায় নিয়ে রিকশা আর গাড়ি দেখাই…
অভিজিৎ রায় আর বন্যা আহমেদ ততক্ষণে টেলিভিশনে। হাসপাতালে বাড়ছে ভিড়; টিভিতে বাড়ছে বিশ্লেষণ। টুটুলকে ফোন করি। টুটুলের সংক্ষিপ্ত উত্তর- পরিস্থিতি বুঝতে পারছি না। ফোন হাতের কাছে রেখো…
ইন্টারনেট ততক্ষণে ভরে উঠেছে শোকে-মন্তব্যে-বিস্ময়ে-বিশ্লেষণে-সমালোচনায়। আমি কিছুই করতে পারি না। খালি মনে হয় যাদের সাথে সারাটা সন্ধ্যা বইমেলায় লেখা আর বই নিয়ে আড্ডা; মেলা শেষে সামান্য আগে পরে মেলা থেকে বের হওয়া। তার কিছুক্ষণ পরেই একজন খুন আরেকজন মৃতপ্রায়। তাদের অপরাধ শুধুই লেখালেখি করা। তাদের অপরাধ বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলা…
কিছুই ভাবি না আমি। খালি মনে হয়- এ মৃত্যু আমারও…
০২
ক্ষ্যাপা মানুষ আক্রমণ করতে পারে যে কারো উপর। ক্ষ্যাপা মানুষের আক্রমণে যে কেউ মরতেও পারে। কিন্তু হাজারো মানুষ আর ক্যামেরার সামনে আক্রমণ করে সম্পূর্ণ গায়েব হওয়া কীভাবে সম্ভব?
প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খায় মাত্র কিছুদিন। তারপর নিজের মতো করে প্রশ্নটার উত্তর আমি পেয়ে যেতে থাকি। প্রায় প্রতিদিন পুলিশ এই হত্যা নিয়ে মিডিয়ায় হাজির। কিন্তু তাদের সমস্ত কথাবার্তা ড. অজয় রায়কে রেফারেন্স করে- প্রফেসর রায় এই বলেছেন; সেই অনুমান করেছেন। যেন হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার সমস্ত দায় সন্তানহীন পিতার আর পুলিশের দায়িত্ব হচ্ছে মিডিয়ায় তার মন্তব্য প্রচার…
তার কিছুদিন পরেই আমরা দেখি অভিজিতের মৃত্যুর দায়টা আধা-সরকারিভাবে চাপিয়ে দেয়া হয় অভিজিতের উপর। প্রধানমন্ত্রীর সন্তান- সিংহাসনের ভবিষৎ উত্তরাধিকার আর উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় মন্তব্য করেন- অভিজিৎ স্বঘোষিত নাস্তিক আর সরকার মানুষের কাছে নাস্তিক হিসেবে পরিচিত হতে চায় না…
নাস্তিক হত্যার বিচার করলে নাস্তিক হিসাবে পরিচয় না পেলেও নাস্তিকের সহযোগী হিসাবে সরকারের পরিচয় লুকানো তো সত্যিই কঠিন। সেজন্যই দেখি প্রধানমন্ত্রী সন্তানহারা পিতাকে সান্ত¡না দিতে গেলেও তা মিডিয়ায় চেপে দেয়া হয়…
আমরাও বুঝে যাই যে পুলিশ বুঝে গেছে এই মামলা নিয়ে মিডিয়ায় উপস্থিত হওয়া ছাড়া আর কিছু করা নিষেধ। জঙ্গীরা বুঝে গেছে দুই চাইরটা নাস্তিক ফেলে দিলে সরকারের কোনো আপত্তি নাই; বরং দেশ নাস্তিকমুক্ত হলে খোদ সরকারে স্বস্তি বাড়ে…
বছর তো ঘুরেই গেলো। আরো কয়েকটা হত্যা হলো সিরিজ আকারে। আমরা শুধুই দেখলাম প্রতিটা ঘটানার পর সরকারের কেউ মৃত্যুর দায়টা আনুষ্ঠানিকভাবে মৃতকেই দিয়ে গেলেন। আর দেখলাম মিডিয়াতে পুলিশের রুটিন উপস্থিতি যার ধারাবাহিকাতায় মাত্র কিছুদিন আগে আইজিপি জানালেন- অভিজিৎ হত্যার কোনো ক্লু এখনো পাওয়া যায়নি খুঁজে…
আইজিপি হত্যার ক্লু পাননি; কিন্তু হত্যা করার জন্য মৌলবাদীদের গ্রিন সিগনাল দিতেও পিছাননি। সীমান লঙ্ঘন না করার জন্য তার মুখে লেখকদের শাসানিতে কি মৌলবাদীরা কোনো সিগনাল পায়নি? অবশ্য তাকে আর দোষ দিয়ে কী লাভ? তিনি নিজেই তো লেখকদের শাসানি দেবার সিগনালটা পেয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কাছে- অনুভূতি তিনারও আছে। এক্কেবারে সেই অনুভূতি যেইটা আছে মৌলবাদী কিংবা তিনার অঙ্গসংগঠন ওলামা লীগের…
প্রধানমন্ত্রীর অনুভূতির সিগনাল পায় পুলিশ; পায় মৌলবাদী; পায় বাংলা একাডেমি আর আমরা পাই উপলব্ধি- অভিজিৎ হত্যার কোনো ক্লু কোনোদিনও পাওয়া যাবে না আর…
০৩
যে নাট্যকর্মীটা ২৬ তারিখ ফোনে কইল- একজনের নাম বন্যা আর আরেকজনের কী যেন একটা হিন্দু নাম। সেই ছেলেটার নাম সজল। সাধারণ পোলা। থিয়েটার করে। ধর্মেও নাই অধর্মেও নাই। সমাজে থাকে। সমাজের নিয়মে সামাজিকতা করে। খুবই হাসিখুশি আর বিনয়ী একটা মানুষ। জীবনেও নিজের সম্পর্কে বাড়তি কিছু কইতে শুনি নাই তারে। কিন্তু কোনো বিয়া-শাদির মতো বড়ো অনুষ্ঠানে খাইতে বসার আগে তারে খালি আস্তে কইরা তার নামটা জানাইয়া দিতে দেখছি- ভাইজান। আমার নাম- অনন্ত কুমার সজল। সার্ভ করার সময় একটু খেয়াল রাইখেন…
যারা খাবার দেয় তারা তার নাম শুইনাই যা বুঝার বুইঝা যায়। বুইঝা যায় এই পাতে গরু দেওয়া যাবে না। মানুষের এই বোঝাবুঝিটা হইল সামাজিক ডিকশনারি থাইকা পাওয়া বুঝ। যেহেতু দুই চারইরজন ঘনিষ্ঠ মানুষ ছাড়া কেউ জানে না যে কেডা নাস্তিক কেডা ধার্মিক আর কেডাই বা খুনি; তাই বাকিরা যা বুঝার তার বেশিরভাগই বুইঝা নেয় সামাজিক ডিকশোনারি থাইকা। আর সেই ডিকশোনারি মতে অভিজিৎ রায় নামটা যে একটা হিন্দু নাম সেইটা তো অস্বীকারের কোনো উপায় নাই। এই নামের কারণেই নাস্তিক অভিজিৎ আর অনন্ত বিজয়রে মালু কইয়া গালি দিলেও নাস্তিক আহমদ শরীফ আর আরজ আলী মাতুব্বররে মালু কইয়া গালি দেয় নাই কেউ। এই নামের কারণেই নাস্তিক আহমদ শরীফ আর আরজ আলী মাতুব্বররে তওবা করার অপশন দিলেও অভিজিৎ আর অনন্ত বিজয়রে তওবার অপশন দিতে পারে নাই মৌলবাদীরাও…
ভাষার এই সাধারণ অর্থগুলা বড়ো বেশি গুরুত্বপূর্ণ সমাজে-ভোটে আর রাজনীতিতে…
আমার সন্দেহ আছে অভিজিৎ রায় নাস্তিকতার লাইগা; নাকি লেখার লাইগা; নাকি নাকি মুক্তমনার লাইগা; নাকি শুধুই তার হিন্দু নাম আর আমেরিকার নাগরিকত্বের লাইগা মৃত্যুবরণ করেছেন…
বাংলাদেশ সরকার একবার মাথা বাইন্ধা লাগছিল না দেশে জঙ্গী আবিষ্কারে? ডেলি ডেলি পত্রিকায় দেখা যাইত না পুলিশ আর র্যাব গণ্ডায় গণ্ডায় জঙ্গী আইএস আনসারউল্লা গ্রেফতার করতাছে? প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী-পুলিশ-আমলা সবাইরে দেখা যাইত না জঙ্গী দমনে সহায়তার লাইগা এই দেশ সেই দেশ বিভিন্ন দেশে বক্তৃতা আর লবিং করতে?
আমার সন্দেহ লাগে। ২০১৫’র মার্চে ইন্ডিয়ার বিজেপি সরকারের নতুন পরারাষ্ট্র সচিবের বাংলাদেশ সফরের কালে জঙ্গী দমনে ইন্ডিয়ার সমর্থন পাওয়ার লাইগা মৃত অভিজিৎ রায়ের হিন্দু নামখান কোনোভাবে কোনো ইস্যু আছিল না তো আবার? কিংবা একইসাথে ইন্ডিয়া আর আমেরিকার সমর্থন পাইবার লাাইগা তার নাম আর নাগরিকত্ব কোনো ফেক্টর আছিল না তো কোথাও?
আন্তর্জাতিক সমর্থন কিন্তু বাংলাদেশ পাইছিল। কিন্তু সমর্থনের লগে লগে একটা উৎকট পরিচিতিও পাইছিল বাংলাদেশ। সেইটা হইল- বাংলাদেশ একটা প্রায় জঙ্গী রাষ্ট্র…
জঙ্গীর অস্তিত্বের পক্ষে সরকারের অবিরাম প্রচারে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি যখন বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলা তাদের নাগরিকগো সতর্ক করা শুরু কইরা দিলো বাংলাদেশে চলাচল কিংবা ভ্রমণে। তখনই হুশ হইল সরকারের। আর তখনই হঠাৎ কইরা আমরা দেখলাম প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী- পুলিশ সকলেই কোরাস দিয়া কইয়া উঠল- বাংলাদেশে কোনো আইএস নাই। কোনো জঙ্গী নাই…
তাইলে আইএস আর জঙ্গী কইয়া যে শত শত গ্রেফতার করা হইল তারা কারা?
আমার মনে হয় আইএস আছে আর আইএস নাই; এই দুইটা বিবৃতিই যেমন একই মুখ থাইকা আসা তেমনি হত্যা-হত্যার পরে গায়েব হইয়া যাওয়া- মৃতের উপর মৃত্যুর দোষ চাপানি- আইসিটি আইন আর হত্যার ক্লু খুঁইজা না পাওয়া; সবই একই পরিকল্পনায় গ্রন্থিত সার্কাসের বিভিন্ন এপিসোড…
২০১৬.০২.২৫ বিষুদবার
এই দেশটিকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসি। কিন্তু এই রাষ্ট্রের কোন কথাই বিশ্বাস করি না।
ভেবেছিলাম, আমেরিকা থেকে এফবিআই যখন এসেছে তদন্ত করতে তখন অভিদার খুনিরা নিশ্চই ধরা পড়বে, বিচার হবে খুনিদের। কিন্তু একবছরেও কিছুই তো হলো না। খুন হলো আরো কয়েকজন। এফবিআই কেন এসেছিল? বিশ্বকে দেখাতে?
বাংলাদেশের পুলিশ এফ বি আই কে খুনী ধরার সাফল্যের বাহবা দিতে চাইবে কি? আবার নিজেদের অদক্ষতা প্রমানও করতে চাইবে না। এই পরিস্থিতিতে একটা মাত্র করণীয়, কেসটা যে খুবই জটিল সেটা বোঝানো ( মানে অদরকারী উপাত্তের আমদানী করে সবাইকে বিভ্রান্ত করা)। আমার ভুল হতেও পারে, তবে বাংলাদেশের পুলিশকে সৎ মনে না হলেও কখনোই বোকা মনে হয় নি আমার।
চুপ করে বসে আছে ওরা, এক মহাপুরুষের অপেক্ষায়।
যিনি এসে বলবেন সব ঠিক হয়ে যাক আর সবকিছু নিমিষে ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু অপেক্ষমান জনতার অপেক্ষা আর শেষ হয় না।
গডো কখনই আসে না। এর মধ্যে হত্যা করা হয় আলোর পথে চলা আলোকিত মানুষদের।
অপেক্ষমান মানুষেরা তখনো গডোর প্রতীক্ষায়, যেন যীশুর মতো গডো ফিরিয়ে আনবে মৃত মানুষদের।
তাদের অধিবিদ্যা বা মেটাফিজিক্স, দর্শণে ফিরে না অনন্ত-অভিজিৎ-বাবু-নীল-দীপনেরা।চাপাতি সবাইকে চুপ করিয়ে দেয়।
ওভাবেই একদিন ঘরে পোষা এতদিনের শখের অজগরটি সবাইকে গ্রাস করে নেয়।