ঠিক এক বছর হয়ে গেলো অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের। অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডে আমি সহ আমরা অনেকেই বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার আন্দোলনের শত্রু মিত্র সম্পর্কে নতুন করে জেনেছি, শিখেছি, বহু মানুষের মুখোশ খুলে যেতে দেখেছি। বহু মানুশের শুধু মুখোশই খুলে যায়নি, বরং রাতারাতি তাদেরকে আবিষ্কার করেছি মৌলবাদীদের তল্পিবাহকের ভূমিকায় । পনেরো বছর আগে “মুক্তমনা” প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে অভিজিৎ রায় তার নিজের প্রজন্মকে এবং তার পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্ত চিন্তার বৈশ্বিক আন্দোলনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করেন। আর তাঁর হত্যাকাণ্ডের পরে আমরা চিনতে শুরু করেছি আমাদেরই দেশে, আমাদের সমাজের মানুষ গুলোর স্বরূপ। এ বড়ো ভারী শিক্ষা। অনেক বড়ো দণ্ডের বিনিময়ে আমরা শিখছি কারা মুক্তচিন্তার মিত্র নয়, কারা সফেদ পোশাকের আস্তিনে ছুরি হাতে দাড়িয়ে আছে প্রতিদিন।


অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এখন পর্যন্ত আমার একটি অত্যন্ত আগ্রহের বিষয় হচ্ছে অভিজিৎ রায়, নাস্তিকতা ও মুক্তচিন্তা আন্দোলন প্রসঙ্গে বাঙ্গালী “উচ্চ শিক্ষিত” নাগরিকদের মনোভাব পর্যবেক্ষণ করা । উচ্চ শিক্ষিত বলতে আমি খুব সাদামাটা ভাবেই বোঝাচ্ছি যারা একাডেমিক ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বা সম পর্যায়ের শিক্ষার সুযোগ লাভ করেছেন। এই বর্গের মধ্যে আছেন ডাক্তার, উকিল, বিশ্যবিদ্যালয়ের শিক্ষক, সামরিক – বেসামরিক আমলা এমন কি বিশ্ববিদ্যালয় পাশ দেয়া বেকার যুবকেরাও । আমি এদের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেছি প্রথমত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এদের বিভিন্ন পোস্ট, কমেন্ট, নোট থেকে, কেননা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই ইদানীং কালের বাঙ্গালীর সবচাইতে খোলামেলা প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় ।


আমাদের অনেকেরই এক ধরনের সহজ সরল ধারনা ছিলো যে হয়ত মৌলবাদীরাই বাংলাদেশে মুক্ত চিন্তার আন্দোলনের প্রধান বা একমাত্র প্রতিপক্ষ। দুর্ভাগ্যজনক সত্যি হচ্ছে, বাংলাদেশে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের প্রায় সমান্তরালে আরেকটি গোষ্ঠী সমান ভাবে মুক্তচিন্তার আন্দোলনের বিপক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। এরা পোশাকি, বাহারি রকমের পোশাক আছে এদের। এরা রবীন্দ্রনাথ এর উপরে বই লেখেন । মার্ক্সবাদের উপরে পাঠচক্র করেন। এরা শহুরে আস্তানায় কিম্বা অভিজাত খামার বাড়ীতে দলবল নিয়ে লালনের গানের আসরে ভবনদী কিভাবে পার হবেন সই চিন্তায় কেঁদে আকুল হন। এদের সন্তানেরা শহরের সবচাইতে খরুচে ইংরাজি মিডিয়াম স্কুলে পড়াশুনা করলেও এরা বাংলাদেশের ষাট লক্ষ্ মাদ্রাসা ছাত্রদের জন্যে দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারেন না। এরা মনে করেন স্বয়ং কার্ল মার্কসও বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষার বিষয়ে দুশ্চিন্তা করার জন্যে এদের পিঠ চাপড়ে দেবেন। এরা উচ্চ শিক্ষিত বাঙ্গালী। এরা জানেন বাংলাদেশের পনেরো কোটি মানুষ কি চান, কি খান, কি পরেন … ! আজকের এই লেখাটিতে এই রকমের একটি উদাহরণ উপস্থাপন করবো।


গণজাগরণ মঞ্চ একটি ইভেন্ট এর আয়োজন করেছে অভিজিত রায় স্মরণে, সেই ইভেন্ট এর শ্লোগান হিসাবে লেখা হয়েছে “অভিজিৎ রায়’রা হারলে, বাংলাদেশ হেরে যাবে”। কোনও সন্দেহ নেই এই শ্লোগানটিতে অভিজিৎ বিষয়ে মঞ্চের আবেগ জড়িয়ে আছে। এখানে ব্যক্তি অভিজিৎ এর চাইতেও অভিজিৎ যে চেতনার ধারক – বাহক ছিলেন সেটাই বোঝানো হয়েছে। মুক্তচিন্তা, ধর্ম নিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে সেই সকল চেতনা। কিন্তু একজন ভট্টাচার্য মহাশয় এ বিষয়ে কলম তুলে নিয়েছেন অভিজিৎ তথা মুক্তমনা নাস্তিক এক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে, উপলক্ষ হচ্ছে গণজাগরণ মঞ্চের এই ইভেন্ট। ভট্টাচার্য মহাশয়ের লেখার বিষয় হচ্ছে “অভিজিৎ রায়’রা” হেরে গেলে বাংলাদেশ কিভাবে হেরে যাবে সে প্রসঙ্গে। আসুন মুল প্রসঙ্গে প্রবেশ করি। ভট্টাচার্য মহাশয় লিখেছেন এভাবেঃ

ovi2

প্রথমত, তিনি ভেবে রেখেছেন অভিজিৎ কে নিয়ে কিছু একটা লিখবেন এবং তার ধর্মপরায়ণ পাঠকদের তিনি দুই একদিন অপেক্ষা করতে বলেছেন। আমি আশা করছি তিনি তার পাঠকদের নিরাশ করবেন না। দ্বিতীয় অংশে দেখুন তিনি মুক্তমনাদের বক্তব্য বলে কোট – আন কোট এর মধ্যে আসলে তার নিজেরই বানানো বয়ান উপস্থাপন করছেন এবং বক্তব্যটিকে এমন ভাবে পেশ করছেন যা বাংলাদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের পছন্দ হবে এবং যেহেতু সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের পছন্দ হবে সুতরাং সবাই বিশ্বাস করবে যে তিনি যা বলছেন তা আসলে সঠিক। আমরা ইংরাজিতে “Argumentum Populum” ধারনার কথা জানি। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ যা মনে করে, তাইই সঠিক এমন ধারনা। যদিও সমাজ ও বিজ্ঞানের ইতিহাস বহুবার প্রমাণ করেছে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত সব সময় সঠিক নাও হতে পারে। সত্য ও সঠিকতা সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে প্রমাণিত হয়না।

প্রথম প্রশ্নটা হচ্ছে কোটেশন মার্ক এর ভেতরে যে কথাগুলো লেখা হলো সেগুলো কি অভিজিৎ রায় লিখেছেন? কোনও মুক্তমনা লিখেছেন? সে সবের কোনও হদিস নেই। এটা খুব পরিচিত এক ধরনের অসততা,যা এই ভট্টাচার্য মহাশয়ের বেশীর ভাগ লেখার প্রধান বৈশিস্ট্য।

ধর্ম এবং সকল ধর্ম প্রগতির পরিপন্থী, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কেনও এবং কিভাবে ধর্ম প্রগতির পরিপন্থী হয়ে উঠেছে ইতিহাসে, সে বিষয়ে বহু লেখা আছে। গুরুভার তাত্ত্বিক লেখা থেকে শুরু করে সহজপাচ্য ব্লগ পর্যন্ত। ধর্মের প্রগতি পরিপন্থী ভূমিকার কথা নাস্তিকেরা আলোচনা করে, কিন্তু তাই বলে কি আপনি একজন মিস্টার এক্স কে নাস্তিকেরা ধরে বেঁধে সেই ধারনাকে গিলিয়ে দেয়? দেয়না। মুক্তমনারা ধর্মের প্রভাবমুক্ত সমাজ চান কিন্তু এই ভট্টাচার্য মহাশয় সেসব কথা বলতে গিয়ে কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন বড়ই চতুরতার সাথে। তিনি লিখছেন –

“একটি ধর্মহীন পরিবেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র তৈরিই তাদের আশু লক্ষ্য”।

আবার দেখুন তিনি লিখছেন

“ধর্মকে জীবন থেকে নির্বাসন দিলে উনারা খুশী হন সেটায় কোনও সন্দেহ নেই”।

এই লাইন গুলো পাঠ করলে যেকোনো সাধারণ মানুষের ধারনা হবে নাস্তিকেরা আসলে সাধারণ মানুষের ধর্ম পালনের ব্যক্তিগত অধিকারটুকুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে। তাদের মনে হবে নাস্তিকেরা বোধহয় তাদের বাপ দাদার ধর্ম পালনের অধিকারটুকু কেড়ে নিতে চায়। সমাজের সেকুলার হয়ে ওঠা এবং মানুষের ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধর্ম পালনের বা না পালনের অধিকারের মধ্যে যে কোনও ডুয়েল লড়াই নেই, একথা নিশ্চিত ভাবেই ভট্টাচার্য মহাশয় জানেন, কিন্তু তিনি জনগণের সম্মুখে সে কথা চেপে যান। কারণ তিনি জানেন এই ধারনা গুলো বাংলাদেশের মানুষেরা খাবেনা। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম পালনের বা না পালনের স্বাধীনতা কে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশের সংবিধান মানুষের ভাব ও চিন্তার স্বাধীন অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করে। বাংলাদেশের সংবিধান মানুষের নিজ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ধর্ম পালনের অধিকার এর নিশ্চয়তা প্রদান করে। তাহলে প্রশ্ন হলো – বাংলাদেশের নাস্তিক ও মুক্তমনা মানুষেরা কি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের এই সাংবিধানিক অধিকারের বিপক্ষে অবস্থান করেন? তারা কি সাধারণ মানুষের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করতে চান? অভিজিৎ রায় কিম্বা মূলধারার নাস্তিকদের কেউ কি কখনই এই রকমের কোনও দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন? নাস্তিকেরা কি কখনও লিখেছেন বা বলেছেন সংবিধান থেকে মানুষের ধর্ম পালনের স্বাধীন অধিকার তুলে দিতে হবে? ধর্মের সমালোচনা করা আর ব্যক্তি মানুষের ধর্ম পালনের অধিকারকে কেড়ে নেয়া কি এক কথা? এক কথা নয়। এখানে ভট্টাচার্য মহাশয়ের শব্দ চয়নের চতুরতার মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে নাস্তিক – মুক্তমনাদেরকে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রতিপক্ষ বানানো। পৃথিবীর সবচাইতে সেকুলার দেশ সমূহ যেমন সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড,ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স এবং জাপানে ধর্ম পালনের মানুষের ব্যক্তিগত অধিকারকে খর্ব করা হয়নি। কিন্তু বহু ইসলামী দেশে ভিন্ন ধর্মের মানুষের ধর্ম চর্চার কোনও অধিকার তো নেইই, বরং তা প্রায় মৃত্যু ঝুঁকি বয়ে নিয়ে আসে। উল্লেখিত সেকুলার এই দেশগুলোতে, রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে ধর্মকে আলাদা করা হয়েছে, শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ধর্মকে আলাদা করা হয়েছে। গঞ্জীবন বা পাবলিক লাইফ থেকে ধর্মকে আলাদা করা হয়েছে। ধর্মকে রাখা হয়েছে নিতান্তই ব্যক্তির জীবনে। নাস্তিকেরা বলেন ধর্ম কে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করতে হবে। ধর্মকে শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে আলাদা করতে হবে। নাস্তিকেরা চায় রাষ্ট্র কোনও বিশেষ ধর্ম কে প্রোমোট ও করবেনা, কোনও ধর্ম কে অবদমন ও করবে না। এই চাওয়া গুলো কি একক ব্যক্তি মানুষের অধিকার কে খুন্ন করে? ভট্টাচার্য মহাশয়েরা এই প্রশ্নের উত্তর কি দেবেন কখনও ?

ভট্টাচার্য মহাশয়ের পোস্টটির দ্বিতীয় অংশটি আরও বিনোদনময় ! তিনি প্রশ্নকরছেন

“অভিজিৎ রায়’রা” কি একুশের চাইতেও বড়? আমাদের মুক্তিজুদ্ধের চাইতেও বড়ো? স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের চাইতেও বড়ো?”

অভিজিৎ রায় কিম্বা কোনও নাস্তিক – মুক্তমনা এক্টিভিস্ট কি কখনও এমনটা দাবী করেছেন যে তিনি বা তাঁরা বাংলাদেশের চাইতে বড়? একুশের চাইতে বড়? মুক্তিযুদ্ধের চাইতে বড়? করেন নি, কিন্তু ভট্টাচার্য মহাশয়ের যে টার্গেট পাঠক তারা বিষয়টিকে এভাবে দেখতে এবং পড়তে ভালবাসবেন, সুতরাং মহাশয় অভিজিৎ ও নাস্তিক-মুক্তমনাদের যুক্ত করে তার ভক্তদের রসনা মেটানোর খাবার রান্না করছেন এভাবে।

গণজাগরণ মঞ্চের শ্লোগানটিতে অভিজিৎ রায়কে নিশ্চিত ভাবেই মুক্ত চিন্তা ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক হিসাবে চিনহিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে যদি মুক্ত চিন্তা, প্রগতিশীলতা, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধ্বংস হয়ে যায়, পরাজিত হয়, বাংলাদেশ যদি আরেকটি ইরান, পাকিস্থান বা আফগানিস্থানের মতো ইসলামিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়, তাহলে কি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ জয়ী হবে? বাংলাদেশে যদি মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধুলিস্যাত হয়ে যায় তাহলে কি একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ জয়ী হবে? বাংলাদেশে যদি বাংলার পরিবর্তে আরবি ভাষা প্রধান হয়ে ওঠে তাহলে কি একুশের চেতনা জয়ী হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর ভট্টাচার্য মহাশয় কি দেবেন কখনও? কারণ তাতে তার “রিডার বেইস” বা বিশাল পাঠককুল কমে যাবে। সুতরাং মহাশয়ের জন্যে, নাস্তিকদের কাঁধে বন্দুক রেখে জনপ্রিয়তা হান্ট করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।


এবারে পাঠক আসুন একই শ্লোগানটিকে যদি একটু ভিন্ন ভাবে সাজানো যায়, কি ঘটে তাহলে। আমি যেকোনো শ্লোগানের আবেগের দিকটাকে তুলে ধরতে চাচ্ছি। ধরুন একটি শিশু শ্রম বিরোধী সংগঠন লিখল – “শিশু শ্রমের বিলোপ না ঘটলে বাংলাদেশ হেরে যাবে”, এই শ্লোগানটিতে ভট্টাচার্য মহাশয় নিশ্চয়ই প্রশ্ন তুলবেন – শিশু শ্রম বন্ধ হওয়া কি বাংলাদেশের চাইতে বড়ো? আমাদের একুশের চাইতে বড়ো? মুক্তিযুদ্ধের চাইতে বড়ো? কিম্বা ধরুন শ্লোগানটিকে যদি এভাবে লেখা যায় – “অসাম্প্রদায়িক চেতনা হেরে গেলে, বাংলাদেশ হেরে যাবে” তাহলে ভট্টাচার্য মহাশয় লিখবেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা কি বাংলাদেশের চাইতে বড়ো? একুশের চাইতে বড়ো? মুক্তিযুদ্ধের চাইতে বড়ো?

ভট্টাচার্য মহাশয় প্রশ্ন তুলবেন না এমন ভাবেও শ্লোগানটিকে লেখা যায়, দেখুনঃ

“ইসলাম হেরে গেলে বাংলাদেশ হেরে যাবে”

এবারে ভট্টাচার্য মহাশয়েরা আর কোনও প্রশ্ন তুলবেন না। কারণ এই শ্লোগানটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানেরা খায়।


অভিজিৎ রায় তো বটেই, কোনও ব্যক্তি মানুষই বাংলাদেশের চাইতে বড়ো নয়। একুশের চাইতে বড়ো নয়। মুক্তিযুদ্ধের চাইতে বড়ো নয়। স্বাধীনতার ঘোষণার চাইতে বড়ো নয়। বরং অভিজিৎ রায়েরা হচ্ছেন বাংলাদেশ, একুশ, মুক্তিযুদ্ধ এই সকল চেতনার সম্প্রসারিত রূপ। কারণ – রবীন্দ্রনাথ কে সেকুলার বাঙ্গালীরাই ধারণ করেন, ইস্লামিস্টরা নয়। বাংলা অভিজিৎদের প্রাণের ভাষা, আরবি বা উর্দু নয়। সুতরাং বাংলাদেশ, একুশ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মশাল টি যারা বহন করছেন, তারা যদি হেরে যান, তাহলে কি বাংলাদেশ বিজয়ী হয়? অভিজিৎ এখানে আর কিছুই নন, সেকুলার বাঙ্গালীর প্রতিনিধি।

পাঠক আসুন এবারে কিছু সত্যর মুখোমুখি হই। ভট্টাচার্য মহাশয় বাংলাদেশ, একুশ, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার ঘোষণা ইত্যাদি শব্দ দিয়ে মূলত বাঙ্গালীর পোশাকি দেশপ্রেমে খানিকটা সুড়সুড়ি দিতে চেয়েছেন এবং তিনি এক্ষেত্রে বরাবরের মতোই সফল। কিন্তু আসুন কিছু মৌলিক প্রশ্ন করি নিজেদের কে ঃ

– রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ কি আসলেই খুব বড়ো, মহান, কল্যাণকর হয়ে উঠতে পেরেছে?

যদি রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ এতো বড়ো। মহান,কল্যানকর হয়ে থাকে, তাহলে গত চার দশকে বাংলাদেশ থেকে পঞ্চাশ লাখ হিন্দু মানুষ কে দেশ ছাড়তে হলো কেনও?

যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি এতোটাই মহান, বড়ো হয়ে থাকে তাহলে কেনও আজও প্রতি মাসেই হিন্দু মন্দির ভাঙ্গা হয়? বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ভস্মীভূত হয় বৌদ্ধ মন্দির? কেনও ভিন্নধর্মী মানুষের জমি বেদখল হয়ে যায়?

বাংলাদেশ যদি এতো মহান, বড়ো হয়ে থাকে, তাহলে কেনও এখনো প্রতিটি নির্বাচনের মৌসুমে ভিন্ন ধর্মের মানুষেরা ঘর ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়?

যদি বাংলাদেশ এতো বড়, এতো মহান হয়ে থাকে তাহলে কেনও পাহাড়ে প্রতিদিন নারীরা “বাঙ্গালী আতঙ্কে” থাকে? কেনও পাহাড়ে নারীরা শিকার হয় পাশবিক নির্যাতনের?


যদি বাংলাদেশ এতোটাই বড়ো হয়, মহান হয়, তাহলে কেনও রাজীব – অভিজিৎ – অনন্ত – বাবু – নিলয় – দীপনদের কে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনা?

ভট্টাচার্য মহাশয়েরাকি ব্যাখ্যা করতে পারবেন

কারা আমাদের দেশকে এতোটা ক্ষুদ্র বানালো যেখানে নির্বাচনে যেইই জয়ী হোকনা কেনও হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে নেমে আসে চরম অপমানের বোঝা?

কারা আমাদের দেশকে এতোটা ক্ষুদ্র বানালো যেখানে অবিশ্বাসীদের মাসের পর মাস পালিয়ে বেড়াতে হয় পার্শ্ববর্তী দেশে?

কারা আমার দেশকে এতোটা ক্ষুদ্র বানালো যেখানে ৭৩ বছরের একজন প্রগতিশীল প্রবীণ মানুষকে প্রকাশ্য দুপুরে হাতে হাত কড়া পরিয়ে জেলে নিয়ে যাওয়া হয় শুধুমাত্র পুস্তক প্রকাশের অপরাধে?

কারা আমার দেশকে এতোটা ক্ষুদ্র বানালো যেখানে মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক অজয় রায়কে পুত্রের ক্ষত বিক্ষত লাশ গ্রহণ করতে হয়?

ভট্টাচার্য মহাশয়দের কোনও নৈতিক দায় নেই এই সকল কিছু ব্যাখ্যা করার। আপোষের পাঁকে ডুবে থাকা মানুষদের কোনও নৈতিক দায় থাকেনা। এরা ইতিহাসের সকল যুগে সকল কালে বর্তমান।


বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় নাস্তিকেরা হচ্ছেন প্রায় অচ্ছুতদের মতোই। হিন্দু সমাজের দলিত গোষ্ঠীর মানুষদের মতো। আউটকাস্ট। শুধু পার্থক্য হচ্ছে হিন্দু সমাজের একজন দলিত ব্যক্তি তার নিজের সামাজিক অবস্থানটি নিজে বেছে নেয়না কিন্তু একজন নাস্তিক অত্যন্ত সচেতন ভাবে তার নিজের অবস্থানটি বেছে নেন। নতুন প্রজন্মের এই নাস্তিকেরা ধর্ম নামের ফাঁকা বিষয়টিকে নিজেদের জীবন থেকে শুধু ঝেড়েই ফেলেন না, সমাজে যৌক্তিক চিন্তা, বিজ্ঞান মনস্কতার প্রসারে নিজেদেরকে এক্টিভিস্ট এর ভূমিকায় যুক্ত করেন। অভিজিত ছিলেন এই প্রজন্মের একজন অগ্রণী মানুষ মাত্র। রকমারি বলে বইয়ের বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি যখন অভিজিত রায়ের বই বিক্রি বন্ধ করে দেয়, তখন রকমারির পক্ষের প্রধান উকিল ছিলেন আমাদের এই ভট্টাচার্য মহাশয়। অথচ দেখুন অভিজিৎ রায় এ প্রসঙ্গে বিশ্বাসের ভাইরাস বইয়ে কি লিখেছিলেন ঃ

‘আমি সামান্য লেখক। কিন্তু যা লিখি সততার সাথে লিখি। কাউকে হুমকি ধামকি দেই না। আশা করব রকমারি এবং তাদের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা বিষয়টি মাথায় রাখবেন। দয়া করে ব্যবসার সাথে ব্যক্তিগত বিশ্বাস জরাবেন না। ফারাবী হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যু হুমকি দিয়েছে। তার হুমকি সত্য হলে আমরা কেউ আজ বেঁচে থাকতাম না। রকমারির উচিৎ লেখকের স্বাধীনতার প্রতি অবিচল থাকা। আমার বই রাষ্ট্র থেকে ব্যান করা হয়নি, আদালতে যায়নি। ফারাবীই বরং আদালতে চার্জশিটপ্রাপ্ত ফেরারী আসামী। তার কথায় আমার বইকে তালিকা থেকে সরানোর কারণটা হাস্যকর। আমরা তো কোন ধর্মীয় বই তালিকা থেকে সরাতে বলছি না। শুধু ধর্মীয় বই কেন, বহু জিহাদি বানী সমৃদ্ধ উগ্র বইপত্র থেকে শুরু করে বড় বড় রাজাকারদের লেখা বই রকমারিতে পাওয়া যায়। সব ছেড়ে আপনাদের চোখ পড়ল এমন এক লেখকের যিনি হুমকি ধামকি দেন না, কেবল যিনি বিজ্ঞান নিয়ে লেখেন? আসলে ভয়টা কার? স্মরণ করি মিখাইল বুলগাকভের উপন্যাস ‘মাস্টার এণ্ড মার্গারিটার’ বিখ্যাত উদ্ধৃতি –‘পাণ্ডুলিপি পোড়ে না’। মুক্তচিন্তককে আক্রমণ করা যায়, কিন্তু তার চিন্তাকে নাশ করা যায় না’।

অভিজিৎ রায় সবসময় নিজেকে সামান্য বলতেন। আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দেখেছি তিনি নিজেকে একজন নগণ্য বিজ্ঞান লেখক হিসাবে উল্লেখ করতেন। অভিজিৎ রায়ের সহকর্মীদেরও সামান্য হতে কোনও লজ্জা নেই, দ্বিধা নেই। কিন্তু বাংলাদেশ কি সত্যিই কোনদিন প্রকৃত “বড়ো” হয়ে উঠবে যেখানে অমুসলিম হবার কারণে কাউকে দেশ ছাড়তে হবেনা, পাহাড়ি হবার কারণে কোনও নারীকে ধর্ষণের শিকার হতে হবেনা, যেখানে অবিশ্বাসী হবার কারণে কাউকে প্রধান সড়কের উপরে নিহত রক্তাক্ত শরীরে পড়ে থাকতে হবে না।

বাংলাদেশ সন্দেহাতীত ভাবে ততটা “বড়ো” নয় এখনো যেখানে সে তার সকল সন্তান কে নিরাপদ আশ্রয় দিতে পারে। “অভিজিৎ রায়েরা” যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন সেই বাংলাদেশ হবে মানুষের বাংলাদেশ, মুসলমানের বাংলাদেশ নয়।

কোন বাংলাদেশ বড়ো – মানুষের বাংলাদেশ নাকি মুসলমানের বাংলাদেশ, সে বিবেচনার ভার পাঠকের উপরে ছেড়ে দিলাম।

অভিজিৎ রায়ের লেখা থেকেই তুলে দিচ্ছি –

পাণ্ডুলিপি পোড়ে না’। মুক্তচিন্তককে আক্রমণ করা যায়, কিন্তু তার চিন্তাকে নাশ করা যায় না’

মুক্ত চিন্তার জয় হোক।