লেখকঃ দিলীপ কর্মকার
বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত নিরীহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, মিথ্যা মামলা, নির্যাতন, অপহরণ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, গুলি এমনকি গলাকেটে কিংবা আগুনে পুড়ে হত্যার মত নির্মম ঘটনা সংগঠিত হচ্ছে। গত ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, রবিবার পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জে এরকম একটা অতর্কিত পরিকল্পিত হামলা ও হত্যার সংবাদ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারলাম। আক্রমণকারীরা সকাল বেলা সন্ত গৌড়ীয় মঠের অধ্যক্ষ শ্রী যজ্ঞেশ্বর রায় দাসাধিকারীকে গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করেছে। হত্যাকাণ্ড চালানোর সময় তা দেখে ফেলে গোপাল চন্দ্র রায় নামে মন্দিরের আর এক ভক্ত সেবক। আর যায় কোথা! দুর্বৃত্তরা হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁকেও লক্ষ্য করে গুলি চালায়। দৌড়ে পালানোর সময় বাম হাতের কনুইয়ে দুটি গুলিবিদ্ধ হয়ে দৈবাৎ সে প্রাণে বেঁচে যায়। বর্তমানে তিনি রংপুর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
আই.এস. নামের সংগঠন থেকে এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ। বাংলাদেশের সরকার ও পুলিশ কর্তৃপক্ষ লেখক, প্রকাশক, আস্তিক, নাস্তিক, ছাত্র, শিক্ষক, শিল্পী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, বিদেশী, শিয়া, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান, বিধর্মী বা যে কোন প্রগতিশীল মানুষকে পরিকল্পিত উপর্যুপরি খুনের সাথে আই.এস. এর সংশ্লিষ্টতা বা অস্তিত্ব স্বীকার করতে রাজী না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী বলে দাবীদার সরকার পক্ষের লোকেরা সমস্বরে এসমস্ত সহিংস ঘটনা সমূহকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে রটনা চালিয়ে তাঁরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। তবে, কাকে ভয় বা খুশি করার জন্য এই অস্বীকার, তা আমার বোধগম্য নয়। আমেরিকার মদদপুষ্ট সৌদি রাজতন্ত্রের সামরিক জোটের সাথে বাংলাদেশ সরকারের গাঁটছড়া বাধার ফলশ্রুতিতে আই.এস. এর সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করার পেছনের কারণ কিনা – কে জানে?
মনে পরে স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা। ১৯৭১ সালে রাজাকার, আলবদর, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ভয়ে সারাদেশের হিন্দুরা বাড়িঘর ছেড়ে প্রাণের ভয়ে জংগলে জংগলে আত্মরক্ষার জন্য নয় মাস পালিয়ে বেড়িয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে আমিও আমার পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন ছিলাম। সম্ভবত মে মাসের শেষ দিকের কথা। পাক সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পলায়নরত অবস্থায় একটা সাঁকো পার হচ্ছিলাম। আমার বাবাও সেই সাঁকো পার হচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এক মিনিটের জন্য তাঁর সাথে সাক্ষাৎ ও কথা হয়েছিল। তাঁকে প্রনাম করতেই তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, “আমার মন বলেছে, তুমি বেঁচে আছ।” নয়মাসের মধ্যে শুধুমাত্র ঐ এক মিনিটের সাক্ষাৎ ঘটেছিল। যা আজও আমার স্মৃতিতে জাগরূক আছে। আমার বৃদ্ধ পিতা, আমার বোনদের নিয়ে কিভাবে, কোথায় আত্মরক্ষা করে ছিলেন, সে প্রশ্নও জিজ্ঞাসা করিনি। তাঁদের দুঃসহ জীবনের অব্যক্ত করুণ কাহিনী সেদিন শুনতে চাইনি। ভেবেছিলাম, শত্রুমুক্ত করে পরে একদিন হয় জেনে নেব। কিন্তু সে ভাগ্য আমার আর কোনোদিন হয়নি। সে কথা মনে করে আজও আমার বুকের মধ্যে দুমড়ে ওঠে। গভীর রাতে ঘুমের মধ্যেও চোখের জল ঝড়ে। আমি কত বড় উম্মাদ ছিলাম যে, জন্মদাতা পিতার একমাত্র পুত্র সন্তান হয়েও রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়স্বজনদের কাছে থাকিনি। তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে, খোঁজ না নিয়ে জীবন বাজি রেখে দেশোদ্ধারে লিপ্ত ছিলাম। হায়রে আমার কপাল, তা কি এমন বাংলাদেশের জন্য!!
বর্তমান বাংলাদেশের আদিবাসী ভাইবোনেরাও সেনাশাসন অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে উড়ে এসে স্থায়ীভাবে জুড়ে বসা বাঙ্গালী দখলকারীদের সংঘবদ্ধ আক্রমণের ভয়ে জংগলে মাঝে মাঝে আত্মগোপন করে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। গতকাল একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে খাগড়াছড়িগামী বাস থেকে আদিবাসী চেহারার লোকদের বাস থেকে নামিয়ে তাঁদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। [নেপথ্যে স্মরণে আসে, একাত্তরে বাস থামিয়ে কাপড় তুলে খৎনা করা আছে কিনা পরীক্ষা হত; আর এখন চেহারা। তখন খোঁজা হত হিন্দু; আর এখন হচ্ছে আদিবাসী] দুর্বৃত্তদের আক্রমণে কেউ কেউ লাশে পরিনত হয়েছে বলেও শোণা গিয়েছে। একজন আদিবাসীর মাথার তালুর উপর কুঠারঘাতে কাঠ কাটার মত ক্ষত করার বীভৎস লোমহর্ষক একটা ছবিও পত্রিকাতে দেখেছি। প্রান্তিক ধর্মীয় ও জাতীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, মন্দির, প্যাগোডা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, জায়গাজমি দখলের খবর কোন নতুন ঘটনা নয়। ২০১০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের এগারোটি আদিবাসী পল্লীতে অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত করা হয়েছিল। বেসরকারি হিসেব ও তথ্য অনুযায়ী, সেদিনের ঘটনায় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সেটেলার বাঙ্গালীরা জড়িত ছিল। তাঁরা ৭৫০টি পরিবারের আবাসগৃহ পুড়ে ছাই করার মাধ্যমে আদিবাসীদেরকে তাঁদের ভূমি থেকে উচ্ছেদের এই মহাযজ্ঞে লিপ্ত হয়েছিল। পাক সেনাবাহিনীর ন্যায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যদের কামনা ও লালসার শিকার হয়ে অসহায় আদিবাসী কত যুবতী নারী, ললনার সম্ভ্রম ও সতীত্ব এযাবত বিনষ্ট হয়েছে, তার হিসেব কে রাখে? পাহাড়ে ও সমতলে বসবাসকারী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন অনেকটাই সিনেমার ছন্দময় জনপ্রিয় গানের কলির মত, “তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়, দুঃখের দহনে করুণ রোদনে তিলে তিলে তার ক্ষয়। প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে, জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে। স্বার্থের টানে প্রিয়জন কেন দূরে সরে চলে যায়, ধরণীর বুকে পাশাপাশি তবু কেউ বুঝি কারো নয়…।”
অথচ, এমন তো হওয়ার কথা ছিলনা। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মত মাথা উঁচু করে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার আকাংখা নিয়ে আমরা সবাই সেদিন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। সেদিনের গানের কলি ছিল, “আমার এ দেশ সব মানুষের, সব মানুষের – কুলি আর কামারের, চাষা আর মজুরের…হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃস্টান এক দেশ সকলের…।” অথবা, “বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে এই জনতা…।” কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের সেই অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের প্রতিশ্রুতি? দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের পরিবর্তে আজ ব্যভিচার, সামাজিক বৈষম্য এবং সবল কর্তৃক দুর্বলের উপর অত্যাচার, বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফলে জীবন ধারণের অধিকার বঞ্চিত হয়ে কত মানুষের স্বপ্ন সাধ আহ্লাদ যে ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে, তার খবর কে রাখে? আজও কি, বিচারের বানি নিরবে নিভৃতে কাঁদবে?
বর্তমান সময়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের ক্ষমতাবলয়ের সাথে যুক্ত আমলা ও রাজনীতিজীবীরা তাঁদের অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা অব্যাহত রাখার উৎস ঠিক রাখার জন্য সদা তৎপর। তাঁরা তাঁদের অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতার উৎস নিরাপদ ও অব্যাহত রাখার জন্য সরকার প্রধানকে খুশী ও বশীকরণের জন্য ব্যস্ত। সর্বময় ক্ষমতার কেন্দ্র সরকার প্রধানের আনুকূল্য বা সুদৃষ্টি লাভের আশায় প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর বংশধর বা আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ লতাপাতা ডালপালাকেও খুশী করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তাঁরা সম্ভবত মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতপ্রবর শ্রী হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর “তৈল” গল্পের মর্মার্থ অনুধাবন ও যথার্থ ব্যবহার করতে শিখেছেন। এখন একশ্রেণীর এমন স্তাবক চাটুকার আছে, যারা কেবলমাত্র সরকারের প্রশংসা ছাড়া ভিন্ন যে কোন মতের প্রতি অত্যন্ত অসহিষ্ণু। আমি বা আপনি সরকার সমর্থক হলেও তাঁদের আক্রোশ থেকে রেহাই নেই। ওঁরা সরকার প্রধান ও তাঁর বংশবদদের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি করে শেয়ালের ডাকের ন্যায় “হুয়াত্তা হুয়া” করে ওঠে। ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়া সেনা বাহিনীর দেয়া বিবৃতি ছাপানোর ভুল স্বীকার করে মনে হয় ভুল করেছেন। এখন পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে চামচারা ৭৭টি স্থানে মাত্র এক লক্ষ ঊনত্রিশ হাজার কোটি টাকা মূল্যের মানহানির ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু চাচ্ছেন, মাহাফুজ আনামের হয়তো বিচার হবে। কিন্তু, ধর্মযাজক যজ্ঞেশ্বর সহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের খুনিদের বিচার কি বাংলার মাটিতে হবে? মাহাফুজ আনামের ভুল স্বীকারের প্রতিদানে প্রধানমন্ত্রী তাঁর পদত্যাগ চাচ্ছেন। ভাল কথা, কিন্তু, সরকার প্রধান হিসেবে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাদানে ব্যর্থতার জন্য তিনি কি প্রধানমন্ত্রী থেকে পদত্যাগ করবেন? সংখ্যালঘুদের জীবনের কোন মূল্য বা মান-মর্যাদা থাকতে নেই বুঝি! ক্ষমতাসীনরা ও ক্ষমতা চ্যুত বা বহির্ভূত অধিকাংশ প্রায় সকলেই সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে নির্বাক। তাঁরা একপক্ষ অন্যপক্ষকে দায়ী করে বিবৃতি দিয়েই ক্ষান্ত থাকেন। রাজনীতিবিদরা এই ব্লেইম গেইম আর কতদিন খেলবেন? অথচ সত্যি বলতে কি, ১/১১ এর তত্বাবধায়কের শাসনকাল সময় বাংলাদেশে কোন সাম্প্রদায়িক হামলা হয়নি। অল্পদিনের জন্য হলেও, সেই সময়টুকুই হয়তো ঘুষখোরদের আত্মায় কাঁপন ধরিয়েছিল। ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ মুক্ত অবস্থায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ নিরাপদে ও স্বস্তিতে ছিল। পাকিস্তানী ধারা থেকে বাংলাদেশকে টেনে তুলেছে মিঃ ফকরুদ্দিন ও জেনারেল মঈনউদ্দিনের সরকার।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাত এর একটি গবেষণাগ্রন্থে তিনি তথ্য, উপাত্তের ভিত্তিতে হিসাব করে বলেছেন যে, ১৯৭১ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে ৬৩ লক্ষ হিন্দু বাংলাদেশ থেকে উধাও হয়ে গেছেন। এই বিতাড়নে হিন্দু সম্পত্তি দখলের সুবিধাভোগীদের মধ্যে ৩১% আওয়ামী লীগের সদস্য-সমর্থক ও ৪৫% বি.এন.পি.’র সমর্থক। ১৯৯২ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর যে ভয়ংকর তাণ্ডব চলে তাতে ২৮,০০০ বাড়ি-ঘর, ৩,৬০০ মন্দির, ২,৫০০ দোকান-বাজার ধ্বংস হয়। খুন হন ১৩ জন। ২০০১-এ বেগম জিয়ার নির্বাচনের পর থেকে শুরু হয় ধারাবাহিক সংখ্যালঘু হিন্দু নির্যাতন। এর ফলে ১৯৫১ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে যে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২২ শতাংশ, ১৯৭১-এ ১৫%, ১৯৭৪-এ ১৩.৫% ও ২০০১ সালে ৯.২ শতাংশে নেমে এসেছে। বর্তমানে তা সম্ভবতঃ ৭-৮ শতাংশ। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা এই ছয় জেলায় হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ৮ লাখ ১৬ হাজার ৫১ জন। ২০১১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায় হিন্দু জনসংখ্যা কমে ৭ লাখ ৬২ হাজার ৪৭৯ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। “১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ এই নিখোঁজ হিন্দু জনসংখ্যা ছিল প্রতিদিন গড়ে ৭০৫ জন। ১৯৭১ থেকে ১৯৮১ তে প্রতিদিন গড়ে ৫২১ জন, ১৯৮১-১৯৯১ এ প্রতিদিন গড়ে ৪৩৮ জন এবং এই সংখ্যাটি অনেক বেড়ে ১৯৯১ থেকে ২০০১ এ দাঁড়ায় প্রতিদিন গড়ে ৭৬৭ জন।” অপর একজন গবেষক বর্ণনা করেছেন, “বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার একটি প্রতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া”। বাংলাদেশ বারবার সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে গেলেও ধারাবাহিক সংগ্রামের ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও বারবার ফিরে এসেছে। সংখ্যালঘু বিরোধী আইন না থাকলেও পাকিস্তান আমলের শত্রু সম্পত্তি আইনের মাধ্যমে হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি ও অর্থনীতিকে ভয়ংকর ক্ষতিগ্রস্থ করা হয়েছে। বাংলাদেশ হবার পর এই আইন নাম বদলে হয় “অর্পিত সম্পত্তি আইন” (Vested Property Act) এবং এই আইনে একইভাবে হিন্দুদের সম্পত্তি জবরদখল চলে। এই আইনের ফলে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত হিন্দুদের প্রায় ২৬ লক্ষ একর জমি ও দেবোত্তর সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি আইনের ফলে বেহাত বা দখলচ্যুত হয়। দশ লক্ষেরও বেশী মামলা হয়েছে, কিন্তু একটি মামলারও নিস্পত্তি হওয়ার খবর আমাদের জানা নেই। অথচ, এব্যাপারে সরকার প্রধান ও তাঁর চামচাদের মুখে কোন রা নেই। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন কাকে খুশী করার জন্য বা আর কতকাল মুখ বুজে নীরবে মার খেতে থাকবে। বর্তমান সরকারের আমলে, সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বা হার অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
নাটকের ডায়ালগের ন্যায়, “গোলাম হোসেন, উপায় নেই।” ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আজ এক নির্মম কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। তাঁদের আর কোন উপায় নেই। “মানুষ মানুষের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না ও বন্ধু……দুর্বল মানুষ যদি, জীবনের অথৈ নদী পার হয় তোমাকে ধরে, বল কি ক্ষতি…” গানের গীতিকার ও সুরকার ডঃ ভুপেন হাজারিকা শেষ জীবনে বিজিপির নমিনেশন নিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। আমি অনেক ভেবেছি, তিনি কি সাম্প্রদায়িক ছিলেন? সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে আমাকে যারা সাম্প্রদায়িক ভাববে, যাঁদের অনুভূতিতে লাগবে, তাঁদেরকে আমি এই মুহূর্তে বর্জন করতে চাই। যে সমস্ত হিন্দুরা গরুর মাংস খেয়ে, আর যে সমস্ত মুসলিমরা কাছিমের (কচ্ছপ) মাংস খেয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, অথচ সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের ব্যাপারে সবসময় নির্বাক থাকেন বা এড়িয়ে থাকতে চান আমি তাঁদের দলের লোক না। জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে তাঁদের সাথে আর সখ্যতা রাখার কোন প্রয়োজন আছে বলেও আমি মনে করিনা। সেই সমস্ত তরুণ যারা নিঃস্বার্থভাবে ক্ষমতার হালুয়া-রুটির ভাগাভাগি ছাড়াই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখে, সেই তরুণ প্রজন্মের গণজাগরণ মঞ্চের সাথে সংশ্লিষ্টদের উপর ভরসা করতে চাই। অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্ত করার বাসনা পূর্ণ করতে চাই। আর কতকাল খল নায়কদের মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে সংখ্যালঘুরা বোকার মত জিন্দাবাদ মুর্দাবাদ করে যুগ যুগ ধরে মার খেয়ে যাবে। এখন সময় এসেছে, শেষ মীমাংসার, হয় এসপার, না হয় ওসপার।
মন্ট্রিয়ল, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৬ সকাল ৪:৪২ মিঃ
আমরা বাঙ্গালীরা শিক্ষায়-দীক্ষায়, জ্ঞানবিজ্ঞানে, সংস্কৃতিতে নিজেদের উন্নত বলে মনে করি। কিন্তু ধর্ম ক্ষেত্রে খুবই সঙ্কীর্ণ মন ভাব আমাদের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ লোকের। এই সংকীর্ণতা থেকে আমাদের কবে মুক্তি ঘটবে তা চিন্তা করে পাই না। যারা ধর্ম নিয়ে থাকতে চায় তারা তাদের নিজ নিজ ধর্মকে নিয়ে থাকুক। অপর ধর্মীয় লোকদের উপর কেন অত্যাচার করবে? সরকার এই বিষয়টা কেন সঠিক ভাবে দেখবেনা? দেশ সব ধর্মীয় লোকের, স্নগখ্যাগ্রিষ্টদের একার নয়। সরকার দেশ পরিচালনা করে। তাদের দায়িত্ব সর্ব সাধারনের স্বাধীনতা রক্ষা করা। কোন একটি গোষ্ঠির স্বার্থ রক্ষা করা তাদের শুধু দায়িত্ব নয়। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের সরকার সংখ্যাগুরুদের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। সংখ্যালঘুদের স্বার্থ দেখার সময় তাদের কোথায়? কেননা ভোটে জিতার জন্য গ্রিষ্ঠদের তোষণ করা কর্তব্যের মধ্যে পরে। কয়েকদিন পূর্বে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক জনকে মেরে ফেলা হল। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া কতটুকু? যে দেশে সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুদের জোর করে ধর্মান্তরিত করে, সেই দেশে কতটুকু সুবিচার পাওয়ার প্রত্যাশা করা যায়? তবে শিক্ষিত জনসাধারণ যদি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তবে কিছু সুরাহা হতে পারে। শিক্ষিত লোকেরা যদি ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়, তবে আপামর জনসাধারণ সেই সম্বন্ধে সজাগ হবে।
বাংলা দেশতো ইসলামিক রাষ্ট্র, সেখানে সংখ্যাগুরু হচ্ছে মুসলিম। ইসলামিক ধারায় দেশ শাসন হওয়াই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ‘গণপ্রজাতন্ত্রী দেশ হিসাবে’ জন্ম হয়েছিল। কিন্তু প্রব্রতি ক্ষেত্রে দেখা যায়, ইসলামিক রাষ্ট্র হিসাবে প্ট পরিবর্তন। কিন্তু বর্তমান শাসক দল ক্ষ্মতায় আসার পরেও ডেসকে ইসলামিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে সেকুলার- গণতন্ত্র হিসাবে ঘোষনা করতে পারেনি। সুতরাং সেই দেশে সংখ্যা লঘুরা নির্যাতিত হবে, তাতে অস্বাভাবিকতা আছে কি? দেশে যারা স্নগাখ্যাগুরু, তাদেরি দেশ। এত ভারত নয়, যে সংখ্যালঘুরাও সমান অধিকার পাবে। বর্তমান সরকারও ইসলামের পক্ষে।
ব্লগ জগৎ সম্বন্ধে আমার ভাল ধারণা নেই। স্বল্প জানায় যতটুকু বুঝতে পেরেছি, ‘মুক্তমনা‘ বিদ্যমান বাংলা ব্লগগুলো‘র মধ্যে অন্যতম প্রগতিশীল এবং মুক্তবুদ্ধির মানুষদের বিচরণ ধন্য একটি বাংলা ব্লগ। এমন ব্লগে এ লেখাটির মত একটি লেখায় কোন মন্তব্য না দেখে খুব অবাক হলাম। এটা থেকে কি বুঝব? লেখক যা লিখেছেন তা অসত্য? নাকি আমরা নিজেদের মুক্তবুদ্ধির মানুষ হিসেবে দাবী করলেও ভিতরে আমরা আসলে বাংলাদেশের মিডিয়ার মত চরিত্রই ধারণ করি। মিডিয়া যেমন সংখ্যালঘুদের খবর চেপে যায় আমরাও তেমনি এ লেখায় মন্তব্য করা চেপে গেলাম। নাকি আমরা ভাবি, লেখক বেশী বেশী বলছেন। সংখ্যালঘুরা আসলে বাংলাদেশে ইউরোপের সংখ্যালঘুদের তুলনায় বেশী ভাল আছে। কথাটি আমার মনগড়া নয়। আমারই সামনে আমার এক সংখ্যালঘু কলিগকে অপর সংখ্যাগুরু কলিগ এ কথাটি বলেছিল। আমি প্রতি উত্তরে তেমন কিছু বলতে পারিনি, শুধু বলেছিলাম যে, উনারা এমনই ভাল আছে যে সে ভাল থাকার কথা প্রকাশ করার সুযোগও উনার নেই। আপনিই তাদের পক্ষ হয়ে তারা যে ভাল আছে তা বলে দিচ্ছেন।
লেখাটির জন্য ধন্যবাদ। এতে সংখ্যালঘুদের মানবেতর অবস্থার একটি খন্ড চিত্র উঠে এসেছে। প্রকৃত পক্ষে তাদের অবস্থা আরও খারাপ। আসল কথা হ‘ল, ধর্মভিত্তিক সমাজে কোন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাই ভাল থাকতে পারেনা। আর আমাদের দেশের মত যেখানে রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করা হয় সেখানে তো অবস্থা আরও বেগতিক। সেখানে ধর্ম আর ধর্ম থাকেনা। এটি হয়ে উঠে যাবতীয় অধর্ম সুলভ কাজ করার এক হাতিয়ার।