Red Indian_Book
( “রেড ইন্ডিয়ানদের সাথে বসবাস” বইটি অনেকদিন পরে হলেও আলোর মুখ দেখলো। বইটি একুশে বইমেলার ২৩১-২৩২ নম্বর “নন্দিতা প্রকাশ” স্টলে পাওয়া যাবে আজকালের মধ্যেই। মাত্র ৬০-৭০ পৃষ্ঠার এ বইটি পাঠকদের ভালোলাগবে বলেই আশা করি। সব কিছু ছাপিয়ে একটা দুঃখবোধ রয়েই গেল। ঘাতকের হাতে নিহত হ’বার মাত্র কিছুদিন আগে অভিজিৎ ( লেখক অভিজিৎ রায়) বইটির নামকরণের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেছিলেন ” রেড ইন্ডিয়ান” নামটি ব্যবহার না করার জন্য। আমি অভিজিতকে বলেছিলাম, আপনার সাথে আমার দ্বিমত নেই , সে কথা বইটিতে উল্লেখও আছে কিন্তু সরস্বতীর সাথে লক্ষ্ণীর ভারসাম্যের জন্য প্রকাশক এ নামটিই বেছে নিয়েছেন; আমি এখানে একটু নমনীয় হয়েছি এ ভেবে যে, বইটি তবু বেরুক। এবার বইটি সত্যি বেরুল, কিন্ত অভিজিৎ নেই। স্মরণ করছি অভিজিতকে। বইটির “ভূমিকা” মুক্তমনার পাঠকদের জন্য এখানে প্রকাশ করলাম। )

ভূমিকা

চিত্রটা সারা পৃথিবীব্যাপি এক ও অভিন্নই| যাদের বেড়ে ওঠা ভূমির “আদি” সন্তান হিসেবে,তাদেরকে অভিধা দেয়া হয় “উপজাতি”; অথচ একবারও কেউ ভেবে দেখি না এসব জনগোষ্ঠী কোন জাতির ‘উপ’? উড়ে এসে জুড়ে বসা তথাকথিত ‘জাতি’ স্বত্বাগুলো ‘উপ’-দের ওপর নিজেদের ধর্ম-ভাষা-কৃষ্টি-সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়ে প্রতিনিয়ত বোঝাতে চেয়েছে এদের সবকিছুই নিচু, সবকিছুই আধুনিকতার বিপরীত; ফলে বদলে দিতে হবে আমূলে, উৎপাটন করে নতুন করে পুঁতে দিতে হবে শেকড়; আধুনিকতার উপযোগী করে তুলতে হবে ‘উপজাতি’ গোষ্টীগুলোকে|

বদলে দেয়ার এ চেষ্টা যেন সর্বত্র| কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন উছিলায়, ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে| সে মাধ্যম কোথাও ধর্ম, কোথাও ভাষা; কোথাও আবার সভ্যতা নামক এক আপেক্ষিক আগ্রাসনের সুচতুর প্রয়োগপদ্ধতি| অতীব আশ্চর্য হয়ে উপলব্ধি করা যায় যে, আগ্রাসনের প্রয়োগপদ্ধতি সবখানেই প্রায় হুবহু এক| বাংলাদেশ থেকে ভারত, অস্ট্রেলিয়া থেকে ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে আমেরিকা সবখানেই ভূমির সন্তান ‘আদিবাসী’-দের ওপর চলেছে আধিপত্যের এ আগ্রাসন নিকট ও দূর অতীত কালে এবং এখনও চলছে এ একবিংশ শতকেও|

সে রকম অসংখ্য ‘উপ’ জাতিসত্ত্বার সম্বন্বয়েই উত্তর আমেরিকার আদি অধিবাসী| কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করলেন তো এই সেদিন| অথচ আজ থেকে প্রায় ৪০,০০০ বছর আগে সাইবেরিয়া থেকে উত্তর মেরু পাড়ি দিয়ে উত্তর আমেরিকা বিশেষত কানাডার উত্তরের হিমশীতল ভূমিতে প্রথম মনুষ্যবসতি এসেছিল সে প্রমান মেলে| তারপরের হাজার বছর ধরে ক্রমে ক্রমে অধিকতর দক্ষিণে চলে আসতে থাকে অনেকেই| এ স্থানান্তরের প্রধান কারণ বেঁচে থাকা; প্রধানতঃ প্রকৃতির বিরুদ্ধে এবং অনেক অনেক ক্ষেত্রে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বিরুদ্ধেও|

হাজার হাজার বছর ধরে চলতে থাকা এ অভিবাসনের ফলে উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের উত্তরপ্রজন্মে এক স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ঠ ধারণ করলো | আজ থেকে প্রায় ২৭,০০০ বছর আগের প্রমান মেলে যে, কানাডার ইউকুন প্রদেশে ইনউইট ও মেটিসদের বসতি ছিল| অর্থাৎ আজকের উত্তর মেরুর কাছের আদিবাসীদের জীবনযাপন পদ্ধতি সে সময় কাল থেকেই চলে আসছিল| অন্যকথায় সেখান থেকে অধিকতর দক্ষিণে অর্থাৎ আজকের পশ্চিম, মধ্য ও পূর্ব কানাডার আদিবাসীদের অভিবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তখন কিংবা সমসাময়িক সময় কাল থেকেই| কারণ,এ সব অঞ্চলের আদিবাসী যাদেরকে আমরা এখন “ ফার্ষ্টনেশনস” বলে জানি, তাদের সাথে ইউকুন প্রদেশের ইনউইট ও মেটিসদের জ়ীবিকা নির্বাহের ধরণ ও ধারণে এক দৃশ্যমান পার্থক্য আছে| যদিও এ সব নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এ দৃশ্যমান পার্থক্য গড়ে উঠেছে ভিন্ন ভিন্ন কারণে, যাদের মধ্যে ভাষা ও অর্থনীতিই প্রধান নিয়ামক ছিল বলে অনেকেই মনে করে থাকেন|

যা হোক এতসব নৃতাত্ত্বিক আলোচনা এ বইটির মুখ্য উদ্দেশ্য নয়| কানাডার অভিবাসী জীবনে নিতান্তই পেটভাতের প্রয়োজনে যেতে হয়েছিল তথাকথিত ভদ্রোজনোচিত এলাকা থেকে দূরে; এই সব আদিবাসীদের মাত্র কয়েকটি গোত্রের কাছাকাছি| তাই এ বইটির পরিধিও উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডার দক্ষিণের নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী বা “ফার্ষ্ট নেশনস”দেরও মাত্র কয়েকটি গোত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে|

উত্তর আমেরিকা বিশেষতঃ কানাডাতে আদিবাসী এসব জনগোষ্ঠী যাদেরকে “রেড ইন্ডিয়ান” কিংবা “ইন্ডিয়ান” বলেই জেনে এসেছিলাম এতদিন, তাদের সান্নিধ্যে কয়েকটি বছর বসবাস অভিজ্ঞতা থেকেই এ বইটি| একেবারেই আগুন্তুক ছিলাম আদিবাসী পল্লীগুলোতে; তাই অজানা অচেনা এক বিপুল বিশাল ভান্ডার খুঁড়ে কোন রত্নরাজি তুলে আনার যোগ্যতা ও সামর্থ্য কোনটাই ছিল না আমার| আর সে চেষ্টাও এ বইটিতে নেই| অনেকের অনুরোধেই ঢেঁকি গেলার মতোই আমার এ প্রচেষ্টা| সে সীমাবদ্ধতা তথা বিহগ দৃষ্টিতে আদিবাসীদের দেখার চেষ্টার কথা সবসময় আমি মাথায় রেখেছি|