লেখকঃ আকতার হোসেন

৫ জানুয়ারি আমাদের প্রিয় লেখক মীজান রহমানের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। মীজান রহমানকে নিয়ে সম্প্রতি এক শ্রদ্ধাঞ্জলিতে অপরাহ্ণ সুসমিতো লিখেছিলেন, ‘আমি আপ্লুত হই তাঁর দর্শনে, তাঁর লেখায় মানুষের মুখ দেখে, আমার জননীর মতো অসহায় আমার মাতৃভূমিকে দেখে। শুধু মাত্র গ্রামকে তীর্থ বলার কারণে আমি তাঁকে তিনবার করতালি দেই’। অপরাহ্ণ সুসমিতোর সেই লেখাটির একটি বাক্য আজকের লেখার শিরোনামে ব্যাবহার করলাম।
মীজান রহমানকে নিয়ে সাপ্তাহিক ‘দেশে বিদেশে’র মতামতের পাতায় টরেন্টো থেকে ২২ মে ১৯৯৭ সালে একটি মতামত লিখেছিলেন ইফফাত আরা। ‘ক্যানাডায় বাঙালিদের গর্ব মিজান রহমান’ শিরোনামে তিনি লিখেছিলেন “সাপ্তাহিক দেশে বিদেশের মাধ্যমে লেখক মিজান রহমানের সাথে আমার পরিচয়। কোন লেখা থেকে ঠিক তাঁকে ভাল লেগে উঠেছিল জানি না। তবে তাঁর প্রতিটি লেখাই আমার কাছে অসামান্য। প্রতিটি লেখাই হৃদয় ছুঁয়ে যায়। প্রবাসে বসে এ ধরনের লেখা পড়তে পারবো ভাবতেই পারি নি কোনদিন। খুব খুশি হলাম জেনে যে তিনি ক্যানাডার বাসিন্দা। ক্যানাডার বাঙালিদের গর্ব প্রিয় লেখকের সু-স্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।”

জানুয়ারি ৫, ২০১৬ তারিখে মীজান রহমানের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী এই কথাটির মানে আমরা আর মীজান রহমানের নতুন কোন লেখা পাব না। এটা অবশ্যই একজন পাঠকের জন্য হতাশাজনক বিশেষ করে যারা নিয়মিত মীজান রহমানের লেখা পড়তেন। বয়সের পৌঢ়ত্বের কোঠায় পৌঁছে যখন তিনি পুনরায় লিখতে শুরু করলেন সেই দিন থকে জীবনের শেষ দিনটিও ব্যয় করেছেন লেখালেখির কাজে। অসুস্থতার কারণে যেদিন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেদিনও তাঁর টেবিলে পাওয়া গেছে অসমাপ্ত লেখা। হাসপাতাল থেকে এম্বুলেন্স পাঠানো হয়েছিল তাঁকে নিয়ে যেতে অথচ স্ট্রেচারে উঠেও তিনি হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়েছিলেন একটা বই। বই নেবার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন “ওখানে (হাসপাতালে) শুয়ে থেকে আমি করবোটা কি”? হাসপাতালে নেবার পর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বেঁচে ছিলেন আমাদের এই প্রিয় লেখক। মীজান রহমানকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে এই খবর শোনার পর থেকেই আমি আমার ম্যানেজারকে খুঁজতে শুরু করেছিলাম। ১৭ দিন ছুটি কাটিয়ে অফিসে গিয়েছি মাত্র স্বভাবত কাজের চাপ ছিল খুব বেশি। অথচ সকাল দশটার দিকে মুন্নী (তাঁর স্ত্রীর পক্ষের ভাগ্নি) ফোন করে জানালো গত কদিনের সর্দি-কাশি নিম্যুনিয়া পর্যন্ত গড়িয়েছে। বসকে খুঁজে পাবার পর তাকে বললাম আমাকে এখুনি অটোয়া যেতে হবে। সব শুনে বস বলল যেতেই যখন হবে তাড়াতাড়ি রওনা দাও যাতে দিনে দিনে পৌঁছাতে পার। হাইওয়েতে ওঠার আগে বাসায় গিয়ে স্ত্রী (রোজী) এবং পিকারিং থেকে মীজান রহমানের আত্মীয় ববিনকে তুলে নিলাম। সন্ধ্যার কিছু পর আমরা যখন তাঁর কাছে যাবার অনুমতি পেলাম তখন তাঁকে উঁচু করে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। সুন্দর জামা কাপড় পড়িয়ে বিছানার চাদর কম্বল বদলিয়ে আমাদের চোখের সামনে বেড়িয়ে এলো নার্স। হাতে গোনা কিছু দর্শনার্থীর প্রথম দর্শন। মীজান স্যারের চোখ বন্ধ অথচ মুখে অদ্ভুত একটা হাসির রেখা। যিনি এতকিছু জানতেন তিনি আর কিছু বলতে পারবেন না ভেবে ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। তাঁর হাত তুলে নিয়ে বললাম স্যার কথা বলেন। মুখ বুঝে থাকা মানুষ আপনি নন। জীবন চলে গেছে তাতে কি আপনি বললেই আমরা শুনতে পাব। রোজী আমার গায়ে হাত দিতেই বুঝলাম আমি যার সাথে কথা বলছি তিনি আর কোনদিন মুখ খুলবেন না। তাঁর হাত ছেড়ে দিলাম আলতো করে। তবুও অপেক্ষায় থাকলাম সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনার জন্য। অন্তত দুদিনের আগের কথাটি না হয় আর একবার বলুক। দুদিন আগে কাশি আর ঠাণ্ডায় কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। টেলিফোনে টরেন্টো থেকে বুঝতে চেষ্টা করছিলাম অসুস্থতার পরিমাপ। এক সময় বললাম আমি চলে আসবো স্যার? সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সব কাশি বন্ধ হয়ে গেল। “তোমার মাথা খারাপ হয়েছে, আর যাই কর এই পাগলামোটা করো না বাপু,আমার তেমন কিছু হয় নি।”

ইফাত আরার মত ভক্ত পাঠকদের আশীর্বাদে হয়তো মীজান রহমান আমাদের মাঝে ৮২ বছর বেঁচে ছিলেন। হয়তো আরো বেশি আশীর্বাদ পেলে আরো কিছু সময় থেকে যেতেন আমাদের সাথে। আবার ভাবি তিনি যে নেই সেটাই বা কি করে বলি। কিছু কিছু মানুষ চলে যাবার আগে রেখে যান দিনের উজ্জ্বলতা এবং জ্যোৎস্নার মত কর্মদক্ষতা। মীজান রহমানের মৃত্যুর পর অভিজিৎ রায় লিখেছিলেন ‘অধ্যাপক মীজান রহমান: এক নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ’। অভিজিৎ রায় লিখেছিলেন ‘এই বরেণ্য মানুষটির পরিচয় ছিল গণিতবিদ হিসেবে। শুধু গণিতবিদ বললে ভুল হবে বাংলাদেশের যে কয়জন একাডেমিয়ার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষাবিদ আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন, বাংলাদেশকে পরিচিত করতে পেরেছেন দর্পভরে বিশ্বের অঙ্গনে, তাঁর মধ্যে মীজান রহমান অন্যতম… গণিত বিষয়ে বাংলাদেশের কিংবদন্তির তালিকা কেউ বানাতে বসলে মীজান রহমানকে বাদ দিয়ে সেটা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু গণিতের কাঠখোট্টা জগতের বাইরেও তাঁর আরেকটি পরিচিতি ছিল। তিনি ছিলেন সুসাহিত্যিক। তাঁর লাল নদী পড়ে আমি বিস্মিত, আলোড়িত হয়েছিলাম, সহসা আবিষ্কার করেছিলাম এক সমাজ সচেতন প্রগতিশীল সুলেখকের প্রতিচ্ছবি’।

মীজান রহমান তাঁর জীবন্ত রচনাগুলোর মাঝে বহুকাল বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে, যতটুকু তিনি আমাদের দিয়েছেন আমরা যেন সেটুকুর সৎ ব্যবহার করতে পারি। আমাদের উচিৎ হবে তাঁর লেখাগুলো খুঁজে খুঁজে পড়া এবং সেগুলো অন্যকে পড়তে উৎসাহিত করা। বিশেষ করে: আফ্রিকার আর্তনাদ, নারী ও নানী, দেশের খবর, মহাপাপ, নরকের নর্তকী, এ যুগ সে যুগ, আমি মুক্তিযোদ্ধা নই, মাটির গান, বৈষম্য ও বৈষম্য, কোরবানি, সবার চেয়ে মানুষ সত্য, ভাবমূর্তির ভাবনা, পুণ্যধাম, এ ঘুম কি ভাঙবে, একাত্তরের প্রেতাত্মা, ঘুঘুর ডাক, শান্তির বোমা, প্রবাসে বার্ধক্য, আনন্দ আশ্রম, মাটির ছোঁয়া, অযাচিত আগন্তুক, জীবনের ধন, যে আলো থাকে আঁধারে, অনন্যা আমার দেশ, চুচু ট্রেন, অবিনশ্বর, লাল নদী, মায়ের কবর, নারীর ধর্ম ও ধর্মের নারী, বিবি, তীর্থ আমার গ্রাম, ইত্যাদি।

তিনি তাঁর লিখনিতে যাদের কথা বলে গেছেন তাঁরা আমাদেরই লোক অথবা আমরাই সেই লোক, অথবা কিছু ভাবলেশহীন অসতর্ক মানুষকে তুলে দিয়ে গেছেন আমাদের মাঝে। মীজান রহমানের দুশ্চিন্তাগুলোকে এখন আমরা যদি অনুধাবন করতে না পারি সে দোষ আমাদের। স্বভাবতই আমরা অনেক ভোলা মনের মানুষ। অথচ তিনি ভুলেন নি কাউকে। চেনা জানা অনেক মানুষ তাঁর কাছে না থেকেও তাঁর সাথে ছিল সারা জীবন। কথাটা আমি আগেও বলেছি না হয় আর একবার বলি। পরশ পাথরের গল্প আমরা অনেকেই পড়েছি। যেখানে সেই পাথরের স্পর্শ লাগত সেটাই সোনা হয়ে যেত। মীজান রহমান ছিলেন পরশ লেখক। যে বিষয় নিয়ে লিখেছেন, যাকে নিয়ে লিখেছেন সেটাই উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। একমাত্র অন্ধরাই সেই উজ্জ্বলতা দেখতে পারে না।

পাঠকদের জন্য মীজান রহমানের লেখা থেকে কয়েকটি অংশ তুলে ধরছি।

“১১ সেপ্টেম্বরের পর অবশ্য সব ঘাসই শুঁকিয়ে খড় হয়ে গেছে। মনে হয় না যে আমরা এখনো জীবিত। ওটা আমাদের বুক থেকে শুষে নিয়েছে সব নিঃশ্বাস, সব অনুভূতি, ভাব উচ্ছ্বাস। এখন থেকে আমরা বুঝি নিজেদেরই মুক প্রেতাত্মা। পক্ষাঘাতগ্রস্ত, বাকশক্তি রহিত, কদাকার কুশপুত্তলিকা। ১১ই সেপ্টেম্বর মানব জাতির জন্য এক অন্তহীন দুঃস্বপ্ন। ওটার সঙ্গে আপোষ করা সম্ভব নয়, অন্তত আমি পারব না”। (ট্রিক অর ট্রিট)

“আমার মত অগুনতি মেধাবী পথেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর সর্বত্র। সন্দেহ নেই যে আমি দেবার নাম করে পাবার উল্লাসে চষে বেড়িয়েছি সারা দেশ। সন্দেহ নেই যে দেশ আমাকে হারায়নি, আমি হারিয়েছি দেশকে। প্রতীতি এসেছে মনে যে দেশ আমার দরিদ্র ছিল না কোনদিন, দরিদ্র ছিলাম আমি – ছিন্নবস্ত্রে নয়, স্বল্প আহার্যে নয়, দরিদ্র ছিলাম আমার ক্ষুদ্রমনে। মাঝে মাঝে মনে হয় দেশের পরম ভাগ্য যে আমি ফিরে যাইনি”। (আমি বাংলাদেশী না ক্যানাডিয়ান)

“যে বাংলাদেশের প্রাণের ভেতরে পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের মত মধ্যযুগীয় দেশগুলি ঠাঁই করে নিতে সক্ষম হয়েছে সে বাংলাদেশ আমার নয়। যে বাংলাদেশ আরবের তেল আর তংকার মোহে নিজেদের বাঙালিত্ব বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়েছে সে বাংলাদেশকে আমি চিনি না। আমি একদিকে ওয়াশিংটন-মস্কো বা বেইজিংপন্থী হতে চাই না তেমনি আমি বেঁচে থাকতে কখনো কাবুল-ইসলামাবাদ বা রিয়াদপন্থী হব না। একমাত্র নামাজের সময় ছাড়া অন্য কোন কারণে মক্কামুখী হবার বাসনা পোষণ করব না। সারাজীবন আমি ঢাকাপন্থী ছিলাম বাকি জীবনটাও যেন তাই থেকে যাই। বিধাতার কাছে এই প্রার্থনা” (নেতার অপেক্ষায়)

“আমার মনে হয় বৃহত্তর এই সমিতি আর ঐ সমিতির বার্ষিক বনভোজনের কথা ভুলে গিয়ে আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিৎ অন্যান্য জিনিসের প্রতি, যাতে দেশের সম্মান বাড়ে, দেশের গুণাগুণ করতে পারে বাইরের পৃথিবী। সমিতির বিজ্ঞাপন না দিয়ে আসুন আমরা দেশের বিজ্ঞাপন দিয়ে শুরু করি”। (দেশান্তরে)

“একাত্তর থেকে শুরু করে আজ অবধি আমরা কোন পথে চলেছি, কোথায় আমরা যেতে চাচ্ছি এবং কেন, সে কথাগুলি অন্যরা কতখানি ভাবেন জানিনা কিন্তু আমি ভাবি। ভেবে হতাশ হই, দুঃখ পাই। দুঃখ পাই দেশের দুর্দশা দেখে নয়, দুঃখ পাই নিজের অক্ষমতায়। অন্যরা কে কি করেনি দেশের জন্য, কে কতটা ক্ষতি করেছে দেশের সেটা বিচার করেই সবটা সময় কাটিয়ে দিয়েছি প্রবাসের প্রাচুর্যে বসে। ঘুণাক্ষরেও কোনদিন ভাবিনি আমি নিজে কতটা করতে পারতাম কিন্তু করিনি” (বিশেষ উপলক্ষ)

মীজান রহমানকে জানতে হলে তাঁর লেখাগুলো পড়া একান্ত প্রয়োজন। যে সমস্ত ব্যক্তি জাগতিক বস্তুবাদী তারা মীজান রহমানকে এড়িয়ে গেছেন। যারা পরজগতে বিশ্বাসী তাঁরা তাকে অবহেলা করেছেন। এই দুইয়ের বাইরের যারা তাঁদের অনেকেই মীজান রহমানকে মনে করেছেন আত্মার লোক। মীজান রহমানের মত মুক্তচিন্তার লোক আমাদের মাঝে খুব বেশি দেখা যায় না। তাঁর বড় গুন ছিল তিনি খোঁজ করতেন অনবরত। সব কিছুর গভীরে গিয়ে তিনি খোঁজ করতেন মানুষের ভেতরের মানুষ। আমরা যারা বাইরের আবরণে মুগ্ধ হয়ে যাই, ভেতরটা দেখতে চাইনা তিনি তেমন ছিলেন না। আমরা যাকে ভুলে থাকি বা ভুলে যাই তারাই মীজান রহমানের কাছের লোক। রবীন্দ্রনাথের সেই কথা; ‘বাহির-পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয়-পানে চাই নি’।

মীজান রহমানের একজন ভক্ত পাঠক কৌশিক মৌলিক ১৯৯৭ এর নভেম্বরে লিখেছিলেন, “তাঁর আবেগের গভীর আবেদন ও তাঁর মানবতাবাদী দর্শন আমাকে বিশেষভাবে স্পর্শ করে। মীজান রহমানের লেখার বিষয়বস্তু কখনও কখনও অতিমাত্রায় দেশজ বা মাটির গন্ধমাখা, কখনও গম্ভীর আবার কখনও সরস। সহজ-সত্যতা সমৃদ্ধ করার এক অন্যতম সাড়া দেবার প্রয়াস এবং তাঁর অভিজ্ঞতাজনিত সত্যের উপলব্ধিই পাঠক জাগিয়ে রাখে”।

মন্ট্রিয়ল থেকে আরেক পাঠক হাজেরা খাতুন ২০০৪ সালের মে মাসে লিখেছিলেন, “মীজান রহমানের সহজ সরল ও জীবন মনস্ক লেখা তাকে সহজেই আমাদের প্রাণের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে… জীবনের সাথে যার একান্ত ভালোবাসা তিনি ছাড়া এরকম আবেগ ও সৌন্দর্যের কথামালা সাজাতে কেউ পারবে না”

সাপ্তাহিক ‘দেশে বিদেশে’তে লেখা মীজান রহমানের ‘বিশ্ব নাগরিক ও অবগুণ্ঠন’ প্রবন্ধটি রীতিমত হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল। অটোয়া থেকে মশিউর রহমান নামের এক লোক প্রতিবাদ লিপি পাঠিয়েছিল দেশে বিদেশের পত্রিকায়। মশিউর রহমানের মত কিছু লোকের ভুল ভাঙ্গতে অনেককেই সেদিন মতামতের পাতাতে লিখতে হয়েছিল। তাদের অন্যতম হলেন লেখক গবেষক হাসান মাহমুদ। নভেম্বর ২০, ১৯৭৭ সালে তিনি লিখেছিলেন, “বিশ্ব নাগরিক ও অবগুণ্ঠন আবারো পড়লাম… না পর্দা প্রথা বা ইসলাম চর্চা-কারীদের প্রতি কোন ব্যাঙ্গ খুঁজে পেলাম না.. লেখক বরং বলতে চেয়েছেন অন্ধকারে আটকে পড়া মানসিকতার, চেতনার কথা। তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বাস গড়ে ওঠার বদলে বিশ্বাস অনুযায়ী তথ্য ব্যবহার করার কথা। বোরখা একটা রূপক মাত্র। লেখক বলতে চেয়েছেন কুয়োর ব্যাঙের মত মন-মানসিকতার কথা, যেখানে জ্ঞানের আলোর প্রবেশ নিষেধ। আমিতো ভাই এমনই বুঝেছি লেখাটা পড়ে। এ বুঝাটা ভুলও হতে পারে, তবে অন্য বন্ধুদেরও দেখলাম একই মত। সবশেষে বলি, লেখক অঙ্কের মাষ্টার। আমাদের দীনতা, সাংস্কৃতিক সংকট, বুড়ো বয়সের সমস্যাগুলো, আইডেন্টিটি ক্রাইসিস এর ওপর কথাশিল্পীর কলমে কিছু দিচ্ছেন বলেই তো বিশাল উত্তর আমেরিকার জননন্দিত লেখক হয়েছেন। আমরা সবাই তাঁর লেখা পড়ি, আগ্রহের সাথেই পড়ি। যদি দু’একটা জায়গায় আমার-আপনার সাথে তাঁর মত নাই মেলে, তবে সেটা নিয়ে এত রাগ করার দরকার কি”?

এই “বিশ্ব নাগরিক ও অবগুণ্ঠন” বিতর্কে আমিও জড়িয়ে পরেছিলাম, সেদিন আমি যা লিখেছিলাম তার থেকে কিছু অংশ তুলে দিয়ে আজকের এই লেখা শেষ করবো।
মীজান রহমানের উপর প্রথম অভিযোগ প্রবাসের কোন বাংলাদেশীকে মীজান রহমান কোন সাহায্য করেছেন কি না। এই প্রশ্নের উত্তর দেবার অনুমতি চেয়ে বলছি। জী হাঁ, তিনি সাহায্য করেছেন, শুধু বাংলাদেশীদেরকে নয় অনেক প্রবাসীকে সাহায্য করেছেন। আমাকেও করেছেন। মীজান সাহেবের লেখা পড়ে আমি বরফের দেশে বসে টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনতে পাই। ধুপ আর গোবরের গন্ধ পাই। তার লেখা পড়তে পড়তে কাদায় পা আটকে গেছে ভেবে পা টেনে তুলে দেখি পা আমার কার্পেটের উপরই ছিল। তার লেখা পড়লে মাথার উপর জোনাকিদের উড়তে দেখি। পুকুরের পানিতে পদ্ম ভাসতে দেখি। তিনি আমাদেরকে শিখিয়েছেন অহমিকা নয়, সত্য কথা বলতে। সাব-ইন্সপেক্টর বাবাকে ডি-এস-পি বলতে নেই, কলাবাগানের বাসাকে ধানমন্ডি বলতে নেই। হৃদয়ের মণিকোঠায় অনুভূতি জাগিয়ে যদি মীজান রহমান কোন সাহায্য না করে থাকেন তবে জসিমুদ্দীন, জীবনানন্দ, আব্বাস উদ্দিন, জয়নাল আবেদিনও কারো কোন সাহায্যে আসেননি। এর পরের নালিশ একজন শিক্ষিত বাংলার সুসন্তান হয়ে মীজান রহমান আমাদের কি দিয়েছেন। মীজান সাহেব এক লেখাতে বলেছেন দেশের কাছে তার ঋণ অনেক। তাই যতদিন বেঁচে থাকবেন সে ঋণ শোধ করে যাবেন। তিনি বলেছেন এখন তাঁর লেখার পালা, জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত লিখে লিখে শোধ করে যাবেন। কবি যেমন কবিতা লিখে, কৃষক যেমন ফসল ফলিয়ে, মুয়াজ্জিন যেমন আজান দিয়ে তাদের ঋণ শোধ করে। লেখক মীজান রহমান তাঁর নিজস্ব মাধ্যমে সে কাজটি করছেন। আর এ কাজটি করতে গিয়ে তিনি অনেক প্রবাসীর মনের ভেতর বাংলার হারিকেন কুপি জ্বালিয়ে দিয়েছেন। এতটুকু দেওয়া কিন্তু কম নয়….। (নভেম্বর ২৭ ১৯৯৭ – দেশে বিদেশে)।

মীজান রহমানের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে ড. অভিজিৎ রায় লেখেছিলেনবিদায় মীজান ভাই, গুড বাই …