bCover27
৫.
তেঁতুল ও এবাদত পার্টির কোনো প্রতিনিধি সংসদে নেই। কিন্তু বিরোধী দলের নেতানেত্রী, সাংবাদিক, ইন্টারনেট পত্রিকা এবং টিভি খবর থেকে সংসদে পাশ হওয়া বিল সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা নিয়ে তারা এই উপসংহারে পৌঁছে যে সরকার অতি সত্বর খবিরকে খোঁয়াড় থেকে বের করে গ্রেফতার দেখিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসবে এবং সেখানে দ্রুত বিচার আইনে তার বিচার করবে। এতে এই দু’টি পার্টির ক্ষতি বই উপকার হবে না, কারণ বিচারে খবিরের হয়তো কয়েক বছরের জেল হবে। এমনকি সরকার চাইলে তাকে জেল থেকে বের করে বিদেশেও পাঠিয়ে দিতে পারে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল এই দল দু’টি চায় ডাইরেক্ট অ্যাকশন, মানে খবিরের মৃত্যু। কিন্তু তারা এ-ও জানে যে কারো প্রাণ নাশ করতে চাইলেই তো সে মরে যাবে না, তার জন্যে চাই কার্যকরি পদক্ষেপ।
ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে তাই দল দু’টি এবাদত পার্টির ঢাকাস্থ হেড কোয়ার্টারে এক জরুরী সভার আয়োজন করে। সভায় জয় হিন্দ পার্টির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককেও আমন্ত্রণ জানানো হয়, কারণ ইতিমধ্যেই সংখ্যালঘুদের এই দলটিও ঘোষণা করেছে যে চাঁদ ও সূর্য তাদের দেবতা অতএব দেবতার অপমান তারা সহ্য করবে না।
মিটিংয়ে বসার আগে তারা ছিলো ফুরফুরে মেজাজে। সরকারের পুলিশ বাহিনীর মাধ্যমে তাদের এমন একটি উপকার হয়ে যাবে, শাহবাগের সমাবেশ ভেঙে দেয়া হবে, আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ মারা যাবে তা তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। অতএব এই ঘটনাকে ‘পবিত্র ভূমি রক্ষা’ আন্দোলনের প্রথম বিজয় হিসেবেই দেখতে চায় তারা। বিজ্ঞান নামক শয়তানের পাঁচ পা যে ভেঙে পড়তে যাচ্ছে এ ব্যাপারে তারা অনেকটা নিশ্চিত হলেও সভায় গুরুতর উৎকণ্ঠার কথা জানান এবাদত পার্টির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, “সংসদে পাশ হওয়া বিল হয়তো সকাল দশটার মধ্যেই গেজেট আকারে প্রকাশিত হবে। উপজেলায় সেই বিলের কপি ততোক্ষণে ফ্যাক্স বা ইমেলের মাধ্যমে পৌঁছে যাবে। তার মানে, দুপুর নাগাদ খবির সরকারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে চলে আসবে। তিনি আরো বলেন, সরকার বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে দেখছে এই কারণে যে ইতিমধ্যে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে যে আন্দোলন হচ্ছে তা যেনো কিছুতেই সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ না নেয় সেদিকে শাসকগোষ্ঠীর সজাগ দৃষ্টি রয়েছে।”
তেঁতুল পার্টির ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি সাথে সাথে আর্তনাদের সুরে বলেন, “খবিরের ব্যাপারে সরকারকে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। খবির র‌্যাব বা পুলিশের হেফাজতে যাওয়া মানে আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া। সরকার সুযোগ পাবে দীর্ঘসূত্রিতার; এবং এই অপরাধের বিচারে বড়ো জোর চার/পাঁচ বছরের জেল হবে, একদিন জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এই খবির হয়ে উঠবে আরো বড়ো, পরাক্রমশালী, ভয়ানক। ততোদিনে মানুষ তার অপরাধের কথাও ভুলে যাবে─যে দেশে মুক্তিযুদ্ধে প্রবাহিত রক্তের বন্যা মানুষ ভুলে যায়, বলা বাহুল্য যার জন্যে আমরা রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছি─সেই দেশে খবিরের অপরাধ তো নস্যি, জনগণের ভুলে যেতে সময় লাগবে না।”
জয় হিন্দ পার্টির নেতা বলেন, “তাহলে কি করতে চান?”
তেঁতুল পার্টির সভাপতি বলেন, “চিরতরে শেষ করে দিতে চাই।”
এবাদত পার্টির সাধারণ সম্পাদক বলেন, “ক্যাচ্চাত!” তিনি গলায় হাত তুলে আঙুলকে ছুরি বানিয়ে দেখাতেও ভোলেন না।
জয় হিন্দ পার্টির নেতা আঁতকে ওঠেন, “কিভাবে?”
“আমাদের উপর ছেড়ে দেন দাদা। ওটা আমাদের দায়িত্ব।” জোর দিয়ে বলেন এবাদত পার্টির সভাপাতি।
“হাতে সময় কিন্তু একটি মাত্র রাত,” স্মরণ করিয়ে দেন তেঁতুল পার্টির সভাপতি।

৬.
ওরা এলো রাত প্রায় তিনটার দিকে। কালো বুট, সাদা পায়জামার সাথে খাকি পাঞ্জাবি, মাথায় শক্ত করে বাঁধা ব্যাচ যাতে লাল কালি দিয়ে লেখা ‘পবিত্র ভূমি আন্দোলন’ আর প্রত্যেকের হাতে ধারালো রামদা।
দূরে দু’একটা কুকুরের ডাক, থেকে থেকে রাত জাগা পাখির ক্ষীণ কণ্ঠ, তাছাড়া মানুষের কোনো সাড়া তখন ছিলো না। মণ্ডল গ্রাম ছিলো শান্ত, নীরব, নিস্তব্ধ। খোঁয়াড়ের পাহারায় থাকা লাঠিয়াল বাহিনীর দু’জন সদস্য বেঞ্চিতে বসে ঝিমোচ্ছিলো। অতএব ওদের বেঁধে ফেলে মুখে টেপ লাগিয়ে দিতে খুব একটা সময় ব্যয় হয়নি।
দীর্ঘক্ষণ অভূক্ত থাকার পরও খবিরের নিদ্রা বা ঝিমুনি কিছুই আসেনি। খোঁয়াড়ে আটকানোর পর ওর স্ত্রী পাশে হাউমাউ করে কাঁদলে লাঠিয়াল বাহিনীর লোকেরাই তাকে সরিয়ে দিয়েছিলো এবং মাতুব্বর হুকুম দিয়েছিলেন যে খোঁয়াড়ের পঞ্চাশ গজের মধ্যে কেউ যেনো যেতে না পারে। অতএব বান্ধবহীন নির্মমতায় দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হলে আকাশের চাঁদ তাঁকে সঙ্গ দিতে থাকে। গলগল করে যেনো চারদিকে জ্যোৎস্না ঢেলে পড়েছিলো, রাতে এতোটা আলো খবির আগে কখনো দেখেনি। খোঁয়াড়ে যেমন গরু ছাগলের জন্যে বসার কোনো জায়গা থাকে না, খবিরের জন্যে তাই বসবার কিছু ছিলো না, অতএব পালাক্রমে দাঁড়িয়ে ও মাটিতে বসে সময় কাটিয়ে দিচ্ছিলো। মাঝে মাঝে দু’একটা মশা বিরক্ত করলে হাত নেড়ে ওদেরও তাড়িয়ে দিতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু দুর্বৃত্তরা এসে যখন অতর্কিতে দরজা ভেঙে ফেললো, সামান্য হলেও তখন তার বুকের মাঝখানটা কেঁপে উঠেছিলো। তাছাড়া ওদের পোষাক ও হাতের অস্ত্র ভীতিকর দৃশ্যের অবতারণা করলে আক্রান্ত এই অসহায় কৃষক হয়তো ভেবেছিলো এই বুঝি তাকে চিরতরে শেষ করে দেয়া হয়। তা যখন হলো না, হাত দুটো যখন পিছনে বেঁধে খোঁয়াড় থেকে বের করা হলো, তখন একবার ভেবেছিলো যে সে জিজ্ঞেস করবে তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওরা, কিন্তু পরক্ষণেই নিজ থেকে সেই কৌতূহল নিবৃত হয়ে যায়।

ঘুমন্ত গ্রাম আস্তে আস্তে জেগে উঠেছিলো। হয়তো এমনও হতে পারে যে এই ধরনের একটি ঘটনা ঘটবে বলে গ্রামবাসী আগে থেকেই জেগে ছিলো এবং নিঃশব্দে যার যার ঘরে শুয়ে কান খাড়া করে রেখেছিলো। ফলত, ওদের পায়ের আওয়াজে তারা পুরোপুরি সতর্ক হয়ে ওঠে। কিন্তু যে গ্রামবাসী খবিরের বিচারের সময় একটি শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি, এমনকি কৃষক নেতা রতন বিশ্বাসও তার বিচার দাবী করেছে, তারা কেনো কান খাড়া করে সারারাত জেগে থাকবে! এর মূলেও কি তাহলে রতন বিশ্বাস? হয়তো তাই। এবং সেটা সম্ভবও হয়েছে নানা কারণে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে শাহবাগের সমাবেশ এবং সেখানে পুলিশের নির্বিচারে হত্যা, সংসদের জরুরী অধিবেশনে খবিরের বিচার সংক্রান্ত বিল পাশের খবর, বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে পক্ষে-বিপক্ষে বিক্ষোভ ইত্যাদি হয়তো রতন বিশ্বাসকে ভাবিয়েছে। তার থেকেও বড়ো কথা আফজাল খবির পরিবারের নিরাপত্তার জন্যে যেসব বন্ধুকে গ্রামে রেখে গিয়েছিলেন তারাই চুপিচুপি দু’একজন কৃষক নেতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, বলার চেষ্টা করেছে আসলে কি থেকে কি ঘটতে যাচ্ছে। খবির যেহেতু কৃষকের উপকারই করেছে, সে নিজেও যেহেতু কৃষক, আফজালের বন্ধুরা বোঝানোর চেষ্টা করেছে, একজন কৃষক কেনো এমন নির্মম অত্যাচারের শিকার হবে, এবং অন্যান্য কৃষকেরা কেনো এই সাধারণ বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবে না যে খবির যদি অপরাধ করেও থাকে সেই অপরাধের শাস্তি হিসেবে তাকে অমানবিক ভাবে অভূক্ত অবস্থায় পশুর খোঁয়াড়ে আটকিয়ে রাখা যেতে পারে না; এমনকি তার ফাঁসি চাওয়াও ভয়ানক ষড়যন্ত্রেরই অংশ। কেনো একাত্তরের হানাদার দোসরেরা সোচ্চার হয়ে উঠবে! আফজালের বন্ধুরা আরো বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে চাঁদ যদি সূর্যের আলো নিয়ে আমাদের আলোকিত করেই থাকে, তাতে তো চাঁদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। আর বিজ্ঞানের কথা মতো পৃথিবী যদি সূর্যের চারদিকে ঘুরে ঘুরে সূর্যের আলো উপভোগ করে, আমাদের প্রাণের স্পন্দন ঠিক রাখে, তাতেও তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। এমনকি খবির যদি পাগলও হয়, পাগলের উপর এমন অত্যাচর হবে কেনো! সর্বোপরি একজন কৃষকের উপর এই অত্যাচার অন্য কৃষক না বুঝে মেনে নেবে কেনো। এইসব শুনে শেষ পর্যন্ত কৃষক নেতা রতন বিশ্বাস বুঝতে পেরেছে যে একটি সহজ ব্যাপারকে গ্রামের মাতুব্বর তার প্রয়োজনে জটিল করে ফেলেছেন। দেশ বিরোধী শয়তানেরা সেই সুযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এবং এইসব নিয়ে চিরাচরিত নিয়ন্ত্রণবাদী খেলা শুরু করে দিয়েছে দেশের দুই বড়ো রাজনৈতিক দল। তাই রাত তিনটায় মণ্ডল গ্রামকে যতোটা নিস্তব্ধ মনে হয়েছিলো আদতে ভেতরে ভেতরে গ্রামখানা অতোটা নিস্তব্ধ ছিলো না।

খবিরকে এবাদত ও তেঁতুল পার্টির ক্যাডারেরা বাজারের দিকে নিয়ে যায়। দূর থেকে আস্তে আস্তে গ্রামের অনেক কৃষকই পায়ে পায়ে অনুসরণ করতে থাকে। পিছে পিছে রতন বিশ্বাসের নেতৃত্বে একটি সুসজ্জিত কৃষক দলও এগিয়ে আসে।
বাজারে একটি ইলেকট্রিকের খুঁটির সাথে তাকে বাঁধা হয়। দুর্বৃত্তরা চায়ের দোকানের কর্মচারিদের জাগিয়ে তোলে; ওদের চায়ের ব্যবস্থা হয়। ততোক্ষণে চারিদিক থেকে অসংখ্য কৃষকের চোখ খবিরের উপর পড়ে। অন্যদিকে সশস্ত্র কৃষকেরা দু’টি দলে ভাগ হয়ে বাজারের উভয় পার্শ্বে, বড়ো রাস্তার দক্ষিণ ও উত্তরে অবস্থান নেয়। খবর পেয়ে গ্রামের সমস্ত লোক বাজারের দিকে ছুটতে থাকে। দুর্বৃত্তরা ইতিমধ্যে রটিয়ে দেয় যে খোঁয়াড় ভেঙে পালানোর সময় ওরা খবিরকে আটক করে এখানে নিয়ে এসেছে। চাঁদ-সূর্যের অবমাননা ও পালানোর চেষ্টা, দুই অপরাধই এতো মারাত্মক যে এর শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদণ্ড, সূর্য ওঠার সাথে সাথে যা কার্যকর করবে দেশ ও ধর্ম রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত এবাদত ও তেঁতুল বাহিনির সেনারা। হাতের ধারালো অস্ত্র উঁচিয়ে ওরা বলে যে এই রামদা দিয়ে ওকে কেটে টুকরো টুকরো করে শরীরের নানা অংশ গাছে গাছে ঝুলিয়ে দেয়া হবে, মাথাটা ঝোলানো হবে খবিরকে বেঁধে রাখা খুঁটিতে। তেঁতুল পার্টির যে নেতা গতকাল বটতলায় বিচারকার্য চলার সময় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিলো, গলা উঁচিয়ে বলে, “এভাবে ঝুলিয়ে দিলে স্থানীয় লোকেরা ভয় পাবে এবং কখনোই ধর্ম-বিরোধী কোনো কাজে লিপ্ত হতে সাহস পাবে না।” এই নেতা আরো বলে, “এভাবে আমাদের পূর্বপুরুষেরাও ১৯৭১ সালে বাজারের মোড়ে, চৌরাস্তার গাছে, উঁচু খাম্বায় শত্র“দের মাথা ঝুলিয়ে রাখতো। আমরা তাদের পথই অনুসরণ করবো ইনশাআল্লাহ।”
ওরা আরো ঘোষণা দেয় যে খবিরের পক্ষে যদি কেউ কথা বলতে আসে কিম্বা তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে চায়, তারও একই হাল করা হবে।
এইসব শুনে গ্রামের মানুষগুলো ভয়ে কাঁপতে থাকে। কেউ কেউ হিসি করে দেয়, কিন্তু মুখে টুঁ শব্দটি করে না।
ওদিকে এক ব্যবসায়ী নেতা এসে দুর্বৃত্তদের বলে, “ভাইয়েরা, খবিরকে এখানে আনা কি ঠিক হলো, আমরা তো ওকে এই বাজারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছি!”
দায়িত্বপ্রাপ্ত এবাদত পার্টির অপারেশন কমান্ডার বলে, “কিছু ভাববেন না জনাব, আমরা ওকে পৃথিবীতেই অবাঞ্ছিত ঘোষণা দিয়েছি। একটু ধৈর্য ধরুন।”

ইতিমধ্যে পূব আকাশে সূর্য দেখা দিয়েছে─রাগী আলো এসে পড়েছে বাজারের ঘরগুলোর উপর, কিন্তু বোঝার উপায় নেই যে এই রাগ খবিরের না তাকে যারা কতল করতে এসেছে তাদের উপর।
সবকিছু যেনো দেখতে না দেখতে স্বপ্নের মতো ঘটে যাচ্ছে।
উপস্থিত চোখগুলোর কেউ কিছু বোঝার আগেই তিনবার বাঁশি বাজিয়ে খবিরকে বাঁধনমুক্ত করে একটু সামনের দিকে আনা হয় এবং দুই দিক থেকে চারজন দুর্বৃত্ত ওর দুই হাত দুই দিক দিয়ে টানটান করে ধরে। আর সেই মুহূর্তে জল্লাদের মতো অতর্কিতে একজন লাফ দিয়ে সামনে এসে আল্লাহু আকবার বলে ধারালো রামদায়ের এক কোপে কব্জির উপর থেকে ওর বাম হাতখানা কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ভয়ঙ্কর চিৎকারসহ আর্তনাদে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ হতে থাকে। মাটিতে পড়ে খবির কাটা পাঁঠার মতো দাপায়, তাজা রক্তে ভেসে যেতে থাকে জমিনের বুক।
ভয়ার্ত মানুষগুলো বেশী বেশী করে কাঁপে, কেউ কেউ এগিয়ে গিয়ে খবিরকে ধরতে উদ্যত হলে রামদা সামনে ধরে শাসানো হয়।
তেঁতুল পার্টির নেতা কাটা হাতখানা তুলে ধরে বলে, “এই দেখুন খবিরের হাত। অন্য কেউ ধর্মের বিরুদ্ধে গেলে, আমাদের ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে গেলে, তারও এই অবস্থা হবে! আমরা একে একে ওর অন্য হাত ও পা কাটবো, এর পর পশু কুরবানির মতো ওকে জবাই করে আমাদের ঘোষণা অনুযায়ী মাথাটা এই খুঁটিতে ঝুলিয়ে দেবো।”
চোখের ইশারায় উদ্দিষ্ট খুঁটিটিও দেখাতে ভোলে না।
দাপাতে দাপাতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা রক্তাক্ত খবিরকে ওরা নির্মম ভাবে আবারো দাঁড় করিয়ে অন্য হাত কাটতে উদ্যত হয়। এমন সময় চারপাশ থেকে অসংখ্য সড়কি এসে সামনের সারিতে থাকা দুর্বৃত্তদের কারো কারো বুকে বিঁধে যায়। তেঁতুল পার্টির নেতা ও অপারেশন কমান্ডার দু’জনেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ধর ধর আওয়াজ তুলে সশস্ত্র কৃষকদল বাকিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিমেষেই প্রায় সবগুলো দুর্বৃত্তকে ভূলুণ্ঠিত করে দেয়। দুই একজন প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলেও সিংহভাগ কাটা পড়ে কৃষকের সড়কি ও রামদায়ে। কৃষকের আক্রমণ এতোটা দ্রুত ও সংগঠিত ভাবে হয় যে তেঁতুল ও এবাদত সৈন্যরা কিছু বোঝার আগেই ওদের ভয়াবহ পরাজয় ঘটে।
ওদিকে রাতেই গাড়ি ভাড়া করে আফজাল শরীফ খবিরের ছেলেকে নিয়ে গ্রামে রওনা দিয়েছিলেন। কুয়াশার কারণে পদ্মা পার হতে বেশ সময় লেগে যায়। কিন্তু কৃষকের এই অভূতপূর্ব বিজয় সংগঠিত হওয়ার কিছুক্ষণের ভেতরই তিনি এসে পড়েন। অবশ্য পথিমধ্যে সব খবরই আফজাল বন্ধুদের ফোনে পেয়ে গিয়েছিলেন।
আফজাল এসে দেখেন যে গ্রামের লোকেরা খবিরকে একটি খাটিয়ার উপরে শুইয়ে তার কাটা হাতে কাপড় চাপা দিয়ে রেখেছে। বিচ্ছিন্ন অংশটুকুও যতœ করে কাপড়ে মুড়ে ফেলেছে। অতএব দেরী না করে আফজাল দ্রুত খবিরকে, তার বিছিন্ন হাতসহ, গাড়িতে তুলে জেলা সদর হাসপাতালের দিকে রওনা হয়ে যান।
উন্মত্ত কৃষকেরা আলী আলী ও রাম রাম ধ্বনি তুলে গ্রামের মাতুব্বরের বাড়ির দিকে ছোটে। কিন্তু ওখানে গিয়ে ওরা যা দেখে তা দিয়ে কোনো সমীকরণই মেলানো যায় না।
মাতুব্বরের বাড়ির খোলা গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে তার মস্তকহীন ভূলুণ্ঠিত দেহ আর তারই কিছু দূরে রক্তমাখা ছিন্ন মাথা। আরেকটু এগিয়ে যেতেই দেখা যায় লাশের স্তূপ। তার মানে দুর্বৃত্তরা খবিরকে বাজারে নেবার আগেই মাতুব্বর বাড়ির সবাইকে চিরতরে শেষ করে দিয়ে গেছে।
ততোক্ষণে মৃতদেহগুলো ঠাণ্ডা হয়ে উঠেছে।

(সমাপ্ত)

[‘শয়তানের পাঁচ পা’ নামে লেখকের গল্পগ্রন্থখানা অনন্যা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। http://rokomari.com/ থেকেও সংগ্রহ করা যায়।]