শুরু করি এই ভিডিও দিয়ে। গতকাল সচলে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে লেখার কিছু অংশ রাষ্ট্র-পক্ষের সাক্ষী দেলোয়ার হোসেনের দেয়া সাক্ষ্য থেকে নেয়া ছিল। এবারে তার জবানবন্দীতেই সরাসরি কথাগুলো শুনুন। শুনে বলুন এই জীবন্ত বর্ণনাকে আপনার মিথ্যা মনে হয় কিনা।

(ভিডিওটির খোঁজ দিয়েছেন – সৌমিত্র পালিত )

মুনির চৌধুরী আলীগড়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পার হয়ে হার্ভার্ড থেকে মাস্টার্স করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনে সরাসরি ভূমিকা রাখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। দুই বছর কারাগারে কাটাতে হয়। কারাগারে বসে লিখেন ও মঞ্চস্থ করেন ‘কবর’ নাটক। কারাগারে বন্দী অবস্থায় এমএ পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হন। ৪৬ বছর ধরে চলা এই বর্ণাঢ্য জীবন শুয়োরের দল শেষ করে দেয় হয়তো ৪৬ মিনিটেরও কম সময়ে। এই মুনির চৌধুরীকে মাটিতে ফেলে তার মাথার উপর পা রেখে তাকে রড দিয়ে পেটানো হয়। তার মাথা ফাটিয়ে গুড়া গুড়া করা হয়।

মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ঢাকা কলেজ, প্রেসিডেন্সী কলেজ, শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী পার হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে বৃত্তি নিয়ে লন্ডনে দুই বছর গবেষণা করেন। একইভাবে মাটিতে ফেলে মাথার উপর পা দিয়ে ধরে তাকে রড দিয়ে পেটানো হয়।

ডক্টর ফজলে রাব্বি ঢাকা মেডিক্যালের এমবিবিএস চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্বর্ণপদক’ লাভ করেন। এরপর তিনি যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমআরসিপি ডিগ্রী লাভ করেন। রীতিমতো লিজেন্ডারি একজন চিকিৎসক ছিলেন তিনি। তাকে গুলি করে বা ফাঁসি দিয়ে একবারে মারা হয়নি। কষ্ট দিয়ে তিলতিল করে মারা হয়েছে। ১৮ই ডিসেম্বর তার ভয়ঙ্কর রকমের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

জিসি দেব ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন। কলকাতা, দিনাজপুর পার হয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান হন একসময়। এমনকি কিছু সময়ের জন্য আমেরিকার পেনসেলভেনিয়াতেও শিক্ষকতা করেন এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পাক সেনারা যখন আক্রমণ করে তখন তিনি বারবার ‘গুড সেন্স, গুড সেন্স’ বলেও রেহাই পাননি। ব্রাশ ফায়ার করে ফেলে রেখে যায়। কিছুক্ষণ পর আবারও ফিরে আসে তারা। শুধু মেরে ফেলেই তাদের রাগ শেষ হয়না। টেনে হিঁচড়ে তার লাশ নিয়ে জগন্নাথ হলের মাঠে ফেলে রাখে লাশ।

‘রাইফেল রোটি আওরাত’ এর লেখক আনোয়ার পাশা রাজশাহী কলেজ থেকে সাহিত্যে স্নাতক পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। শিক্ষকতা করেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

চক্ষু চিকিৎসক আবদুল আলিম চৌধুরী ঢাকা মেডিক্যাল থেকে এমবিবিএস করে লন্ডন থেকে উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করেন। সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে।

সারেং বউ আর সংশপ্তক এর রচয়িতা শহীদুল্লা কায়সার প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, রিপন কলেজ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। কাজ করেছেন ইত্তেফাক আর দৈনিক সংবাদ পত্রিকায়।

ডক্টর সিরাজুল হক খান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ করেন। ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে বিটি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান পেয়ে এমএড করেন। যুক্তরাষ্ট্রের নর্দান কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অব এডুকেশন ডিগ্রি প্যান। নানা জায়গা পার হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে থিতু হন।

এরকম আরও শত শত উদাহরণ দিতে পারি। আমার নানা বিখ্যাত কেউ ছিলেন না। মফস্বলের সামান্য উকিল ছিলেন। খানিকটা নাম ডাক হয়েছিল হয়তো। তাকে আর তার পাশের বাসার আরেকজন উকিলকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কাকতালীয় বাবা আমার নানা বেঁচে ফিরলেও, ওই উকিল ফিরতে পারেননি। এরকম আরও হাজার-খানেক মানুষকে মারা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের লাখ লাখ মৃত্যু থেকে এই মৃত্যু একটু আলাদা। এদের কাউকে যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা হয়নি। হিসাব নিকাশ ছাড়া গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে যেই হত্যার উৎসব হয়েছে এদের হত্যা ঠিক তার মধ্যেও পড়ে না। এদের হত্যা করা হয়েছে ‘তালিকা’ করে। ঠাণ্ডা মাথায় বসে পরিকল্পনা করে এই মানুষগুলোর নাম উঠানো হয়েছে তালিকায়। সেই তালিকা অনুসারে একের পর এক হত্যা হয়েছে। তালিকায় ওঠার মূল কারণ, এরা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দারুণ ভাবে সফল। এরা সবাই শিক্ষিত, বুদ্ধিমান এবং মেধাবী। এদের ক্ষমতা ছিল ন্যায় অন্যায়কে খুব সহজে আলাদা করার। এদের সামর্থ্য ছিল একটা অন্যায় সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করার। এদের অভ্যাস ছিল চোখ বন্ধ করে কোন কিছুকে না মেনে নিয়ে সেটা নিয়ে ভাবার এবং প্রশ্ন করার। একটা মৌলবাদী শক্তির সবচেয়ে বড় শত্রু ব্রেন বা মগজ। মগজটা সরিয়ে দিতে পারলেই যে সুন্দর ফুল পাখি লতা পাতার আড়ালে মৌলবাদের চাষ করা যায়। এই কারণেই হয়তো মুনির চৌধুরীকে রড দিয়ে আঘাত করা হয় মাথায়, এই কারণেই হয়তো অভিজিৎ রায়কে আঘাত করা হয় তার মগজ বরাবর।

একটা মানুষকে তার নিজ ক্ষেত্রে অবদান রাখার মতো করে তৈরি হতে চলে যায় অর্ধেক জীবন। একটা মাস্টার্স বা পিএইচডি করতে লেগে যায় বছরের পর বছর। একটা বই লিখতে সময় লাগে মাসের পর মাস। একটা ছোট্ট ব্লগ লিখতেও লাগে দিনের পর দিন। কিন্তু একটা মানুষকে মেরে ফেলা যায় মাত্র দুই মিনিটে। অভিজিৎ রায়কে যখন মেরে ফেলা হল, আমার প্রথম অনুভূতি ছিল, হায় হায়, এত সোজা একটা মানুষকে মারা। যে মানুষটা তিলতিল করে তার স্বপ্নকে গড়ে তুলল, একটা একটা করে শব্দ গেঁথে মাসের পর মাস পরিশ্রম করে এত এত বই লিখল তাকে কিছু নরকের কীট এসে মাত্র দুই মিনিটে শেষ করে দিল? পাঁচ ছয় বছর ধরে একজন মানুষ বুয়েটে অনার্স শেষ করলো। আরও বছরের পর বছর পার করে সিঙ্গাপুরে মাস্টার্স, পিএইচডি করলো। শূন্য থেকে একটা ব্লগ সাইটকে দাড় করালো বছরের পর বছর খেটে। গোটা দশেক বই লিখে ফেললো মাসের পর মাস খেটে। বেহেশতে গিয়ে ৭০ টা হুর নিয়ে মাস্তি করার স্বপ্নে বিভোর কিছু কীট এসে সেই মানুষটাকে দুই মিনিটে শেষ করে হা হা করে হাসতে হাসতে চলে গেল। একইভাবে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলমান রাষ্ট্রের স্বপ্নে বিভোর কিছু নরকের কীট এসে তালিকা অনুসারে মুনির চৌধুরী থেকে জহির রায়হান পর্যন্ত দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রড দিয়ে পিটিয়ে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলল। বিজয়ের আনন্দ ছাপিয়ে সে সময় হয়তো মানুষের মনে একই আফসোস হয়েছিল, হায় হায় মেরেই ফেললো? সত্যি সত্যি মরে গেল? আর কখনও ফিরে আসবে না?

এই মানুষগুলা আজ বেঁচে থাকলে আমাদেরকে ফারুকির চলচ্চিত্র নামের বিষ্ঠা দেখতে হতো না। আমরা আরও কত কত ‘জীবন থেকে নেয়া’ পেতাম। এই মানুষগুলা আজ বেঁচে থাকলে আমাদের ভাঁড়ামো আর লুতুপুতু প্রেমের উপন্যাস পড়তে হতো না। আমরা আরও কয়েকটি ‘সংশপ্তক’ পেতাম, কয়েকটি ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ পেতাম। এ মানুষগুলা থাকলে আমাদের শিক্ষানীতি আরও শক্ত হতো হয়তো। বছর বছর ছাত্রদের নিয়ে এই এক্সপেরিমেন্ট আর প্রশ্ন ফাঁসের তামাশা দেখতে হতোনা হয়তো। এ মানুষগুলা থাকলে আমরা হয়তো আরও ঝানু কিছু দার্শনিক পেতাম, আরও কিছু পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ পেতাম। তবে অন্যভাবে ভাবলে আবার মনে হয় এরা ১৯৭১ এ না মারা গেলেও হয়তো এদের অনেকেরই স্বাভাবিক মৃত্যু হতো না। হয় ১৯৭৫ এ এসে মরতো। অথবা এই ২০১৫ তে এসে মরতো। কারণ এদের হত্যাকারী যে কীট, সেই কীটেরা আজও জীবিত। হয়তো আগের চেয়ে আরও সবলভাবে জীবিত। আগের মতো করেই এরা তালিকা করে। ৭১ এ ভারতের দালাল আর মালাউন বানিয়ে এদের না মারতে পারলেও, ২০১৫ এ এসে ধর্মবিরোধী আর নাস্তিক বানিয়ে ঠিকই মেরে ফেলতো। তালিকার কথা বিশ্বাস না হলে ছোট একটা এক্সপেরিমেন্ট করুন। ‘হত্যা তালিকা’ শব্দটি লিখে গুগলে সার্চ করুন। দেখুন তো ৭১ এর তালিকার পাশে ২০১৫ এর তালিকার খবরগুলো খুঁজে পান কিনা। অথবা আন্সারুল্লাহ হুমকি লিখে সার্চ দিন। দেখেন তো কাদের হুমকি দেয়া হচ্ছে, কাদেরকে মারতে চাচ্ছে। তালিকা দেখে একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলেই হয়তো বোঝা যাবে মস্তিষ্ক এদের মূল শত্রু, বোঝা যাবে কেন মগজ বরাবর আঘাত করতে চায় এরা। এই তালিকা করার ভয় দেখিয়েই মৌলবাদী শক্তি চুপ করিয়ে দিয়েছে দেশের মূলধারা বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশকে নিয়ে। অনেক বড় বড় প্রগতিশীল মানুষেরা বেঁচে আছেন নিজের ছায়া হয়ে। কোন কিছুর পরোয়া না করে তবুও যারা বলে যাচ্ছে তাদের নাম উঠে যাচ্ছে তালিকার শীর্ষে। কেউ মরে বেঁচে যাচ্ছে, কেউ বেঁচে প্রতিদিন মরছে।

৭১ এ আমার ছোটোখাটো সামান্য উকিল নানার নাম উঠেছিল তালিকায়। কে তালিকা করেছিল জানিনা। তবে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল পাড়ার পরিচিত লোকজনই। “মুক্তার সাহেব একটু আসেন আমাদের সাথে, কথা আছে” বলে। আজকে নানা বেঁচে থাকলে আমাদের মতো ছোটোখাটো সামান্য লেখকদের নাম তালিকায় উঠেছে দেখে গর্ববোধ করতেন নাকি আজও এই কীটেরা বেঁচে আছে ভেবে ঘৃণায় নাক কুঁচকাতেন তা জানিনা। তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। আমি দিব্যি বেঁচে বর্তে আছি। কিন্তু মুনির চৌধুরীরা নেই, অভিজিৎ রায়েরা নেই। সামনে তালিকা হবে আরও, তালিকা ধরে হারিয়ে যাবে আরও। দেশের বেশীরভাগ মানুষ হাই তুলতে তুলতে বলবে, ধুর কেন এরা কামড়াকামড়ি করতে যায়, মরে আর দেশে অশান্তি সৃষ্টি করে। এদের নাম তালিকায় উঠছে তো আমার কি? বুদ্ধিজীবী দিবসে বিবৃতি দিতে দিতে এরা মুখে ফেনা উঠিয়ে ফেলবে। চলে যাওয়া সূর্য সন্তানদের কথা বলতে বলতে চোখে পানি চলে আসবে। কিন্তু তালিকা যে আজও বন্ধ হয়নি, বুদ্ধিজীবী হত্যা যে আজও চলছে সেই সত্যটুকু বুঝতে পারবে না।