একজন মানুষ কি জন্ম থেকেই মৌলবাদী হয়ে গড়ে ওঠে?অবশ্যই না।ধর্ম,ভাষা,প্রথা ইত্যাদি ছাড়াই একটা মানুষের জন্ম হয়।যে পরিবার বা সমাজে সে লালিত পালিত হয় সেই পরিবার থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাই তার মধ্যে ভাষা,ধর্ম আর নানা রকম প্রথার বীজ বপন করে।এরপর সমাজের নানারূপ সংগঠনের পরিচর্যায় সেই বীজ মহিরূহে রূপান্তরিত হয়।খুব অল্প সংখ্যক মানুষই পরবর্তীতে সঠিক শিক্ষা লাভ করে সেই প্রথা কিংবা ধর্ম কে চ্যালেঞ্জ করবার সক্ষমতা অর্জন করে।কাজেই কোন মানুষ মৌলবাদী হবে কিনা,কিংবা হলেও তার মাত্রা কতটুকু হবে সেটা নির্ভর করে পারিবারিক শিক্ষা তথা শিশুকালে প্রাপ্ত শিক্ষা হতেই।একই ভাবে একজন মানুষ মুক্তচিন্তা করতে সক্ষম হবে কিনা সেটাও অনেকাংশে নির্ভর করে ঐ শিশুকালে প্রাপ্ত শিক্ষা হতেই।ছোটবেলা থেকে যদি পরিবারে উদার মানবিক শিক্ষা প্রদান করা হয় এবং শিশুটি যদি বই কে সঙ্গী করে বড় হতে পারে তাহলে আপনা-আপনিই তার মধ্যে মুক্তচিন্তা এবং যুক্তিবদ্ধ চিন্তা করার সক্ষমতা তৈরি হবে।তাই মৌলবাদ বলি আর মুক্তচিন্তা- দুটোর শিকড়ই লুকিয়ে আছে একদম শিশু বয়সে,পরিবারের শিক্ষায়।আমাদের দেশে মৌলবাদের তীব্র বিস্তার,জঙ্গিবাদ এবং চরমপন্থা আর সাধারণের ধর্মান্ধতা- সব কিছুর সূত্রপাত ঘটে ঐ শিশুকালেই।

মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া একটি শিশু প্রথমেই শিক্ষা লাভ করে সেই শ্রেষ্ঠ,তার হিন্দু সহপাঠিটি তার থেকে নিকৃষ্ট।সে আল্লাহর অনুগ্রহ প্রাপ্ত,শেষ নবীর উম্মত কিন্তু ঐ হিন্দু বন্ধুটি অভিশপ্ত।বেশি গোড়া পরিবার হলে হিন্দু সহপাঠীটির সাথে বন্ধুত্ব করতেও নিষেধ করা হয় তাকে।এভাবে প্রথমেই অন্য ধর্মের প্রতি বিরূপ মনোভাব এবং নিজ ধর্মের ভিত্তিহীন শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বড় হতে থাকে সে।তার ভিতরে বপিত এই ঘৃণার বীজে জলসিঞ্চন করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।কোমলমতি শিশুদের পাঠ্যবই এ শেখানো হয় ঘৃণার বাণী।সে দেখে ‘ধর্ম শিক্ষা’ নামে বিষয়টি সবার জন্য এক নয়।সে যে বইটি পড়ছে,তার হিন্দু সহপাঠীটি সেই বইটি পড়ছেনা।এভাবে সে শিখে যায় ‘বিভাজন’।ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্য কোন ধর্মের বই-এ অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করা হয়নি।অন্য কোন ধর্মের বই-এ নরকের বিভৎস বর্ণনা দিয়ে শিশুদের মস্তিষ্কের বারোটা বাজানো হয়নি।এভাবে ছোট থেকে একেবারে মাধ্যমিক পর্যন্ত সে বিভাজন,অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ,নিজের ভিত্তিহীন শ্রেষ্ঠত্ব শিখতে শিখতে বড় হয় এবং তার মধ্যে এই ক্ষতিকর চেতনা গুলো চিরস্থায়ী রূপ নেয়।বন্ধ হয়ে যায় চেতনার বিকাশ।এতো বললাম সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথা।মাদ্রাসা শিক্ষার কথা তো বলাই বাহুল্য!

আমাদের দেশে বাঙলা বর্ণমালা শেখানোর আগে শিশুকে শেখানো হয় আরবি বর্ণমালা,শিশুর বেহেশত নিশ্চিত করতে ছোটবেলায় মোল্লা রেখে কোরান খতমের ব্যবস্থা করা হয়।এভাবে শিশুটি দুর্বোদ্ধ আরবি অক্ষর চিনে পড়তে পারে ঠিকই কিন্তু অর্থ তার কাছে অজানাই থেকে যায়! এবং এই ভাষা কে সে গণ্য করে পবিত্র ভাষা হিসেবে।আরবি ভাষা মাটিতে রাখা যাবেনা,নীচে পড়ে থাকলে তুলে চুমু খেতে হবে,আরবি ভাষা পবিত্র ভাষা ইত্যাদি বিচিত্র মনস্তাত্তিক অপশিক্ষা তার মনের মধ্যে আসন গেড়ে বসে।আর তাইতো আমাদের সরকার দেয়ালে প্রস্রাব ঠেকাতে দেয়ালে দেয়ালে আরবি লিখে রাখার হাস্যকর পরিকল্পনা করতে পারে!

আমাদের দেশে বই পড়ার চর্চাটা খুব কম বলে (যারাও পড়ে তাদের বেশির ভাগের দৌড় কিছু অপন্যাস পর্যন্তই) এই অযৌক্তিক অপশিক্ষাকে মোকাবিলা করার মত মানসিক সক্ষমতা শিশুদের মধ্যে গড়ে উঠতে পারেনা।যেসব ছেলেমেয়ে ছোটবেলা থেকে প্রচুর ‘আউটবই’ পড়ে কিংবা যাদের পরিবারে নানা বিষয়ে নানা রকম বই পড়ার চর্চাটা আছে সেই ছেলেমেয়ে গুলোর মধ্যে এই সকল অযৌক্তিকতাকে চ্যালেঞ্জ করার সক্ষমতাও তৈরি হয়। একারণেই বাইরের বই কে তথাকথিত ‘গুরুজন’ দের এত ভয়!লাইব্রেরীকে এত ভয়!সরকার যেহেতু মৌলবাদী চেতনা কে জিইয়ে রাখতে চায় নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে সেকারণে একটা এলাকায় দশটা মসজিদ স্থাপনে তাদের যে আগ্রহ,ঐ এলাকায় একটা লাইব্রেরী স্থাপনে সেই প্রচেষ্টা বা বরাদ্দ নেই!ঢাকা শহরে দশ কিলোমিটারের মধ্যে একশটা মসজিদ পাওয়া যাবে কিন্তু একটাও লাইব্রেরী পাওয়া যাবেনা।সেই পরিকল্পনাও কারও আছে বলে মনে হয়না।

যেকোন সমস্যা সমাধান করতে হলে আগে সমস্যাটাকে স্বীকার করে নিতে হয়।তাহলেই সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনা করা যায়।কিন্তু আমাদের দেশে মূল সমস্যার দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছেনা,আমরা বারবার চিৎকার করে বললে আমদের গলা টিপে ধরছে রাষ্ট্রযন্ত্র।মূল সমস্যাকে জিইয়ে রেখে একশ জঙ্গিকে ফাঁসিতে ঝুলালেও কোনই লাভ হবেনা।এই সমস্যার সমাধান ব্যক্তি উদ্যোগে করা যাবেনা।এর জন্য রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ দরকার।’নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টাকে রেখে ধর্ম শিক্ষা অংশটুকু জাতিয় পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দিতে হবে।রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিক কে নৈতিক করে গড়ে তোলা,ধার্মিক করে নয়।ধর্ম নাগরিকের ব্যক্তিগত ব্যাপার,নাগরিকগণ সেটা ব্যক্তিগত ভাবে চর্চা করবে।রাষ্ট্রীয় পাঠ্যক্রমে ধর্ম শিক্ষা রাখার কোন যৌক্তিকতা নেই।বরঞ্চ এর স্থলে নৈতিক শিক্ষাকে জোরদার করা জরুরি।ধর্মের প্রসারে সরকার যেভাবে অগ্রগামী,শিক্ষার প্রসারে তেমনটি নয়।প্রতি উপজেলায় একটি মডেল মসজিদ এর থেকে একটি মডেল লাইব্রেরি দেশের উন্নয়নের সম্ভাবনা হাজার গুণে বাড়িয়ে দেবে।সরকারের কি সেরকম কোন পদক্ষেপ আছে?

ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে শিশুদের মধ্যে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের কাজ চলছে দেশে।কিন্তু সেগুলো অপ্রতুল।রাষ্ট্রীয় ভাবেই এই কাজটি করতে হবে।মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক করার দাবি আজকের নয়।কিন্তু সরকার সেই দাবিতে কর্ণপাত করার প্রয়োজন মনে করেনি।যদি করত তাহলে আজকে হয়তো মৌলবাদের এই আস্ফালন দেখতে হতনা।

মৌলবাদী চিন্তার বিপরীতে আধুনিক যুক্তিবাদী মানবিক চেতনা গড়ে তোলা সম্ভব সুশিক্ষা-প্রচুর পরিমাণে বই পড়ার অভ্যাস আর সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের মাধ্যমে।ব্যক্তি ও গোষ্ঠী পর্যায়ে এই আন্দোলন চললেও সামগ্রিক ভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এমন কোন পদক্ষেপ নেই।যেমন,মুক্তমনা একটি সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের উদাহরণ।আমাদের বিভিন্ন প্রগতিশীল ব্লগ ফোরাম গুলো এর উদাহরণ।পাড়ায় মহল্লায় ব্যক্তিউদ্যোগে গড়ে তোলা লাইব্রেরী গুলো এর উদাহরণ,গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন এর উদাহরণ।যেহেতু মৌলবাদী গোষ্ঠিটি দলে ভারি এবং শক্তিশালী তাই তাদের বিরূদ্ধে যারাই দাঁড়াবে তাদের উপরে নেমে আসবে অত্যাচারের খড়গ।তেমনটিই দেখতে পাচ্ছি আজ আমরা।হুমায়ুন আজাদ স্যার থেকে দীপন- এই যুদ্ধেরই শহীদ।লড়াইটা অসম কিন্তু নিঃসন্দেহে আমরা শুভ শক্তি।আর ইতিহাস সাক্ষী যে শুভ শক্তির জয় অবশ্যাম্ভাবী।

রাষ্ট্রযন্ত্র আমাদের বিপক্ষে।কাজেই লড়াইটা আরও কঠিন।থেমে গেলে চলবেনা।ব্যক্তি উদ্যোগেই আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে হবে- নিজ নিজ পরিবার,নিজ নিজ এলাকা মহল্লা থেকে,নিজ নিজ গন্ডী থেকে।এতে জীবন সংশয় হতে পারে,হচ্ছেও।কিন্তু পিছুহটার উপায় নেই।কারণ আমাদের সমাজে মুক্তচিন্তা আমরা লাভ করিনা,অর্জন করে নিতে হয়।কাজেই মুক্তচিন্তার মানুষদের দায়বদ্ধতাও অনেক বেশি।সেই দায়বদ্ধতা থেকেই মৃত্যু ঝুঁকি নিয়েও আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।আপাত কলম-চাপাতির এই অসম লড়াই!