শেষ রজনী
আকাশ মালিক।
(একদিন গল্পটির শুরু হয়েছিল এখান থেকে।)
ভারতচন্দ্র দ্বী-পাক্ষিক উচ্চবিদ্যালয়ে ছয়টি বছর স্কুলে আসা যাওয়ার পথে মুকুল, যে মেয়েটিকে দূরে থেকে ফুল দিল, টিজিং করলো,কাছে পাওয়ার জন্যে পাগল ছিল,আজ এত নিকটে পেয়ে যেন তাকে চিনতেই পারলোনা। জিনাতের পরণে বিয়ের লাল শাড়ি, গোলাকার চেহারার সাথে মানানসই আধুনিক মেকআপ, গলায় সোনার হার, কানে দুল, হাতে বালা, সিঁথাপাটি, টিকলি, লিপষ্টিকরাঙ্গা ঠোঁট, মাথায় পাতলা গোলাপী ওড়না। বিয়ের প্রথম সন্ধ্যারাতে ঝমকালো বিদ্যুতবাতির আলোয়, নিজের বেডরুমের পালংকের মাঝখানে মানুষের ভীড়ে বসা, জিনাতকে দেখে মুকুল আপন মনে উচ্চারণ করেছিল- ‘হায় আল্লাহ, তোমার কোন সৃষ্টি এর চেয়ে সুন্দর হতেই পারেনা’। বাসর ঘরে মধ্যরাতে ডিম-লাইটের (dim light) আলোতে ঘোমটা মাথায়, গয়নাবিহীন শরীরে, আটপৌরে শাড়ি পরা, বিছানার ওপরে একাকী বসা জিনাতকে দেখে মুকুল অনেকক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো। জিনাত অনুমান করলো মুকুল কিছুটা লজ্জা, কিছুটা নার্ভাস ফিল করছে। সে আস্তে করে ধীরে ধীরে মাথাটা একটু তুলে কপাল থেকে খানিকটা ঘোমটা সরিয়ে দিয়ে, লিপষ্টিকহীন অধর দুটোতে বাঁকা ধনুকের হাসি তুলে, হরিণীর টানাটানা চোখে, মেহদিরাঙ্গা ডান হাতটি মুকুলের দিকে বাড়িয়ে দিল। মুকুল পালংকের পাশে বসে জিনাতের হাত ধরে নির্বাক নিষ্পলক তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। জিনাতই প্রথম মুখ খুললো-
– কী দেখছো?
– দেখছি স্রষ্টার অতুলনীয় সৃষ্টি তোমাকে, আর রাতের কাছে করছি প্রার্থনা ‘রজনী তুই হইসনারে প্রভাত’।
মুকুল আস্তে আস্তে জিনাতের হাতটি নিজের বুকে টেনে নেয় আর মুখটা বাড়িয়ে তার ঠোঁটের খুব কাছাকাছি নিয়ে আসে। বাম হাতের উষ্ণ-কোমল দুটো আঙ্গুল মুকুলের ঠোঁটের ওপর ধরে জিনাত তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে-
– রাত এখনও অনেক বাকি।
– তোমার চোখে ঘুম নাই, সারা রাত জেগে থাকবে?
– উপাসনা রাত জেগেই উত্তম, মনযোগে ব্যাঘাত ঘটেনা। আমি অজু করে বিছানায় এসেছি। তুমি ওপরে বাথরুমে গিয়ে অজু করে এসো, আমরা একসাথে দু-রাকাত নফল নামাজ পড়বো। এতটুকু কন্টক ছড়ানো পথ পাড়ি দিয়ে, কত ঝড়-জঞ্ঝাট, বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে আমরা এখানে এসে মিলিত হলাম, তার জন্যে প্রভুর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে হবেনা? চলো তুমি বাথরুমে চলো, ততক্ষণে আমি জায়নামাজটা বিছিয়ে দেই।
মুকুল বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখে জিনাত নামাজে দাঁড়িয়ে গেছে। নামাজ শেষে বিছানায় শুয়ে জিনাত মুকুলের পাশ ঘেঁষে তার বুকের ওপর হাত রেখে প্রশ্ন করে- ‘বলো তো তোমার আমার সম্পর্কটা কী? আমি তোমার কে আর তুমি আমার কে’? মুকুল ইতস্তত বোধ করে। ভেবে পায় না, সর্বজন স্বীকৃত অতি পরিচিত একটি উত্তর, জেনেশুনে আবার এ কেমন প্রশ্ন। এই মুহুর্তে উত্তরের অপেক্ষা করে জিনাত মুকুলকে বিব্রত অবস্থায় ফেলতে চায় না। ‘আমরা একে অপরের পরম বিশ্বস্ত বন্ধু’ জিনাত নিজেই উত্তর দিল। দার্শনিকের ভাব ধরে মুকুল বললো- ‘আমি সেটাই বলতে চেয়েছিলাম’। জিনাত মৃদু সুর করে হেসে ফেলে। মুকুলের চোখের ওপর চোখ রেখে জিনাত বললো ‘ বিশ্বস্ত বন্ধুর কাছে কোন কিছু গোপন রাখতে নেই। আমার সবকিছু তোমার কাছে আর তোমার সব কিছু আমার কাছে প্রকাশিত থাকবে, কেমন? প্রকাশিত থাকাটা যতটুকু নিরাপদ, অপ্রকাশিত থাকাটা তার চেয়ে অধিক বিপদজনক’। মুকুল এ কথার মর্মোদ্ধারে উদ্যোগী না হয়ে বললো-‘নিশ্চয়ই’। জিনাত বললো- ‘আমাদের দুজনের দুটো দেহ, দুটো মন আজ মিলেমিশে এক দেহ এক মন হয়ে গেছে। আমরা চাইলে আমাদের জীবনের প্রতিটি রজনী একেকটি বাসর রাত করে নিতে পারি’। মুকুল আর কথা না বাড়িয়ে জিনাতকে তার বাহুবেষ্টনীতে জড়িয়ে নিল। রাতের এক পর্যায়ে এসে জিনাতও মনে মনে কামনা করলো-‘ এই রাত কভু যদি ভোর না হতো’।
জিনাত ঠিকই বলেছে, অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে অনেক জটিলতার মধ্য দিয়ে তাদের এই বিয়েটা হয়েছে। দাদু কলমদর আলী সাহেবের বড় সাধ ছিল মৃত্যুর আগে জিনাতের বিয়েটা দেখে যাবার। কিন্তু বিয়ের দুই মাস পূর্বে বয়ঃজনিত কারণে নাতনীর বিয়ে না দেখার শোক বুকে নিয়ে, তার দাদা ইহলোক ত্যাগ করেন। জিনাতের ‘এইম ইন লাইফ’ অনুযায়ী সে টিচার্স ট্রেইনিং কোর্স সফলতার সাথে শেষ করার পর নিজ গ্রামের শিশু স্কুলে সহকারি শিক্ষকের চাকুরি,আর অন্যদিকে একই সময়ে মুকুল ‘ফটোগ্রাফি অ্যান্ড ফটো সাংবাদিকতা’র ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের গ্রাম থেকে বিশ মাইল দূরে শহরে একটি অনলাইন পত্রিকায় কাজ পেয়ে যায়। জিনাতের বাড়ি লক্ষীপুর গ্রাম থেকে মুকুলের বাড়ি কুমারপাড়া পূর্বদিকে আড়াইল মাইল দূরে। কাজের সুবাদে মুকুল আর জিনাতের চোখের আড়ালের দূরত্ব প্রায় তেইশ মাইল হলেও একে অন্যের মনের আড়ালে কোন সময়েই ছিলনা। জিনাতের বান্ধবী রোকসানা উরফে রুখুর কাছ থেকে যেদিন মুকুল জানতে পেরেছিল যে,জিনাত তাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবেনা,সেদিনই মুকুল প্রতিজ্ঞা করেছিল জীবনে বিয়ে করলে জিনাতকেই করবে। ব্যাপারটা উভয় পরিবারের মধ্যে জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর একদিন মুকুলের মা তার স্বামীর কাছে কথাটা তুললেন-
– আমাদের মুকুলের বিয়ের বয়স তো হয়ে গেল। মাসে একবার বাড়ি আসে দুই দিনের জন্যে,একদিনও বাড়িতে শান্তিমত কাটায় না। দুই দিনই কাটিয়ে দেয় লক্ষীপুর গিয়ে। এর চেয়ে মেয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে কোন আপত্তি না থাকলে মেয়েটাকে বউ করে ঘরে তুলে নিলে হয় না? বয়সের দোষে কত কিছুই না ঘটে যেতে পারে।
– অসুবিধের তো কিছু দেখিনা। মেয়ের বাবা আহমেদ আলী সাহেবকে আমি চিনি,তাঁর মেয়েকেও একবার দেখেছি। বছর খানেক পূর্বে সে’ই তার একটি অনুষ্ঠানে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিল। রূপে গুণে বুদ্ধিমত্তায় মেয়েটি অসাধারন। কিন্তু এখন শুনেছি সে নাকি একটি শিশু স্কুলে চাকুরি করে। আমাদের বংশে পরিবারে মেয়েদের চাকুরি করার প্রথা নেই। এখানে একটু অসুবিধে আছে দেখছি।
– কোন অসুবিধে নেই। ছেলে থাকবে মাসের আটাইশ দিন শহরে,বউ এখানে একা একা কী করবে? তার চেয়ে দিনের বেলা ঐ শিশুদের নিয়ে ব্যস্ত থাকলে মেয়েটার মন মানসিকতা ভাল থাকবে। রিকশায় যাবে,রিকশায় আসবে আড়াইল মাইল রাস্তা তো আর এমন কিছু না।
– আচ্ছা তবু আমি মেয়ের বাবার সাথে এ ব্যাপারে একটু আলাপ করে দেখি।
কথাটা জিনাতের কানে যখন পৌছুলো, সে পরিষ্কার জানিয়ে দিল, দিনে একবার ঐ শিশুদের না দেখলে সে বাঁচবেনা। মুকুলের বাবা মহসিন উদ্দিন তার এই দাবী থেকে পিছু হটলেন। কানে কানে জিনাতের বাবাকে বললেন-‘ঠিক আছে বেয়াই, নাতি-পুতি হওয়ার সময় কিন্তু বউমাকে আমি এতদূর এসে স্কুল করতে দেবোনা,তার যে কষ্ট হবে’। আহমেদ আলী বললেন-‘আপনার বউমাকে আপনি হেলিক্যাপ্টার দিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিবেন,অসুবিধে কী’? এ পর্যন্ত বিয়ের বন্দোবস্ত করতে তেমন আর কোন অসুবিধে চোখে পড়লোনা। দেন-মোহর, কাবিন-কেবালা,দিন তারিখ ঠিক করার আগে নিকটাত্ম্বীয়দের পরামর্শ নিতে হয়,অন্যতায় অকারণেই কেউ বেঁকে বসতে পারেন। মহসিন উদ্দিন সাহেবের ঘরে বৈঠক বসলো। খানা-পিনা,সোনা-দানা জেওরাতপাতি নিয়ে আলাপ চলছে,এক পর্যায়ে মহসিন উদ্দিনের ছোট ভাই সদরুদ্দিন নম্র অথচ গম্ভীর কণ্ঠে এই বিয়েতে আপত্তি জানায়ে বললেন-‘ একজন রাজাকারের নাতনীকে আমাদের পরিবারের বউ বানিয়ে আনতে পারিনা, আমি এই বিয়েতে নেই’। সকলের চেহারায় বিষণ্ণতার ছাপ, ঘরে পিনপতন নিরবতা, নিঃশব্দ মুখে একে অন্যের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছেন। সদরুদ্দিন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলেন। ‘দাঁড়াও সদরুদ্দিন’ মুকুলের মা ধমকের সুরে বলে উঠেন। সদরুদ্দিন তার বড় ভাইকে যতটুকু ভয় পান তার চেয়ে অনেক বেশী শ্রদ্ধা করেন তার ভাবীকে। ‘তোমাদের পলিটিক্স, দুইটা নিষ্পাপ সন্তানের ভালবাসায় নিয়ে না আসলে হয় না’? সদরুদ্দিন মাথা নিচু করে নেন। তারপর মুকুলের মা তার জ্ঞানে যতটুকু কুলায় ‘শেখ মুজিবের সাধারন ক্ষমা’ ও পাশাপাশি আশেপাশের কিছু উদাহরণ উপমার কথা তুলে ধরে কথাটাকে চাপা দিতে সক্ষম হলেন। বাতাসে ভর করে ঘটনাটা একদিন জিনাতের বাবার কানে পৌছুলে তিনি মনে খুব দুঃখ পেলেন এবং মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে শংকা বোধ করলেন। একদিন হয়তো মেয়েটিকে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে। কিন্তু তিনি কারো কাছে দুঃখটা প্রকাশ করলেন না। মেয়ের ভবিষ্যত তার অদৃষ্টের ওপর ছেড়ে দিয়ে তিনি বিয়ের দিন তারিখ ধার্য করে নিলেন। যথা সময়ে যথারীতি বেশ ধুমধামের সাথে নিরাপদে নির্বিঘ্নে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল।
বিয়ে উপলক্ষে দুই সপ্তাহের ছুটি কাটিয়ে কাজে ফেরার দিন জিনাত মুকুলকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রেখে আবদার করলো ‘সপ্তাহে কমপক্ষে একবার ফোন করো আর বাড়ি আসার পূর্বে দিন তারিখ আমাকে জানিও’। মুকুল এর কারণ জিজ্ঞেস করায় জিনাত বলেছিল – ‘বাসর ঘর আমাকেই যে সাজিয়ে রাখতে হবে, সময় লাগবেনা’? উভয়ে নিজ নিজ কাজে ফিরে গেল আর আহমেদ আলী সাহেবের আশংকা মিথ্যে প্রমাণিত হতে থাকলো। নিয়মিত ভাবে মুকুল প্রতি মাসে দুই দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে। আসার পূর্বে টেলিফোন করে দিন তারিখ জিনাতকে জানিয়ে দেয়। উভয় পরিবারের আত্মীয়তা আরো ঘনিষ্টতা লাভ করতে থাকলো আর এ ভাবেই দিন যায় রাত আসে জিনাত-মুকুল দম্পতি সুখে শান্তিতে দুঃখ-বিষাদহীন দিন যাপন করতে লাগলো।
গল্পটা এখানে শেষ হয়ে গেলে বোধ হয় ভাল হত, আমরা রূপকথার রাজকুমার রাজকুমারীর একটি স্বার্থক প্রেমকাহিনি পড়ে অবসর সময়ের বিনোদন পেতাম। কিন্তু যেহেতু শেষ হয়নি তাই আমরা কাহিনির শেষটা না হয় দেখেই যাই।
বিয়ের দুই বছররের মাথায় এসে জিনাত লক্ষ্য করলো কিছুদিন যাবত তার মাতা শাশুড়ীর কেমন যেন উদাসীন ভাব, কথা বার্তা কম বলেন, সব সময় চেহারায় বিরক্তির ছাপ। আরো আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো আজকাল স্কুল থেকে ফিরে এসে প্রায়ই তার বিছানা বালিশ, ড্রয়িং টেবিলের জিনিসপত্র এমন কি আলমারীর ভেতরের ভাঁজ করা কাপড়-চোপড়ও যেন ঠিক জায়গামত পায় না। অথচ তার বেডরুমে যে, বিনা অনুমতিতে কারো প্রবেশাধিকার নেই তা সে দরোজায় লিখেই রেখেছে। একদিন কাজের বুয়া সখিনার মাকে জিজ্ঞেস করলো- বিষয়টা কী? সখিনার মা বললো- ‘কি জানি আফা, কয়দিন ধইরা দেখছি আফনে ইশকুলে ছইলা গেলে খালাম্মা এসে আফনের রুমে কী যেনো খোঁজাখুঁজি করেন’। একদিন সে টের পেল তার ভ্যানিটি ব্যাগেও শাশুড়ীর হাত পড়েছে। জিনাত ভেবে পায়না কারণটা কী? তার শাশুড়ী একজন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ভদ্র পরিবারের মহিলা। তিনি এমনটা তো করার কথা না। একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে ঘরের বারান্দায় বসে ঠান্ডা বাতাসে জিনাত বিশ্রাম নিচ্ছিল। তার ডান হাতে ছোট্ট একটি কাঁচা আম। হঠাৎ করেই তার শাশুড়ী বিষ্ময়ভরা চোখে সামনে এসে দাঁড়িয়ে আহলাদী মুখে বললেন-‘কাঁচা আম! তুমি কাঁচা আম খাচ্ছো বউ মা? খুব ভাল খুব ভাল’। জিনাত ভাবে, এই বিকেলে বৈশাখীর আকাশের মেঘেঢাকা কালো অন্ধকার ভেদ করে মাথার ওপর সূর্য আসলো কী ভাবে? জিনাত ভেবে কুল পায় না শাশুড়ীর এই অস্বাভাবিক আচরণের কী কারণ হতে পারে? সে মনে মনে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। তার আশংকা হয়, বার্ধক্যজনিত কারণে কোন রোগ-ব্যাধী নয় তো? পরদিন আশংকা দূর করে দিতে এগিয়ে এল সখিনার মা। সখিনার মায়ের কাছে ঘটনার আদ্যোপান্থ জানার পর, বিয়ের জীবনে এই প্রথম জিনাতের চোখ দুটো অশ্রুজলে ঝাপ্সা হয়ে উঠলো। প্রখর মেধাবী ও অত্যন্ত সাহসী জিনাত এত সহজে ভেঙ্গে পড়ার মেয়ে নয়। দুই সপ্তাহ পর মুকুল বাড়ি আসলে সে তার সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করার প্লান করলো।
অলস শরীরে সন্ধাবেলা বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে মুকুল চোখদুটো বন্ধ করে গুনগুন করে গান ধরেছে-
“শুধু তোমার বাণী নয় গো,হে বন্ধু হে প্রীয়
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো।
সারা দিনের ক্লান্তি আমার সারা দিনের তৃষা
কেমন করে মেটাবো যে খুঁজে না পাই দিশা”।।
আগে থেকে প্লান করে পুরাতন একটি মাসিক ম্যাগাজিন হাতে জিনাত এসে পাশে দাঁড়ালো। একেবারে নোরম্যাল সহজভঙ্গীতে নির্দিষ্ট প্রবন্ধে আঙ্গুল রেখে মুকুলকে জিজ্ঞেস করলো-
– এই লেখাটা পড়েছো?
– কী?
– লেখার শিরোনাম হচ্ছে ‘ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ’।
– হয়তো পড়েছি, মনে নেই।
– আচ্ছা,এ ব্যাপারে তোমার কী অভিমত?
– জন্মের সাথে ‘নিয়ন্ত্রণ’ শব্দটাই বে-মানান।
– মা’নে?
– মা’নে, জন্ম এবং মৃত্যু দুটোই আল্লাহর হাতে। জীবন দেয়ার ক্ষমতা যেমন মানুষের নেই, জীবন নেয়ার ক্ষমতাও মানুষের নেই। প্রাণ নিয়ন্ত্রণ,প্রকারান্তরে প্রাণ হত্যারই শামিল।
– কী রকম?
– উপযুক্ত পরিবেশে পুরুষের শুক্রানু প্রায় পাঁচ দিন এমনকি তারও বেশি সময় জীবন্ত থাকতে পারে। এই জীবন্ত শুক্রানু যাতে নারীর ডিম্বানুতে ঢুকতে না পারে সেই ব্যবস্থার নামই জন্মনিয়ন্ত্রণ। কিছু বুঝাতে পারলাম?
– ও মা, তুমি এ সব জানো কী ভাবে?
– পত্রিকায় কাজ করি, এখানে ডাক্তার-মৌলভীর অভাব আছে?
জিনাত তার কাঙ্খিত উত্তর পেয়ে যায়। আনন্দে আবেগে মুকুলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁটে দীর্ঘ একটা চুম্বন দেয়। মুকুল জিজ্ঞেস করে ‘কী হলো দাগ পড়ে যাবে যে’? জিনাত বলে ‘ আমার মনের মানুষ চিনতে আমি ভুল করিনি’।
শত চেষ্টা করেও শাশুড়ীর কথা জিনাত মন থেকে সরাতে পারেনা। স্কুলে ব্রেকটাইমে খেলার মাঠে শিশুদের দিকে সে উদাস মনে তাকিয়ে থাকে। খেলায় মত্ত চঞ্চলমতি শিশুদের ভিড়ে আপন একটি সন্তান কল্পনা করে। জিনাতের মাঝে মাতৃত্বের আকাঙ্খা জেগে ওঠে। মনে পড়ে মুকুলের কথা-‘জন্ম মৃত্যু দুটোই আল্লাহর হাতে’। জিনাত অসহায় বোধ করে। একদিন তার পুরাতন বান্ধবী রুখুকে ফোন করে-
– রুখু, আমি জিনাত।
– জিনাত তুই? আছিস তাহলে এই পৃথিবীতেই?
– স্কুল নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকি, ফোন-টোন করতে পারিনা। রুখু, একটা কাজে ফোন করেছি।
– ইমার্জেন্সি কিছু?
– না, তবে ইমপোর্টেন্ট।
– টেলিফোনে বলা যায় না?
– না। একটু প্রাইভেট, কনফিড্যান্সিয়েল।
– আগামী শনিবারে আসলে হবে?
– আমি তোর জন্যে অপেক্ষা করবো।
উল্লসিত অভ্যর্থনা, আবেগী আচরণ, কণ্ঠে আড়ষ্টতা লক্ষ্য করে রুখু অনুমান করলো জিনাতের জীবনে মারাত্বক কিছু একটা ঘটেছে। সবকিছু অবগত হয়ে রুখু সান্তনার সুরে বললো-
– এটা একটা চিন্তার বিষয় হলো জিনাত?
– আমাকে যে শুধু আমার চিন্তা করলে হয় না রে রুখু। অন্যের সুখ-শান্তি, খুশী-আনন্দ, দুঃখ-ব্যাথার দায়ও নিতে হয়। আমরা যে নারী। রুখু, আমি কি ডাক্তার দেখাবো?
– ধুর, তুই এতো টেনশন করিস কেন ? ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন হলে দেখাবে, না হলে নেই, এখানে অপরাধবোধের কী আছে? আমার জানামতে এমন কয়েকটা কেইস আছে যাদেরকে পরিবারের লোকেরা বন্ধ্যা ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল, তাদের কেউ চিকিৎসায় কেউ বিনে চিকিৎসায় বিয়ের ৩/৪ বছর পরে গর্ভবতি হয়েছেন।
– আচ্ছা যদি ডাক্তার দেখাতে হয়, তাহলে পুরুষ ডাক্তার—
– আহ হা, গ্রামে না থাকতে পারে আমাদের সিলেট শহরে মহিলা Gynaecologist এর কি অভাব আছে? প্রয়োজন হলে তোকে আমি আমার বাসায় নিয়ে গিয়ে ট্রিটমেন্ট করাবো, তুই কোন চিন্তা করিসনা।
জিনাতের আবেগের বাঁধ ভেঙ্গে এক সাগর জল এসে তার চোখে ভর করে। রুখুকে জড়িয়ে ধরে জিনাত হু হু করে কেঁদে ওঠে। জিনাতের বুকের ওপর বয়ে যাওয়া প্রচন্ড ঝড়ের জলোচ্ছাস রুখু টের পায়। তার পিঠে চুলে হাত বুলিয়ে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পর জিনাতকে বুক থেকে সরিয়ে তার চোখে চোখ রেখে রুখু বলে ‘দেখ জিনাত আমি সব সহ্য করতে পারি কিন্তু নারীর চোখের জল সহ্য করতে পারিনা। আর একফোটা জল ফেলবিনা’। রুখু নিজের শাড়িল আঁচল দিয়ে জিনাতের চোখ মুছে দেয়। কথার ফাঁকে ফাঁকে তাদের স্কুল জীবনের স্মৃতির অবতারণা করে জিনাতকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। এতক্ষণে জিনাত মোটামুটি শান্ত হয়ে গেছে, রুখু বলে-
‘বিনে চিকিৎসায় বিয়ের ৩ বছর পর আমার ননদ গর্ভবতি হয়েছিলেন। উনি আমার দেয়া টিপস ফলো করেছিলেন। ঐ যে ‘বাজ পড়ে পাখি মরে / পীরের পীরাকি বাড়ে’ এমনি আর কি। আমি তাকে কী টিপস দিয়েছিলাম সে কথা পরে বলছি। এখানে অনেকটা বিষয় জড়িত আছে। তোর যে বন্ধ্যাত্ব বা ইনফার্টিলিটি জাতীয় কোন সমস্যা আছে সেটাই তো পরীক্ষা করে জানা হয় নি, তো তোর এত চিন্তা কিসের? আর জানিস, কোন সমস্যা না থাকলেও বছরে বছরে বাচ্চা হবে এর কোন নিশ্চয়তা নেই। এটাকে একপ্রকার এক্সিডেন্ট্যাল ঘটনাই বলা যায়। মেডিক্যালের ছাত্র ছিলাম বিধায় কিছু কিছু সাধারণ বিষয় এমনিতেই জানি, তবে আমি কোন Gynaecologist নই। শোন, আমার পড়া-জানা থেকে বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করি। জীবনের প্রতিটি দিনই পুরুষ শুক্রানু উৎপন্ন করতে পারে। পক্ষান্তরে নারী প্রায় ১০ থেকে ২০ লক্ষ্ ডিম্বানু নিয়ে জন্ম গ্রহন করে এবং তার অল্প কিছু মাত্র জীবনকালে অবমুক্ত করে। আবহাওয়ার পার্থক্যভেদে নারীর ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সে প্রথম পিরিয়ড শুরু হয়। পিরিয়ড শুরু হবার সময়কালে মাত্র ৩ লক্ষ ডিম্ব সক্রিয় থাকে, তার পুর্বেই বেশিরভাগ ডিম্বানু নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। পরবর্তীতে প্রতি মাসিক ঋতুকালে মাত্র একটি ডিম্ব পরিপক্ক হয়ে ডিম্ব থলি থেকে নিঃসরিত হয়। নিঃসরিত ডিম্বানু ফেলোপাইন টিউব (প্রজনন তন্ত্রের একটি অংশ) এর শেষ প্রান্তে এসে অবস্থান নেয়। পরবতীতে তা ক্রমশঃ গর্ভাশয়ের দিকে অগ্রসর হয়। তার এই যাত্রাপথে যদি কোন শুক্রানু দ্বারা ডিম্বটি নিষিক্ত হয় তবে তা গর্ভাশয়ে গিয়ে বসে যাবে। যাকে আমরা নারীর গর্ভধারন বলি। গর্ভাশয়ে পরবর্তীতে শিশুর জীবনকাল আরম্ভ হয়। আর যদি ডিম্বানুটি কোন পুরুষের শুক্রানু দ্বারা নিষিক্ত না হয়,তবে তা বিচূর্ণ হয়ে কিছু রক্তকনিকা সহ মাসিক ঋতুচক্রের সময় নির্গত হয়ে যাবে। গড়পড়তা প্রতি ঋতুচক্র ২৮ থেকে ২৯ দিন ব্যাপ্ত থাকে। যা পুর্ববতী ঋতুচক্রের প্রথম দিন থেকে শুরু করে পরবর্তী ঋতুচক্র শুরুর আগের দিন পর্যন্ত গননা করা হয়। বেশিরভাগ নারীর মাসিক ঋতুচক্রের ১১তম থেকে ২১তম দিবসের মাঝের সময়ে ডিম্বাশয় থেকে পরিপক্ক ডিম্ব নিঃসরিত হয়। ডাক্তারী ভাষায় এই সময়কে নিষেক-কাল বলা হয়। কারণ এই সময়ের মধ্যে যৌন মিলনের ফলে নারীর গর্ভধারনের সম্ভাবনা থাকে। দেখ,এখানে ‘সম্ভাবনা’ বলা হয়েছে ‘নিশ্চিত’ বলা হয় নি। এবার দেখ,জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্যে কৃত্রিম কোন কিছু ব্যবহার না করেও কী ভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ করা যায়। যারা কোন প্রকার জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি বা ইনজেকশান ব্যবহার না করতে চান তারা এই সময়কালে মিলনে বিরতি দিয়ে গর্ভধারন থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। একই ভাবে যে সকল যুগল সন্তান নিতে চান তারা এই সময়কালে বেশি বেশি মিলন করলে গর্ভধারনের সম্ভাবনা প্রকট থাকে। তবে মনে রাখবে প্রতি মাসে একই সময়কালে ডিম্ব নিঃসরণ নাও হতে পারে। এবার বল,ওপরের কথাগুলোতে আমার ননদকে দেয়া টিপস এর কোন সন্ধান পেলে’?
জিনাতের ঠোঁটে লাজুক হাসি। রুখু জিজ্ঞেস করে ‘ তোর মাসিকস্রাবে কোন প্রবলেম আছে’? জিনাত মাথা নাড়ে। রুখু বলে ‘মাসিক যদি নিয়মিত হয় তাহলে তাড়াহুড়োর কোন দরকার নেই। দুই তিন মাস আমার টিপসটা ফলো করে দেখ, আল্লাহর মর্জি কাজ হয়েও যেতে পারে’।
রাতে দুই সখি, স্কুল জীবনের স্বর্ণালী,বর্ণালী সুন্দর দিনের কথা স্মরণে দরজা জানালা বন্ধ করে বিছানায় মুখোমূখি বসলো। রুখু এই গ্রামেরই মেয়ে,বিয়ে হয়েছে শহরে তারই এক আত্মীয়ের সাথে যারা একদিন এই গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। রুখুও শহরের একটি হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক।পুরনো দিন-স্মরণপর্বের শেষ পর্যায়ে এসে হঠাৎ করেই আলোচনায় বিষাদের সুর বেজে উঠে জিনাতের এক প্রশ্নে। জিনাত জিজ্ঞেস করে-
– হ্যাঁ রে রুখু, তোদের নুতন বাসা শ্যামলদের বাসা থেকে কতদূর?
– রিকসায় ৫ মিনিটের রাস্তা।
– শ্যামল দাশ খুন হওয়ার পর তুই তাদের বাসায় গিয়েছিলি?
– হ্যাঁ, শ্যামলরা যে বাসায় থাকেন এর নিকটেই আমাদের হাইস্কুল। উনি ছিলেন আমার স্বামীর ঘনিষ্ট বন্ধু। মীরা বাজার আমাদের একটি লাইব্রেরি আছে,বিকেল বেলা ওখানে এসে প্রায়ই শ্যামল দাশ আড্ডা দিতেন। সেখানেই আমার স্বামী একদিন তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। বইয়ের পোকা ছিলেন শ্যামল দা। সব সময় তার হাতে একটা না একটা বই থাকবেই। প্রায়ই স্কুলে আসা যাওয়ার পথে দেখা হলে হাত উঠিয়ে প্রণাম করে বলতেন ‘কেমন আছেন রুখু আপা’। অথচ বয়সে আমি তার এক বছরের ছোট। এমন একজন সদা হাস্য, উজ্জল চেহারার, আমায়ীক, ভদ্র, সদ্বচরিত্রের মানুষকে হত্যা করতে পারে এমন অসুরও যে দুনিয়ায় আছে কোনদিন ভাবিনি। মানুষ কেন,কোনো প্রাণীই কি পারে এত নির্মম,এত বর্বর,এতটা বোধহীন হতে? আহা, কী আদব শ্যামল দা’র আচরণে, কী মিষ্ট তার ভাষা। সেদিন শ্যামল দা’র বাসার সামনে যে কী এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল, তা না দেখলে অনুমান করতে পারবিনা। এক হাত লাশের উপরে রেখে আরেক হাত আকাশের দিকে ছুঁড়ে শ্যামল দা’র বোনের কী বিলাপ, সেই আহাজারী দেখে সেদিন আকাশও বুঝি কেঁদেছিল। পুত্র হারানোর শোকে মা তার বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। আর বাকশক্তিহীন বাবা তো নির্জীব পাথরের মত শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছিলেন, বুঝতে পারছিলেন না তার আদরের সন্তানকে কেউ খুন করে ফেলেছে, সে যে আর জীবিত নেই’।
– রুখু, আমরা লক্ষীপুর শিশু স্কুলের উদ্যোগে শ্যামল হত্যার বিচারের দাবীতে একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছি আগামী মাসের ৫ তারিখ,আমাদের শিশু স্কুলের মাঠে। স্কুলের পক্ষ থেকে সেখানে আমাকে বক্তৃতা দিতে হবে। গত দুই সপ্তাহে আমি এই নৃশংস খুনের মোটিভ,এই চোরাগোপ্তা হত্যার ভিত্তি কোথায় এ নিয়ে বেশ কিছু রিসার্চ করেছি,বিভিন্ন ইসলামি বই কিতাব থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি, তাফসির ইতিহাস পড়েছি। এই বক্তৃতাটাই কাটছাট করে আমি একটা শিরোনাম দিয়ে পরবর্তিতে জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ করতে চাই। এর জন্যে শ্যামলকে নিয়ে আমার আরো কিছু জানার প্রয়োজন।
– সত্যিকারের একজন ভাল মানুষ ছিলেন শ্যামল দা। একদিন এক গাদা বই নিয়ে আমাদের হাইস্কুলে এসে বললেন ‘রুখু আপা, আমার ঘরের বুক সেলফে আর জায়গা নেই, এই বইগুলো আপনাদের স্কুল লাইব্রেরিতে দান করে দিলাম’। বেশীরভাগই কল্পবিজ্ঞান আর কিছু ছোটদের গল্পের বই। আরেকদিন করছেন কি জানিস, পাঁচ হাজার টাকার এক বান্ডিল নিয়ে এসে স্কুলে হাজির। আমি জিজ্ঞেস করলাম, শ্যামল দা এতো টাকা? তিনি বললেন ‘আপনাদের স্কুলের গরীব ফান্ডে রেখে দিন’। তার এক বিদেশী বন্ধু নাকি এই টাকা তাকে কিছু বই কিনে দেয়ার জন্যে দিয়েছিলেন। তিনি তার বন্ধুকে নিজের পকেটের টাকা দিয়ে বই পাঠিয়ে দিয়েছেন, এই টাকা তিনি রাখবেন না। জানিস জিনাত, আমাদের স্কুলে মাত্র চারজন মণীপূরি হিন্দু ছাত্র আছে বাকি সবাই মুসলমান। শ্যামল দা গরীব মুসলমান ছাত্রদের ফান্ডে টাকা দান করেন আর তাকে কি না খুন করলো মুসলমানরাই।
– রুখু, এই নোট প্যাডে আমার যা বলার সব লিখে রেখেছি। দেখ তো কেমন হলো স্পিচটা? তুই প্রুফ রিডারের কাজটা কর, আমি ততক্ষণে দুই কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসি।
রুখু পড়লো জিনাত তার স্পিচে লিখেছে –
“ সম্মানিত উপস্থিতি, শ্রদ্ধেয় অভিভাবকবৃন্দ, লক্ষীপুর শিশু স্কুলের সম্মানিত শিক্ষক-শিক্ষিকা মহোদয়গণ ও স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী আমার প্রীয় সোনামণিরা, আসসালামু আলাইকুম। পত্রিকায় টেলিভিশনে সবকিছু দেখে শুনে মনে হয় যেন আমাদের বাংলাদেশে আজ মানুষ খুনের উৎসব চলছে। আমি সংক্ষেপে কিছু কথা, কিছু প্রশ্ন আপনাদের সামনে রাখতে চাই। সাধারন মানুষের মনে এ প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক যে, এই চোরাগোপ্তা হত্যা ধর্মসম্মত কি না। আমি শতভাগ নিশ্চিত যে, কোরান-হাদিস থেকে একটি বাক্য বা প্রমাণ দেখাতে কেউ পারবেনা যেখানে কোন অন্যায় অপরাধের শাস্তি দেয়ার অধিকার সাধারণ মানুষের হাতে দেয়া হয়েছে। এমন কি আল্লাহ কিংবা রাসুলের বিরুদ্ধাচারণ বা সমালোচনা্র জন্যেও শাস্তি দেয়ার একমাত্র অধিকার শরিয়া আইন দ্বারা পরিচালিত ইসলামি রাষ্ট্রের বা শারিয়া আদালতের, সাধারন মানুষের নয়। বিচার বহির্ভুত শাস্তি ইসলাম অনুমোদন করেনা। এই কথাটা, এই ইসলামি নিয়ম বা হাদিসটা আলেমরূপী জঙ্গী সন্ত্রাসীরা সেই সকল যুবকদের জানতে দেয় না যারা মানুষ হত্যার মাধ্যমে আল্লাহকে খুশী করে বেহেস্ত পেতে চায়। ইসলামের নামে যারা মানুষ খুন করে আমি সেই যুবকদেরকে জিজ্ঞেস করি, সাহস আছে আল্লাহকে খুশী করার এই পূণ্য কাজের কথা তোমাদের মায়ের কাছে প্রকাশ করতে? পারবে তোমাদের স্ত্রীকে বলতে যে, আমি একজন মানুষকে খুন করে এসেছি? মায়ের সামনে দাঁড়াবে কি, হিজড়া বলে যাদের তোমরা ঘৃণা করো তাদের সামনেই দাঁড়াবার সাহস তোমাদের নেই। তোমাদের মগজ ধোলাই করে, জাহান্নামের আগুনে ঠেলে দিচ্ছে ইসলামের শত্রু, আল্লাহর দুষমন একদল শয়তান, তোমারা তা বুঝনা? ধরা পড়লে তোমরা পড়বে, গণপিটুনি খেয়ে মারা গেলে তোমরা মরবে, জেল খাটলে তোমরা খাটবে, তোমাদের বউ স্বামীহারা হবে, মা সন্তানহারা হবে, সন্তান পিতাহারা হবে, আর মরলে নিশ্চিত জাহান্নামী হবে, এইটুকু জ্ঞান তোমাদের নেই? তোমরা বুঝনা, মানুষের ভেতরে প্রাণ সঞ্চারের ক্ষমতা আল্লাহ যেমন কাউকে দেন নি, মানুষ খুন করার অধিকারও কোন মানুষকে দেন নি?
পৃথিবীর কোন মা’ই চান না তার পবিত্র গর্ভে একজন খুনী জন্ম নিক, কোন স্ত্রী চান না তার স্বামী একজন জঙ্গী সন্ত্রাসী হউক। উপস্থিত আমার শ্রদ্ধেয় মাতা পিতা, ভাই বোন, অভিভাবকবৃন্দের কাছে আমি অনুরুধ করবো আসুন আমরা এই নরঘাতকদের বিরোদ্ধে সোচ্চার হই। হিংস্র জন্তুর ভয়ে মানুষ গৃহে আটকে থাকেনি, লড়াই করেছে বন্যপশুর সাথে, অরণ্যের ত্রাস মানুষকে দমিয়ে রাখতে পারেনি মানুষ জয় করেছে নরখাদক পশুকে, মানুষের মননশক্তির কাছে পশুশক্তি হার মেনেছে।
১৪কোটি শান্তিকামী মুসলমানের দেশে, মানুষ নামের কলঙ্ক, ইসলামের শত্রু, দেশদ্রোহী কিছু ভীরু কাপুরুষ শয়তান আজ মানুষ হত্যার উৎসবে মেতেছে। আমাদেরকে আমাদের নুতন প্রজন্মকে দংশন করতে আমাদের ঘরেই বেড়ে উঠছে এক ভয়ানক বিষাক্ত সাপ। এর ছোবল থেকে নিজেদের এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে বাঁচাতে হবে। এই নরপিশাচ অসুরদের রুখে দাড়াতে না পারলে আমাদের ধর্ম আর সভ্যতার মর্যাদা রইলো কোথায়? হায়েনারা যতই ধূর্ত চতুর হউক না কেন,আমরা যদি সজাগ দৃষ্টি রাখি, ১৪ কোটি মানুষের চোখকে ওরা ফাঁকি দিতে পারবেনা। আপনাদের সামনে বসা এই মাসুম নিষ্পাপ শিশুদের মাথায় ছোবল মারার আগে সেই সাপকে মেরে ফেলতে হবে। আসুন আমরা নারী পুরুষ সমাজের সকল স্তরের মানুষ আজ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, আমরা হিংস্র হায়েনারূপী এই জঙ্গীবাদী সন্ত্রাসীদের নির্মূল করে এ দেশকে ভবিষ্যত প্রজন্মের বাসযোগ্য দেশ হিসেবে গড়ে তুলবো। ইনশাল্লাহ আমরা জয়ী হবোই’’।
চা নিয়ে রুমে ঢুকতে ঢুকতে জিনাত জিজ্ঞেস করে ‘কি রে রুখু কেমন হলো স্পিচটা, আর কিছু যোগ করা যায়’? রুখু বলে ‘জানিস জিনাত প্রায় হুবহু এই কথাগুলোই ভাইয়া এক মিটিংয়ে তার বক্তৃতায় বলেছিলেন’। ঠিক তখনই বাহিরে গাড়ির হর্ণ শুনা গেল।জিনাত বলে ‘তোর স্বামীকে অনুরুধ করে দেখনা আজ রাতটা আমাদের বাড়ি থাকা যায় কি না’? রুখু বলে, না রে আজ রাতেই ফিরতে হবে, কাল সকালে দশটায় কর্তা মশায়ের একটা এপয়েন্টপেন্ট আছে ঢাকায়’।
রুখু চলে যাওয়ার দুই সপ্তাহ পর জিনাত মুকুলের হাতের একটি চিঠি পায়-
প্রীয় জিনাত,
নতুন কাজে যোগদানের পর কর্মব্যস্ততার কারণে এ মাসে ছুটি পাচ্ছিনা। ফোনও করতে পারি নাই। আগামী মাসের দুই তারিখ চার দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি আসবো। তুমি ভাল থেকো।
ইতি, তোমার মুকুল।
এক নাগাড়ে চার দিন! জিনাত কেলেন্ডারের সাথে তার পিরিয়ডের তারিখ মেলায়। ঠিক উপযুক্ত সময়েই মুকুল বাড়ি আসছে। ভেতরে ভেতরে খুশীতে একা একা হাসে। মুকুল সাধারণত সন্ধ্যায় মাগরিব আর এশার নামাজের মাঝামাঝি সময়ে আসে। দুই তারিখ শনিবার জিনাত নববধুর বিয়ের সাজে সাজবে বলে প্লান করেছিল, শেষ মুহুর্তে প্লান চেঞ্জ করে ফেলে। এবার বিয়ের লাল শাড়ির বদলে পাতলা স্কাই ব্লু রঙ্গের সিল্কের শাড়ি আর সাদা ব্লাউজ। শাড়ির রঙ্গের সাথে ম্যাচিং করা মেকআপ। ব্লাউজের সাথে ম্যাচিং করে খোপার ফুল। শাড়ির আঁচল বাম দিকে পিছন থেকে ঘুরিয়ে ডান দিকে এনে কুচি দিয়ে বাম কাঁধে ব্লাউজের সঙ্গে সেফটিপিন দিয়ে গাঁথা। ফলস্বরূপ, কোমর থেকে ব্লাউজের নিচ পর্যন্ত বাম বাহু খানিকটা উন্মুক্ত। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জিনাত নিজের শরীরের এপাশ ওপাশ ঘুরে দেখে আর অস্পষ্ট স্বরে গুনগুন করে-
“কুঞ্জদ্বারে বনমল্লিকা
সেজেছে পরিয়া নবপত্রালিকা
সারাদিন রজনী অনিমিখা
কার পথ চেয়ে জাগে
রোদনভরা এ বসন্ত
সখি কখনো আসেনি বুঝি আগে”।।
সন্ধ্যা আটটায় মুকুল বাড়ী আসলো। এমনিতেই এয়ার ফ্রেশেনারের মিষ্টিগন্ধে ঘর মউ মউ করছে তার ওপর জিনাত আজ তার পছন্দের শ্রেষ্ট পারফিউম দেহে লাগিয়েছে। রাতের ডিনার টেবিলে জিনাত মুকুলের পাশ ঘেঁষে অকারণেই শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়িয়ে বার কয়েক উঠা-বসা করলো। প্রতিদিন ঘুমুবার আগে স্নান বা শাওয়ার করা জিনাতের শেখানো স্বামী স্ত্রীর মিলন কর্তব্যের অন্যতম কর্তব্য। মুকুল একদিন প্রশ্ন করেছিল ‘ সকাল বিকাল দিনে দুইবার গোসল না করলে হয় না’? উত্তরে জিনাত বলেছিল ‘আল্লাহর দুনিয়ায় জলের অভাব আছে? যতবার মিলন ততবার স্নান এটা আমার নিজস্ব আইন’। আরো কিছু অপছন্দের জিনিস জিনাত মুকুলকে বিয়ের দুই সপ্তাহের মধ্যে জানিয়ে দিয়েছিল যেমন,হলদে আর ঘাড় সবুজ রঙ্গের শার্ট ট্রাউজার পরা,দরজায় নক না করে রুমে ঢুকা,পায়ে ধরে সালাম করা, জোরে হাঁচি দেয়া, শব্দ করে চা পান করা ইত্যাদি। মুকুল প্রতিবারই বলতো ‘ওটা আমিও মোটেই ভাল পাইনা’। আহার পর্ব শেষে জিনাত বললো ‘শুনো, ওপরে ট্যাংকের জল এখনও উষ্ণ আছে,বাথরুমে তোমার টাওয়াল-শ্যাম্পু সব রেডি আছে,একটু বিশ্রাম নিয়ে তুমি শাওয়ার করে নিও। আমি এশার নামাজে যাচ্ছি,ফিরে না আসা পর্যন্ত ঘুমোবেনা কিন্তু’। জিনাতের বেডরুমের পাশেই মহিলাদের নামাজের জায়গা। এর পাশ দিয়েই ওপরতলায় বাথরুমে যাওয়ার সিড়ি।
একবার শাশুড়ির কথা আর একবার রুখুর টিপসের কথা মনে পড়ায় আজ নামাজে জিনাত দুইবার ভুল করেছে। নামাজ শেষে দোয়ার মাঝে স্কুলের শিশুদের চেহারা মানসপটে ভেসে উঠায় দোয়ার মাঝেও মনযোগে বিঘ্ন ঘটে। হঠাৎ জিনাতের মনে হলো, এই বিশ পঁচিশ মিনিটের মধ্যে কারো ওপরে উঠার পায়ের শব্দ কিংবা বাথরুমের জলের শব্দ শোনা গেলনা, মুকুল কি ঘুমিয়ে পড়লো? জায়নামাজ ভাঁজ করে করে জিনাত বেডরুমের দরজার সামনে এসে দেখে মুকুল বিছানায় নেই। সিড়ির পাশে গিয়ে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘তোমার শাওয়ার শেষ হলো? কোন সাড়া শব্দ নেই। সে বেডরুমে ফিরে আসে। বিছানায় তাকিয়ে দেখে জিনাতের নোটপ্যাড তার বালিশের ওপরে রাখা। তার ওপর একটি সাদা কাগজের টুকরায় বড় অক্ষরে লেখা-
জিনাত,
তোমার পবিত্র গর্ভে আমার পাপ আমার মতো আরেকটা খুনী জন্ম নিক, তা আমি চাইনা।
চির বিদায়, মুকুল।
দুই হাতে জায়নামাজ বুকে চেপে ধরে জিনাত বিকট চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। উপুড় হয়ে সেজদারত অবস্থায় জায়নামাজে মাথা ঠুকে আর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানায় ‘প্রভু গো, এ রাত যেন হয় আমার জীবনের শেষ রাত, আমি আর একটা ভোর দেখতে চাইনা, রাতের কাছে মিনতি করে ‘রজনী তুই আর হইসনারে প্রভাত’।
Leave A Comment