প্রিয় বাংলাদেশ সরকার,

আপনি আমাদের দাবিদাওয়া পূরণে নিয়মিত ব্যর্থ হচ্ছেন। ভাবছিলাম এর কারণটা কী হতে পারে। অর্থবল, লোকবল, সমর্থনবল, মনোবল সবই আপনার তুঙ্গে। তারপরও কেন আমাদের বারে বারে হতাশ করছেন। ভেবে বের করলাম, এত কিছুর আধিক্য থাকা সত্ত্বেও যেটার ঘাটতি পড়েছে তা হলো বুদ্ধি-শুদ্ধি। অতয়েব অহেতুক নতুন দাবিদাওয়া পেশ করার পরিবর্তে বরং কিছু বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করার নিমিত্তে এই চিঠি লিখতে বসেছি।

পৃথিবীর যেসব দেশে এখন জঙ্গিবাদে পর্যদুস্থ। খোঁজ নিলে দেখা যায়, সেইসব জংঙ্গিদের সামরিকায়নে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর হাত রয়েছে। ইহা সত্য। কিন্তু এই সত্যটাকে বামাতিরা নিজেদের পাতে ঝোল টানার জন্য নানাভাবে বুঝানোর চেষ্টা করে। এবং এত শত ডিসকোর্স ফাদে যে সেসবে আড়ালে আরো গভীর সত্যটা ঢাকা পড়ে যায়। আর তা হলো, সুস্থ্য শরীরে ব্যাক্টেরিয়া ভাইরাস সহজে আক্রমন করে না। হাসপাতালের ডাক্তারদের যে কারণে দৈনিক এত রোগী ঘাটার পরেও বড় বড় অসুখ হয় না। আমরা মুক্তমনারা, ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লিখতাম যেন জনমনে এই সুস্থ্যতা বজায় থাকে। কারণ পরাশক্তিরা বড়জোর ধর্মান্ধদের আরো কিছু ইন্ধন, ও দানাপানি দিয়ে শক্তিশালী-জঙ্গি করে তুলতে পারে, কিন্তু সুস্থ্য সবল ও ধর্মান্ধ নয় এমন মানুষকে জঙ্গি বানাতে পারে না। এই কারণেই, সুশিক্ষিত, ও জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্যের চর্চাকারী দেশে জঙ্গিবাদ খাটে না। আপনি যদি স্রেফ আমাদের লেখালিখির-পড়াশুনার মুক্ত পরিবেশটা রক্ষা করতেন, তাহলেই এখন যারা জঙ্গি-টঙ্গি হচ্ছে তাদের সবাইকে রীতিমত মানবিক-মানুষে রুপান্তরিত করে ফেলতাম। এটা তো এত দিনে প্রমাণিত, যে অস্ত্র দিয়ে, ড্রোন দিয়ে জঙ্গিবাদের অন্ধকার দূর হয় না। শুধু মাত্র জ্ঞানের আলোই সেটা পারে।

তাই বলে এখন যে কিছু জঙ্গি ছোকড়া এদিক ওদিক কোপাকুপি করে বেড়াচ্ছে তাদের সামনে, ধারাপাত আর আদর্শলিপির বই নিয়ে হাজির হতে হবে তা বলছি না। এদেরকে অনতিবিলম্বে কারায়ত্ব করতে হবে। সেই সঙ্গে এদের মত বিপথে যেন আরো কেউ না যায়, সে প্রচেষ্টায় দেশের আনাচে কানাচে জ্ঞানের আলো ছড়াতে হবে। কিন্তু এদেরকে ধরবে কারা? এটা আপনিও বোঝেন আমরাও বুঝি যে শান্তির সময়ে নিয়মিত ল-এনফোর্সমেন্ট বাহিনীর নানান পদে ভুড়ি ফোলানো আমলাতন্ত্রে পারদর্শীলোকজন দিয়ে ভরে যায়। এদের পক্ষে জরুরী অবস্থা ট্যাকেল দেওয়া মুশকিল। তাই অনতিবিলম্বে সাহসী, কর্মঠ, বুদ্ধিমান অফিসারদের নিয়ে পুলিশ বা র্যাবের স্বাধীন এন্টি-টেররিজম সেল গঠন করুন।

‘দেশে কোনো জঙ্গি নাই’ এই কথাটা আপনারা পাবলিকলি বলেন তা এক রকম ঠিক আছে। নাইলে জনমনে বাড়তি ত্রাস সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু অন্যকে বুঝ দিতে বলা কথাটা নিজেও বিশ্বাস করে বসে থাকবেন না। জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব একটা বাস্তবতা। এবং এখনই এদেরকে শল্যচিকিৎসা করে, বা এন্টিবায়োটিক দিয়ে নিরাময় করতে হবে। যা করতে পারে প্রস্তাবিত বিশেষায়িত বাহিনী। এবং সেই সঙ্গে জঙ্গিবাদের প্রতিষেধকও দিতে হবে। যা করতে পারে এ দেশের প্রগতিশীল লেখক ও শিক্ষাবিদরা। এসব ব্যাপার দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে, বা কোনো ভাবে অবস্থা সরকারের হাতছাড়া হয়ে পড়লে তার সুযোগ নিতে পরাশক্তির শকুনরা ওত পেতে আছে। তাই চোখ বুজে ‘জঙ্গি নেই জঙ্গি নেই’ জিকির না তুলে কার্যকর ব্যবস্থা নিন।

বিশ্ব অনেক বদলে গেছে। বর্তমান ডিজিটাল বিশ্ব কীভাবে চলে তা হাড়জিরজিরে বুড়োদের জানার কথা না। তাই কিভাবে উদ্ভুত সমস্যা সমাধান করা যায় সেইসব নীতি নির্ধারণে কিছু মেধাবী তরুণদের নিয়ে ‘সিচুয়েশন রুম’ গঠন করুণ। নানান রকম পরিস্থিতির বিচার বিশ্লেষণে এদের কাজে লাগান। এইযে বড় বড় পরাশক্তি সারা দুনিয়ার উপর ছড়ি ঘোরায়, এরা কিন্তু বুড়া-ধুড়া দিয়ে এনালিস্ট এর কাজ করায় না।

আপনারা হয়তো ভুলে গেছেন যে কোনো বদমায়েশকে ছাড় দিলে সে ভাল হয়ে যায় না। বরং পরবর্তীতে আরো বড় বদমায়েশির নকশা কষে। জঙ্গি-টঙ্গিদের যা প্রশ্রয় দেওয়ার দিয়ে ফেলছেন। এখন রাশ টেনে ধরুণ। কিভাবে রাশ টানা যাবে জানতে উপরের প্যারাগুলো আবার পড়ুন। আর এ কাজে বিলম্ব করলে কী অবস্থা হবে তা জানতে, জঙ্গিপর্যদুস্থ দেশগুলোর দিকে তাকান।

চিনি মিষ্টি হলেও অতিরিক্ত চিনি স্বাস্থ্যহানির কারণ। তেমনই আপনার কিছু অতি-সমর্থকের ব্যাপারেও আপনাকে সতর্ক হতে হবে। এইসব অতিসমর্থকদের অনেকেই মনে করে মুক্তমনারা, সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য চাপাতির কোপে খুন হচ্ছে। কিন্তু একটু বুদ্ধিখাটালেই বোঝা যায় যে ‘নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ’ যদিও সম্ভব, নিজের কল্লা কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ মোটেই সম্ভব না। তাই অতিভক্তদের আবালীয় যুক্তিগুলো চিহ্নিত করুন। আমরা স্রেফ স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে নিজেদের মত প্রকাশের অধিকার চাই। মাথা উচু করে বাঁচতে চাই। এর বাইরে রাজনৈতিক ঘুটিবাজিতে আমাদের কোনোই আগ্রহ নেই।

আমরা এ প্রজন্মের প্রগতিশীল তরুণরা ‘সেক্যুলার’ আওয়ামীলীগকে সমর্থন দিয়েছিলাম। তারা সরকার গঠন করে বাকস্বাধীনতা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্র-বিশ্বাস নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করবে সেই আশায়। কিন্তু আপনারা কিছু ধর্মান্ধকে নিজেদের দলে টানার লোভে আমাদের দূরে সরিয়ে দিলেন। একটু বুদ্ধি খাটালেই বুঝবেন যে ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠিকে রাজকন্যা-রাজত্ব সব লিখে দিলেও তারা একটা ভোটও কোনো দিন আওয়ামীলীগকে দেবে না। বরং সুযোগ পেলেই কোপাবে। খোঁজ নিয়ে দেখেন আপনাদের পেয়ারা ওলামালীগও প্রকাশ্যে নাবালিকা বিবাহ করার ও গোপনে গোপনে ধর্মান্ধদেরই ভোট দেওয়ার মনোবাসনা পোষণ করে।

আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি যে নাস্তিকদের মেরে যে হত্যাযজ্ঞের শুরু, সেটা শেষ হবে পাকিস্থান আফগান স্থানের মত অবস্থায়। শিয়াদের উপর হামলা, বিদেশিদের উপর হামলা, পুলিশের উপর হামলা এসব তারই লক্ষণ। ইতোমধ্যেই বিদেশী খেলোয়াড়রা বাংলাদেশে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। এর পর বন্ধ করবে বিনিয়োগকারীরা। প্রতিটি ঘটনার পর, বিশ্ব মিডিয়া ফলাও করে এগুলো প্রচার করছে। আগে বাংলাদেশকে বহির্বিশ্ব চিনতো বন্যাদুর্গত দেশ হিসাবে। এখন জঙ্গিদুর্গত দেশ হিসাবে পরিচিতি বাড়ছে। পাকিস্থান বলতেই যেমন জঙ্গিবাদ বোঝায়, আওয়ামীলীগের হাত ফসকে বাংলাদেশেরও তেমন জঙ্গিবাদের প্রতিশব্দ হবার দশা।

মৌলবাদী দল ক্ষমতায় থাকলে কী কী ঘটতে পারে তার কিছু মানসিক ধারণা সবারই আছে। আপনারা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যদি সেসব পুরো দমে ঘটতে শুরু করে দেশে, তাহলে কিন্তু আর “দেখ আমরা না থাকলে ওরা এসে পড়বে” টাইপ যুক্তি জনগণকে খাওয়ানো যাবে না।

আইএস-বোকোহারেম-আলকায়েদা এদের অপকর্মের ছবি যেগুলো পত্রিকা ইন্টারনেটে আসত, সেগুলো পশ্চিমা ষড়যন্ত্র, ফটোশপের কারসাজি, এসব বলে ফেসবুকীয় জনতাকে বেশ বোকা বানানো গেছে এতদিন। দেশে হিজাবটুপির প্লাবন বয়ে গেছে সেই সূত্রে। কিন্তু এসব দেখে ভাবার কারণ নেই যে, জনগণ জঙ্গিদের সমর্থক তাই আওয়ামীলীগকেও জঙ্গি ভেক ধরতে হবে। বরং দেশের মধ্যেই জঙ্গিরা যে হারে কুপাকুপি-ফুটাফুটি শুরু করেছে এতে জণগনের মোহভঙ্গ হতে সময় লাগবে না। তাই অসাম্প্রদায়িক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল সৃষ্টিই আখেরে লাভজনক।

নতুন কুঁড়ি নামক একটা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান এক সময় দেশ জুড়ে হত। সেটা নিয়ে রাজনৈতিক মাইরপ্যাচ থাকলে, ভিন্ন নামে এ ধরনের অনুষ্ঠান শুরু করুন। দেশের বিলিয়ন বিলিয়ন রিজার্ভ কিছু সত্যিকার কাজে খাটান। সুন্দর মনন গড়ে না উঠলে সহজেই মানুষকে জঙ্গিতে পরিণত করা যায়। তখন নামের আগে আলহাজ্জ বসিয়ে, টুপি-পাগড়ি পরেও পার পাবেন না।

ভারতের সাথে শুধু রাজনৈতিক সম্প্রীতি রেখেই ক্ষ্যান্ত দিয়েন না। বরং কিছু শিক্ষা-দিক্ষাও লাভ করুন। তারা পিসটিভির মত জঙ্গি ও বিদ্বেষসৃষ্টিকারী চ্যানেলের প্রচার নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাতেও এগুলো অনতিবিলম্বে বন্ধ করুণ। দেশের সাম্প্রদায়িক সম্পৃতি নষ্ট হয়ে গেলে প্রচন্ড দুর্ভোগ পোহাতে হবে। মনে রাখবেন সংখ্যালঘুদের মেরে ধুরে ১০০% ইসলামিক দেশ বানিয়ে ফেললেও, তখন নানান মাজহাব, নানান পীরের ভক্তরা একে অপরকে কুপাকুপি করবে। তাই সাম্প্রদায়িক সমপ্রীতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র ধরে রাখতে সচেষ্ট হোন।

মাননীয় সরকার, সরকারের কর্তাব্যক্তি, ব্লগের উপর নজর রাখা টিকটিকিবৃন্দ ও ছিপিগ্যাঙ্গগণ, এই যে এত বুদ্ধি পরামর্শ দিলাম সেগুলো সরাসরি মেনে নেওয়ার দরকার নাই। এই লেখাটা যদি পড়ে থাকেন তাহলে এখন হালকা ঘুম দেওয়ার চেষ্টা করুন। আপনার সচেতন মন হয়তো নানান বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত কিংবা ঘটনার ঘনঘটায় কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কিন্তু অবচেতন মন ঠিকই যুক্তিগুলো গ্রহণ করতে পারবে।

সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।

ইতি,

একজন শুভাকাঙ্ক্ষী