বিচার চান না বন্যা। অভিজিৎ হত্যার। বিচার চান না অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, তাঁর ছেলে দীপনের হত্যার। এই সরকারের কাছে বিচার চেয়ে কোন লাভ নেই। তাঁরা জানেন। সরকার এবং সরকারের দায়িত্বপূর্ণ কর্তাব্যাক্তিরা এটা স্পষ্টতই বুঝিয়ে দিয়েছেন এইসব হত্যাকান্ড নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যাথা নেই। শুধু তাই নয়, এই সব হত্যার বিচার করলে, হত্যাকারীদের ধরে বিচারের আওতায় আনলে তাদের সমূহ রাজনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনা। সরকার প্রধানের ‘সুযোগ্য’ পুত্র এবং উপদেষ্টা বিদেশী মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের জানিয়েছেন, তাঁর মায়ের পক্ষে টেলিফোনে গোপনে সমবেদনা জানানো ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আর সমবেদনাটা গোপনেই জানাতে হচ্ছে, তা নইলে হত্যার মদদদাতারা নাখোশ হতে পারে। এর বেশি কিছু করলে তারাও নাস্তিক অপবাদের শিকার হবেন।
বিচার চাই না এই সরকারের কাছে। এই সরকারের কাছে বিচার চেয়ে আসলেই কোন লাভ নেই। আমরা না বুঝলেও বুঝেছেন বন্যা। বুঝেছেন দীপনের বাবা।
দীপনের বাবা বিচার না চাওয়ায় রাগ করেছেন সরকারের এক পাতিমন্ত্রী। অভব্য ভাষায় কটু কথা বলেছেন তাঁকে উদ্দেশ্য করে। শোকাতুর একজন পিতার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে কথা বলা উচিত – এই সাধারণ কান্ডজ্ঞানটুকুও এই ক্ষমতান্ধ অমানুষেরা হারিয়ে বসেছেন।
সরকারের তদন্ত কর্মকর্তারা অভিজিতের স্ত্রী বন্যার সাথে কথা বলারও প্রয়োজন বোধ করে নি। পরিকল্পিতভাবে কিছু গুজব ছড়িয়ে, দায়সারা গোছের কিছু কর্মকান্ডের মাধ্যমে দু’চার জনকে ধরে পত্রিকায় ছবি ছাপিয়ে ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ করা হয়েছে।
এই বছরেই অভিজিৎ হত্যার পরে হত্যা করা হলো একে একে ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয়, নিলয় নীলকে। এদের হত্যার বিচার হয় নি বলে মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের সাহস বেড়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির শিকড় আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। হত্যাকারীরা উৎসাহ পেয়েছে। আরো খুনের পরিকল্পনা করেছে। বছর শেষ হয় নি। আরো দুইমাস বাকী। তারা গতকাল দুটি প্রকাশনা সংস্থার কার্যালয়ে গিয়ে অভিজিতের বইয়ের প্রকাশকদের কুপিয়েছে। খুন হয়েছেন জাগৃতির ফয়সাল আরেফিন দীপন। আহত হয়েছেন শুদ্ধস্বরের আহমেদুর রশীদ টুটূল, তাঁর সাথে মুক্তমনা লেখক রণদীপম বসু আর তারেক রহিম।
এই খুনীদের থামানোর কোন ব্যবস্থা সরকার নিচ্ছে না। নেবে – এমন কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। তাই বেদনা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলতে হচ্ছে, হয়তো আরো হত্যার খবর আমাদের শুনতে হবে।
হয়তো হবে না। যদি আমরা আইনের শাসনের দাবীতে সোচ্চার হই, আন্দোলনে নামি। এখনও কি সময় আসে নি? আর কতো লেখক মরলে সময় হবে? আর কতো প্রকাশক খুন হলে সময় হবে? আওয়ামি গুন্ডাদের লাথিতে আর কতো অন্তসত্তা নারীর গর্ভপাত হলে সময় হবে? ওসমানদের হাতে আর কতো ত্বকী হত্যা হলে সময় হবে?
আর সময় নেই। এখনই রুখে দাঁড়ানোর সময়। এই সরকারকে আর ছাড় দেয়া যায় না। এই সরকা্রের মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা ভন্ডামি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলে ছিল ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক জাতি হিসেবে বাঙালীর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আকাঙ্খা।
এই সরকারের কর্মকান্ডে রয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদের প্রতি দূর্বলতা, নতজানু অবস্থান। এই সরকারের কর্মকান্ডে রয়েছে পদে পদে গণতান্ত্রিক অধিকারের পদদলন। এই সরকার ন্যায়ভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের প্রকাশ্যে বিরোধী। এই সরকারের কাছে জাতীয়তাবাদ ফ্যাসিবাদেরই নামান্তর।
অথচ এরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সব আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ‘সোল প্রোপ্রাইটার’ সেজে বসেছে। লোক-দেখানো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে কিছু মানুষের মুখ বন্ধ করার জন্য। কিন্তু আর কতো?
যে কাজ বেয়াল্লিশ বছর আগে করার কথা ছিল, সে কাজ এখন করছে আর তার অজুহাতে দাবী করছে তাদের যেন সহস্র অপরাধ মাফ করা হয়। তাদের যেন একটু ছাড় দেয়া হয়। তাদের একটু-আধটু দুষ্টামি-ছ্যাবলামি যেন ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হয়। তা নইলে আবার বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় আসতে পারে।
কিন্তু আর কতো?
আর আমরাও, আমাদের বুদ্ধিজীবিরা এই অজুহাতে এই সরকারের সমস্ত অক্ষমতা, অযোগ্যতা, অকর্মণ্যতা, আর ঔদ্ধত্য মেনে নিচ্ছি বিনা প্রতিবাদে। কিন্তু আর কতো? তলে তলে এই সরকার ও সরকারী দলের কাজকর্মও যে বিএনপি-জামাতের মতো হয়ে উঠেছে, আমরা সেদিকে দৃষ্টি দিচ্ছি না। দূর্নীতিতে আর দুঃশাসনে শুধু নয়, হিন্দুদের ওপরে লাগাতার অত্যাচারে, সাম্প্রদায়িকতার পৃষ্টপোষকতায় ক্ষমতাসীনেরা বিএনপি-জামাতকেও ছাড়িয়ে গেছে। আওয়ামি লিগ রূপান্তরিত হয়ে গেছে আমাতি লিগে। অথচ আমরা উটপাখীর মতো মাথা গুঁজে বসে আছি।
কিন্তু আর কতো?
একাত্তরের রাজাকার-আলবদরদের বিচার করা হচ্ছে, ভালো কথা। কিন্তু ২০১৫-তে যে নতুন করে রাজাকারত্ব আর আলবদরত্বের জন্ম হয়েছে সরকারেরই প্রশ্রয়ে, সে নিয়ে মনে হয় না আমরা খুব একটা উদ্বিগ্ন । একাত্তরে যেমন আমাদের শ্রেষ্ট সন্তানদের খুন করা হয়েছিল রাতের আঁধারে, সেভাবেই হত্যা করা হচ্ছে আমাদের মেধাবী মুক্তমনা লেখক, মুক্তচিন্তক প্রকাশকদের, দিনের আলোতেই। আমরা নির্বিকার। ভয়ঙ্কর আমাদের এই মৌনতা। একাত্তরে আমরা জেগে উঠেছিলাম, কিছুটা দেরীতে হলেও। অনেক মূল্য দিতে হয়েছে আমাদের সময়মতো জেগে না ওঠার জন্য। এখনো দিতে হচ্ছে।
কিন্তু আর কতো?
তদন্ত ছাড়াই তো মন্ত্রবলে মন্ত্রীপ্রধান থেকে মন্ত্রী কয়েক আর চামচারা বলে দেন কে অপরাধী। ন্যায় বিচার হবে কি করে?
বিচারকের চেহারায় মুর্খ খোদা।
“মৌনতা ভয়ঙ্কর।
কিন্তু আর কতো?” — না, আর মৌনতা নয় । আমরা যখন জেনেই গিয়েছি, সরকার বাহাদুরের কাছে বিচার চাইলে দোষ ( বেডরুমের নিরাপত্তা দিতে পারবেন না ) , না চাইলেও দোষ ( হত্যাকারীদের মতাদর্শে বিশ্বাসী ) ; সেক্ষেত্রে তৃতীয় পথ হল – কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা । হ্যাঁ, খুব জোর দিয়েই বলছি, এখনি, সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদ না করে, সেগুলোর সংগঠিত রূপদান খুব জরুরী। স্মরণ করছি, সেইসব মাছিদের কথা; যারা মাকড়সার জালে আটকা পড়ে , মারা যেত । তারপর মাছিরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিল, সবাই, একসাথে ঝাঁপ দেবে মাকড়সার জালে। সিদ্ধান্ত অনুসারে তারা একসাথে ঝাঁপ দিল এবং জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল। আমরা কি পারি না, মাছিদের মত একসাথে ঝাঁপ দিতে ?
বিচার চেয়ে কি লাভ ?? বাংলাদেশে ক্ষমতা আর অর্থের ঝংকার না থাকলে বিচারের আশা করা নিতান্ত বিলাসিতা ।
বিচারের কথা বলা হচ্ছে না,আমরাতো জানিই এই আওমী মুসলিম লীগ দেশের সবচাইতে এবং সময়ের অগ্রগামী চিন্তাবিদ ও নায়কদের হত্যার বিচার করবে না। কারন তাদের ভোট দরকার,এই নিয়ে রাজনীতি করার দরকার সামনের দিনগুলিতে এবং আরও কত কি !!! তবে তাদেরকে এর মাশুল কড়ায় কড়ায় , গন্ডায় গন্ডায় যেমন দিতে হবে তেমনি জাতিকে এর মাশুল গুনতে হবে আগামীদিনে এ কথা নির্ধিদায় বলা যায়।
ইরতিশাদ বলছেন, আমাদের জাতির বিবেক,বুদ্ধি ও যৌবনের, তারুন্যের জোয়ার কোথায় গেল , আমরা এতগুলি হত্যা একের পর এক হওয়ার পর শুধু চোখ দিয়ে দেখে যাব না-কি প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে এগিয়ে আসব । এই কথাই ওনি মনে হয় এই লেখায় বলতে চেয়েছেন।
কলম চলুক দূর্বার গতিতে,ছিন্নভিন্ন হঊক সকল চিন্তার জড়তা ………