আনিসুল হকের অন্ধকারের একশ বছর বইটি ১৯৯৫ সালের বইমেলায় প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি একটি উপন্যাস। বইটি পড়ে শেষ করলাম। এই সময়ের আগে পড়লে বইটি আমার কাছে তিলকে তরমুজ বানানোর মত অতিরঞ্জন মনে হত। এখন বইটি পড়ার পর মনে হয়েছে, অতিরঞ্জন ত নয়ই বরং লেখকের তখন ধারণাই ছিল না আরবি শান্তি (ইসলাম) কতটা বীভৎস হতে পারে।
জামাতিয়া শাসন চলছে দেশে। শরীয়া আইন। এক সন্ধ্যায় শফি আকবর সমুদ্রের পাড়ে একা একা বসে আছেন। নানান ভাবনা ভাবছেন। হঠাৎ গান আসে গুনগুনিয়ে তার মনে। তিনি নিজের অজান্তেই গুনগুনিয়ে গাইতে শুরু করেন একটি রবীন্দ্র সংগীত – এ অন্ধকার ডুবাও তোমার অতল অন্ধকারে। গান শেষ হতেই কয়েকজন লোক এসে তাকে গ্রেফতার করে। কারণ তিনি হারাম সংগীত গাইছিলেন। এই গানটি রবীন্দ্রনাথ নামে একজন মালাউন, বেদ্বীনের লেখা। এমনিতেই ইসলামে গান-বাজনা হারাম। তার উপর মালাউনের লেখা গান গাওয়া ত মহাহারাম কর্ম। শফি আকবরকে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়ার কবীরা গুনাহের দায়ে কয়েদখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তার আঙ্গুলে আঙ্গুলে সুই ফোটানো হয়, তার দশটি আঙ্গুল ভেঙ্গে দেওয়া হয়।
স্বামীর চিন্তায় দিশেহারা শফি আকবরের স্ত্রী নাসিমা। এক সময় তিনি টেবিলে মাথা রেখে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতে থাকেন, কাদার মধ্যে শুয়ে আছে শহিদুল্লাহ কায়সারের লাশ। লাশটি উঠে বসে। নাসিমাকে নিয়ে যায় আরো অনেকের লাশ দেখাতে। অসংখ্য লাশ শুয়ে আছে কাদায়। হাবিবুর রহমান, ডাঃ আলীম চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা আরো অনেকে। সেই জায়গা পেরিয়ে আরেকটি বাগান।লাশের বাগান। সেখানে একেকটি বৃক্ষের নাম দেওয়া হয়েছে একেকটি লাশের নামে। একটা গাছের নেমপ্লেটে ঝুলছে শামসুর রহমান। এরকম অসংখ্য গাছের অসংখ্য নাম। আহমেদ শরীফ, সৈয়দ হাসান ইমান, হুমায়ুন আজাদ, শাহরিয়ার কবির প্রমুখের নামে গাছগুলির নাম। মানবতাবাদী, প্রগতিশীল মানুষদের হত্যা করে করে এই বাগানে এনে গাছ বানিয়ে রাখা হয়।
নাসিমাকে ইসলামিস্টরা তার বাড়িতে গিয়ে ধর্ষণ করে। কারণ শফি আকবর একজন অমুসলিম, একজন মুরতাদ। নাসিমা একজন মুরতাদের স্ত্রী। আল্লার আইনে অমুসলিমদের স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পত্তি ও অমুসলিম নারীরা মুসলিমদের গনিমতের মাল। ওদের সম্ভোগ করা মুসলমানদের জন্য হালাল করে দিয়েছেন তাদের আল্লা।
১৩ বছরের কিশোর ইয়াকুবকে জামাতিয়া আদালত গ্রেফতার করে ফুটবল খেলার অপরাধে। খেলাধুলা ইসলামে হারাম। কেতাবে লেখা আছে হালাল খেলা মাত্র তিনটি – অশ্বচালনা, যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষার উদ্দেশ্যে তীরধনুক চালনা ও দাম্পত্য ক্রীড়া। কিন্তু কিশোর ইয়াকুব হালাল খেলাগুলি না খেলে হারাম খেলা খেলেছে। সে জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলেছে। শাস্তি ত তাকে পেতেই হবে। জামাতিয়া আদালতে আল্লার আইনে ইয়াকুবের বিচার শুরু হলো। জামাতিয়া আদালতের প্রধান মিজানী ইয়াকুবকে প্রশ্ন করে, তুমি জাম্বুরা পেলে কোথায়। ইয়াকুব বলে, পাশের বাড়ির বাগান থেকে পেড়ে নিয়েছি। মিজানী বলে, তাহলে তুমি শুধু হারাম খেলাই খেলোনি, চুরিও করেছ। চুরির শাস্তি হাত কেটে ফেলা। মিজানী কোরান থেকে উদ্ধৃতি দেয়, “ পুরুষ মহিলা চোরের চৌর্যবৃত্তির শাস্তি হিসাবে তাদের হাতগুলি কেটে দাও, এটাই ওদের কৃত কর্মের ফল আল্লার পক্ষ হতে নির্দিষ্ট; আল্লা পরাক্রান্ত বিজ্ঞ। সুরা মায়িদা, আয়াত ৩৮।
এজলাশে উপস্থিত একজন আব্দুল হাফিজ। তার মন কেঁদে ওঠে ছেলেটির জন্য। ছেলেটিকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে সামান্য একটা জাম্বুরার জন্য। তিনি বলেন, হুজুর, ছেলেটির বয়স নিতান্ত অল্প। তাকে মাফ করে দেওয়া যায় না? মিজানী বলে, শোনেন তাহলে; একদিন এক চোরকে আনা হলো নবীজির কাছে। নবীজি তার হাত কেটে দিলেন। সবাই বললো, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমরা ধারণা করি নাই যে আপনি একে এই শাস্তি দেবেন। রাসুলুল্লাহ বলেন, আমার কন্যা ফাতেমা এই কাজ করলে আমি তারও হাত কেটে দিতাম। এটা বোখারী শরীফের সহী হাদিস।
আব্দুল হাফিজ তবুও প্রাণপণ চেষ্টা করে যান ছেলেটিকে পঙ্গুত্বের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। বলেন, সামান্য একটা ফল চুরির জন্যও কি একই বিধান? মিজানী বলে, হাদিসে লেখা আছে, গাছে ঝুলন্ত ফল বেড়া দিয়ে সুরক্ষিত অবস্থায় থাকলে তা চুরির অপরাধে হাত কাটা হবে। মিজানী আবার হাদিস উদ্ধৃত করে বলে, একবার এক লোক চুরি করলে নবীজি নির্দেশ দিলেন তার ডান হাত কাটার। তারপর সে আবার চুরি করলে নবীজির নির্দেশে তার বাম হাত কাটা হলো। এরপর সে আবার চুরি করলে নবীজির নির্দেশে তার ডান পা কাটা হলো। সে আবার চুরি করলো। নবীজির নির্দেশে তার বাম পা কাটা হলো। সে আবার চুরি করলো। এবার নবীজির নির্দেশে তাকে হত্যা করা হলো। ইয়াকুবের হাত কেটে ফেলার রায় ঘোষণা করলো মিজানী।
ইসলামি শাস্তি কার্যকর করতে হয় প্রকাশ্যে, জনসমক্ষে। যাতে মুসলমানেরা সবাই তা উপভোগ করতে পারে ও তা থেকে হাত পা মাথা কাটার, চোখ উপড়ে ফেলার, পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে মানুষ হত্যা করার শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। অনেক মুসলিম দেশে এই রকম অনুষ্ঠান প্রতি শুক্রবারে জুমার নামাজের পর মসজিদের সামনে অনুষ্ঠিত হয়। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা প্রাণ ভরে উপভোগ করে। বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর। ইয়াকুবের হাত কেটে ফেলা হলো। ইয়াকুব কোরবানি দেওয়া পশুর মত ধড়ফড় করলো অনেকক্ষণ।
রফিকুল হক নামে একজন কলেজ শিক্ষককে গ্রেফতার করে মিজানী বাহিনী। কারণ তিনি ছেলেমেয়েদেরকে বিবর্তনের কথা বলেন, বিজ্ঞানের কথা বলেন। তাঁর মাথা কেটে ফেলা হয় ইসলামি আইনে। কারণ তিনি বলেন, বিগ ব্যাঙের কথা, তিনি বলেন, পৃথিবী সূর্যের একটা অংশ। আর এসবই অনৈসলামিক কথাবার্তা, আল্লাবিরোধী কথাবার্তা। আল্লাবিরোধী কথা বলার একমাত্র ইসলামি শাস্তি হলো, মাথা কেটে ফেলা।
বিদেশ থেকে তিনটি বিষয়ে পিএইচডি নিয়ে রফিকুল হক দেশে ফিরে আসেন। সবাই বলেছিল, ওদেশে যেওনা। ওটা একটা গুমোট অন্ধকার গুহা। তিনি বলেছিলেন তাদের, অন্ধকারেই ত আলো জ্বালাতে হয়। আলো জ্বালাতে এসে নিজের মাথাটি তিনি হারালেন।
অন্ধকারের একশ বছর বইটা আরো আগে পড়লে বাড়াবাড়ি মনে হতো। মনে হতো, সব ধর্মগ্রন্থে কত আজেবাজে কথাই তো লেখা আছে। তাই বলে মানুষ ধার্মিক হলেও কি এইসব বাজে কাজ করে নাকি? ওগুলি শুধু ধর্মগ্রন্থগত শব্দগুচ্ছ হয়ে পড়ে থাকে। এখন মনে হচ্ছে, না, লেখকের আসলে তখন ধারণাই ছিল না চূড়ান্ত ইসলামে বীভৎসতা সম্বন্ধে। বইতে লেখা হয়েছে, জামাতিয়া বাহিনী মানুষকে গ্রেফতার করে হাত কেটে দিচ্ছে, মাথা কেটে দিচ্ছে। এখন আমরা দেখতে পেলাম, বিজ্ঞানের কথা, মানবতার কথা লেখার জন্য লেখকদেরকে রাস্তায় কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করা হলো। ইসলামিস্টদের দাবী অনুযায়ী সরকার ব্লাসফেমি আইন পাশ করলো ধর্ম নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে স্বাধীন হওয়া দেশে। সরকারের হাতে লেখদের লিস্ট ধরিয়ে দেয়া হলো। সরকার সেই লিস্ট অনুযায়ী লেখক খুঁজতে শুরু করলো ব্লাসফেমি করার জন্য। সরকার ঘোষণা দেয়, দেশ চলবে মদিনা সনদ অনুযায়ী।
ধর্মপ্রাণ মুসলিম হয়েও ইসলামি আইন মোতাবেক মানুষের হাত কাটার দৃশ্য দেখে আব্দুল হাফিজের প্রাণ কেঁদে ওঠে। কারণ, বিশ্বাসী হলেও মানুষ অত খারাপ হতে পারে না যতটা খারাপ ছিল ধর্মপ্রবর্তকেরা, যত খারাপ কথা তার রচনা করে গেছে ধর্মগ্রন্থগুলিতে।
আপাদমস্তক বস্তায় মোড়ানো এক মেয়েকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শফিউল ইসলাম বলেছিলেন, তোমাকে তো চিনলাম না। মুখ না দেখলে চিনবো কেমন করে। এজন্য তাকে কুলিয়ে কুপিয়ে ইসলামি পদ্ধতিতে হত্যা করে ইসলামিস্টরা। কোনো বিচার হয়নি। মানুষ হত্যা এখন উৎসবে পরিণত হয়েছে মদিনা সনদের দেশে। উৎসবের আবার চিবার কীসের?
যিনি ঘোষণা দিয়েছেন, দেশ চলবে মদিনা সনদ অনুযায়ী, তাঁর কাছে আমার প্রশ্ন, মদিনা সনদের দেশে কেন মানুষের হাত কেটে ফেলা হয় না? কেন মানুষকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হয় না? কেন মদিনা সনদের দেশে ইসলামের এত অবমাননা?
লেখাটা কি ফেবুতে শেয়ার করতে পারি ?
এই সব গল্প পান কোথায় দুই হাত এক পা কাটার পরও চুরি করে।
কেউ চুরি করলে নবীজি প্রথমে তাদের হাত কেটে ফেলে দিতেন। তারপর চুরি করলে পা কেটে ফেলে দিতেন। এসব গল্প নয়, ইতিহাস। হাদিস শরীফে লেখা আছে এসব ইতিহাস।
আমার ফেসবুক ওয়ালে পোস্টটি শেয়ার করতে পারি কী ? 🙂
অবশ্যই
বড় অদ্ভুত লাগছে | কেন এই তিনটি খেলাকে হালাল করা হলো ? উদ্দেশ্যটা কি ? শুধু সৈনিক তৈরী করা ? এবং নারী ধর্ষণ করা ? এছাড়া তো আর কোনো উদ্দেশ্য এইসব খেলা দিয়ে পাওয়া যায় না |
সব হালাল উদ্দেশ্য।