বাংলাদেশ সরকার এবং বিরোধী দলগুলো সব সময়ই উঁচু গলায় বলে আসছে, বাংলাদেশে কোন জঙ্গি নেই। এই দেশে সকল ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণ ভাবে সহাবস্থান করে। ধর্মের নামে এখানে কোন সন্ত্রাস হয় না। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনা ধারণ করে এদেশের নিরানব্বই ভাগ মানুষ। এক ভাগ রেখে দিয়েছি, কারণ যখনই কোন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস হয় তখনই ঐ এক ভাগের উপরে দোষ চাপিয়ে তারা দায় এড়ায়।
৭১ এর ১৬ ই ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে মোট জনসংখ্যার ২২ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। ২০১৫ তে এসে হিসেবটি দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশ তে ! প্রশ্ন হল কেন?
উত্তরটি কমবেশি সকলেই জানে। এই দেশে মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠরা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপরে দিনের পর দিন নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যেতে বাধ্য করেছে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সম্পদ দখল করা, নারীদের উপর যৌন হামলা করা, সামাজিক ভাবে হেয় করা, বাংলাদেশে বর্তমানে একটা স্বাভাবিক ঘটনার পর্যায়ে চলে এসেছে।
এই সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সেকুলার ব্লগাররা সর্ব প্রথম সোশ্যাল মিডিয়াতে লেখালিখি শুরু করে। সামাজিক সচেতনতা এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাছে এই বর্বর ঘটনাগুলো প্রকাশ করে প্রতিবাদ শুরু করে। প্রথম দিকে সরকার এবং মুসলিম মৌলবাদীরা নানা ভাবে হুমকি দিয়েও সেকুলার ব্লগারদের লেখালেখি বন্ধ করতে পারে নি। বরং দেশের সচেতন প্রজন্ম প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে। কিন্তু ২০১৩ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি সেকুলার ব্লগার রাজীব হায়দার কে হত্যা করে ইসলামিক মৌলবাদীরা প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়, তাদের অপকর্ম নিয়ে যেই প্রতিবাদ করবে তাকেই হত্যা করা হবে। তাদের ঘোষণা যে শুধুই হুমকি ছিল না তার প্রমাণ গত দুবছরে চার জন ব্লগার হত্যা ,দুইজন শিক্ষক হত্যা, মৌলবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা ছাত্র জনতা হত্যা। এবং বর্তমানে বাংলাদেশে বিদেশী নাগরিক হত্যা।

প্রশ্ন হল এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরকাররে অবস্থান কি?

সরকার জোরগলায় বলে আসছে দেশে কোন জঙ্গি নেই। বাংলাদেশে জঙ্গি নেই, সরকারের এই বিবৃতির বিরুদ্ধে খোদ পুলিশই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে দেশে জঙ্গি আছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে,

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো.শাহাজাহান বলেছেন, সর্বশেষ আমরা বারিধারা ডিওএইচএস-এর নিজ বাসা থেকে আবদুল্লাহ আল গালিব নামে আইএস-এর এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছি৷ গালিব অবসরপ্রাপ্ত একজন সেনা কর্মকর্তার ছেলে৷ তার কম্পিউটার থেকে একটি ভিডিও উদ্ধার করা হয়েছে৷ সেখানে দেখা যাচ্ছে যে, ১০ জন আইএস সদস্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছে৷ জিজ্ঞাসাবাদে গালিব ঐ ভিডিওটি কোথায় ধারণ করা হয়েছে, সে ব্যাপারে কিছু বলেনি৷ তবে আমরা ধারণা করছি এটা দেশের মধ্যেই ধারণ করা হয়েছে৷
তিনি আরও বলেন- আইএস-এ যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত ১১ জন মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল৷ এদের মধ্যে পাকিস্তানে বন্দুকযুদ্ধে দু’জন নিহত হয়৷ এরা হলো – সাখাওয়াতুল কবিরের ভায়রা শামীম আহম্মেদ ও বাতেনের ভগ্নিপতি মুহম্মদ সায়েম৷ গত ২৯শে জানুয়ারি ডিবি খিলক্ষেত ও যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে সাখাওয়াতুল কবির (৩৫), আনোয়ার হোসেন ওরফে বাতেন (৩৩), রবিউল ইসলাম (৩৫) ও নজরুল ইসলামকে (৩৩) গ্রেপ্তার করে৷ (তথ্য সূত্র -ডয়েচ ভেল, ২২শে জুন ২০১৫)

বাংলাদেশের ময়মনসিংহে ইসলামিক স্টেট আইএস এর সমর্থক হিসেবে দেয়ালে পোস্টার লাগানোর অভিযোগে এক স্কুলছাত্রকে আটক করেছে পুলিশ। (বিবিসি বাংলা, ৩ অক্টোবর , ২০১৫)
গতবছরের ২৮ সেপ্টেম্বর কমলাপুর রেলস্টেশনে সামিউন রহমান ইবনে হামদান নামে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক ব্রিটশ নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়, যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত থাকার অভিযোগে মামলাও হয়েছে। মামলায় বলা হয়েছে, ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সদস্য সংগ্রহ করে সিরিয়ায় পাঠানোর জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন হামদান। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে আল-কায়েদা নেটওয়ার্ক স্থাপন এবং বাংলাদেশে ইসলামি শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তন করাও তার উদ্দেশ্য ছিল। এ ছাড়া ইসলামিক স্টেটের জন্য অনলাইনে সদস্য সংগ্রহের অভিযোগে গত ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার পুরানা পল্টন এলাকা থেকে হিফজুর রহমান নামের ২২ বছর বয়সী আরেক জঙ্গি সদস্যকে আটক করা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে সিলেটের শাহজালাল উপ-শহর এলাকার সরকারি তিব্বিয়া কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হিফজুর, ওই সময়ই রাজধানীর সেগুনবাগিচা ও রমনা এলাকা থেকে আসিফ আদনান ও ফজলে এলাহী তানজিল আটক হন (সূত্রঃ বাংলামেইল২৪)

বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত তথ্য অনুযায়ী ১২৫ টি ইসলামিক মৌলবাদী সংগঠন আছে এবং যারা নানা ধরণের সাম্প্রদায়িক জঙ্গি তৎপরতার সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে জড়িত। ১৯৮০-এর দশকে আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধে আমেরিকা ও পাকিস্তান আফগানিস্তানকে সহায়তা করে। এই যুদ্ধে আফগানিস্তানের পক্ষে জামায়াত-শিবিরের সদস্যসহ বেশ কিছু বাংলাদেশি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এরা পাকিস্তানে আইএসআই-এর অধীনে এবং আফগানিস্তানে তালেবানদের অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। পরে এদের মধ্যে কিছুসংখ্যক বাংলাদেশি প্যালেস্টাইন ও চেচনিয়া যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিল। এরা প্রায় সবাই বাংলাদেশে ফিরে আসে। এসব যুদ্ধ ফেরত সদস্যরাই পরে বাংলাদেশে আইএসআই/তালেবান ও আলকায়েদার স্থানীয় সদস্য হিসেবে এ দেশে আইএসআই/এলইটির (লস্কর-ই-তৈয়বা) এজেন্ট হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। (তথ্য সূত্র- আবুল বারাকাত , দৈনিক ভরের ডাক, ২৯ শে মে ২০১৫)

এছাড়াও ব্লগার হত্যা সন্দেহে জড়িতদের সকলেই কোন না কোন ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। এই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সেকুলার ব্লগাররা একটা সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তাই তাদের হত্যা করে সেটা দমিয়ে দেয়া হয়েছে ।
আশ্চর্যের বিষয় হল সরকার হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং সেকুলার ব্লগারদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালো। ব্লাস্ফেমি আইন করে সেকুলার ব্লগারদের লেখালিখে বন্ধ করে দিল। তাদের গ্রেফতার করল কিংবা নানা ভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করল।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে মৌলবাদের বন্ধুত্ব গ্রহণ করে সরকারের কি লাভ হল?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে মৌলবাদের শেকড়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্তিতি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সব চেয়ে ক্ষমতাধর বাহিনীটির নাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। দেশের যে কোন পরস্তিতি তারা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে।প্রশাসনিক ভাবে তাদের কোন কর্মতৎপরতা দেখা না গেলেও দেশের সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা তারাই ভোগ করে। প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় আসার সাথে সাথেই এদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশের মত একটি দরিদ্র দেশে শুধু প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য বছরে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার খরচ করা হয় (দৈনিক প্রথম আলো-৯ই জুন২০১৪)। অথচ এই অর্থ কোথায়, কিভাবে, কেন খরচ হয় সে বিষয়ে কোন তথ্য নেই।
আগেই বলেছি বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর নিজস্ব কর্মতৎপরতা সীমিত। কিন্তু দেশে কোন ধরনের আন্দোলন সংগঠিত হলে এই বাহিনী সেই আন্দোলন কে রোধ করতে মাঠে নামে। এবং তারা তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে দেয়। তাদের বিরুদ্ধে যখনই কেউ কথা বলেছে, তারা কোন না কোন ভাবে সেই কণ্ঠ রোধ করেছে।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে আদিবাসী নেত্রী কল্পনা চাকমা কে তারা প্রকাশ্যে অপহরণ করে এবং আজ পর্যন্ত তার কোন খবর মেলেনি। পুলিশের অঙ্গ সংস্থাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদও তাদেরই দখলে। প্রকৃত অর্থে এই বাহিনীটির তেমন কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। বরং তাদের পেছনে যে অর্থ ব্যয় হয় তা দিয়ে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা সম্ভব। এখানে উল্লেখ করা জরুরী যে ব্লগাররা এই বিষয়টি নিয়েও সোচ্চার ছিল।

কিছু দিন আগে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম তার এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করে, ব্লগার হত্যায় একজন প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা জড়িত।
একজন সেনা কর্মকর্তা জড়িত অথচ গত দুবছরে আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ এই বিষয়ে কিছুই জানে না, সেটা কিভাবে সম্ভব?
যেহেতু বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগ ডিজিএফআই , বাংলাদেশ সেনা বাহিনী দাড়া পরিচালিত সেক্ষেত্রে গত দুইবছরের ব্লগার হত্যার কোন তথ্য তাদের কাছে থাকবে না, বিষয়টি অবিশ্বাস্য।
আগেই বলেছি বাংলাদেশের বাজেটের একটা বিরাট অংশই খরচ হয় সেই সেনাবাহিনীর পেছনে। একজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তার যে পরিমাণ বৈধ আয়, তাতে তার চাকরী জীবনে সরকারি বাড়ি গাড়ি থাকলেও অবসরে যাবার পরে তার যে পরিমাণ অর্থ সম্পদ থাকে সেগুলো বেতন ভাতা দিয়ে হওয়া সম্ভব না। বাংলাদেশে উচ্চপদস্থ এমন সেনা কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়া খুবই দুরুহ, যার বাড়ি গাড়ি ব্যাংক ব্যালেন্স এর পরিমাণ দশ কোটি টাকার নিচে।(না এই তথ্যটির কোন তথ্য সূত্র দিতে পারব না।কারণ এই বিষয়ে লেখার সাহস আমাদের সংবাদ মিডিয়া এখনো করতে পারেনি। তবে ডিওএইচএস গুলশান বনানীতে প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তাদের বাড়ি সম্পর্কে খোঁজ নিলে আমার কথার সত্যতা মিলবে)
এই সম্পদ কোথা থেকে আসে? তাদের বিলাসবহুল জীবন যাপনের উৎস কি ? বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোর ক্ষমতা নেই তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরণের সংবাদ প্রচার করে। বাংলদেশের একটা বেসরকারি নিউজ চ্যানেল সিএসবি, ঢাকা ভার্সিটির ছাত্রদের উপর সেনাবাহিনীর নির্যাতনের সংবাদ প্রচারের তিন দিনের মাথায়, সেই চ্যানেলটি বন্ধ করে দেয়া হয়।

এত ক্ষমতাধর একটা সংস্থার নাকের ডগায় মৌলবাদীরা একের পর এক সেকুলার ব্লগার হত্যা করে যাচ্ছে, বিদেশী নাগরিক হত্যার দায় স্বীকার করছে অথচ তাদের কোন ধরণের তৎপরতা নেই বরং এই হত্যার সাথে জড়িত সন্দেহে তাদেরই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে বিষয়টা কি একই সূত্রে গাঁথা না?
হত্যা , নিপীড়ন নির্যাতন করে সেকুলার ব্লগারদের সংখ্যাটা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে ফেলা হয়েছে। হত্যা করার মত তেমন ব্লগার নেই দেশে। যে কয়জন আছে তারাও সবাই আত্মগোপন করে আছে। কিন্তু সাধারণ জনগণ কে আতঙ্কগ্রস্থ করতে না পারলে এই মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আবারও আন্দোলন হবে, মৌলবাদ এবং এর মদদ দাতাদের মুখোশ উন্মোচিত হব।অনেক লুকানো সত্য পর্দার আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসবে। সুতরাং বিদেশী নাগরিক হত্যার নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে।
এতে সরকার, ইসলামিক মৌলবাদী সংগঠনগুলো,আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং বিরোধী দল চার পক্ষই লাভবান। মৌলবাদীরা হত্যা করুক কিংবা না করুক দায় স্বীকার করে জনগণ কে আতঙ্কিত করছে সেই সাথে প্রতিবাদের কলম বন্ধ করে দিচ্ছে, সরকার জঙ্গি নেই বলে জঙ্গিদের রক্ষা করছে, সেই সাথে হত্যাকারীদের খুঁজে শাস্তি দেবার কথা বলে জনগণের চোখে ধুলা দিচ্ছে। বিরোধী দলগুলো সরকারের উপড়ে দায় চাপিয়ে তাদের আন্দোলন এর ফুয়েল যোগাচ্ছে। আর বাংলাদেশের সব চেয়ে ক্ষমতাধর সংস্থাটি কি করছে সেটা হয়ত ভবিষ্যতে জানা যাবে, কিংবা আদৌ জানা যাবে না।