silent atheist

আজকাল খুব শুনতে পাই এই কথাটা – আপনি আপনার নাস্তিকতা নিয়ে থাকুন না ভাই। আমি আমার ধর্ম নিয়ে থাকি। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। খামাখা আপনারা ধর্মের পিছনে লেগে, তার নানা অসামঞ্জস্য খুঁজে ধার্মিকদের মনে কষ্ট দেন কেন? তারা তো আপনাদের পেছনে লাগতে যায় না! ধর্ম হলো বিশ্বাসের ব্যাপার – যে যার মত নিজের বিশ্বাস নিয়ে থাকলে ক্ষতি কি? দুনিয়াতে ধর্ম ছাড়াও আরো হাজারো সমস্যা আছে, সেইগুলা নিয়ে কথা বলেন। এটা মোটামুটি উদারপন্থী মডারেট ধার্মিকের বয়ান। তবে তার চেয়ে যারা একটু কম উদার, তারা বলেন, ভাই আপনারা ধর্ম নিয়ে লিখলে ধার্মিকেরা অনুভূতিতে আঘাত পায়। কাজেই আপনারা এইসব লেখালেখি বন্ধ করেন, নিজের নাস্তিকতা নিয়ে নিজেরা থাকেন। দেখেন নি, আগের দিনে লালন শাহ, বেগম রোকেয়া, কবি নজরুল, আরজ মাতুব্বর কিভাবে নাস্তিকতা করে গেছেন? তাদেরকে কি কেউ খারাপ বলে, কিম্বা চাপাতি নিয়ে কোপাতে যায়? তাদেরকে কেউ উগ্র নাস্তিক বলে? বলে না।

আমি অবাক হয়ে শুনি তাদের কথা। তাদের ভাষ্য মতে, আমাকে নীরব নাস্তিক হয়ে যেতে হবে, আমার নাস্তিকতা আমার ঘরের ভেতরে তুলে রেখে বাইরে থেকে তালা দিয়ে রাখতে হবে, যেন কেউ দেখতে না পায়, কিম্বা কারো অনুভূতি আহত না হয়। যারা কয়েক মিলেনিয়াম প্রাচীন ধ্যানধারণা আজকের দুনিয়ায় চর্চা করছে, তারা মসজিদে দিনে পাঁচবার আজান দিয়ে কিম্বা মন্দিরে বারো মাসে চৌদ্দ বার ঢোল পিটিয়ে সবাইকে দাওয়াত দিয়ে সে কাজ করতে পারব, আর আমি মানবজাতির প্রগতির বাহন বিজ্ঞান ও দর্শনের আলোকে সেগুলোকে ভ্রান্ত মনে করি বলে আমাকে চুপ থাকতে হবে। যে ২+২=৫ বলে বেড়াচ্ছে, এবং তা দিয়ে সমাজে নানা সমস্যা তৈরী করে বেড়াচ্ছে, সে সরবে তা বলে বেড়াবে, আর আমি ২+২=৪ বললে তাতে ওদের অনুভূতি আহত হবে। ধর্ম এবং ঈশ্বর আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে একটি ব্যর্থ অনুকল্প। দুনিয়া অনেকদুর এগিয়েছে। এখনো আমরা যদি কাউকে কুসংস্কারে আবদ্ধ দেখি, অন্ধবিশ্বাসে আবদ্ধ দেখি, প্রাচীন অতিপ্রাকৃত ভিত্তিহীন ঈশ্বরের আরাধনায় ব্যস্ত দেখি, আমি কি আমার ভাবনাগুলোকে আমার নিজের দেয়ালে, নিজের পাতায়, নিজের আকাশেও প্রকাশ করতে পারব না?

কেউ কেউ বলবেন, ধর্মকে আহত না করে কিম্বা ধার্মিকদেরকে আহত না করে আপনাদের মতগুলো প্রকাশ করুন। কিন্তু যখন দেখি এই সব অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কার মানুষের জীবনকে, সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং সহিংসতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তখনো কি আমরা চুপ থাকব? ওরা যখন বাহাত্তুরের সেক্যুলার বাংলাদেশকে, কিম্বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটা প্রধান স্তম্ভ – ধর্মনিরপেক্ষতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে ধর্মভিত্তিক তথা চাপাতিভিত্তিক রিপাবলিক বানিয়ে ফেলবে, তখন আমরা তাতে বাধা দেব না? ওরা যখন সভ্যতার সূতিকাগার টাইগ্রীস-ইউফেটিস বিধৌত মেসোপটেমিয়াকে হাবিয়া দোজখ বানিয়ে ফেলবে কল্পিত মহাজনের নামে, তখনো কি আমরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকব? ধর্মের কারণে ওসামা বিন লাদেন আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেন, বাংলাদেশে মসজিদ-মন্দির-প্যাগোডা ভাঙা হয়, ব্লগারদেরকে হত্যা করা হচ্ছে দিনের আলোতে, তারপরেও আমরা, সত্য জানা সত্বেও, চুপ করে থাকব? নিজের ভাবনাগুলো নিজের মাথায় আবদ্ধ করে রেখে ‘ভদ্র’ নাস্তিকের তকমা জুটাব? ধর্মবিশ্বাসের কারণে আজ জার্মানীতে এক পাকিস্তানী বাবা তার উনিশ বছরের মেয়েকে হত্যা করেছে, কারণ সে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছিল। ধর্মবিশ্বাসের কারণে ব্রিটেনের বা অস্ট্রেলিয়ার তরুণ মুসলমান ছেলেরা সিরিয়ায় জঙ্গীবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে। ধর্মবিশ্বাসের কারণে কর্ণাটকে মুক্তচিন্তক ও গবেষক অধ্যাপক কুলবার্গি খুন হয়ে যান, খুন হয়ে যান ভাষাতত্ববিদ সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ। ধর্মবিশ্বাসের কারণে বাংলাদেশের তরুন নাফিস নিউইয়র্কে বোমা হাতে ধরা পড়ে। ধর্মবিশ্বাসের কারণে বাংলার হাজারো মানুষ হজ্জ্বের নামে সৌদী রাজতন্ত্রকে সোনার মার্সিডিজ কেনার তহবিল যোগান দিয়ে যাচ্ছে। কল্পিত এক ডেভিলকে পাথর ছুঁড়ে মারতে গিয়ে সহযাত্রীদের পদতলে পিষ্ট হয়ে মরছে হাজারে হাজারে। ধর্মের নামে ময়মনসিংহে-এলাহাবাদে জাকাত/পূণ্যের আশায় মানুষেরা একে-অপরকে পদদলিত করে, প্রাচীন দেবতাদের পীঠস্থান কাবায় পদদলিত হয়ে মরে হাজারে হাজার মানুষ। ধর্মবিশ্বাসের কারণে পাকিস্তানে আফগানিস্তানে মেয়েরা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, বঞ্চিত হয় জীবনের নানা অধিকার থেকে। ধর্মবিশ্বাসের কারণে দাউদ/তসলিমা/আসিফ দেশছাড়া, দেশছাড়া মরিয়ম নামাজী কিম্বা সালমান রুশদী। তবুও এই ভুল বিশ্বাসের বিশ্বাসীরা জনসমক্ষে তাদের বিশ্বাসের চর্চা করে যাবে, আর সচেতন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষেরা তাদের ভাবনাকে সিন্দুকে পুরে রাখবে?

নীরব ভাবনা আর নীরব কবিত্ব, এই দুই বস্তুই আমার দৃষ্টিতে সমান অর্থহীন। নীরবে ভাবনা ভাবার চেয়ে বরং না ভাবাটাই ভালো। যদিও সরাসরি প্রাসঙ্গিক নয়, তবুও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরণাপন্ন হবার লোভ সামলাতে পারছি না। সাহিত্যের সামগ্রী প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, “নীরব কবিত্ব এবং আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাস, সাহিত্যে এই দুটো বাজে কথা কোনো কোনো মহলে চলিত আছে। যে কাঠ জ্বলে নাই তাহাকে আগুন নাম দেওয়াও যেমন, যে মানুষ আকাশের দিকে তাকাইয়া আকাশেরই মতো নীরব হইয়া থাকে তাহাকেও কবি বলা সেইরূপ। প্রকাশই কবিত্ব, মনের তলার মধ্যে কী আছে বা না আছে তাহা আলোচনা করিয়া বাহিরের লোকের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। কথায় বলে ‘মিষ্টান্ন মিতরে জনাঃ’; ভাণ্ডারে কী জমা আছে তাহা আন্দাজে হিসাব করিয়া বাহিরের লোকের কোনো সুখ নাই, তাহাদের পক্ষে মিষ্টান্নটা হাতে হাতে পাওয়া আবশ্যক।

জগতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোক আপনার যে কথাগুলিকে চিরকালের শ্রুতিগোচর করিতে চাহিয়াছিলেন তাহাদিগকে তিনি পাহাড়ের গায়ে খুদিয়া দিয়াছিলেন। ভাবিয়াছিলেন, পাহাড় কোনোকালে মরিবে না, সরিবে না; অনন্ত কালের পথের ধারে অচল হইয়া দাঁড়াইয়া নব নব যুগের পথিকদের কাছে এক কথা চিরদিন ধরিয়া আবৃত্তি করিতে থাকিবে। পাহাড়কে তিনি কথা কহিবার ভার দিয়াছিলেন।পাহাড় কালাকালের কোনো বিচার না করিয়া তাঁহার ভাষা বহন করিয়া আসিয়াছে। কোথায় অশোক, কোথায় পাটলিপুত্র, কোথায় ধর্মজাগ্রত ভারতবর্ষের সেই গৌরবের দিন! কিন্তু পাহাড় সেদিনকার সেই কথা-কয়টি বিস্মৃত অক্ষরে অপ্রচলিত ভাষায় আজও উচ্চারণ করিতেছে। রাজচক্রবর্তী অশোকের ইচ্ছা এত শতাব্দী পরে একটি বিদেশীর সাহায্যে সার্থকতা লাভ করিল (এক বিদেশী অশোকলিপির পাঠোদ্ধার করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ সে দিকে ইঙ্গিত করেছেন)। সে ইচ্ছা আর কিছুই নহে, তিনি যত বড়ো সম্রাটই হউন, তিনি কী চান কী না চান, তাঁহার কাছে কোন্‌টা ভালো কোন্‌টা মন্দ, তাহা পথের পথিককেও জানাইতে হইবে। তাঁহার মনের ভাব এত যুগ ধরিয়া সকল মানুষের মনের আশ্রয় চাহিয়া পথপ্রান্তে দাঁড়াইয়া আছে। রাজচক্রবর্তীর সেই একাগ্র আকাঙ্ক্ষার দিকে পথের লোক কেহ বা চাহিতেছে, কেহ বা না চাহিয়া চলিয়া যাইতেছে।”

নবী হেরা গুহা থেকে বেরিয়ে এসে তার ধর্ম মানুষের মাঝে প্রচার করেছিলেন কেন? এটা তো তিনি নিজের মধ্যে রাখলেই পারতেন। মুসা ফেরাউনের পালিত পুত্র হয়ে সারাজীবন বিলাসী জীবন কাটাতে কাটাতে মদের আখড়ায় মিশরের ইহুদী দাসদের জন্য কপট অশ্রুপাত করলেও পারতেন, সরাসরি ফেরাউনের বিরোধিতা না করে। ঈসা ভেবেছিলেন ইহুদীরা আসল পথ থেকে সরে গেছে, তাই তাদেরকে সুপথে ফেরানোর জন্য তিনি সরব হলেন, পথে নেমে কথা বলা শুরু করলেন। নীরব রিসালাত বলে কি কিছু হয় আদতে? মোহাম্মদ যদি নীরবই থাকতেন আর নিজের জীবন নিজের মত কাটিয়ে পরপারে গমন করতেন, তাহলে কি আর আমরা আজকে এই বঙ্গীয় বদ্বীপে বসে কোরানের তোতাপাখি-তেলাওয়াত করতাম? [তোতাপাখি-তেলাওয়াতঃ ইকরা দিয়ে কোরানের শুরু, যার অর্থ পড়া। পড়া মানে স্রেফ আবৃতি নয়, পড়া – অর্থাৎ লিখিত অক্ষরের পাঠোদ্ধার করা। পড়া মানেই বুঝা, না বুঝে কখনো পড়া যায় না, না বুঝে শুধু উচ্চারণ করা যায়। পড়া ক্রিয়াপদের মধ্যেই ‘পড়ে পাঠোদ্ধার করা কিম্বা অনুধাবন করা’ এই ক্রিয়াগুলো লুকিয়ে আছে। অন্যথায় আমার গ্রেড-টু’তে পড়া ছেলে এবিসিডি জানার সুবাদে শেক্সপীয়র মিলটন পড়ে ফেলতে পারে। যাই হোক, এমনকি শিক্ষিত মডারেট ধার্মিকেরাও ‘বুঝে হোক না বুঝে হোক, কোরানের বাণী উচ্চারণ করলেই পূণ্যলাভ হয়’ বলে বিশ্বাস করেন। আমি এই পড়ার নাম দিয়েছি তোতাপাখি-তেলাওয়াত। এদের জন্যই শিখা গোষ্ঠীর আবুল হুসেন ‘আদেশের নিগ্রহ’ প্রবন্ধে বলেন, ‘কোরআন শরিফ পাঠ (তেলাওয়াত) করার হুকুম আজ যেরূপভাবে পালন করা হচ্ছে, তাতে মনে হয়, তেলাওয়াত বন্ধ করে দিলেই মন ও মস্তিষ্কের পক্ষে পরম মঙ্গলকর হবে। সকালে মসজিদের মধ্যে কেরাত করে দলে দলে এক বর্ণও না বুঝে শুধু সওয়াবের লোভে যারা তেলাওয়াত করে, তাদের বুদ্ধি যে সিঁকেয় তোলা থাকে তা বলাই বাহুল্য। এই হুকুমের নিগ্রহ প্রকাশ পায় ওই সব তেলাওয়াতকারীর মূর্খতা ও অজ্ঞতার ভিতর দিয়ে।’]

রাজা রামমোহন রায় বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যদি চুপ থাকতেন, আজও ভারতবর্ষে ধর্মের নামে অনেক জীবন ধ্বংস হতো। তাদের আগে ও পরে আরো অনেকে নিশ্চয়ই তাদের মতো করে ভাবতেন, অথচ সমাজের ভয়ে অথবা অন্য কিছুর ভয়ে নীরব ছিলেন। কি লাভ হয়েছে সেই নীরবতায়? যদি আরো কিছু রামমোহন/বিদ্যাসাগর পেত ভারতবর্ষ, আজকে আমরা সেখানে হয়তো পেতাম এক যুক্তিনির্ভর বিজ্জানমনস্ক ধর্মনিরপেক্ষ কুসংস্কারহীন আলোকিত সমাজ। প্রাচীন গ্রীক কবি ইউরিপিডিস (৪৮০-৪০৬ খ্রীঃ পূঃ) সে জন্যই সম্ভবতঃ বলেছিলেন, ‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল।’ যুগে যুগে নানা চিন্তার মধ্য দিয়েই মানব সমাজ এগিয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাঙলার সমাজে মুক্তবুদ্ধির চর্চা দেশভাগের আগে যতটুকু হয়েছিল, পাকিস্তানে তা পাক-সাফ জমিনে এসে বরবাদ হয়ে যায়, এবং স্বাধীনতার পরেও নানা অপশাসনের আমলে আর হালে পানি পায় নি। শিখা গোষ্ঠী যা করেছিল সেই তিরিশের দশকে, গত শতকের শেষ দশকে তসলিমা নাসরীন বা হুমায়ুন আজাদের ধাক্কা এবং বর্তমান শতকের শূন্য দশকে মুক্তমনার আবির্ভাবের আগে আর কেউই সে কাজে হাত দেয় নি। ফলে আমাদের ভাবনাগুলো ধর্মীয় বিশ্বাসধারীদের কাছে এত অচেনা লাগছে যে, তার প্রতিক্রিয়াটাও হচ্ছে সহিংস। বাঙালি মুসলমান মুক্তবুদ্ধির চর্চা থেকে বিচ্ছিন্ন আজ অনেক দশক ধরে।

বাংলাদেশের মুসলমানেরা আজ আমাদেরকে লালনের মত কিম্বা কাজী নজরুলের মত মুক্তচিন্তা করতে বলেন। আমার ধারণা, তারা জানেন না লালন আর নজরুল আসলে কি বলে গেছেন। নজরুলের অনেক কবিতা/প্রবন্ধ কিম্বা লালনের গান ফেসবুকে বা লিখিত আকারে প্রকাশ করলে চাপাতিওয়ালারা দৌড়ে আসবে হুরী ও মদের নদীর লোভে। তাছাড়া, হুমায়ুন আজাদ তো ভবিষ্যদ্বাণী করেই গেছেন, বাঙালি মুসলমান জীবিত প্রতিভাকে লাশে পরিনত করে, আর মৃত প্রতিভার কবরে আগরবাতি জ্বালে। তারা হুমায়ুন আজাদ-অভিজিতকে চাপাতির কোপ দেয়, আর লালন-রোকেয়া-নজরুলের নামে কপট জিকির করে, যদিও লালন-নজরুল-রোকেয়া তাদের জীবদ্দশাতেই প্রবল বাধা ও আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন তাদের আশেপাশের মানুষের কাছ থেকে। তারা যা লিখে গেছেন, তা আজ আমাদের জন্য আলোর মশাল হয়ে আছে। তারা সেই ভাবনাগুলোকে ঘরে আটকে রাখলে আমরা এবং আমাদের প্রগতির আন্দোলন কি বঞ্চিত হতো না?

১৯২৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য-সমাজ ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’ এই বাণীকে সামনে রেখে যে শিখা পত্রিকা চালু করলেন, তাতে তারা সত্যসত্যই মুক্তভাবে জ্ঞানের এবং ধর্মশাস্ত্রের চর্চা করেছেন। তাদের কেউ নাস্তিক কুখ্যাতি পেয়েছিলেন কি না, জানিনা, তবে আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী আব্দুল ওদুদ, মোতাহের হোসেন চৌধুরী প্রমূখেরা ধর্মের নানা সমালোচনা করেছেন, তার সংস্কার চেয়েছেন, তার নতুন ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন। ‘শিখা’ পত্রিকাটি তাদের এসব ভাবনার বাহন ছিল। সেকালে আজকের মতন ব্লগ/সোশ্যাল মিডিয়া থাকলে তারাও হয়তোবা ডিজিটাল জগতে লিখতেন। সে সময় অবিভক্ত বাংলার সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশ ছিল পূর্ব বাংলা এবং তার প্রধান শহর ছিল ঢাকা। এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিলেন মুসলমান যাদের সামগ্রিক সামাজিক পরিমন্ডল ছিল শাস্ত্র ও সংস্কারের অচলায়তনে আবদ্ধ। মুসলিম সাহিত্য-সমাজের দ্বিতীয় বর্ষের কার্য বিবরণীতে পাওয়া যায়ঃ “আমরা চাই সমাজের চিন্তাধারাকে কুটিল ও পঙ্কিল পথ হইতে ফিরাইয়া প্রেম ও সৌন্দর্য্যের সহজ সত্য পথে চালিত করিয়া আমাদের দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে। এক কথা আমরা বুদ্ধিকে মুক্ত রাখিয়া প্রশান্ত জ্ঞানদৃষ্টি দ্বারা বস্তু জগত ও ভাবজগতের ব্যাপারাদি প্রত্যক্ষ ও করিতে ও করাইতে চাই।” মুসলিম সাহিত্য সমাজের লক্ষ্য ছিল ধর্ম ও ধর্ম প্রভাবিত মুসলমান সমাজকে বৈজ্ঞানিক যুক্তির পাটাতনের উপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া।

এখানে ‘দায়িত্ববোধের পরিচয়’ শব্দবন্ধটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তারা ঘরে বসে আলাপ করে বিদ্বানসুলভ তৃপ্তির ঢেকুর তুললেই পারতেন, ঘরোয়া আড্ডায় ধর্মের অসারতা আলাপ করে বাইরে এসে মডারেট ধার্মিক হয়ে ধর্মের মোহাচ্ছন্ন সমাজের বাহবা কুড়াতে পারতেন। আমার আশেপাশের মডারেট খিচুড়ী ধার্মিকেরা আমাকে তেমন পরামর্শই দেন হরদম। তারা আমাকে শোনান ‘লাকুম দ্বীনুকুম’ এর বাণী, যেন ধার্মিকেরা সহিষ্ণুতার অবতার! কিন্তু শিখা গোষ্ঠীর সদস্যরা তা করেন নি। নিজের সমাজ পরিবেশ এবং নিজের কালের রাজনীতিসচেতন কোন মানুষই তা করতে পারেন না। ফলে তারা মানুষের সমালোচনার ভয়ে কুঁকড়ে থাকেন নি, বরং ওভাবে আবদ্ধ হয়ে থাকাটাকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করেছেন। সেই তিরিশের দশকে ঢাকায় বসে তারা কি লিখতেন, তার কিছু নমুনা দিচ্ছি। আপনাদের গা শিউরে উঠতে পারে তাদের সাহস আর বক্তব্যের তীক্ষ্ণতা দেখলে, নিশ্চিত করে বলতে পারি।

সাহিত্যে মুসলমান প্রবন্ধে আবুল হুসেন লিখছেন, “রুশোর একটা কথা আজ মনে পড়ছে, “মানুষ তার স্বাধীনতা না চাইলেও জোর করে তা তাকে দিতে হবে”। আজ মুসলমান তার নিজের ত্রুটি বুঝতে পারছে না, তাকে তা জোর করে বুঝাতে হবে। কিন্তু গালি দিয়ে নয়, তাদের মর্মে ঘা দিয়ে নয়, দরদ দিয়ে।”

আদেশের নিগ্রহ প্রবন্ধে আবুল হুসেন বলছেন, “মানুষ মাত্রেরই একটা না একটা ধর্ম-বিশ্বাস আছে; অর্থাৎ মানুষ মাত্রই কোন না কোন ধর্মগুরুর আদেশ মেনে চলে। তার বিশ্বাস, সেই ধর্মগুরু বিধাতার প্রেরিত শ্রেষ্ঠ পুরুষ, তাঁর খাস উপকরণ দিয়ে তৈরী, এবং সাধারণ মানুষ ঢের নিকৃষ্ট উপকরণে গঠিত। এই ধর্ম-বিশ্বাস আদিম মানব প্রকৃতির একটি প্রধান লক্ষণ। ভয়, দুর্বলতা ও অজ্ঞতা, এই তিনটি মনোভাব এই ধর্ম-বিশ্বাসের জননী। যে জাতি, অর্থাৎ যে জাতির মন এখনও ন্যাংটা বর্বর যুগের কাছাকাছি প’ড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে, সে জাতির ভয়, দুর্বলতা ও অজ্ঞতা তত বেশী, সুতরাং তার ধর্মবিশ্বাসও তত প্রগাঢ়, অর্থাৎ ধর্মগুরুর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালনে সে তত ততপর এই ভয়ে যে, পাছে তার কোন অনিষ্ট ঘটে কিম্বা তার ধর্মগুরু প্রদর্শিত পরলোকে দুর্গতি হয়। এক কথায়, যে জাতি যত আদিম প্রকৃতি বিশিষ্ট, সে জাতি তত অনুষ্ঠানপ্রিয়। এইখানে অনুষ্ঠান অর্থে আমি ধর্মানুষ্ঠান মনে করছি। **** দেশ-কালের প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য যে ধর্মবিধিসমূহ সৃষ্ট হয়েছিল, তা কখনো সনাতন (সার্বজনীন) হতে পারে না। সে বিধি-বিধান কালের পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তন লাভ করতে বাধ্য, নতুবা এই পরিবর্তনশীল মানবের নব নব প্রয়োজন তাতে মিটতে পারে না। মানুষ তার প্রয়োজন চিরদিন বেঁধে সীমাবদ্ধ করে রাখতে পারে না। কাজেই, যে যুগে যে প্রয়োজন নির্ধারিত করতে যে ধর্মোপদেশ প্রচারিত হয়েছিল, সেই ধর্মাদেশ পরবর্তী পরিবর্তিত নব প্রয়োজন সিদ্ধ করতে পারে না, যদি না সেই ধর্মাদেশ ত্যাগ করা হয় কিংবা নূতন করে তার ভিন্ন অর্থ দেওয়া হয়। এই ত্যাগ করতে কিংবা নূতন অর্থ দিতে যে ধর্মভীরু জাতি অপারগ বা শংকিত, সে জাতি দুনিয়ার পরিবর্তনে কোন সাড়া দিতে পারে না।”

১৯২৮ সালে তৎকালীন রক্ষনশীল মুসলিম সমাজে এই লেখার বেশ কড়া প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ঢাকার শিক্ষিত মুসলমান সমাজে চরম বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে এবং তারা আবুল হুসেনকে ইসলামের শত্রুরুপে আখ্যায়িত করে। আহসান মঞ্জিলের এক সালিসিতে উপস্থিত হয়ে তাঁকে লিখিত ভাবে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়। রোমান ধর্ম আদালতের সামনে গ্যালিলিওর স্বীকারোক্তির কথা মনে করিয়ে দেয় এ ঘটনা। নিজের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গিয়ে এ নতিস্বীকারকে আবুল হুসেন নিজের নৈতিক পরাজয় বলে মনে করেছেন। বিবেকের এই গ্লানিবোধের কারণে তিনি নিজেকে আর সম্পাদক পদে উপযুক্ত মনে করেননি। পরদিনই সাহিত্য সমাজের সম্পাদকের পদ ত্যাগ করেন। এ উপলক্ষে লেখা পদত্যাগপত্রে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি আদেশের নিগ্রহ নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছে তাতে আমি এটুকু বুঝতে পেরেছি যে, সমাজের প্রকৃত কল্যাণাকাঙ্খী দার্শনিকের কথায় কেউ কর্ণপাত করবে না, বরং তার কথার উল্টা অর্থ করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করবে।

সংস্কৃতি কথায় মোতাহের হোসেন চৌধুরীর বক্তব্য, “ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম। কালচার মানে উন্ননতর জীবন সম্বন্ধে চেতনা – সৌন্দর্য আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি।”

ব্যক্তি ও রাষ্ট্র প্রবন্ধে মোতাহের হোসেন চৌধুরী লিখছেন, “ ব্যক্তি ও সমাজের দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে একটি কথা মনে রাখলেঃ সত্য এক নয়, বহু; আর বহু সত্যের সামঞ্জস্য বিধানেই জীবনের চরমোতকর্ষ। A truth-কে The truth তথা একটি সত্যকে একমাত্র সত্যে পরিণত করার মূল প্রবৃত্তি থেকে যে শোচনীয় মানসিকতার সূত্রপাত হয়, তা আমরা জানি।”

মুসলমানের পরিচয় প্রবন্ধে কাজী আব্দুল ওদুদঃ “ইসলামের পরিস্ফুর্তির মূলে এই যে বিশেষ রাজনৈতিক প্রভাব, একই সঙ্গে এটি ইসলামের শক্তির ও দুর্বলতার কারণ হয়েছে। শক্তির কারণ এই জন্য যে, ধর্মাদর্শের সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপলাভ তার সার্থকতার জন্য একান্ত বাঞ্ছিত, নইলে তা রয়ে যায় শুধু সম্ভাব্যতার দেশের ব্যাপার। এর দৃষ্টান্ত, ইসলামের সাম্য-নীতি। অন্যান্য ধর্মাচার্যও সাম্যনীতি প্রচার করেছিলেন, কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপের অভাবে তা রয়ে গেছে শুধু শুভ ইচ্ছা। আর দুর্বলতার কারণ এই জন্য যে, ধর্মাদর্শের কোন বিশেষ রুপই তার চরম রুপ নয়; আদর্শের বিকাশ আছে, তার রুপেরও বিকাশ আছে; কিন্তু ধর্মাদর্শ সাধারণতঃ কঠিন দেহ – কোন ধর্মাদর্শ যদি একবার কোন সামাজিক ও রাজনৈতিক রুপ লাভ করে, তবে তারও রূপান্তর সহজসাধ্য হয় না। এর দৃষ্টান্তঃ বিপখের সাথে মুসলমানের সম্পর্ক। সে ক্ষেত্রে একবার যে তলোয়ারের সম্বন্ধ বড় হয়েছিল, তারপর সে তলোয়ারকে কোষবদ্ধ করা দুঃসাধ্য হচ্ছে, যদিও হযরত মোহাম্মদের বহু কর্মে ও কোরানে বিপক্ষের সঙ্গে প্রীতি অগ্রগণ্য হয়েছে, এবং মুসলমান সভ্যতায় মাঝে মাঝে এর মনোজ্ঞ প্রকাশও হয়েছে।”

১৬৫৬ সালে ২৪ বছর বয়সী স্পিনোজাকে সমাজের ধর্মীয় নেতারা স্থানীয় উপাসনালয়ে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন: শুনেছি তুমি ধর্মদ্রোহী হয়ে গেছ। তোমার বন্ধুদের কাছে ধর্মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাজে কথা বলছ। স্পিনোজার উত্তর কি ছিল আমরা জানি না, তবে এটা জানা গেছে যে, নেতারা তাকে প্রস্তাব দেন, ‘মানুষকে দেখানোর জন্যে হলেও যদি তুমি ধর্মের প্রতি অনুরক্ত থাক, তবে তোমাকে বছরে ৫০০ মুদ্রা দেয়া হবে’। স্পিনোজা তাতে রাজী হননি। ফলে তাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একঘরে করা হয়েছিল। ভাগ্যিস তাকে শুলে চড়ানো হয়নি সেদিন, এবং স্পিনোজাও তার ভাবনার জন্য লজ্জিত বা কুণ্ঠিত না হয়ে কিম্বা নীরব না থেকে বরং আমাদের জন্য সব রেখে গেছেন তার সৃষ্টিগুলো, অন্যথায় স্পিনোজার ভাবনার মনি-মুক্তো থেকে পৃথিবী বঞ্চিত হতো।

কথা হচ্ছিল নীরব নাস্তিকতা নিয়ে। নাস্তিক কে, সেই প্রশ্নে হুমায়ুন আজাদের কাছে ফিরে আসি। তিনি লিখছেন, “মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায় আসে না; যায় আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে। মসজিদ ভাঙে ধার্মিকেরা, মন্দিরও ভাঙে ধার্মিকেরা, তারপরও তারা দাবি করে তারা ধার্মিক, আর যারা ভাঙাভাঙিতে নেই তারা অধার্মিক বা নাস্তিক”। একজন ধার্মিকের কাছে তার নিজের ধর্ম বিশ্বাসই আসল, এবং কোন রকম সন্দেহ ছাড়াই এটি একমাত্র সত্যতার দাবী করে। তার কাছে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্ম বিশ্বাস শুধু ভ্রান্তই নয় বরং হাস্যকর। অপরদিকে নাস্তিকের সাথে ধার্মিকের পার্থক্য এই যে, নাস্তিক কোন ধরনের ধর্মবিশ্বাসে আবদ্ধ নয়। তার কাছে সকল ধর্মই সমানভাবে অগুরুত্বপুর্ণ, ভ্রান্ত ও হাস্যকর। একজন ধার্মিক যে কারণে বাকী ৯৯৯টি ঈশ্বরকে ভ্রান্ত মনে করেন, একজন নাস্তিকও সম্ভবতঃ সেই কারণে হাজার ঈশ্বরের সবগুলিকেই সেই একই কাতারে ফেলেন। মজার ব্যাপার হলো, একজন ধার্মিকের কাছে অন্য ধর্মের অস্তিত্ব যতটা না প্রশ্নের সম্মুখীন, একজনের কোন ধর্মে বিশ্বাস না থাকাটা তার চেয়েও বেশী প্রশ্নবোধক, যদিও নাস্তিক ধার্মিকের সেই কল্পিত ঈশ্বরের বিপরীতে নিজের কোন ঈশ্বর দাঁড় করায় না। আমরা জানি, ধর্মগুলো একটা আরেকটাকে সহ্য করতে পারে না, কিন্ত নাস্তিককে তাদের কেউই সহ্য করে না, কারণ নাস্তিক তাদের অতি প্রাচীন লাভজনক ব্যবসার গোমর ফাঁস করে দিতে চায়। ফলে ইহুদী-খ্রীষ্টান একে অপরের সাথে মারামারি করলেও নাস্তিকের সাথে লড়াই করার সময় তারা হাত মেলায়। একই ঘটনা বাকী সব ধর্মের বেলাতেও। সোশ্যাল মিডিয়াতে ঈশ্বর নিয়ে কথা বলার সময় হিন্দু আস্তিক নাস্তিককে থামিয়ে দিতে চায়, মুসলিম আস্তিকও তাইই চায়, যদিও একজন হিন্দু মুসলমানের ঈশ্বরকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে, এবং একজন মুসলমান হিন্দুর ঈশ্বরকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই কথাটা এখানে বেশ প্রযোজ্য।

হুমায়ুন আজাদ আরো বলছেন, ‘শোনা যায় পুরোনো কালে ঘটতো নানা অলৌকিক ঘটনা, তবে পুরোনো কালের অলৌকিক ঘটনাগুলো বানানো বা ভোজবাজি। প্রকৃত অলৌকিক ঘটনার কাল হচ্ছে বিশশতক। পুরোনো কালের কোনো মুসা/মোজেস লাঠিকে সাপ বানাতে, বা সমুদ্রের উপর সড়ক তৈরি করতে পারতেন- ক্ষণিকের জন্যে। ওগুলো নিম্নমানের যাদু। সত্য স্থায়ী অলৌকিকতা সৃষ্টি করতে পেরেছে শুধু বিশ শতকের বিজ্ঞান। বিদুৎ, বিমান, টেলিভিশন, কম্পিউটার, নভোযান, এমনকি সামান্য শেলাইকলটিও অতীতের যে-কোনো অলৌকিক ঘটনার চেয়ে অনেক বেশি অলৌকিক। বিজ্ঞান অলৌকিকতাকে সত্যে পরিণত করেছে ব’লে গাধাও তাতে বিষ্মিত হয় না, কিন্তু পুরোনো তুচ্ছ অলৌকিকতার কথায় সবাই বিহ্বল হয়ে ওঠে। পুরোনো কালের মানুষ যদি দৈবাৎ একটি টেলিভিশনের সামনে এসে পড়তো, তাহলে তাকে দেবতা মনে ক’রে পুজো করতো। আজো সেই পুজো চলতো। ধর্মগুলো বিশ্বাসের নাম করে অপবিশ্বাসের চর্চা করিয়ে নিচ্ছে একুশ শতকের বিজ্ঞানের ছোঁয়া পাওয়া মানবজাতিকে, যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। ধর্মের কাজ মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা; তাই এক ধার্মিকের রক্তে সব সময়ই গোপনে শানানো হ’তে থাকে অন্য ধার্মিককে জবাই করার ছুরিকা। ধার্মিক কখনোই সম্পুর্ন মানুষ নয়, অনেক সময় মানুষই নয়।’

ফলে আমাদের আর বুঝতে বাকী থাকে না যে, নাস্তিককে কেন সরব হতে হবে। কেন বাঙলার ধার্মিকেরা, বিশেষকরে মুসলমানেরা, নাস্তিকদেরকে নীরব হয়ে নাস্তিকতা চর্চা করতে বলে। কারণ একটাই, নাস্তিকদের লেখালেখিতে তাদের দীর্ঘদিনের প্রাচীন বিশ্বাসে চীড় ধরে গেছে। এই নাস্তিকেরা নতুন দিনের নাস্তিক – তারা আরজ আলী মাতুব্বরের মত একটি লেখা প্রকাশের জন্য বহুদূরে অবস্থিত শহুরে গুণগ্রাহীদের উপরে নির্ভরশীল নয়, তারা লালনের মত মনের কথা সরাসরি বলতে না পেরে সুফী গান আর দেহতত্বের রুপকের আশ্রয় নিতে চায় না। তারা ইন্টারনেট নামক মুসার লাঠির সাহায্যে যাদুবলে মাউসের এক ক্লিকে পৌঁছে যাচ্ছে লক্ষ পাঠকের মোবাইল আর ল্যাপটপের স্ক্রীনে, কিম্বা ক্লাউডে। জুকারবার্গের মোজেজায় তারা শহরে-গ্রামে অসংখ্য অনুসন্ধানী তরুণ মনকে প্রশ্ন করতে শেখাচ্ছে। তাদের বই বাজারে ব্যান করেও পাঠকের কাছে পৌঁছানো থামানো যাচ্ছে না, থামানো যাচ্ছে না কারফিউ কিম্বা ৫৭ ধারা দিয়ে। হুমায়ুন আজাদ মরেই যেন প্রমাণ করলেন, বাংলায় একুশ শতকের বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব তিনিই – তিনিই উস্কে দিয়েছেন অসংখ্য অভিজিত, আসিফ, তসলিমা, সবাক কিম্বা সন্যাসী রতনকে। তিনিই নতুন জীবন দিয়েছেন নজরুল-লালন-আরজকে, কিম্বা সনাতন ভারতীর নাস্তিক্যবাদী দর্শনকে। ধার্মিকদের বানানো বিষবৃক্ষের পতন ঘটিয়ে সেক্যুলার এবং বিজ্ঞানভিত্তিক আলোকিত সমাজ গড়ায় নাস্তিকদের এই সরবতা খুবই জরুরী। অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে সমাজ বদলানো যায় না, আর নীরব থেকে অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া সম্ভব নয়।

অধ্যাপক আহমেদ শরীফ তার ‘নাস্তিকের ধর্মচিন্তা’ প্রবন্ধে বলেন, ‘নাস্তিক শব্দের ব্যুতপত্তিগত অর্থ হচ্ছে, যে বা যারা ‘বেদের অপৌরুষেয়তায় আস্থাহীন’, অর্থাৎ বেদকে আসমানী বাণীরূপে মানেন না, তারাই নাস্তিক। এখন শব্দটি অর্থান্তর লাভ করেছে। এখন নিরীশ্বরবাদীকেই নাস্তিক বলা হয়; যারা নাস্তিক তারা শাস্ত্রের সত্যতায় আস্থা রাখেন না।’ তাদের মতে ঈশ্বর যদি এক এবং চিরন্তন হোন, তাহলে তিনি জনবহুল ইউরোপ-আফ্রিকা-দুই আমেরিকা-চীন-জাপান-অস্ট্রেলিয়া-নিউগিনিতে নবী-অবতার পাঠাননি কেন, কেবল পুরনো কেনান তথা আধুনিক ইজরায়েল থেকে সুয়েজ অবধি একটা বিরল বসতি অঞ্চলে এবং ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যেই লাখখানেক বা ততোধিক নবী কেন পাঠালেন? অন্তর্যামী সবজান্তা ঈশ্বর কেন কালে কালে স্থানে স্থানে স্ববিরোধী বিপরীতমূখী বাণী পাঠাবেন মানুষের মধ্যে বিরোধ-বিবাদ-বিচ্ছেদ এবং নিত্যকালের সংঘাত ঘতানোর জন্য? ঈশ্বরেরা আসলে অজ্ঞ মানুষের কল্পনাপ্রসূত বলেই কি এমন?’

ধর্মগুলো সারা দুনিয়াতেই আজ মানুষের ব্যক্তিগত ঘরে ঢুকে পড়েছে, রাষ্ট্র ও অর্থনীতি থেকে বিদায় নিয়ে। ইস্টিশন ব্লগে পৃথু সান্যাল ‘নাস্তিকেরা কেন ইসলাম বিদ্বেষী?’ শিরোনামে লিখছেন, ‘সারা বিশ্বেই আজকাল ধর্মের সমালোচনা করাটা একটা স্বাভাবিক ব্যপার হয়ে গেছে। এই ধর্মবিষয়ক সমালোচনা থেকে কোন ধর্মই রেহাই পাচ্ছে না। পাশ্চাত্যে কিংবা অন্যান্য দেশে যীশু খ্রীস্ট, মাতা মেরি, নান ও পাদ্রিদেরকে হাস্যরসাত্মক ভাবে উপস্থাপন একটা মামুলী ব্যপার। খ্রীস্টান ধর্মের এই বিষয়গুলোর হাজার হাজার কার্টুন নেটে পাওয়া যায়। আবার নান, মেরিকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে ব্যবহার করে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন নির্মান একটা সাধারণ ব্যপার। মজার বিষয় হলো, এই সব ধর্ম ব্যঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করে বলে জানা যায়নি। বরং ধর্মের এসব কটুক্তি বা ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনাকে কমবেশি সবাই উপভোগ করে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে হিন্দু ধর্মের উদ্ভব ঘটলেও সেখানে দেব-দেবীদের নিয়ে শুধু আলোচনা সমালোচনা নয়, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করা নিত্যদিনের ঘটনা। কিন্তু সেখানে উগ্র ধর্মান্ধদের আস্ফালন নেই বলে তা আমাদের কাছে এতটা গুরুত্ব পায় না বা আমরা এসবের খবর পাই না।কিন্তু ইসলাম ধর্ম নিয়ে কেউ কোন ধরনের কটুক্তি তো দূরে থাক কঠোরভাবে সমালোচনা করলেই সারা মুসলিম বিশ্বে সাড়া পড়ে যায়।’

এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এখানে নীরবতার সুযোগ নেই। সরব হয়ে ব্লগে লিখে, বই প্রকাশ করে, সেমিনার-কনফারেন্স করে, শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য আন্দোলন করে, ধর্মীয় জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আমাদের মনের কথাগুলো পরিস্কার ভাষায় বলতে হবে। মডারেট মুসলিমেরা অবশ্য সেক্ষেত্রে হাজির করবেন সুরা কাফিরুন এর সেই অমর বাণীঃ লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালে ইয়া দ্বীন, যার ভাবানুবাদ হলো এ রকমঃ তোমাদের ধর্ম তোমাদের কাছে, আর আমার ধর্ম আমার কাছে। আরো সরল করে বললে, যার যার ধর্ম তার তার কাছে। এই বাক্য দিয়ে ইসলামকে মহান প্রমাণ করার সময় তারা আর এই সুরার শা’নে নজুলটা বলেন না, অর্থাৎ এর নাজিল হওয়ার সময়কাল ও প্রেক্ষাপটটা বলেন না। তার ফলে অর্থটা উলটা মনে হয়। আসুন, দেখে নিই কখন এবং কোন কারণে এই সুরাটি নাজিল হয়েছিল। হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন, মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তি ওলীদ ইবনে মুগীরা, আস ইবনে ওয়ায়েল, আসওয়াদ ইবনে আবুদল মোত্তালিব ও উমাইয়া ইবনে খলফ প্রমুখ একবার রাসুলের কাছে এসে বললঃ আসুন, আমরা পরস্পরের মধ্যে এই চুক্তি করি যে, একবছর আপনি আমাদের উপাস্যদের এবাদত করবেন এবং একবছর আমরা আপনার উপাস্যের এবাদত করব।

ইসলামের তখন আদি অবস্থা। রাসুল তখনো মক্কায়। যারা ইসলামের আদি ইতিহাস জানেন না, তাদের জন্য একবাক্যে বলে নিইঃ রাসুল নবুওয়্যাত পাবার পরে মক্কার ধর্মপ্রচার শুরু করেন, পরে কোরাইশ ও অন্যদের বাধার মুখে পালিয়ে মদীনায় যান গুটিকতক শিষ্য নিয়ে – সেখানে আস্তানা গেড়ে শক্তিবৃদ্ধি করে মক্কা আক্রমন করেণ এবং ইসলামের গোড়া শক্তভাবে প্রোথিত করেন মক্কার মাটিতে। ফলে এই আদি অবস্থায় যখন মক্কার প্রভাবশালী বিশিষ্টজনেরা উপরোক্ত প্রস্তাব নিয়ে আসেন, সেটি মেনে নেওয়া হতো ইসলামের রাসুলের জন্য আত্নহত্যার শামিল। তিনি ছিলেন সাংগঠনিকভাবে দুর্বল, নানা আক্রমণের শিকার, এবং সাথে অল্প কয়েকজন মাত্র সাহাবী।

একই ঘটনার কয়েকটা বর্ণনা পাওয়া যায় দলিলে। উইকিপিডিয়া থেকে তুলে দিচ্ছিঃ

“তিবরানীর রেওয়ায়েতে হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন, কাফেররা প্রথমে পারস্পরিক শান্তির স্বার্থে রসূলুল্লাহ্‌ এর সামনে এই প্রস্তাব রাখল যে, আমরা আপনাকে বিপুল পরিমাণে ধনৈশ্বর্য দেব, ফলে আপনি মক্কার সর্বাধিক ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে যাবেন। আপনি যে মহিলাকে ইচ্ছা বিবাহ করতে পারবেন। বিনিময়ে শুধু আমাদের উপাস্যদেরকে মন্দ বলবেন না। যদি আপনি এটাও মেনে না নেন, তবে একবছর আমরা আপনার উপাস্যের এবাদত করব এবং একবছর আপনি মাদের উপাস্যদের এবাদত করবেন।আবু সালেহ্‌-এর রেওয়ায়েতে হযরত ইবনে আব্বাস বলেনঃ মক্কার কাফেররা পারস্পরিক শান্তির লক্ষ্যে এই প্রস্তাব দিল যে, আপনি আমাদের কোন প্রতিমার গায়ে কেবল হাত লাগিয়ে দিন, আমরা আপনাকে সত্য বলব।” এর পরিপ্রেক্ষিতে সূরা কাফিরূন নাজিল হল।

ভাবুন একবার, এই অবস্থায় ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালে ইয়া দ্বীন’ না বললে ইসলাম কি টিকতে পারতো? তখনো তারা মক্কার গোত্রগুলোর সাথে সম্মুখযুদ্ধে যাবার মত শক্তিশালী হয়ে উঠে নি, আবার তাদের প্রস্তাবে তাদের উপাস্য খোদাকে উপাসনাও করতে পারছেন না। ফলে তাদের সাথে এক ধরণের শান্তিচুক্তির দরকার ছিলো তার, নিজের ও নিজ-প্রবর্তিত ধর্মের অস্তিত্বের স্বার্থে। সুরাটির অনুবাদ আবার খেয়াল করুন; এখানে প্রথম আয়াতে সম্বোধনের পরে মূলতঃ একই কথা
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কয়েকবার বলা হয়েছে।

১. বলুন, হে কাফেরকূল তথা অবশ্বাসীকূল,
২. আমি এবাদত করিনা, তোমরা যার এবাদত কর।
৩. এবং তোমরাও এবাতকারী নও, যার এবাদত আমি করি।
৪. এবং আমি তার এবাদতকারী নই, যার এবাদত তোমরা কর।
৫. তোমরা তার এবাদতকারী নও, যার এবাদত আমি করি।
৬ তোমাদের কর্ম ও কর্মফল তোমাদের জন্যে এবং আমার কর্ম ও কর্মফল আমার জন্য।

অনেকটা ইনিয়ে বিনিয়ে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে সন্মান দেখিয়ে একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রস্তাব দেওয়া। এখানে আমি একজন বাকপটু ও দূরদর্শী বাস্তবজ্ঞানওয়ালা মানুষের দেখা পাচ্ছি। মক্কাওয়ালাদের নানা ঈশ্বরের প্রতি তার প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল, কিন্তু এই বিপদের দিনে তিনি তা প্রকাশ না করে বলছেন, তোমাদের ধর্ম তোমাদের কাছে, আর আমার ধর্ম আমার কাছে। এর পরে মদীনায় গেলেন নবী, শক্তিবৃদ্ধি করলেন, মক্কায় ফিরে এলেন, এবং প্রথম সুযোগেই কাবার মূর্তিগুলোকে ভেঙে দিলেন। তখন আর তার ‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের কাছে, আর আমার ধর্ম আমার কাছে’ বলার দায় নেই, কারণ তিনি তখন বিজয়ীর আসনে। এর পরে কোন মডারেটকে সুরা কাফিরুনের “লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালে ইয়া দ্বীন” বলতে শুনলে তাদের অস্ত্রেই তাকে ঘায়েল করবেন, পুরো প্রেক্ষাপটটি বর্ণনা করে।

এটা নিয়ে এত কথা বললাম, কারণ আমার বক্তব্য হলো নবী-রাসুলেরা তাদের ধর্মমত সক্রিয়ভাবে প্রচার করেছেন, সম্ভাব্য সকল ছল, বল, কৌশলের সহায়তা নিয়ে। ঈসা-মুসা-ডেভিড-গোবিন্দ সিং-বাহাউদ্দীন সবাই তাই করেছেন, এবং এভাবে দুনিয়াকে অসংখ্য ধর্ম উপহার দিয়ে মানুষের জীবনকে সমস্যাসংকুল, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও সংঘাতময় করে গেছেন। এককালে যখন দুনিয়া অনেক বড় ছিল, এক অংশের মানুষ আরেক অংশের কথা জানত না, তখন আলাদা আলাদা এলাকায় আলাদা ঈশ্বরের রাজত্বে কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু যখন দুনিয়াটা ছোট হয়ে আসতে থাকল, এবং বিভিন্ন ঈশ্বরের অনুসারীদের মাঝে দেখাসাক্ষাত হতে থাকল, তখন থেকেই ধর্মের ভয়ানক ক্ষতিকর দিকগুলো মানুষের সামনে বেশি বেশি করে ধরা পড়তে লাগলো। অদূর ভবিষ্যতে ধর্মের কপালে আরো দূর্গতি আছে নিঃসন্দেহে। ধর্ম বিরাট বিপদে পড়েছে এই নতুন দুনিয়ায়, এবং তারা সহাবস্থানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সেই অতি পুরাতন ‘লাকুম দ্বীনুকুম’ এর ট্রিক ব্যবহার করে। যেখানে তারা শক্তিশালী – যেমন মক্কা বা ঢাকা, সেখানে তাদের অস্ত্র চাপাতি; যেখানে তারা বিপদে আছে, যেমন ওয়াশিংটন, বার্লিন বা মেলবোর্ন, সেখানে তারা ‘লাকুম দ্বীনুকুম’ দিয়ে বাকীদের বোকা বানাতে চায়। সে সুযোগ তাদেরকে দেওয়া ঠিক হবে কি? পশ্চিমে ইতিমধ্যেই ধর্মের সমালোচনা করাটা ডালভাতে পরিণত হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বেও হয়তো হবে একদিন। আজ হলিউডে রাসেল ক্রো নোয়াহ সিনেমায় নুহ নবীর চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন, মুসা নবীকে দোষে-গুণসম্পন্ন মাটির মানুষ হিসেবে দেখানো হয়, তাহলে রাম-রহিমেরা কেন কৃষ্ণ/মোহাম্মদকে ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে বিবেচনা করে তাদের আলোচনা/সমালোচনা করতে পারবে না? কেন আজ অস্ট্রেলিয়ান এবোরিজিনাল দেবতা বা রোমান দেবতাদের মতন আল্লাহ/ব্রহ্ম/যীশুর পিতা/বনী ঈসরায়েলের ঈশ্বর রুপকথায় স্থান করে নেবে না, মানুষকে দু’দণ্ড শান্তিতে থাকতে দেবে না?

স্যাম হ্যারিস তার বিখ্যাত ‘এন্ড অফ ফেইথ’ বা বিশ্বাসের মৃত্যু বইতে ‘লাকুম দ্বীনুকুম’-এর মিথকে তুলোধুনা করেছেন এভাবেঃ “অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, এই বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিশ্বাস আমাদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করছেঃ তারা অনিবার্যভাবে আমাদের পরস্পরকে হত্যা করার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আপনি চোখ বুলান ইতিহাসের পাতায় অথবা দৈনিক পত্রিকার পাতায়, তাহলে দেখবেন যে, সাধারনত যে বিশ্বাসগুলো মানুষকে বিভক্ত করছে, অথবা শুধুমাত্র অপরকে হত্যার কাজে মানুষকে একত্র করছে, সেগুলোর গোড়া পোঁতা রয়েছে ধর্মের মধ্যে। মনে হয় যেন মনুষ্যপ্রজাতি যদি কখনো নিজেদেরকে যুদ্ধের দ্বারা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে, তবে সেই যুদ্ধের কারণ হবে আমাদের কপালে কি লিখা ছিল সেটি নয়, বরং আমাদের ধর্মগ্রন্থে কি লিখা ছিল, সেটি। *** পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করে যে, এই বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা একখানা বই লিখেছেন। দূর্ভাগ্যক্রমে, আমাদের হাতে এ রকম বেশ কয়েকটি বই আছে, এবং প্রতিটা বইই নিজেকে একমাত্র সঠিক বই বলে দাবী করছে। মানুষ তাদের ভাষা, গায়ের রং, জন্মস্থান অথবা অন্য কোন গোষ্ঠীগত বৈশিষ্টের ভিত্তিতে নয়, বরং তারা এই পরস্পর অসামঞ্জস্যপূর্ণ দাবীগুলির কোনটিকে গ্রহন করছে, তার ভিত্তিতে নিজেদেরকে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত করছে। প্রতিটা বই তার পাঠকদেরকে বেশ কিছু বিশ্বাস ও আচরণ গ্রহন করতে বলছে, যার কিছু কিছু বেশ ভাল ভাল কথা, যদিও বেশির ভাগই তেমনটা নয়। তবে এদের সবার মধ্যে একটা মৌলিক বিষয়ে ভয়ানক মতৈক্য, আর তা হল, এই সব পুস্তকে বর্নিত যে ঈশ্বর, তিনি অন্য ধর্মগুলোর প্রতি কিম্বা অবিশ্বাসীদের প্রতি ‘সন্মান’ বিষয়টা সহ্য করেন না। যদিও সব ধর্মই কম বেশি ‘যার যার ধর্ম তার তার কাছে’ স্লোগানের দ্বারা একটু আধটু আক্রান্ত হয়েছে, তবুও প্রতিটি ধর্মের মৌলিক বিশ্বাস হল এই যে, বাকী সব ধর্মগুলো ভুলে ভরা, অথবা বড়জোর ভয়ংকর রকম অসম্পূর্ণ ও বিকৃত। কাজেই, অসহিষ্ণুতা আসলে ধর্মগুলোর একেবারে অচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট। যদি একজন মানুষ বিশ্বাস করে – সত্যিই বিশ্বাস করে – যে বিশেষ কিছু কাজ বা বিশ্বাস তাকে চিরস্থায়ী সুখ এনে দিতে পারে (অথবা এর উল্টোটা), তাহলে তার প্রিয় মানুষগুলো অবিশ্বাসীদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হতে পারে, এই সম্ভাবনায় সে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। পরলোক সম্পর্কে নিশ্চয়তা ইহলোকে পরধর্মসহিষ্ণুতার সঙ্গে খাপ খায় না”।

স্যাম হ্যারিস আরো বলছেন, ‘আলকেমির ব্যাপারটাই ধরুন – এটা মানুষকে হাজার বছরেরও বেশী সময় মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল, অথচ আজকে কেউ যদি সত্যিসত্যিই দাবী করে বসেন যে তিনি মনোযোগ দিয়ে আলকেমির চর্চা করেন, তাহলে তাকে সমাজের চোখে হেয় হতে হবে এবং যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজের ব্যাপারে তাকে অযোগ্য মনে করা হবে।’ কেউ যদি বলেন যে, চাঁদ দু’ভাগ হয়েছিল তাদের নবীর কথায়, অথবা সূর্য্য আল্লাহ’র আরশের নীচে রাতে আশ্রয় নেয়, তাকেও একইভাবে হাস্যস্পদ হতেই হবে আজকের দুনিয়াতে। বিশ্বাসভিত্তিক ধর্মগুলোকে বিস্মৃতির অতল গহবরে তলিয়ে যেতেই হবে।

একদিন বিশ্বাসভিত্তিক ধর্মগুলো বিস্মৃতির অতল গহবরে তলিয়ে যাবে, অথবা মানুষের ব্যক্তিগত সিন্দুকে ঢুকে পড়বে, আর সেক্যুলারিজমই হবে মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্শন, সেই দিনের আশায় মুখ খুলেছি। নীরব নাস্তিকতা নয়, সরব নাস্তিকতা চাই। নীরব কারো থাকতে হলে সে হবে প্রাচীন হাস্যকর ভুলে ভরা রুপকথায় বিশ্বাসী ধার্মিকেরা।

গ্রন্থপঞ্জিঃ
প্রবচনগুচ্ছ, হুমায়ুন আজাদ, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৫
নির্বাচিত প্রবন্ধ, আবুল হুসেন, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা ১৯৯৭
বাঙালির ধর্মচিন্তা, মোহাম্মদ আব্দুল হাই সম্পাদিত, সূচীপত্র, ঢাকা ২০১৪
মুসলিম-সাহিত্য সমাজ: সমাজচিন্তা ও সাহিত্যকর্ম, বাংলা একাডেমী, ঢাকা ১৯৮৪ ও ২০০৬
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও নবীন হোসেন, ২০০৩, “’শিখা’ গোষ্ঠীঃ ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত পর্যালোচনা”
পৃথু সান্যালের ব্লগ, ইস্টিশন – নাস্তিকেরা কেন ইসলাম বিদ্বেষী? http://www.istishon.com/node/2079
অবিশ্বাসের দর্শন, অভিজিত রায় ও রায়হান আবীর, জাগৃতি প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১১
The End of Faith: Religion, Terror and the future of Reason – Sam Harris, W. W. Norton & Company, 2005