অনন্ত নক্ষত্রবীথির যেই বিশাল জগত তারি মাঝে যদি এমন একটা প্রতিযোগিতা হত, রহস্য, সৌন্দর্য আর চাঞ্চল্যের বিবেচনায়। তবে দ্বিতীয় স্থানটা হয়ত পেত পৃথিবীর প্রানের স্পন্ধন। প্রথম স্থানটা দিলাম
না। কারণ প্রথম স্থানটা নিয়ে বিতর্ক থাকে। দ্বিতীয় অবস্থান দিলে সেটা নিয়ে কারো বিশেষ মাথা ব্যাথা থাকবে না।
( পৃথিবীতে জীবনের এ এক অপূর্ব ধারা )
জীবন! এক অপূর্ব প্রসেস। যার মধ্য দিয়ে আমরা বেচে থাকি।যেই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্পন্দন বয়ে চলে দীর্ঘ এক সময়ের পরিক্রমায়। আমাদের মানব জাতির হিসেবে গড়ে সেটা ৬০ কি ৭০ বছর।
তাপগতি বিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র নামে মহাজগতের এক নীতি রয়েছে। আমাদের বিশ্বকে সেই নীতি মেনে চলতে হয়। এর মূল কথা – মহাবিশ্বের এন্ট্রপি সর্বদা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। সবকিছুই শেষ পর্যন্ত পৌঁছুবে এক সমতাপমাত্রায়। প্রকৃতিতে স্থায়ী হবে তাপীয় সমতা। এই সমতার বিষয়টা হয়ত আমাদের নিত্য জীবনেও আমরা প্রত্যক্ষন করে থাকি। চুলা থেকে গরম ডাল এনে রেখে দিলে কিছু সময় পরে তার তাপমাত্রা কমে গিয়ে প্রকৃতির সাথে একাকার হয়ে যায়। সব কিছুই এরকমভাবে একই তাপমাত্রায় স্থায়ী হবে। দুরের অনন্ত নক্ষত্র বীথির জগতের সেই উত্তপ্ত মহাতারকারাও এক সময়ে উত্তাপ হারিয়ে উবে যাবে চির শীতল অসীম শূন্যতার মাঝে। মহাবিশ্বের এন্ট্রপি কিংবা বিশৃঙ্খলা বাড়তে বাড়তে সর্বচ্চ পর্যায়ে পৌঁছুবে। সবকিছুই নিঃশেষ হয়ে যাবে সেই দূর ভবিষ্যতে। আমার কথাগুলোর সত্যতা যাচাই করবার মতনও কেউ উপস্থিত থাকবে না, সে হিমশীতল মহাকাশে, থাকবে না কোন ধীমান সত্তার অস্তিত্বও। এই এন্ট্রপি মহাবিশ্বের এক চরমতম বিধি, যা সব কিছুকে এক পাল্লায় এনে হাজির করে।
এন্ট্রপি অনুসারে সবকিছুই পৌছুতে চায় সমতাপমাত্রায় । কিন্তু খেয়াল করে দেখেছেন কি , আপনার শরীররে স্বাভাবিক তাপমাত্রা সবসময়ই চারিপাশের প্রকৃতি থেকে বেশিই থাকে। কেন ? আবার মৃত মানুষের শরীরের তাপমাত্রা পৌঁছে যায় এক শীতলতার পানে। তাই বা কেন হয়?
তার মানে কি প্রানের অর্থ – তাপ? তাপীয় সমতার ভঙ্গন? অনেকটাই তাই।
প্রাণই একমাত্র প্রসেস যার মধ্য দিয়ে হয়ত শক্তি উৎপন্ন হয় অটোমেটিকালি। নিজের মাঝেই। বাহিরে থেকে শক্তি দিয়ে এন্ট্রপি ভাঙবার প্রয়োজন হয় না। অসীম কালের হিল্লোলে এক ক্ষীণ সময়ের জন্য ভঙ্গ হয় এন্ট্রপির মত মহান মহাজাগতিক বিধিও। শুধু তাপীয় সমতার ভঙ্গন দিয়েই হয়ত প্রাণকে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। তবে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অবহেলা করা হয়ে থাকে। প্রানের এক অপূর্ব বৈচিত্র্যতম প্রসেসকে ফেলে আসা হয়, আর তা হচ্ছে নিজের প্রতিরূপ সৃষ্টি। প্রান এক রহস্যময় বস্তু । বললামই তো দুরের ওই নীহারিকার চাইতে এর মায়াজাল কম রহস্যপূর্ণ নয়। তাই শুধুমাত্র তাপীয় সমতার ভঙ্গন আর প্রতিরূপ তৈরির মাধ্যমেই প্রানের দায়িত্বকে শেষ করে দেয়া যায় না। এর আসল ব্যাখ্যা নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক আছে। ওইদিকে না গিয়ে আমাদের এখনকার আলোচনার জন্য এটুকুনই যথেষ্ট।
আমরা বলেছিলাম প্রান এমন একটি প্রক্রিয়া যার মধ্য দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শক্তি উৎপন্ন হয়। কিন্তু কিভাবে উৎপন্ন হয় এই শক্তি? আপনাতেই ? না তো । আপনাতে তো শক্তি উৎপন্ন হওয়া সম্ভব না। তাপ গতিবিদ্যার প্রথম সূত্র মতে শক্তি ধ্বংসও হয় না আবার সৃষ্টিও ঘটে না । তবে কিভাবে তৈরি হয় প্রানের মাঝে সেই অদৃশ্য শক্তির? কোথা থেকে তৈরি হয় সেই মায়াবী ক্ষমতা?
সেই শক্তি আসে সূর্য থেকে। আমাদের থেকে প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার দুরের একটি নক্ষত্র। ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে হলেও এটিই আমাদের সবচাইতে কাছের তারকা। আমাদের শক্তির উৎস। আমাদের প্রান ব্রক্ষা। ৩৫০ কোটি বছর আগে প্রানের সৃষ্টি কিংবা উৎপত্তিতেও রয়েছে এর তাৎপর্যময় ভূমিকা।
সূর্য থেকে প্রাপ্ত শক্তি আমাদের শরীর গরম করে আর তার মধ্য দিয়েই আমরা বেচে থাকবার শক্তি পাই । এরকমটা কিন্তু নয় । তবে হয়ত মৃত্যু বলে কিচ্ছুটির অস্তিত্ব থাকত না , অথবা প্রতিদিন সূর্যাস্তের পরে প্রানের স্পন্দন নিঃশেষ হয়ে যেত। আসলে সূর্য থেকে পাওয়া শক্তি আমাদের গরম করতে না পারলেও বৃক্ষদের কিন্তু ঠিকই পারে। গরম হওয়া বলতে আভিধানিক অর্থের গরম হওয়াকে বুঝানো হয় নি । এই গরম হওয়া দ্বারা শক্তি শোষণের ক্ষমতাকে বুঝানো হয়েছে।
ঠিক কিভাবে উদ্ভিদ গরম হয় কিংবা শক্তি সংগ্রহ করে সূর্য থেকে ?
পদার্থবিদ্যার নীতি অনুসারে বিকিরণ প্রক্রিয়ায় সূর্যের তাপ পৃথিবীতে পৌঁছে। কেননা এর মধ্যবর্তী কোন মেসেঞ্জার মাধ্যম নেই। তাই শক্তিকে নিজেরই একটা মাধ্যম তৈরি করে পৃথিবীতে পৌছুতে হয়। মাধ্যমের নাম তরিত চুম্বকীয় ক্ষেত্র। তারপর সেই ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে সূর্যের তাপ শক্তি আলোক তরঙ্গ বা বিকিরণ হিসেবে পৌঁছে ভূধরে। ভূধরের মাঝের বৃক্ষরাজি সেই তাপ শক্তিকে কায়দা মতন শুষে নেয়। অপূর্ব তার শোষণের ক্ষমতা। মানব সৃষ্ট সমস্ত প্রযুক্তির চাইতেও বেশি এই ক্ষমতা। বৃক্ষের পাতা এক যন্ত্রের ন্যায়।
মাল মশলা মিক্সচারের এক যন্ত্র। বাড়ি তৈরি করবার সময় রাস্তার ধারে যেই যন্ত্র গুলোতে ইট , বালু , সিমেন্ট সব একত্র করা হয় অনেকটাই তার মতন এই বৃক্ষ রাজির পাতা। পাতায় এক ধরনের টিস্যু আছে যার নাম মেসফিল টিস্যু। সেই মেসফিল টিস্যুর ক্লোরোপ্লাস্ট হচ্ছে সব মশলার কারখানা। সূর্যের আলোকশক্তি সেই বিচিত্র স্থানে গিয়ে পৌঁছে রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত হয়। সেই বিচিত্র স্থানে শুধু আলোই নয়, পানি কার্বনডাইঅক্সাইড এর মতন যৌগ গিয়েও পৌঁছে , তারপরে শুরু হয় মাল মশলা দিয়ে শক্তি উৎপাদনের প্রক্রিয়া। এই উৎপাদিত শক্তি উদ্ভিদ তার জীবন যাপনের সমস্ত মেটাবলিক কাজ চালাবার জন্য ব্যবহার করে। বাকিটুকু জমা রাখে তার কাণ্ড, পাতা, ফুল, ফলে। সেই সমস্ত ফুল ফল আবার খেয়ে থাকে তৃণভোজীরা। উদ্ভিদের ফলের মাঝে জমাক্রিত শক্তিকে গ্রহণ করে তারা শক্তিমান হয়ে উঠে। সেই শক্তিমানদের খেয়ে আবার শক্তি গ্রহণ করে আরেক দল প্রাণী। এরকম তিন চার স্তর পর্যন্ত খাদ্য গ্রহণের এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। মূলে সব শক্তিই কিন্তু আসে সূর্য থেকে। সূর্যের শক্তি বৃক্ষরাজি গ্রহণের পর এক শ্রেণির প্রাণী সেই শক্তি, ফলমূল খেয়ে বৃক্ষ থেকে গ্রহণ করে। শক্তি চলে যায় সেই প্রাণীর মাঝে। আরেক দল প্রাণী আবার প্রথম শ্রেণিকে খেয়ে তার কাছে থেকে শক্তিটা কেড়ে নেয়। এ যেন শক্তিকে খাবার এক নিরবিচ্ছিন প্রক্রিয়া। এই শক্তিটা যেন অনেকটা বাচ্চা ছেলেদের খেলা করার সেই বলের মতন । এক জন থেকে আরেকজনকে ছুঁয়ে দেয়। যদি আসলেই সেই শক্তিকে বলের মত কল্পনা করা যেত তবে আমরা তার নাম দিতাম গ্লুকোজ। বৃক্ষ এক বিচিত্র প্রক্রিয়ায় সূর্য থেকে শক্তি নিয়ে গ্লুকোজ উৎপন্ন করে। যা খেয়ে বেচে থাকে সমস্ত প্রানের প্রবাহ। বেচে থাকে সমস্ত জীবকুল, প্রানের কলোনি। সেই গ্লুকোজ থেকেই উৎপাদন করে শক্তি। যেই শক্তি তার মেটাবোলিজমকে সচল রাখে। ভঙ্গ হয় মহাজগতের এক মহান বিধি । যার নাম তাপীয় সমতা।
(চলবে)
সম্পাদকের নোট-
প্রিয় জাবের, ছবি আপলোড করার পর লিঙ্ক পেস্ট না করে, ছবিটি সিলেক্ট করুন। এরপর ঐ মেনুতেই নিচের দিকে insert into post নামক একটি বোতাম দেখতে পাবেন। সেটিতে ক্লিক করলে ছবি পোস্টে চলে আসবে। এবং পোস্ট করার আগে, preview দিয়ে দেখে নিন ঠিকঠাক এসেছে কি না। ছবি আপলোডে ভুল থাকায়, প্রকাশ হতে বিলম্ব হয়েছে।
সুখপঠ্য :good: চলুক…
আপনি চমৎকার লেখেন
ধন্যবাদ
ভালো লেগেছে লেখাটি। আরো পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম…।
ধন্যবাদ আপনাকে। সময় পেলেই বাকি লিখাগুলো দেব।