অনেকদিন পর একজন রাজনীতিকের ‘ভাল’ কাজের নমুনা দেখলাম! দ্বীন ইসলামের ‘একনিষ্ঠ সেবক’ সাতক্ষীরার জনৈক আওয়ামীলীগ নেতার ত্বরিত পদক্ষেপে ইসলাম ‘অবমাননা’ করা একটি মন্তব্য ফেসবুকে প্রকাশের আধাঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে পুলিশ মন্তব্যকারীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শ্যামনগরের মনসুর সরদারের গ্যারেজ থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। মন্তব্যকারী তাঁর মন্তব্য মুছে দেয়ার পরেও শেষরক্ষা হয় নি। অবশ্য এই সময়কাল আসলেই আধাঘণ্টা, নাকি আরও কম বা বেশী, তা স্বাধীন কোন সূত্র থেকে নিশ্চিত করা সম্ভব হয় নি; তবে মন্তব্যকারী যে পুলিশের হেফাজতে সে নিয়ে কোন দ্বিমত নেই।

মন্তব্যকারীর নাম মোহন কুমার মণ্ডল। তিনি ‘লিডার্স’ নামের একটি এনজিওর পরিচালক; মানুষের খাদ্য অধিকার, জলবায়ু সংকটে উপকূলবাসীর করণীয়, বাঘের আক্রমণে স্বামী-হারা নারীদের পুনর্বাসন ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা তৈরির মত কাজ করে থাকেন। অন্তর্জালে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মোহন সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব পানি সম্মেলনে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানি সংকটের চিত্র তুলে ধরেছেন।

মোহনের যে মন্তব্যের কারণে এই ঘটনা, তার প্রেক্ষিত মিনায় বড় শয়তানকে পাথর ছুড়তে গিয়ে ধাক্কাধাক্কিতে বিপুল সংখ্যক হাজীর প্রাণহানি। তাঁর মন্তব্যে মোটামুটিভাবে তিনটি বিষয় আছে; ১) মিনায় লাশের স্তূপ দেখে তাঁর মনে হয়েছে এর আগে লতিফ সিদ্দিকীর হজ নিয়ে করা মন্তব্য সঠিক ছিল কিনা; এছাড়া ২) হজ পরিচালনায় সৌদি অব্যবস্থা; এবং ৩) শয়তানকে পাথর ছুড়তে বিপুল অর্থ খরচ করে মিনায় যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। দেখা যাক, এই মন্তব্যের জন্য মোহনকে জেলে দেয়া কতটা যৌক্তিক।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঘরোয়া সভায় লতিফ সিদ্দিকীর হজ-বিশ্লেষণ সম্প্রতি তাঁর মন্ত্রিত্ব হারানোর কারণ হয়েছে। নিজে হজ পালন করেছেন বলে দাবী করলেও হজে সময় আর সম্পদের অপচয় ঘটে, একথা বলে সিদ্দিকী সরকার আর ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের চরম-বিরাগভাজন হয়েছেন। হজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, এবং অনেক হাজী জান্নাতবাসী হওয়ার আশায় হজ পালন করতে গিয়ে মৃত্যু হওয়াকে সৌভাগ্য বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু তারপরেও এবারের হজে এতো বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি অনেককেই বিচলিত করেছে, এর মধ্যে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরাও আছেন। এখন একজন অমুসলিমের কাছে (নামের কারণে ধরে নিচ্ছি মোহন ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী নন) কেবল মানবিক কারণে যদি এই প্রাণহানি করুণ অপচয় বলে বিবেচিত হয় এবং তিনি তা সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেন তাহলে তা কোন যুক্তিতে অপরাধ বলে গণ্য হবে ঠিক বোধগম্য নয়।

হাজীরা হজ পালনের জন্য সৌদি সরকারকে রাজস্ব প্রদান করে থাকেন; অথচ হজের ব্যবস্থাপনায় সৌদি সরকারের দুর্বলতা লক্ষণীয়। বিশেষত, এবারের হজের সময় তিন-শতাধিক দেহরক্ষী নিয়ে এক বাদশাহজাদার মিনা ভ্রমণ হাজীদের স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়ে ধাক্কাধাক্কির সময় অধিকতর হাজীর প্রাণহানির কারণ হয়েছে বলে কথা উঠেছে। এছাড়া হজের কয়েকদিন আগে নামাজরত হাজীদের উপর ক্রেন ভেঙ্গে পড়েও অনেক হাজীর মৃত্যু হয়েছে। দেশের প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া আর সামাজিক প্রচার মাধ্যমে এ নিয়ে সৌদি সরকারের তুমুল সমালোচনা চলছে, মুসলিম বিশ্বেও দাবী উঠেছে হজ ব্যবস্থাপনার ভার একটি আন্তর্জাতিক সংসদের মাধ্যমে পরিচালনা করার। মোহন তাঁর মন্তব্যের দ্বিতীয় অংশে কেবল এই দুঃখজনক ঘটনার পেছনে সৌদি সরকারের ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন, যা ইতিমধ্যেই বহুল আলোচিত; এজন্য বিশেষ করে তাঁকেই কেন দোষী হতে হবে তা আসলেই এক রহস্য।

মন্তব্যের শেষাংশে মোহন শয়তানকে ঢিল মারার জন্য অর্থ ব্যয় করে মিনা গমনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন, যেখানে আমাদের ঘরে বা আশেপাশেই আছে শয়তানের অবস্থান। মোহনের মন্তব্যের এই রূপক-ধর্মী অংশটি আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। আমাদের ধর্মপালনকারীরা আজকাল ধর্মের ‘Spiritual’ দিকটি নিয়ে যতটা না আগ্রহী তার চেয়ে অনেক বেশী আগ্রহী এর ‘Ritual’ গুলো নিয়ে। এইজন্য দেখা যায় নামাজ পড়তে পড়তে কপালে দাগ ফেলে দিয়েছেন এমন মানুষও উৎকোচ লাভের আশায় টেবিলের নীচ দিয়ে হস্ত প্রসারণে দ্বিধা করেন না; কোরবানির সময় নিজের ভেতরের পশুটিকে হত্যা না করে কে কত লাখ ব্যয়ে জীবহত্যা করেছেন তার হিসাব করেন; আশি বছরের বৃদ্ধ ধার্মিকও নিজের কামনা-বাসনাকে দমনের চেষ্টা না করে কন্যা-সম নারীকে তেঁতুলের সাথে তুলনা করে বসেন। মুসলিমরা তাদের ধর্ম পালনের অংশ হিসাবে হজে যাবেন, সে স্বাধীনতা তাদের আছে; কিন্তু ধর্মের মূল সুরকে যারা আত্মায় ধারণ করেন বলে দাবী করেন তাঁদের একথা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না যে নিজের ভেতরের শয়তানী প্রবৃত্তি আর প্ররোচনাকে ঘায়েল না করে হজে গিয়ে শয়তানকে পাথর ছুড়ে আসা কেবল আচার-সর্বস্ব একটি প্রথা মাত্র। মোহন তাঁর মন্তব্যে এই দিকটিই তুলে ধরতে চেয়েছেন। আসলে মন্তব্যের এই অংশের কারণে মোহনকে জেলে দিতে হলে লালন, নজরুল তো বটেই হয়তো অনেক সাধু-সন্ত আর ধর্মগুরুকেও জেলে পুরে দিতে হবে।

আজকাল সরকারী দলের কিছু পাতি-নেতার কাজ দেখে বারবার মনে পড়ে যায়, ‘বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ’। মোহনের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী নেতার কোন রাজনৈতিক স্বার্থ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এই মন্তব্যে আসলেই কার কি ক্ষতি হয়েছে? দেশে এতো বড় বড় গলাকাটা অপরাধী/সন্ত্রাসী গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে বছরের পর বছর কেটে যায়, অথচ একজন নিরীহ, দেশপ্রেমিক, সমাজ-সচেতন, উদ্যোগী তরুণকে কেবল মত প্রকাশের জন্য জেলে পুরতে কয়েক ঘণ্টাও লাগে না!!

[দরজায় ঘণ্টি বাজছে! কে এল, আইন নাকি ধর্ম? আমার এই স্বাধীন মতপ্রকাশ তো এখনও অন্তর্জালের পাতায় যায় নি! নিজের ব্যক্তিগত কম্পিউটারে স্বাধীন চিন্তার কথা লেখাও কি অপরাধ? কে জানে?……………]