অভিজিৎ দা’র বাবা ড. অজয় রায়ের মুখে অভিজিৎদার জন্মের গল্প শুনেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাবা অজয় রায় পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন, আর অন্যদিকে তাদের ঘর আলো করে আজকের এই দিনে (১২ সেপ্টেম্বর) জন্ম নিলেন অভিজিৎ রায়। বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবা-মা যুদ্ধ করতে করতে জন্ম দিলেন আরেক যোদ্ধার। বাবা যুদ্ধ করেছেন পরাধীন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা অর্জনে, আর ছেলে অভিজিৎ রায় যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিয়েছেন দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আর মত প্রকাশের স্বাধীনতা অর্জনে।

অভিজিৎ রায় নিজেই বলতেন, ‘রক্ত ছাড়া কোনো বিজয় অর্জিত হয় না।’ আর নিজের জীবন দিয়ে সেটাই প্রমাণ করে গেলেন, একটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন আর ধর্মান্ধ সমাজে মানুষের চিন্তার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অর্জন হচ্ছে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ। আর সেটিও বিনা রক্তে অর্জিত হয় না।

দুঃখ এটি যে, অভিজিৎ রায়ের খুনিরা জানে না, তারা কী অর্জন করলো? আর এ হত্যাকাণ্ডে দেশেরই বা কী লাভ হলো? কিন্তু আমরা কী হারালাম, কাকে হারালাম– তা উপলব্ধি করার ক্ষমতাও এ অন্ধকার দেশের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের নেই। মুক্তমনাদের জন্য এ সীমাহীন ক্ষতির কোনো সান্তনা যেমন নেই, তেমনি প্রগতিশীল আন্দোলনে এই শূন্যতা কোনো দিনই পূরণ হওয়ার নয়।

অভিজিৎদাকে অসংখ্যবার হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল। তারপরও তিনি হুমকিতে ভয় পেয়ে পিছপা হননি। মৃত্যুর ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও নিরলসভাবে লিখে গেছেন দেশের মানুষদের জন্য। বার বার ছুটে গেছেন নিজের কুসংস্করাচ্ছন্ন মাতৃভূমিতে অন্ধকারের মানুষগুলোকে আলোর পথ দেখাতে। আর মৃত্যূঝুঁকির ভেতরেও সাহস দেখিয়েছিলেন অভিজিৎ রায়।

শার্লি এবদো’র অফিসে কোনো শক্ত দরজা ছিল না। ছিল না কোনো লোহার গেট বা নিরাপত্তা কর্মী। ক্যমেরায় চেহারা দেখিয়ে বা বাইরে থেকে ইন্টারকমে কথা বলে ভেতরে ঢুকতে হতো না। অফিসটি ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত, আর যে কেউ বিনা প্রশ্নে ভেতরে ঢুকে যেতে পারতো। অথচ তারাও জানতো, তারা অবস্থান করছে আল-কায়দার হিটলিষ্টে।

হুমায়ুন আজাদ স্যার জানতেন, মৌলবাদীরা সুযোগ পেলেই তার ওপর হামলা করবে। তাকেও অসংখ্যবার হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি কখনো তা পাত্তা দেননি। বীরের মতো নির্ভয়ে হেঁটেছেন তার পথে।

অভিজিৎদাও সেই একই সাহস দেখিয়েছেন। মাথার ওপর হত্যার হুমকি নিয়ে তার নতুন বই প্রকাশের ঘোষণা দিয়ে দেশে গেছেন। কোনো রকম নিরাপত্তা ব্যাবস্থা না নিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরেছেন বই মেলায়।

বড় বড় মুক্তমনাদের সাহস দেখে অবাক হই। আরো অবাক হই, এই জ্ঞানী বীরদের আত্মবিশ্বাস দেখে। তারা জানেন, মানুষের জ্ঞান, আদর্শ আর অবদানকে হত্যা করা যায় না। বিশ্বে পরিবর্তনের অবদান রেখেছেন সাহসীরাই।

এ রাষ্ট্র অভিজিৎ রায় হত্যার বিচার করবে, এটি আমি আশা করিনা। এ রাষ্ট্র হুমায়ুন আজাদ স্যারের ওপর হামলার, কিংবা রাজিব হায়দার হত্যার বিচার করবে- এটিও আমি আশা করি না। এ রাষ্ট্র পেট্রোল বোমায় নিহত নাগরিকদের হত্যার বিচার করবে, এটিও তো আমি কোনোভাবেই আশা করি না।

দেশের নাস্তিক, বুদ্ধিজীবী, কিংবা যে কোনো নাগরিকের হত্যার বিচার করা যেন এ সরকারের কাজ নয়। সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা প্রদান, কিংবা তাদেরকে হত্যার বিচার করার জন্য তো আর আমরা এ সরকারকে ভোট দেইনি! আমরা এ সরকারকে ভোট দিয়েছিলাম শুধুই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য! এছাড়া এ সরকারের কাছে অন্য কোনো হত্যার বিচার দাবি করাই যেন অন্যায়!

তাছাড়া এদেশে তো সরকার নাস্তিক হত্যা করাকে বৈধতা দিয়েছে অনেক আগেই। শফি হুজুর প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘দেশের নাস্তিকদেরকে হত্যা করা ওয়াজিব হয়ে গেছে।’ আর এর পরই বর্তমান সরকার শফি হুজুরকে ৩২ কোটি টাকা দামের সরকারি জমি দিয়ে পুরস্কৃত করে ‘প্রকাশ্যে নাস্তিক হত্যার হুকুম’কে বৈধতা দিয়েছে। ‘নাস্তিক হত্যা বৈধ’ এমন ইসলামী দেশে আমরা আসলে অভিজিৎ হত্যার বিচার চেয়ে বোকামীই করছি!

বাংলাদেশ সরকার হয়তো অভিজিৎ হত্যার বিচার কোনোদিনই করবে না। উল্টো মৌলবাদীদের পৃষ্টপোষকতা করা আরো বাড়িয়ে দেবে। তার বিভিন্ন লক্ষণ ইতিমধ্যেই দেখছি। এত বড় হত্যাকাণ্ডের পর সরকারের পক্ষ থেকে তো কোন বিবৃতি তো দেয়া হয়ইনি, বরং অভিজিৎ রায়ের মতো একজন বিজ্ঞান ও মুক্তমনা লেখককে ইসলাম বিদ্বেষী হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। যে সব কথিত মোল্লারা অভিজিৎ সমালোচনায় নেমেছেন, লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, আসলে তারা কেউই অভিজিৎ রায়ের লেখা কোনো বই বা ব্লগ পড়েননি। মৌলবাদীরা অভিজিৎ রায়কে হত্যা করেছে জানতে পেরে মোল্লাদের অনুসারীরা বুঝে ফেলেছেন, নিশ্চয়ই অভিজিৎ ইসলাম বিদ্বেষী ছিলেন!

আর এভাবেই তার হত্যাকারীদের গ্রেফতার না করে বিভিন্ন মহল এ বিষয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। পরে কয়েকজন খুনীকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও তার পক্ষে বিশ্বাস অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ ও সরকার উভয়েই। একের পর এক লেখক এবং ব্লগার হত্যায় অপরাধীদেরকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে সরকার ও পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে সাজানো নাটকের কারণে তাদের ওপরে আস্থা হারিয়েছেন জনগণ।

ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যা মামলার ৮ আসামীকে অভিযুক্ত করে তাদের বিচার শুরু হয়েছে। আসামীরা নিজেদের নিরাপরাধ দাবি করেছেন, যদিও তারা স্বীকার করেছেন যে, রাজীব হায়দারকে তারা পরিকল্পনা মতোই কুপিয়ে হত্যা করেছেন।

রাজীব হায়দারের বেলায় আমরা দেখেছি, জিহাদীদের হাতে নির্মমভাবে খুন হওয়া রাজীবকে একজন আইনজীবী ‘মুরতাদ’ প্রমাণ করার জন্য আদালতে নিজ দায়িত্বে লিফলেট বিলি করেছেন। আর অভিজিৎ হত্যার পর দেশের প্রায় সকল বুদ্ধিজীবী ও সচেতন নাগরিকেরাও নিশ্চুপ থেকে তাদের পরোক্ষ সমর্থন দিয়েছেন এ হত্যার প্রতি। এমনকি রাষ্ট্রের ক্ষমতায় থাকা বড় বড় রাজনীতিবিদরাও নীরব থেকে তাদের অবস্থান বুঝিয়ে দিয়েছেন।

বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে একজন ‘নাস্তিক হত্যার বিচার’ হবে, এটি আশা করাটাই যেন দূঃস্বপ্ন!

স্বাধীনতার পর থেকেই বাঙলাদেশের প্রতিটি সরকার এবং রাজনৈতিক দল যেভাবে নিজেদের স্বার্থে ধর্মান্ধতা, ধর্ম ব্যবসা আর ধর্মীয় রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, তার মূল্য দিতে হবে এ জাতিকে। আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা আর ধর্মনিরপেক্ষতাকে উপেক্ষা করে মৌলবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করার ফল যে কি ভয়ঙ্কর হতে পারে, তার উদাহরণ বিশ্বের অসংখ্য মুসলিম দেশ, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোও। একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে আমাদের চোখের সামনে মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য যতোই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে দোষ দেয়া হোক না কেনো, এর জন্য তার চেয়েও বেশী দায়ী নিরব মডারেটররা, যারা ধর্মীর গোঁড়ামী আর হিংস্রতা দেখেও চোখ বন্ধ করে চুপ করে ছিলেন। আরো দায়ী সেই সব তথাকথিত শিক্ষিতরা, যারা নিজেদের স্বার্থে বা কল্লা হারাবার ভয়ে মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। জঙ্গিবাদের উত্থানে তারাও একদিন হয়তো চপেটাঘাত খাবেন দাড়ি না রাখার জন্য। সে সময় বোরখা না পরার দায়ে তাদের পিঠেও হয়তো একদিন দোররা পড়বে। আসলে উগ্র মৌলবাদীরা শেষ পর্যন্ত আস্তিক-নাস্তিক কাউকেই ছেড়ে কথা বলবে না, অন্তত জেহাদের ইতিহাস তা-ই সাক্ষ্য দেয়।

অভিজিৎ দা’র বাবা ড. অজয় রায় এখনো সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের একজন অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক, অভিভাবক, আজকে যার জীবনের শেষ সময়ে এসে দুদণ্ড বিশ্রামে থাকার কথা ছিল, বয়সের ভারে ন্যুজ অসুস্থ শরীরের যত্ন পাওয়ার দরকার ছিল, সেই অজয় স্যারকে আজ সকাল-বিকাল দৌড়াতে হচ্ছে পুত্র হত্যার বিচার চেয়ে। যে মানুষটি নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, আজীবন দেশের উন্নয়নে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন, প্রতিদানে শেষ জীবনে এসে পেয়েছেন সন্তানের নৃশংস হত্যা! এই বেদনায় আমরা যতোই হা-হুতাশ করি না কেন, একজন স্নেহশীল পিতার পুত্রশোক আসলে কখনোই যথাযথ অনুভব করতে পারবো না, এটিই বাস্তবতা।

আজ ইচ্ছে করে, অভিজিৎ দা’র সকল বই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠ্য বলে অন্তর্ভূক্ত করি! ইচ্ছে করে, অভিজিৎ দা’র বাবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলি, ক্ষমা করো পিতা, তোমার নক্ষত্রের মতো আলোকিত সন্তানের যতটুকু মগজ আমরা রাস্তায় ঢেলেছি, সে পরিমান মগজ আসলে আমাদের অধিকাংশেরই নেই। আমি লজ্জিত। আমার আমৃত্যু প্রাশচিত্ত হোক!

পরিশেষে, ঘোর অন্ধকারেও বলে যাই, অভিজিৎ রায় একটি মূর্খ, বর্বর, আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন জাতিকে আলোর সন্ধান দিতে গিয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন– এ ইতিহাস শত সহস্র বছর ধরে ধারণ করার দায়িত্ব বিশ্বের সকল মুক্তমনা, স্বাধীন মত প্রকাশে বিশ্বাসী আর ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের। আমরা জানি, অভিজিৎকে কিভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হয়।

(লেখাটি নিউজনেক্সটবিডি-তে প্রকাশিত হবার পর মুক্তমনার সম্পাদকমন্ডলীর অনুমতিক্রমে এখানে পুণঃপ্রকাশিত হলো)