অভিজিৎদা কে নিয়ে কিছু লিখতে হলে অবধারিতভাবে চলে আসে অনন্তদার “যুক্তি” ম্যাগাজিনের নাম, কারণ সেই থেকেই তো শুরু। ২০১০ সালের বইমেলায় লিটল ম্যাগ চত্বরে ঘোরাঘুরির সময় এক বন্ধুর আগ্রহে কিনে ফেলি “যুক্তি” ম্যাগাজিন। এসএসসি পর্যন্ত বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেছি, অথচ প্রাণের সূচনা আর এগিয়ে চলার পেছনে “বিবর্তনাবাদ” বলে সবচেয়ে যৌক্তিক যে ব্যাখ্যাটা আছে তা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা ছিলনা। ভাসাভাসাভাবে শুনতাম বিবর্তনবাদ “তত্ত্বমাত্র” যার মূল বক্তব্য হচ্ছে আমরা সবাই “বানর” থেকে এসেছি! জাকির নায়েক কোরান-বাইবেল-বেদ-এন্ড হোয়াট নট থেকে উক্তি আর ব্যাখ্যার তোড়ে সব অপোনেন্টকে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছেন এটা দেখে আশেপাশের সবাই যখন তৃপ্তিতে আহা উহু করত তখন মনে হত কিছু একটা মিলছেনা, লোকটাকে চালবাজের চেয়ে বেশি কিছু আমার মনে হতনা আমার। কিন্তু আমার যত সন্দেহ আর অবিশ্বাস এগুলোর পাকাপোক্ত ব্যাখ্যা ঠিক কিভাবে কোথায় পাব তা জানা ছিলনা, উলটো মাঝে মাঝে মনে হত আমারই কোন একটা সমস্যা আছে, নইলে আর কারো মনে তো এত সন্দেহ বা প্রশ্ন জাগেনা! ঠিক তখনই “যুক্তি” পড়ে জানলাম আমি একা নই, এই প্রশ্নগুলো করেছেন শুধু হুমায়ুন আজাদ বা আহমদ শরীফের মত ধরাছোয়ার বাইরের মানুষেরা নয়, আরো অনেকে।
“যুক্তি” থেকে মুক্তমনা ব্লগের ঠিকানা পেয়ে ঢু মারলাম, একের পর এক লেখা পড়তে লাগলাম আর আমার সন্দেহগুলো একে একে বল পেতে লাগল, ভেঙে পড়তে লাগল ধর্ম আর প্রথার মত আপাত “ইনভিন্সিবল” অযৌক্তিক বিষয়গুলোর ভিত। বিবর্তন তত্ত্বের সৌন্দর্য ও শক্তি সম্পর্কে ধারণা হল, “বিজ্ঞানময় কিতাব” এর মত অযৌক্তিক দাবিগুলোকে যুক্তি দিয়ে অগ্রাহ্য করার সাহস পেলাম। মহাবিশ্ব, সমকামিতা, শূন্য, প্রাণ, চুম্বনের ও ভালবাসার বিজ্ঞান, ভ্রমণ, সাহিত্য…একের পর এক বিস্ময়রাজ্যে ঘোরাঘুরি শুরু হল মুক্তমনার প্ররোচনাতেই।
মুক্তমনা থেকে জীবন বদলানো দুটো শিক্ষা পেয়েছিলাম- প্রথমটি হল “বরং দ্বিমত হও…” আর দ্বিতিয়টি হল কেউ কিছু একটা দাবি করলেই তা মেনে না নিয়ে কিভাবে যাচাই করে দেখতে হয়। দাদার একেকটা লেখায় দশ বিশ থেকে প্রায় শ খানেক রেফারেন্সও দেখে নিজের পড়াশোনার পরিসর, জানার পরিসরকে খুবই ক্ষুদ্র মনে হত- নেশার মত হয়ে পড়েছিল ব্লগ পড়া। মুক্তমনা ব্লগের অজানা-অচেনা-অদেখা মানুষগুলো আমার সময়ের এমনই অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিল যে যখনই সুযোগ পেতাম মুক্তমনায় থাকতাম। এমনও সময় গিয়েছে যখন এত দ্রুত আর এত বেশি মন্তব্য টাইপ করতাম যে প্রায়ই “ধীরে বৎস ধীরে” ওয়ার্নিং পেতাম!
অভিজিৎদা এবং আরো অনেকের উৎসাহে একসময় লেখাও শুরু করি, সে ছিল আমার জীবনের এক উত্তাল সময়। আমার কাঁচা চিন্তাভাবনা থেকে উৎসারিত লেখায় আলোচনা, উৎসাহ আর মন্তব্য দিয়ে সাহায্য করেছেন সব অদেখা ভাই-আপু-বন্ধুরা। খুব উত্তেজনা নিয়ে একসময় সরাসরি দেখা করি মুক্তমনার কিছু বন্ধুর সাথে। অদ্ভুত আর মজার কিছু সময়, ঘোরলাগা কিছু আড্ডা-বইমেলায়! দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি “বইমেলা” ব্যাপারটা একসময় অবিশ্বাস্য কিছু দুঃসময়ের স্মৃতির সাথে একাকার হয়ে যাবে।
মৃতদেহকেও যে খুন করা যায়, লাশেরও যে পরিচয় থাকতে হয়, তা আমরা সেই শাহবাগ আন্দোলনের সময় রাজীব হায়দারের মৃত্যুর পরে দেখেছি, অভিজিৎদার মৃত্যুর পর থেকে তার পুনরাবৃত্তি আরো জঘন্যরূপে শুরু হয়েছে। যেন দুপেয়ে একটা প্রানীর একটিই পরিচয়- জীবিত ও মৃত অবস্থায় তাকে হতে হবে মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-ক্রিশ্চান-আস্তিক বা নাস্তিক, যেন মানবিকতার সংজ্ঞা তৈরি হতে হবে খৎনা বা ধর্ম দেখে, যেন “মানুষ” পরিচয়টাই মাঝখান থেকে হারিয়ে যেতে হবে!
যারা অভিজিৎদার মত মানুষদেরকে জীবনে ও মৃত্যুতে প্রতিনিয়ত হত্যা করে চলেছে- দাদা একটা ব্লগ লেখার জন্য যে পরিমান বই পড়তেন তার কণামাত্রও সারাজীবনে তারা পড়েনি। তারা জানেনা Being a true humanitarian is difficult, because it is the simplest of all the concepts. তারা বুঝবেনা নিচের এই কথাগুলো লিখতে হলে বুকে যে কতটুকু হৃদয় থাকতে হয়, মানবিকতা নিয়ে কি পরিষ্কার একটা ধারণা থাকতে হয়!
“Atheism is characterized by an absence of belief in the existence of supernatural gods or goddesses. To me, it is a rational concept to oppose any unscientific and irrational belief.
But being an atheist does not automatically guarantee you to be entirely free from prejudice or hatred, unless you have a genuine feeling for humanity. Whether you are religious or not, the nut cracks are everywhere. History suggests, there were indeed many non-religious heartless autocratic rulers who mercilessly killed numerous countrymen, now we know there is Craig Stephen Hicks too who has a hatred for Muslims. These criminals deserve no sympathy, no excuse.
The NC Chapel Hill killings are inhumane, disgusting, gruesome and should be denounced by every human being having a slightest level of conscience.
Today my thoughts are with Dea Shaddy Barkat, Yusor Mohammad, and Razan Mohammad Abu-Salha.”

এই কথাগুলো মনে মনে আওড়াই প্রায়ই, এইরকম মানুষ হবার চেষ্টা করি। আমাদের চেষ্টাতেই অভিজিৎদা বেঁচে আছেন, থাকবেন।