অভিজিৎ রায় এই মানুষটিকে আমি কতদিন ধরে চিনি ? খুব বেশী দিন না হয়তো । দুই বছর বা তার চেয়ে বেশী কিছু সময় হয়তো । তাঁর লেখার সাথে পরিচয় যখন তাঁর ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটি বের হয় তখন থেকে । কারণ, তখন অনলাইন ভিত্তিক একটি বই বিক্রির প্রতিষ্ঠান হুমকি পেয়ে তাঁর বইটি সরিয়ে নিয়েছিল তাদের বিক্রির তালিকা থেকে। কেন তাঁর বই সরানো হলো সেই আগ্রহ থেকেই মূলতঃ তাঁর লেখা পড়তে শুরু করি । আজ মুক্তমনার এই ‘লিখুন আলোকিত হওয়ার গল্প’ আয়োজনে যখন ভাবলাম আমিও কিছু লিখি তখন ভাবছি শুরুতেই কি লিখব । আমি যখন ভাবতে বসলাম কি কথা লিখবো তখন সেই অভিজিৎ রায়ের হাত ধরেই লেখার কিছুটা বিষয় খুঁজে নিলাম। অভিজিৎ রায় এই মানুষটি আজ নেই কিন্তু তারপরেও তিনি কিভাবে মানুষকে মোটিভেট করতে পারে বা কেউ যদি তাঁর থেকে কিছু শিখতে চায় সে কি শিখতে পারে তাঁর লেখা থেকে, তাঁর জীবন থেকে সেগুলোই আমার ভাবনার আলোকে একটু লেখার চেষ্টা করছি মাত্র।

আমার কাছে সর্বপ্রথম অভিজিৎ রায়ের যে গুণটি ভালো লেগেছে এবং যেটা আমি গ্রহন করবো বলে মনস্থির করেছি তা হলো, অভিজিৎ রায়ের পড়ার গুণ। একজন মানুষ তখনই একজন ভালো লেখক হয়ে উঠতে পারে যখন তার মাঝে একটি পড়ার আগ্রহ গড়ে উঠে । তাঁর প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু যেমন আলাদা ছিল তেমনি তাঁর লেখা পড়লেই বুঝা যেত এই লেখাটির পেছনে লেখকের শ্রমের কথা। একজন মানুষ কত পড়াশোনা করলে তা নিয়ে এতো গভীরভাবে লিখতে পারে এবং ঐ নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে পারে সেটা তাঁর প্রতিটা লেখা পড়ার পর আমার মনে হতো । কত দূর এক দেশে বসে তিনি কতই না বিচিত্র বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেছেন তা ভাবলেই অবাক লাগে । ভাবি, তাঁর কি কোন দরকার ছিল মানুষের জন্য এসব লেখার ? কত আরাম আয়েসের জীবন তিনি ব্যয় করতে পারতেন কিন্তু তা না করে তিনি অনেক পরিশ্রমের দ্বারা তাঁর এক একটি লেখা দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর এই ব্যাপ্ত পড়ার গুণ সত্যিই এখনকার এই সময়ে খুব একটা দেখা যায়না বললেই চলে। কারো কাছে এখন এতো সময় নেই গভীরভাবে কোন বিষয় নিয়ে পড়ার । শুধুমাত্র নিজেদের পড়ার বইয়ের বাদে আমাদের মাঝে বই পড়ার আগ্রহ যে অনেকটাই কমে এসেছে তা আমরা আশেপাশে লক্ষ্য করলেই দেখি। তিনি খুব নীরবেই কাজ করে গেছেন । তাঁর এই পড়ার গুণটি আমাদের সমাজের প্রতি স্তরে দরকার । ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে এই পড়ার গুরুত্ব যদি আমরা পৌছে দিতে পারি তাহলে কত বড় বিপ্লব খুব নীরবেই যে এই দেশে সংগঠিত হবে তা আমাদের কল্পনার বাইরে। শুধুমাত্র শহর নয়, গ্রামে এবং মফস্বলে এই পড়ার গুরুত্ব আমাদের ছড়িয়ে দিতে হবে তাহলেই বাজবে অন্ধকার ভাঙার গান। তাঁর এই ব্যাপ্ত বিষয়ের উপর পড়ার গুণ নিজেদের মাঝে সিকিভাগও যদি আমরা নিতে পারি নিজেদের অবস্থারও একটা পরিবর্তন আসবে তা বলাই বাহুল্য। এতো ব্যস্ততা, হরেক রকম কাজের মাঝে থেকেও যদি একজন মানুষ এতো পড়ালেখা করতে পারে তাহলে আমরা আমাদের অলস সময়গুলো কেন একটু পড়ার পিছনে ব্যয় করবো না । এই প্রশ্ন নিজেদের করলে আমরাই উত্তর পেয়ে যাব আশা করি। তাই নিজের মাঝে এই গুণটা আয়ত্ত করার চেষ্টা আমি অব্যাহত রেখেছি এবং সেই চেষ্টা রাখবো আশা করি। এই গুণ রপ্ত করলে একজন নিজে যেমন আলোকিত হবে আশেপাশের সবাই তেমনি সেই আলোর আভায় উদ্ভাসিত হবে এই নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। এভাবেই তাঁর এই গুণের কিছুটা যদি আমরা নিজেদের মাঝে নেই তাহলে আমরাও আলোকিত মানুষ হওয়ার পথে এক পা অগ্রসর হবো ।

অভিজিৎ রায়কে নিয়ে স্বল্প জ্ঞানের অধিকারী মানুষের মাঝে যে কথাটা ঘিরে আছে সেটি হচ্ছে তিনি একজন ‘নাস্তিক’ । একজন মানুষ ভিন্ন কিছুতে তার আস্থা স্থাপন করলেই তাকে আমরা নাস্তিক উপাধি দিয়ে দেই। সে যদি বিজ্ঞানের চর্চা করে,যদি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে,যদি মুক্তিবুদ্ধির কথা বলে তাকে কেন নাস্তিক ট্যাগ পেতে হবে সেটি আমার বোধগম্য হয় না। হয়তো এর পিছনে আমাদের অন্ধ বিশ্বাস, নতুনকে মেনে না নিতে চাওয়ার মন মানসিকতা, জ্ঞানের চর্চা না করা, খুব স্বল্প পরিমাণ জ্ঞানের উপর নিজেদের আস্থা রাখা এসবই দায়ী বলে আমার মনে হয়। তিনি বলেছেন, ‘আমি নাস্তিক। কিন্তু আমার আশে পাশের বহু কাছের মানুষজন বন্ধু বান্ধবই মুসলিম। তাদের উপর আমার কোন রাগ নেই, নেই কোন ঘৃণা। তাদের আনন্দের দিনে আমিও আনন্দিত হই। তাদের উপর নিপীড়ন হলে আমিও বেদনার্ত হই। অতীতেও তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবো। এটাই আমার মানবতার শিক্ষা।’ হয়তো তাঁর কোন কিছুতে বিশ্বাস না থাকতেই পারে । এই কারণেই যে সে মানুষটি খারাপ মানুষ হয়ে যাবে সেটি কিরকম কথা আমার ঘটে তা কিছুতেই ঢুকে না। যারা বলে তিনি নাস্তিক তাদের মতে নাস্তিকরা দুনিয়ার সবথেকে খারাপ প্রানী, মনে হয় এর চেয়ে নিকৃষ্ট আর কিছু নেই। যদি এমনটি হবেই তবে কিভাবে তারা মানবতার এতো সুন্দর কথা শুনিয়ে যায়। মানুষকে ভালোবাসার কথা বলে। তাঁর প্রবন্ধ ‘ইসরায়েলের বর্বরতার সমাপ্তি হওয়া প্রয়োজন’ সেখানে তিনি লিখে গেছেন, ‘মুসলিম’ তো কোন বিশ্বাস নয়, মুসলিমরা হল রক্তমাংসের মানুষ। যাদের রয়েছে আশা, আকাঙ্ক্ষা, ভালবাসা আর সুন্দরভাবে বেঁচে থাকবার অধিকার।’ তিনি যদি নাস্তিকই হবে তা হলে তাঁর হাত দিয়ে নিশ্চয়ই এই লেখা বের হতো না। যারা তাকে চিনতে পারেননি তাদেরকে আরো পড়াশোনার আহবান জানানো ছাড়া আর কোন উপায় আমার জানা নেই। তাঁর এই মানবতার কথা,ধর্মনিরপেক্ষতার কথা, অপরকে ভালোবাসার কথা সবকিছুই আমাদের আলোকিত হতে সাহায্য করবে বলে আমি মনে করি। যারা আলোকিত হতে চায় তাদের জন্য তাঁর লেখা যথেষ্ট কিন্তু যারা শুনেও কিছু বিশ্বাস করতে চাইবে না, পড়েও দেখবে না তাদের সাথে বৃথা তর্ক করে কোন লাভ আছে বলে আমি মনে করি না । আমিও নিজেও ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবেই বেড়ে উঠেছি। তাঁর লেখা সেই পথে আমার জ্ঞানের দুয়ার বিস্তারে ভূমিকা রেখেছে এটাই তাঁর লেখার গুরুত্ব আমার কাছে ।

আর দশটা-পাঁচটা হুমকি পেয়ে বিদেশে গা ঢাকা দেয়া লেখকের মতো ছিলেন না অভিজিৎ রায়। তিনি ছিলেন সাহসী এক কলমযোদ্ধা । যিনি অনেক হুমকি উপেক্ষা করে লিখে গিয়েছেন তাঁর কথা । তৈরি করেছেন আরো মানুষের লেখার একটা প্ল্যাটফর্ম । তাঁর বক্তব্যের সাহায্য নিয়েই বলতে হয় তাঁর সাহসের কথা, ‘যারা ভাবে বিনা রক্তে বিজয় অর্জিত হয়ে যাবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের মতো জিনিস নিয়ে যখন থেকে আমরা লেখা শুরু করেছি জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালেখি করছি।’ এবং এই বক্তব্যের যথার্থতা তিনি তাঁর জীবন দিয়েই প্রমাণ করে গেছেন। বুঝিয়ে গেছেন, যতবার তোমরা ঐ অন্ধকারের বিরুদ্ধে লেখালেখি করবে ততবার তোমাদের উপর আঘাত করতে আসবে ঐ হায়েনার দল। তারা ঐ অন্ধকার থেকেই আসবে। তারা আসবে নীরবে ভীরু, কাপুরুষের মতো। তাদের কলমে কোন জোর নেই, নেই কোন বুদ্ধিমত্তা, নেই স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা। তারা নতুনের বার্তা শুনতে চায় না। তারা দেখতে চায় না আলোর মুখ। তারা পুরোনো অন্ধকার নিয়ে বেঁচে থাকতেই খুশী। তাই তোমরা যদি আলো আনতে চাও, যদি চাও অন্যকে আলোকিত করতে তাহলে সবসময় বুকে সাহস রেখে, মন দৃঢ়চিত্ত করে তবেই লিখতে হবে ঐ অপশক্তির বিরুদ্ধে । সম্মুখ সমরে যোদ্ধার মৃত্যু আলিঙ্গন করলেও তার সহযোদ্ধারা যাতে কখনোই এই ভয়ে বিচলিত হয়ে পিছপা না হয় সেই কথাই তিনি বলতে চেয়েছেন বারবার। তিনি আমাদের দেশের হাজারো তরুনের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলেছেন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই । শুধুমাত্র বিজ্ঞান, মুক্তবুদ্ধি বা ধর্মনিরপেক্ষতা নয়; তিনি মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধীতাকারী শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার বাণী তুলে ধরেছেন। তিনি বলছেন প্রতিটি জায়গায় এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মানুষকে জাগিয়ে তুলতে হবে নাহলে এই দেশ কখনোই মুক্ত হবে না। তিনি নিজের বেঁচে থাকা অবস্থায় একটি বিচারের সাজা দেখে যেতে চেয়েছিলেন যা তিনি দেখে যেতে পেরেছেন এইটা অনেক আশার কথা।

প্রথার বিরুদ্ধে লিখলেই এই দেশে এক শ্রেণীর বিরাগভাজন হয়ে যেতে হয় । ভিন্ন কিছু উপস্থাপন হলেই এদেশে কণ্ঠরোধ হয়ে যায় । যত ভালো স্কুল, কলেজ এদেশে থাকুক না কেন , যত ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রছাত্রী এদেশে বের হোক না কেন, নিজেদের মত ভাবতে না পারলে এমন মানুষদের দিয়ে আমাদের খুব বেশী কোন কাজ হবে বলে মনে করিনা । আস্তিকের সংজ্ঞা পরিবার থেকে নিয়ে বড় হয়ে ধর্মকর্ম পালন করলেই দেশ ফুলে ফসলে ভরে উঠবে না এটা সবার আগে মনে রাখতে হবে। আমাদের সবকিছু দরকার । ভালোর সাথে সাথে খারাপ দরকার , সত্যের সাথে মিথ্যা দরকার। তারপর আমাদের নিজেদের বুদ্ধি, জ্ঞান-গরিমা দিয়ে আমাদের বুঝতে হবে কোনটা আমরা গ্রহন করবো। আমার সবচেয়ে খারাপ লাগে একটা জিনিস তা হলো, শুধুমাত্র লেখার জন্য মানুষগুলাকে হত্যা করা হয়েছে ঠাণ্ডা মাথায় । তারা কারো মসজিদ ভাঙ্গে নাই, মন্দিরে হাত দেয় নাই, কারো গির্জায় আঘাত করে নাই। শুধুমাত্র লেখার কারণে…! এটা ভাবতেই সবথেকে বেশী খারাপ লাগে যেই লেখা মানুষের নুন্যতম ক্ষতিও সাধন করে নাই তার জন্য তাদের জীবন দিতে হলো ।

বারবার প্রথাবিরোধীরাই জয়ী হয়েছে, কারো কাছে হারে নাই। তাদের জিততে সময় একটু বেশী লাগে, কিন্তু দিনশেষে তারাই জয়ী হয়। তাদের কথা পরবর্তীতে সবার বোধগম্য হয়। আলোকিত করে চারপাশ। সক্রেটিস, চে, স্পার্টাকাস যারাই ভিন্ন কিছু চেয়ে কিছু নির্দিষ্ট মানুষের বিরাগভাজন হয়েছিলো তাদেরকেও সেই মানুষদের হাতে খুন হতে হয়েছে। কিন্তু তাদের ভাবনা, চিন্তা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ সবই মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে যত সময়ই লাগুক । লেখালেখি চলবে , কোন পরাশক্তি, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িক ট্যাগ কিছুই তাদের দমাতে পারবে না । প্রগতিকে কখনোই গলা কেটে, কোপ মেরে থামানো যায় না । মত প্রকাশ থাকবেই । আপনার ভালো লাগুক বা না লাগুক ।

শেষমেশ, হুমায়ুন আজাদ স্যারের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, ‘পৃথিবীতে যতোদিন অন্তত একজনও প্রথাবিরোধী মানুষ থাকবে, ততোদিন পৃথিবী মানুষের।’ অভিজিৎ রায় না থাকলেও তাঁর কর্মযজ্ঞ আছে, যার সূত্র ধরে এক পথ খুঁজে ফেরা পথিক হয়তো একদিন চলে যাবে আলোর ঠিকানায়, আমি এই আশাই করি । সেই আলোর ঠিকানায় পৌছে আরো অনেক অভিজিৎ রায় আসবে এই মর্তে যারা ছড়িয়ে দিবে আলোচ্ছটা যা দিয়ে ধুয়ে যাবে অন্ধকার আর কুসংস্কার। আমি সেই আলোয় আলোকিত হতে চাই এবং সেই পথে পা বাড়াই যেই পথে আছে ভালোবাসা এবং পরিশুদ্ধ জ্ঞান । এই দানবের মাঝে অভিজিৎ রায় শুনিয়ে গেছেন মানবের গান । যেই গানে আছে মুক্তি এবং আলোর সন্ধান । মানবতার সৌন্দর্য যদি আমরা একবার উপভোগ করতে পারি, এর গুরুত্ব যদি আমরা উপলব্ধি করতে পারি তাহলেই হাসবে সকল মুখ আনন্দ আর ভালোবাসা নিয়ে। এই বিশ্বে দানবের মাঝে বেজে উঠুক মানবের গান তাহলেই আসবে সার্থকতা যে গান অভিজিৎ রায় শুনিয়ে গিয়েছেন তাঁর কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে ।