বাংলাদেশে চাঁদকে যতটা ভালোবাসা হয় ততোটা সূর্যকে আপন করে নেয়া হয় না। বাঙলার মায়েরা বাচ্চাদের চাঁদের গল্প শোনায়, কিন্তু আলোকিত সূর্যের তাৎপর্য বর্ণনা করেন না। অভিজিৎ রায় ছিলেন বাঙলার সূর্য; বাঙলার আলোকিত মানুষ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পুত্র যদি আততায়ীদের দ্বারা নিহত হতেন তবে কী তিনি নিশ্চুপ থাকতেন? অথবা প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রীর পুত্রকে যদি হত্যা করা হত, তবেও কী তিনি নিশ্চুপ থাকতেন? প্রশ্ন জাগে মনে, স্বার্থপরতা কাকে বলে?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লেখক অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব করেন নি। এমনকি তিনি সামান্যটুকু সাড়াশব্দ করেন নি। সরকারের এক গৃহপালিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডটি ভিন্নখাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বামপন্থি ভদ্রলোকেরাও হিন্দু শব্দটি উচ্চারণ করে ভিন্নখাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের একজন তুখোড় নাস্তিক অধ্যাপক লেখক অভিজিৎ রায় সম্বন্ধে বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। সাংবাদিক তথা এক বিখ্যাত ব্লগার একটি আবেগপ্রবণ নোট লিখে তার দায়িত্ব শেষ করেন, এবং টেলিভিশনে বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। যারা মৃত লেখকের সাথে শেষ ৩০ মিনিট উপস্থিত ছিলেন তারাও মুখ ফুটে কিছু বলতে চান নি। প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী প্রধানমন্ত্রীর মত একফোঁটা সাড়াশব্দ করেন নি। ক্ষমতাশীল দলের কেউ দোষী অপরাধী খুনিদের গ্রেপ্তার করতে হবে বলে কোন বক্তব্যও শোনা যায় নি। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের লৌহ মানবও নিষ্প্রাণ ছিলেন।
বাঙলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অভিজিৎ রায়কে লেখক হিশেবে নেন নি, তিনি অবিশ্বাসী হিশেবে দেখেছেন। অভিজিৎ রায় শুধু বিশিষ্ট ব্যক্তির সন্তান বলেই হত্যাকাণ্ডের পর অভিজিৎ রায়ের পিতাকে ফোন করেছিলেন। সাধারণ কোন ব্লগার-লেখক বা অপরিচিত কোন অবিশ্বাসী মানুষকে হত্যা করা হলেও প্রধানমন্ত্রী ফোন করে খোঁজ নিতেন না। ২০১৩ সালে ইসলামী মৌলবাদী দ্বারা এক নাস্তিক ব্লগারের হত্যা পর দৌড়ে গিয়ে নিহত ব্লগারের বাসায় যাওয়া এবং শহিদ আখ্যা দেওয়ার দুঃস্মৃতি প্রধানমন্ত্রী এখনও ভুলতে পারেন নি। প্রধানমন্ত্রী বড্ড ভীত; অতীতে তিক্ত অভিজ্ঞতার খেসারত দিতে হয়েছিল রাজনীতিতে চরম মূল্যে। এরপর থেকেই তিনি মৌলবাদীদের সাথে আপোষ করতে শুরু করেন। নষ্ট রাজনীতির বেড়াজালে আঁটকে পড়ে বিসর্জন দিয়েছিলেন নীতি-নৈতিকতা। ভালোবাসা স্বরূপ মৌলবাদীদের দিতে থাকেন কোটি কোটি টাকা এবং শত শত বিঘা জমি। বর্তমানে আওয়ামী সরকার যতটা ধর্মনিপরেক্ষ, তার দ্বিগুণ মৌলবাদী। অভিজিৎ রায়ের মূল্যায়ন এই নষ্ট ভ্রষ্টরা করতে পারবে না। সূর্যকে ছুঁয়ে দেখা এত সহজ নয়।
অভিজিৎ রায় কে ছিলেন?
তিনি কি সন্ত্রাসী ছিলেন? বাঙলাদেশের কতটি থানায় তার নামে মামলা ছিল? তিনি কি কখনও ধর্ষণের আসামী ছিলেন? নাকি তার নামে বিস্ফোরণ মামলা ছিল? এসিড নিক্ষেপের দায়ে তাঁকে কি কখনও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল? নাকি তিনি দরবেশ বাবার মত দুর্নীতি পরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন? অভিজিৎ রায় তাহলে কী ছিলেন?
তিনি লেখক ছিলেন। বিজ্ঞানের লেখক ছিলেন। স্বাধীনচেতা ছিলেন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-দর্শনে তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল। তিনি কী কখনও হাতে অস্র তুলে নিয়েছিলেন? না, তিনি কলম দিয়ে লিখতেন। অস্র-চাপাতি-বোমার বিপক্ষে লিখতেন। তিনি মানবতার কথা বলতেন। সমগ্র পৃথিবীর কথা বাদই দিলাম।শুধু বাঙলাদেশেই হাজার হাজার ধরণের চিন্তাধারার মানুষ আছে। সেক্ষেত্রে তিনিও একটু ব্যতিক্রম ছিলেন। প্রথাগত জীবনকে আগলে না ধরে তিনি বিজ্ঞানকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। মুক্ত করতে পেরেছিলেন নানা ধরণের সীমাবদ্ধতা। এটা কি একবিংশ শতাব্দীতে খুব বড় অপরাধ!
একজন সন্ত্রাসী-গডফাদারের মৃত্যুতেও বাঙলার প্রধান প্রধান মানুষেরা কিছু না কিছু বলে থাকেন কিন্তু একজন সৎ সাহসী লেখক অভিজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে তারা নিশ্চুপ ছিলেন। তবে কি এ দেশে একজন লেখকের চে’ একজন সন্ত্রাসীর মূল্য অনেক? আজ যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পুত্র নিহত হতেন তাহলে কি কেউ গ্রেপ্তার হত না? কেউ কি বক্তব্য দিত না? অভিজিৎ রায় তাহলে এতটাই শক্তিশালী ছিলেন যে তাঁকে নিয়ে বক্তব্য দেয়ার মত মানুষ সমাজে নেই!
এ লজ্জা কোথায় রাখি! অভিজিৎ রায়ের উপর বর্বরোচিত হামলায় সারা বিশ্ব যেখানে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেখানে যে দেশের মানুষের জন্য তিনি লড়াই করেছিলেন সেখানে তেমন কোন সাড়াশব্দ হয় নি। এখনও তাহলে বাঙলার মানুষেরা অন্ধত্বকে বরণ করে আছে! বাঙলাদেশে সবই আছে, শুধু লেখক নেই। বর্তমানে যারা লেখক আছেন তারা অধিকাংশই গৃহপালিত। আপোষের লেখনীতে তারা বাঙলাতে খুব জনপ্রিয়। কাজী নজরুল ইসলাম- হিন্দু না ওরা মুসলিম এই জিজ্ঞাসে কোন জন হে, কাণ্ডারি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র।
একবিংশ শতাব্দীতে বাস করেও যে দেশে আস্তিক নাস্তিকের উপর ভিত্তি করে মানুষকে ভালো খারাপ হিশেবে মূল্যায়ন করা হয়; সে দেশে আর যাই থাকুক না কেনো, সত্য নেই, বিজ্ঞান নেই, ভালো নেই, ভালোবাসা নেই, ভবিষ্যৎ নেই। সত্য বলতে হবে, যে কোন মূল্যে সত্য বলতে হবে। যে কারো বিপক্ষেই যাক না কেনো- সত্য বলতে হবে। যে আলোকিত অভিজিৎ রায় সত্য জানতে শিখিয়েছিলেন, সূর্য দেখতে শিখিয়েছিলেন, আমরা কীভাবে তাঁর আদর্শের সাথে বেঈমানি করতে পারি!
অনন্য আজাদ
ব্লগার ও লেখক
জার্মানি
চৌঠা সেপ্টেম্বর ২০১৫
মিথ্যাচার করে যদি পীর, পয়গম্বর, অবতার টাইটেল পাওয়া যায় তো সদাচারীর সমস্যা কোথায়। অভিজিত অন্তত স্পষ্ট সত্য কথা বলে দিয়েছেন। কিংবা বলতে পারা শিখিয়েছেন। তার আগেও অনেকে বলতে চেয়েছেন বা চেস্টা করেছেন। কিন্তু অভিজিত স্পষ্ট করে সত্য বলার অবতারণা করেছেন। অতঃপর জীবন দিয়ে এই সাহসীকতার মূল্য দিয়েছেন। সেই অর্থে বাংলা ভাষায় তিনি সত্যের অবতার বটে।
@কাজী রহমান। যতটুকু অভিজিতকে পড়েছি তাতে বিনম্র শ্রদ্ধা আর মুগ্ধতা ছাড়া কিছুই সৃষ্টি হয়নি মনে তার সম্পর্কে । তিনিতো অত্যন্ত সাবলিলভাবে এই দেশে বাংলা ভাষায় সত্য পঠনের অবতারণা করেছেন বলেই আমি মনে করি । অনেকেই এখানে সেখানে বলতে চেস্টা করেছেন। কিন্তু সাহস নিয়ে একেবারে নিরেট সত্য কথাটা সবার মুখের উপরে সম্ভবতঃ তিনিই প্রথম বলেছেন বা এই বলাটার অবতারণা করেছেন । তাই তিনি আমার কাছে অবতার বই কিছু নন। দোষ ত্রুটি যদি কিছু পাই নিশ্চয়ই বলব।
“অভিজিৎ রায়কে ধারণ করার মত বাঙলাদেশ এখনও গড়ে তুলতে পারি নি”-
ধর্মের মত করে যদি বিজ্ঞানেও অবতার আছে বলে চিন্তা করা যায়, তাহলে অভিজিত ছিলেন বাংলাদেশের অবতার। তার দেখানো সত্য পথে একদিন এদেশের সহশ্র মানুষ হাটবে নিশ্চিত।
অভিজিৎ এইসব ভক্ত অবতার ধরণের কিছু একেবারেই পছন্দ করত না। বলত, ভক্তরা দোষত্রুটি ঢেকে রাখে এবং এই অবস্থায়টা কিছুতেই সত্যের কাছাকাছি হতে পারে না। মানুষের যদি ভুল ভ্রান্তি না হল তাহলে সে মানুষ কি করে হল?