লেখকঃ সোজাকথা
কন্নড় সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক, গবেষক এবং কর্নাটক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য এম মালেশাপ্পা কালবুর্গি গত ৩০ শে আগষ্ট নিজের বাড়িতেই হিন্দু মৌলবাদীদের গুলিতে খুন হয়েছেন । ভারতের কর্নাটক রাজ্যের বাসিন্দা এই লেখক সারাজীবন গবেষনা করে কাটিয়েছেন । কন্নড় সাহিত্যের নব্য আন্দোলনের পথিকৃৎ কালবর্গি জীবদ্দশায় পদ্মভূষন ও জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন । তিনি তার ক্ষুরধার যুক্তিবাদী লেখনীতে হিন্দু দেবদেবীর অসারতা নিয়ে সরব ছিলেন । হিন্দু দেবদেবী যে অকর্মন্য, তাদের যে, কোন অলৌকিক শক্তি নেই একথা তিনি বরাবরই বলেছেন । এদিন সকাল ৮.৪০ মিনিটে ধারওয়াড়ের কল্যাননগরে আততায়ী মোটরগাড়িতে করে এসে লেখকের দরজায় কড়া নাড়ে । লেখকের স্ত্রী দরজা খুললে, আততায়ী অধ্যাপক কোথায় আছে জানতে চান । স্ত্রীর পাশেই লেখক এসে দাঁড়ালে আততায়ী খুব কাছ থেকে দু চোখের মাঝামাঝি লক্ষ্য করে গুলি করেন । এভাবে অবলীলায় খুন করার পর ঘাতক খুব শান্ত মাথায় আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মোটর গাড়িতে উঠে এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে যান । কালবুর্গিকে তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা তাকে মৃত বলে ঘোষনা করে । সাতাত্তর বছর বয়সী কালবুর্গি ছিলেন আপাদমস্তক নাস্তিক । ধর্মীয় ভাবাবেগে ‘আঘাত’ করার অভিযোগে গত বছর জুন মাসে অধ্যাপক কালবুর্গি এবং লেখক ইউ আর অনন্তমুর্তির(এখন প্রয়াত) বিরুদ্ধে মামলা করেন এক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন । কালবুর্গি অনন্তমুর্তির ব্রাক্ষণ্যবাদ, কুসংস্কার এবং ভন্ডামির বিরুদ্ধে লেখা উপন্যাস “হোয়াই নুড ওরশিপ ইস নট আ্যাকসেপটেবল” গ্রন্থের পাশে জোরালো ভাবে দাঁড়ান । গত বছর জুনের ৯ তারিখে কালবুর্গি তা নিয়ে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেন । তিনি বলেন- “লেখক অনন্তমুর্তি তার লেখায় প্রমান করেছেন হিন্দু দেবদেবীরা আদৌ মহাশক্তিধর নয়” । এই বিবৃতির পরই বিশ্বহিন্দুপরিষদ, বজরঙ দল, শ্রীরাম সেনার রোষের মুখে পড়েন অধ্যাপক কালবুর্গি । হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি রাজ্যজুড়ে বিক্ষোভ দেখায় । কুশপুতুল পোড়ায় । এমনই এক বিক্ষোভে তার বাড়ি লক্ষ্য করে ইটপাটকেল, সোডার বোতল ছোড়ে বজরঙ দলের কর্মীরা । এছাড়াও কালবুর্গি জীবনে বহুবার হিন্দুমৌলবাদীদের থেকে প্রাননাশের হুমকি পেয়েছেন ।
null
এম মালেশাপ্পা কালবুর্গি
মৌলবাদীরা কালবুর্গিকে হত্যা করে আবার বুঝিয়ে দিতে চাইল সনাতন পন্থার বিরোধিতা করলে খুনই ভবিতব্য । এর আগে এই ভারতেই ২০ আগষ্ট ২০১৩ সালে পুনেতে খুন হন মহারাষ্ট্রের কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলন তথা জাতপাতের ভেদাভেদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আজীবন যোদ্ধা সুচিকিৎসক নরেন্দ্র দাভেলকর । তাকেও খুনিরা গুলি করে খুন করে । চলতি বছরের ফেব্রুয়ারীর ২০ তারিখে ঠিক একই কায়দা অবলম্বন করে মৌলবাদীরা কোলাপুরের যুক্তিবাদী নেতা গোবিন্দ পানেসারেকে খুন করেন ।
সব কটা হত্যার ক্ষেত্রে সরকারের গয়ংগচ্ছ মনোভাব । কোন খুনের ক্ষেত্রে প্রশাসন বিচার করা তো দুরে থাক এখনো পর্যন্ত একজনকেও গ্রেফতার করতে পারিনি ।
কিন্তু সম্প্রতি নাগরিক সমাজের ভুমিকাটাও হতাশাজনক । পূর্ব ভারতের অগ্রনী শহর কলকাতাতে কালবুর্গি হত্যা নিয়ে বিশেষ কোন জমায়েত লক্ষ্য করা গেল না । এই শহর অতীতে বহু ঘটনায় পথে নামলেও কালবুর্গি কিংবা বাংলাদেশের ব্লগার হত্যা নিয়ে নিরুত্তর । পুর্বভারতের এই অগ্রনী বাঙালি শহরটি সম্ভবত দিন দিন মৌলবাদীদের কবলে চলে যাচ্ছে । প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় এই প্রগতিশীল শহরটিতে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে লেখিকা তসলিমা নাসরিন থাকতে চেয়েছিলেন । মৌলবাদীদের কাছে এই শহরের হত্তাকর্তারা নিজেদের বিবেক বিসর্জন দেওয়ার কারনে এই শহর থেকেও একদিন তসলিমাকে এক কাপড়েই বিদায় নিতে হয়েছিলো । এই শহর এখন সম্ভবত প্রতিবাদ ভুলে গেছে । পুরনো গৌরব ভুলে এই শহর এখন মধ্যযুগে মুখ লুকাতে চাইছে । তাই এই শহরের কথা না বলাই ভালো ।
কোন হত্যার পরেই মৌলবাদীদের তরফ থেকে যেমন হুমকি আসে পরবর্তী হত্যা করার । ঠিক তেমন ঢঙে কালবুর্গিকে হত্যার পরই বজরঙ দলের যৌথ আহ্বায়ক ভূবিথ শেট্টির টুইট- “তখন ছিলো ইউ আর অনন্তমূর্তি, এখন এম এম কালবুর্গি । হিন্দুত্বকে নিয়ে তামাশা এবং একটি কুকুরের মৃত্যু । এবং প্রিয় কে এস ভগবান এরপর আপনি” ।
null
ভুবিথ শেট্টির টুইট
এই কে এস ভগবান হলেন আরও একজন কন্নড় লেখক । ইনিও নাস্তিকতার স্বপক্ষে লেখালিখি করেন ।
ঠিক একই ভাবে গত মাসের ৭ তারিখে বাংলাদেশী ব্লগের লেখক নিলাদ্রী চক্রবর্তী(নিলয় নীল)-কে মুসলিম মৌলবাদীরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে গনমাধ্যমে ইমেল পাঠায় । এই ইমেলে অনেক হুমকির সাথে বলা হয়-“ যদি তোমাদের বাকস্বাধীনতা কোন সীমানা মানতে প্রস্তুত না থাকে, তবে তোমাদের হৃদয় যেন আমাদের চাপাতির স্বাধীনতার জন্য উন্মুক্ত থাকে, আমরা অচিরেই তোমাদের কাছে আসছি” ।
null
আনসার-আল-ইসলামের বিবৃতি
সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশেও মুক্তচিন্তার লেখকদের নির্বিচারে হত্যা, চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে । ২০০৪ সালে হুমায়ুন আজাদের পর ২০১৩ সালের ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়। একই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে এবং পিটিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের কর্মী ও ব্লগার জাফর মুন্সিকে হত্যা করা হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার রাজীব হায়দার শোভনকে। ২৮ ফেব্রুয়ারি হত্যা করা হয় ব্লগার মামুন হোসেনকে । ২ মার্চ ব্লগার জগৎজ্যোতি তালুকদার ও জিয়াউদ্দিন জাকারিয়া বাবুকে খুন করা হয়। ৭ মার্চ রাতে মিরপুরে কুপিয়ে জখম করা হয় ব্লগার সানিউর রহমানকে। ৯ এপ্রিল কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার আরিফ রায়হান দ্বীপকে। জুনে কোপানো হয় গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার রাকিব আল মামুনকে। ১১ আগস্ট তন্ময় আহমেদকে কুপিয়ে জখম করা হয়। এগুলি ২০১৩ সালে ঘটে যাওয়া আক্রমন গুলি ।
২০১৫ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারী বইমেলায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় খ্যাতনামা বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে এবং তার স্ত্রী রফিদা আহমেদ বন্যাও আক্রমনের শিকার হয়ে মারাত্মক ভাবে জখম হন । একই বছরের ৩০ মার্চ বাসার সামনে রাস্তায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার ওয়াশিকুর বাবুকে । ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকেও ১২-ই মে তারিখে একইভাবে হত্যা করা হয়। এখন পর্যন্ত সর্বশেষ হত্যার শিকার হল নীলাদ্রী চক্রবর্তী । এবং নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছেন অন্তত ৬জন ব্লগার । এসব ছাড়াও বহু লেখকদের উপর ঝুলছে প্রাননাশের হুমকি । সম্প্রতি খবরে প্রকাশ একজন মহিলা ব্লগারকেও দুই অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি অনুসরন করেছে ।
পাকিস্তান নামক দেশটিতে মুক্তচিন্তকের জন্ম হয় না । কারন সেখানে মুক্ত শিক্ষার উপযোগী পরিবেশ নেই । কোন কারনে কেউ যদি মুক্তবুদ্ধির অধিকারী হয় তবে তাকে হয় বিদেশে, নয় দেশীয় কালা আইনে হয়রানি, নয় বেশীদিন বাঁচতে দেওয়া হয় না । মালালা ইউসুফজাই সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে নোবেল পেয়েছে ।
উপমহাদেশের লেখকদের এই সংকটজনক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখা যাচ্ছে মৌলবাদীরা ভীষনভাবে সংঘবদ্ধ । এবং এরা একান্তই পরিকল্পিতভাবে এগোচ্ছে । এরা খুন ব্যাপারটা দিন দিন বেশ শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে । এদের গুপ্ত হত্যার কারখানাটি বেশ মজবুত । সে তুলনায় মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা আগোছালো উদাসীন এবং ঐক্যবদ্ধ নয় । এদের নিজেদের মধ্যে সংঘবদ্ধ যোগাযোগ বিশেষ নেই বললেই চলে । নিরাপত্তা বলতে সরকার মুখাপেক্ষি হয়ে থাকা । কিন্তু সরকার বৃহৎ জনমতটাই প্রাধান্য দিয়ে চলার পক্ষপাতী । যা মুক্তমনাদের কাছে অত্যন্ত চিন্তার ব্যাপার । কোন লেখক আক্রান্ত হলে সরকারের তরফ থেকে বিশেষ কোন বিবৃতি পাওয়া যাচ্ছে না । গেলেও তা দু লাইন । লোক দেখানো ভন্ডামি । বাংলাদেশ সরকারের এক উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্তা যেভাবে লেখকদের নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে লিখলে হুশিয়ারী দিয়েছেন তাতে প্রশাসনের আসল মুখোশ বেরিয়ে এসেছে । এতগুলো লেখক ব্লগার হত্যার বিচার করার আন্তরিকতা তাদের যে কতটুকু তা বোঝা গিয়েছে । আসলে সর্ষের মধ্যেই ভূত । এটা স্পষ্ট যে- এরা আন্তর্জাতিক বিশ্বের চাপে পড়ে, ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও দায়সারাভাবে এগোচ্ছে । ভারতেও কালবুর্গি খুনের তিন চার দিন কেটে গেলেও কোন গ্রেফতারির খবর নেই।
যে দেশে উচ্চবুদ্ধির বুদ্ধিজীবীরা নির্বিচারে খুন হন সে দেশে সাধারন মানুষ কতটা নিরাপদ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । সে দেশ বধ্যভুমি, মৃত্যু উপত্যকা । আর মৃত্যু উপত্যকা কারও দেশ হতে পারে না ।
এই মুহুর্তে পরিস্থিতির প্রয়োজনে দেখা যাচ্ছে যে সর্বাঙ্গীন ভাবে মুক্তবুদ্ধি যুক্তিমনস্কদের জন্য একটি জোরালো সংগঠন দরকার । যে সংগঠনের উদ্দ্যেশ্য সমস্ত মুক্তচিন্তকদের নিরাপত্তা প্রদান । ঊপমহাদেশে এমন সংগঠন নেই বললেই চলে। ইউরোপে পেন নামক একটি সংগঠন আছে । যারা পৃথিবী জুড়ে লেখকদের নিরাপত্তা দেয় । কিন্তু সংগঠনটিরও সীমাবদ্ধতা আছে । সংগঠনটির হাত বেশীদূর বিস্তৃত নয়। এই সংগঠনে ভারতীয় উপমহাদেশের কয়েকজন আক্রান্ত লেখক ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু সেটা যৎসামান্য । এই বড়মাপের লেখকগোষ্ঠির দায়িত্ব নেওয়ার পরিকাঠামো পেনের নেই ।
ঠিক পেনেরই আদলে এই উপমহাদেশেই একটি জোরালো সংগঠন তৈরির উদ্যোগ খুব তাড়াতাড়িই নিতে হবে। মৌলবাদীরা যেভাবে সংঘবদ্ধভাবে লেগেছে তাতে হাবেভবে মনে হচ্ছে আগামীতে লেখক ব্লগার হত্যা মহামারীর আকার নেবে । এখনি পরিস্থিতি বাগে আনতে না পারলে সমূহ বিপদ। দেশ আবার মধ্যযুগে ফিরে যাবে । সভ্যতার পর এই প্রথম আমাদের উপমহাদেশ আলো দেখার দিকে অল্প অল্প করে এগোচ্ছে । সেই পরিকাঠামোটাই ধ্বংস হয়ে যাবে । অনুভুতি সম্পন্ন সহৃদয় ব্যক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে একটি সংগঠনের লক্ষ্যে । যে সংগঠন লেখকদের জন্য সমস্ত নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে, যে সংগঠন সরকারের বাকস্বাধীনতা হানিকর কালা আইনের জন্য বিরোধিতা করে পথে নামবে, যে সংগঠন যুব সমাজকে মুক্তচিন্তায় উৎসাহিত করবে ।
এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি । খুব শীঘ্রই সবাই এগিয়ে আসুন । নইলে বড্ড দেরী হয়ে যাচ্ছে ।