আমি প্রায়ই একটি বিদ্যালয়ে ক্লাস নিই। কখনো ছায়ানটের নালন্দা, কখনো অন্য স্কুল। সেই সূত্রে ছোটদের সঙ্গে বিনিময় ঘটে। বিনিময়গুলো অদ্ভুত। যেমন বিন্দু, রেখা, তল কী? অথবা আপেল বা আম যদি গাছ থেকে পড়ে, কোথায় গিয়ে পড়বে? কখনও ডিম আগে না মুরগি আগে? এ ধরনের প্রশ্নই আমরা পরস্পরকে করি। আমি এক রকমভাবে ভেবেছি। ওরাও এক রকমভাবে ভেবেছে। কিন্তু প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়ে মতবিনিময় করেছি, তখন সেগুলো আরও সরলতা ও গভীরতা নিয়ে আমার কাছে উপস্থিত হয়েছে। বিন্দুর প্রশ্নে ওরা উত্তর দিয়েছে, বিন্দু হলো তাই_ যার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-বেধ নেই; কিন্তু অস্তিত্ব আছে। কিন্তু যার কোনো মাত্রা নেই তার কেন অস্তিত্ব থাকবে? আমরা তা ফোঁটা দিয়ে বোঝাব কেন? কলমের ফোঁটা তো পরমাণুর চেয়ে লক্ষগুণ বড়। তার তো আয়তন থাকে। তাহলে? তখন আমরা ক্লাসের সবাই মিলে এই সিদ্ধান্তে আসি_ বিন্দু আসলে একটি ধারণা, এর কোনো মাত্রা নেই, জ্যামিতিক প্রমাণের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ তার তাৎপর্য আমরা অনুধাবন করতে থাকি। আর বোঝানোর জন্য পেন্সিল বা কলমের ফোঁটা দিই। বলি এটি বিন্দু নয়, বিন্দুর মতো; বোঝানোর জন্য এক ধরনের দৃশ্যায়ন। অনেকগুলো রেখা যখন পরস্পরকে ছেদ করে, তখন ছেদিত অংশ মোটা হয় না। তখন সত্যি অবাক লাগে, এত সুন্দর ধারণা আমাদের চিন্তাজগতে বিকাশ ঘটেছে।

আবার এ প্রশ্ন নিয়েও বিনিময় ঘটে। আম, জাম, নারিকেল এগুলো গাছ থেকে কোথায় পড়ে? জিজ্ঞেস করলে অনেকে বলে ওঠে, নিচে। যখন জিজ্ঞেস করি, তুমি নিশ্চিত? তখন হঠাৎ দেখা যায় পিনপতন নীরবতা! গভীরভাবে ভাবতে থাকে সবাই। দুয়েকজন ভয়ে ভয়ে বলে, ভূমিতে। তখন ক্লাসের কেউ কেউ বলে, অপেক্ষা করো, একটু ভেবে নিই। আমি তখন বলি, উপরেও তো পড়তে পারে। এভাবেই হয়তো পুরো ক্লাসটা সময়ের একদম শেষে এসে পেঁৗছায়। ওর মধ্যে থেকে দুয়েকজন বলে, উপরেও পড়বে না, নিচেও পড়বে না। পড়বে ভূ-পৃষ্ঠে; আরও ভালোভাবে বললে, গ্রহপৃষ্ঠে। অনেকে বলেছিল নিউটনের মাথায় আপেল পড়েছিল। অবশ্য আপেল পড়ূক আর নাই পড়ূক, নিউটনই মহাকর্ষশক্তি আবিষ্কার করেছিলেন। নিউটনের মহাকর্ষশক্তি আবিষ্কার হওয়ার পর এটা তো পরিষ্কার হয়ে গেছে, উঁচু-নিচু ধারণাটাই একটা সংস্কার। না হলে পৃথিবীর বিপরীত দিকে যারা থাকবে, তাদের কাছে পুরো বিষয়টিই উল্টে যাবে। আসলে এই মহাবিশ্বে উঁচু-নিচু বলে কিছু নেই। ভাবলে কত কিছুই না স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়।

রুশ বাংলা বই ‘পৃথিবী কি গোল’। লেখক আনাতোলি তমিলিন, ছবি একেছেন ইউরি সমোলনিকভ, অনুবাদ- অরুণ সোম। বইটিতে লেখা আছে, ভাবনা ও জ্ঞান আশ্চর্য জিনিস বটে! রূপকথার সেই টাকার মতো, যতই খরচ করো না কেন, কোনো শেষ নেই। প্রাচীন প্রবচনের ভাষায় : তোমার আমার দু’জনের কাছেই যদি আপেল থাকে, আমরা দু’জনেই যদি নিজেদের মধ্যে বদলাবদলি করি তাহলেও আমাদের একটি আপেল থেকে যায়। কিন্তু তোমার আমার দু’জনেরই যদি ভাবনা আর জ্ঞান থাকে, আর তা যদি আমরা নিজেদের মধ্যে বিনিময় করি তাহলে দু’জনের ভাবনা ও জ্ঞান দ্বিগুণ হবে। বিনিময়ই ভাবনাকে সমৃদ্ধ করতে পারে।

একবার পৃথিবী গোল নিয়ে একটা আলোচনা করেছিলাম। পঞ্চম শ্রেণীর অন্বিতা বিশ্বাস ‘বৃত্তের গল্প’ শিরোনামে একটি লেখা এনে দিল। লেখাটির আরম্ভে এত মজা করেছে কী বলব_ ‘বৃত্তের আবার কী গল্প হতে পারে? এক ধরনের আকারের গল্প কেমন করে বলব আমি? তাহলে এমন কিছু নিয়ে গল্প বলা যাক যেটা গোল। কী নিয়ে গল্প বলা যায়? চোখের সামনে তো কত কিছুই গোল দেখা যায়_ রুটি গোল, ডিম গোল, কমলা গোল, কুল গোল, বিশ্বকাপের ফুটবল গোল, চোখের মণি গোল, মাথা গোল, পৃথিবী গোল_ আরে! পৃথিবী যে গোল, সেটা কি চোখের সামনে দেখা যায়? তাহলে পৃথিবী গোল সেটা আবিষ্কার হলো কীভাবে?’ সেটা জানতে মানুষকে দীর্ঘসময়ের চিন্তাধারার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘপথ। সেটা নিয়ে এই বইটা।

আরেক জায়গায় বিপাশা, অন্বিষা, মাইশা আরও অনেকে লিখেছে_ অনেক অনেক দিন আগের কথা, তখনকার মানুষ পৃথিবী যে গোল সেটা জানতেন না। তাদের ধারণা ছিল, পৃথিবী খালি একটা চারকোনা ভূমি মাত্র। তাই তারা জাহাজ খুব সাবধানে চালাতেন। যদি চালাতে চালাতে পৃথিবীর কোনায় এসে পড়ে যায়! সবার মনে এই একই ভয় লুকিয়ে থাকত। কিন্তু সেই সময়ে পিথাগোরাস একজন বিজ্ঞানী থাকতেন স্যামসন দ্বীপে। তিনি অনেক বড় গণিতবিদ ছিলেন। কত মাথা ঘামানো অঙ্ক তিনি আবিষ্কার করেছেন! চাঁদের ওপর পৃথিবীর ছায়া, সূর্যগ্রহণ_ এগুলোর সাদৃশ্যতা থেকে পৃথিবী গোল অনুমান করে ফেললেন। কিন্তু এই তথ্য লোকে খুব একটা গ্রহণ করল না। জনগণ বলল, পৃথিবী যদি গোলই হতো, তাহলে তো আমরা পৃথিবী থেকে গড়িয়ে পড়ে যাই না কেন? এর ২০০ বছর পরে, যখন আলেক্সান্দ্রিয়া ইরোতোস্থেনিস পৃথিবীর পরিধি বের করলেন, তখনও এই ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে পারল না মানুষ। এরপর ফার্দিনান্দ মাগেল্লানের পৃথিবী ভ্রমণ নিশ্চিত করল, পৃথিবী মোটামুটি গোল। কিন্তু পড়ে যায় না কেন তার যৌক্তিক সমাধান তখনও হয়নি। এই ঝামেলার সমাধান তারও অনেক বছর পর গ্যালিলিও, কেপলার হয়ে নিউটনের হাতে পরিণতি লাভ করে দুই হাজার বছর পরে। মূলত মহাকর্ষ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে পৃথিবী গোল এবং তা থেকে পড়ে যাই না কেন_ এর ধারণাগত সন্তোষজনক উত্তর মিলল।

এই বইটা পড়তে কখনও কখনও মনে হবে এটা একটা উপকথার বই, কখনও গল্পের বই, কখনও ইতিহাসের বই। কিন্তু তুমি যদি একটু ভাবো, দেখবে প্রত্যেকটি বিষয় এসেছে পৃথিবীর সঠিক রূপটি জানার প্রচেষ্টা থেকে। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবী উত্তর-দক্ষিণে একটু চাপা, পূর্ব-পশ্চিমে একটু ফোলা। তাই জ্যামিতির ভাষায় মনে হতে পারে পৃথিবী ‘গোল’ না হয়ে হয়েছে ‘উপগোলক’। আসলে তাও ঠিক নয়। সত্যি বলতে কী, জ্যামিতির কোনো শব্দই পৃথিবী সম্পর্কে যথোপযুক্ত নয়। সুভাদ্রা বলেছে, পৃথিবী আসলে ঠিক আসল পৃথিবীর মতোই। এর কোনো তুলনা হয় না। এর চেয়ে আপন মানবজাতির জন্য আর কেউ হতে পারে না। আমারও তাই মনে হয়। কেননা আমরা প্রাণীরা মিলেই এই পৃথিবীর অক্সিজেন-নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডল তৈরি করেছি। দূর মহাশূন্য থেকে দেখলে আবেগে বলি, ওই হলো পৃথিবী নীলাভ সাদা,মানবীক পথের প্রান্তর!

রচনা কাল : ডিসেম্বর ২০১৪

আসিফ
ডিসকাশন প্রজেক্ট