লেখকঃ সোজাকথা

মুলত নরেন্দ্র মোদী সরকারে আসীন হওয়ার পর ভারতে গৈরিকীকরনের রাস্তা দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে । ২০১৪ সালে বিজেপির এমন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার প্রতিষ্ঠা হবে তা প্রথমে কট্টর হিন্দুত্ববাদীরাও আশা করেননি । আশা করেননি স্বয়ং নরেন্দ্র মোদীও । বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার যখন প্রতিষ্ঠা হল তখন থেকেই আশঙ্কা ছিল ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ পরিকাঠামোর ভবিষ্যত নিয়ে । বহু মহল থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছিলো- ভারতের সংবিধান স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষ পরিকাঠামো ধাক্কা খাবে । যত দিন যাচ্ছে বিজেপি সরকার সে আশঙ্কা ক্রমেই বাস্তবে রূপ দিচ্ছে । ঘর থেকে বাহির, রুচি থেকে চাহিদা, শিক্ষা থেকে সংস্কৃতি সমস্ত ক্ষেত্রেই জারি হচ্ছে ফতোয়া । এ সরকারের আসল উদ্দ্যেশ্য যে গৈরিকীকরন সেটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার ।
মোদী ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে হিন্দুত্ববাদীরা “ঘর ওয়াপসি” কর্মসূচি হাতে নিয়েছে । অর্থাৎ তোমরা যারা একসময়ে হিন্দুধর্মে ছিলে এখন অন্যধর্ম গ্রহন করেছ তারা আবার ঘরে(হিন্দুত্বে) ফিরে এস । হিন্দুত্ববাদীরা “ঘর ওয়াপসি” যদি কারও সম্মতিক্রমে করতো তাতে কোন মহলের কোন আপত্তি ছিলো না । অর্থাৎ কেউ যদি স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয় তবে তাতে কারও আপত্তি নেই । কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে জোর করে, টাকার লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে শিবিরে এনে এ কর্মসূচি চলছিলো । বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠায় “ঘর ওয়াপসি” আপাতত বন্ধ ।
মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকার গোমাংস খাওয়া ও গোহত্যা আইন করে নিষিদ্ধ করেছে । এক্ষেত্রে প্রজাগন কী খাবে তার ওপর সরকারের অভিনব তালিবানি ফতোয়া । শুধু যে মহারাষ্ট্রের পরিস্থিতি এমনটাই তা কিন্তু নয় । মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকার স্কুলের মিড ডে মিলের তালিকা থেকে ডিম বাদ দিয়ে দিয়েছে । নিরামিষ আহার ভারতীয় সংস্কৃতির একটি প্রাচীন ঐতিহ্য । উল্লেখ্য ভারতীয় প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ও সাধুসন্তগন নিরামিষ আহারের বিধান দেন । সেই সংস্কৃতি বজায় রাখার জন্য আধুনিক ভারতে মিড ডে মিলের তালিকা থেকে ডিম বাদ দেওয়া হল । স্কুলের শিশুদের পুষ্টির কথা এক্ষেত্রে বিবেচনা করা হল না ।
আবার সংঘ পরিবারের আপত্তিতে সম্প্রতি ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির অনেকগুলো সাইট সরকারি উদ্যোগে বন্ধ করে দেওয়া হল । যদিও পরে সমালোচনার চাপে পড়ে সে নিষেধাজ্ঞা আংশিক তুলে নেওয়া হলো । কিন্তু প্রশ্ন হলো এভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করে পর্নোগ্রাফির মতো এমন স্পর্শকাতর একটি বিষয়কে বন্ধ করা যায় কিনা? নেট থেকে যারা পর্নোগ্রাফি দেখতে পাবেন না তারা কালোবাজারে সিডির জন্য ভিড় জমাবেন । চোরাপথে সিডি ব্যবসায়ীদের সরকার আঁটকাবেন কী করে । এমন ফস্কা পথ অবলম্বন করে সরকার পরোক্ষে পর্নোগ্রাফিরই ঢাকঢোল পেটালেন । এই বিশ্বায়নের যুগে পর্নোগ্রাফি কে দেখল, কে দেখল না তা নিয়ে অত খুঁতখুঁতানির প্রয়োজন নেই । আর পর্নোগ্রাফি দেখলে ধর্ষন বাড়ে হিন্দুত্ববাদের এ নতুন ব্যাখ্যা ধোপে টেঁকে না । ধর্ষন কমাতে গেলে পুরুষের দিক থেকে নারীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে । সমাজে নারী মানেই জোরজবরদস্তি একটা বস্তু- এই ষান্ডামার্কা চিন্তাভাবনার বদল ঘটাতে হবে ।
২০১৫ এর জানুয়ারীতে “ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসকে” হিন্দুত্ববাদীগণ যেভাবে কলঙ্কিত করল তা বিশ্বজুড়ে হাসাহাসির খোরাক হল । ক্যাপ্টেন আনন্দ জে বোডাস নামে এক ব্যক্তি বৈদিক পুরান কথার উপর ভিত্তি করে, একটি পেপার পেশ করে দাবি করলেন- আধুনিক বিজ্ঞান বিমান আবিষ্কারের বহুকাল আগেই প্রাচীন মুনিঋষিরা বিমান আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন । সেই বিমান আকৃতিতে ছিল বিশালাকৃতি এবং গতিবেগ ছিল আজকের বিমানের তুলনায় অত্যন্ত বেশী । সেই বিমানকে যেকোন মুহুর্তে যেকোন দিকে চালানো যেত । সামনে-পিছে-ডাইনে-বাঁয়ে যেতে তার কোন আপত্তি ছিল না । চোখের পলকে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ছুটে যেত সেই বিশালাকৃতির বিমান । প্রাচীন মুনিঋষিরা সেই বিমান তৈরির সমস্ত প্লান পুঁথিতে লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন । কিন্ত সেই বিমান তৈরির সমস্ত প্ল্যান সমন্বিত পুঁথি আজকে আর নেই । তার কারন স্বরূপ বোডাস বললেন- সময়ের পরিবর্তনে ভারতবর্ষ বৈদেশিক আক্রমণ এবং লুট হবার কারনে অন্যান্য সামগ্রীর মতো সেই সমস্ত নথি চুরি হয়ে গেছে । আজকের বিচিত্র ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের যুক্তি শুনলে বিমান আবিষ্কারকারী অরভিল রাইট আর উইলবার রাইটও লজ্জা পেতেন । রাইট ভ্রাতৃদ্বয় বিমান আবিষ্কার করার মতো দূঃসাহস দেখাতেন না । তাদের সাইকেল দোকানের উন্নতিতে আরও বেশী করে মনোনিবেশ করতেন ।
বিজেপি শাসিত গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশের পাঠ্য ইতিহাস বই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে পরামর্শদাতা হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে দিননাথ বাত্রাকে । গুজরাটের সরকারী স্কুলে তার মনোনীত বই-ই পড়ানো হচ্ছে । সেই বই পড়ে পড়ুয়ারা শিখছে, প্রাচীন ভারতেই আবিষ্কার হয় গাড়ি ।
সব ক্ষেত্রকে ছাপিয়ে গিয়েছেন আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদী । তিনি ভারতকে অত্যন্ত লজ্জায় ফেললেন । ২০১৪ সালে চিকিৎসকদের একটি সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী দাবি করলেন- আজকের বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারের বহুপূর্বেই প্লাষ্টিক সার্জারি এবং টেষ্টটিউব বেবী ভারতবর্ষেই আবিষ্কার হয়েছিলো । যুক্তিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী বললেন- দেবতা গণেশের দেহে মানুষের মুন্ডুর বদলে হাতির মুন্ডু প্রতিস্থাপন আসলেই প্লাষ্টিক সার্জারির ফল । আর টেস্টটিউব বেবী নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর যুক্তি- মহাভারতের কৌরবরা সবাই মাতৃগর্ভের বাইরে জন্মেছেন, তাদের টেস্টটিউব বেবী ছাড়া আর কিই-বা বলা যেতে পারে ।
এর কিছুকাল পরে মোদী আবার বললেন– জগদীশ চন্দ্র বসুর উদ্ভিদের প্রান আবিষ্কারের বহুকাল পূর্বেই গীতায় উদ্ভিদের প্রানের অস্তিত্ব সম্পর্কে বলা ছিল ।
সব ক্ষেত্রেই ধর্মগ্রন্থের সাথে বিজ্ঞানকে জুড়ে দেওয়ার প্রবনতা । কিন্তু নরেন্দ্রমোদী সম্ভবত জানতেন না । এই রকম ধর্মগ্রন্থের সাথে বিজ্ঞানকে জুড়ে দেওয়ার প্রবনতা শুধু তার এবং তার আমলের দান নয় । এর আগে থেকে তার হিন্দুত্ববাদী পূর্বসুরীরা এ কাজ করে আসছে। তিনি তার যোগ্য উত্তরসুরী মাত্র। ধর্মগ্রন্থের সাথে বিজ্ঞানকে জুড়ে দেওয়ার প্রবনতা শুধু হিন্দুধর্মে নয়। সব ধর্মেই এ প্রবনতা দেখা যায় এবং যাচ্ছে । কী করা যাবে বিজ্ঞানের কাছে ধর্মের যেভাবে মুখোশ খুলে যাচ্ছে তাতে অস্তিত্বের সংকটে ভোগা ধর্মের এখন নাভিশ্বাস উঠছে। তাই যাহোক করে ধর্ম এখন বিজ্ঞানের সাথে জুড়ে থাকতে চাইছে । নইলে বিলুপ্তির আশঙ্কা।
মোদী সরকার যে ভাবে সবক্ষেত্রেই গৈরিকীকরন করে চলেছে তাতে হাবেভাবে মনে হচ্ছে- মোদীর স্বপ্নের “মেক ইন ইন্ডিয়া”র সুপ্ত কর্মসূচী হল গৈরিকীকরন ।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী সরকারে আসীন হওয়ায় সংঘ পরিবার ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ যারপরনাই খুশি । বিপুল জনাদেশ পেয়ে বিজেপির জয়ী হওয়াকে তারা বিগত আটশো বছর পর হিন্দুত্বের আসল জয় বলেই বর্ননা করেছে । এটা ঠিকই যে মুসলমানরা ভারত আক্রমনের পর ভারতীয় হিন্দুরা সমস্ত শাসন ক্ষমতা হারিয়ে মুসলমান এবং পরবর্তী ব্রিটিশদের কাছে পরাধীন হয়ে পড়েছিলো । নিজভূমে পরবাসী হয়ে দিন কাটাচ্ছিল । ভারত ব্রিটিশ মুক্ত হওয়ার সাথে সাথে হিন্দুর হারানো জমি অনেকটাই পুনরূদ্ধার হয়েছিলো বটে কিন্তু সেই জমিতে এমন একতরফা হিন্দু জয় বিগত আটশ বছরে ঘটেনি । এটাই হিন্দুত্ববাদীদের মনে অত্যন্ত আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঐতিহাসিক তত্ত্ব । কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের এটা মনে রাখা জরুরী, আজ ভারতীয় উপমহাদেশ আটশ বছর আগের হারানো উপমহাদেশটি আর নয় । এই উপমহাদেশ এখন খন্ডিত উপমহাদেশ । সেই খন্ডের একটি খন্ড ভারত । আর এই উপমহাদেশ এখন বহু ভাষাভাষী, বহু ধর্মের, বহু বর্নের, বহু জাতি উপজাতির আবাসভূমি । রবীন্দ্রনাথ তার “ভারততীর্থ” কবিতায় বহু আগেই সেটা স্মরন করিয়ে দিয়েছিলেন । এই সরল সত্যিটা যদি অখন্ড ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ বুঝতেন তবে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ খন্ড বিখন্ড হয়ে যেত না । আমাদেরও দেশভাগের মতো এত বড় অপ্রিয় সত্যের সম্মুখীন হতে হত না । জাতীয় কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী মনোভাবই দেশভাগের মূল কারন । আজও হিন্দুত্ববাদীরা প্রবল জনাদেশ পেয়ে খন্ডিত ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ পরিকাঠামো অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিচ্ছে ।
তাই আপাতত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষিত খন্ডিত ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙা হবে, ঘর ওয়াপসি, গৈরিকীকরন, সংখ্যালঘু নির্যাতন, সংখ্যালঘু হত্যা চলবে । আর অখন্ড ভারতীয় উপমহাদেশের দুটি দেশ, পাকিস্থান আর বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচার হবে হিন্দু প্রাচীন স্থাপত্য ধ্বংস হবে । মুসলমানরা ভারতের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা দেখে আরও কট্টর আরও হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠবে ।
সেজন্য সমগ্র উপমহাদেশ জুড়ে আপাতত গীতা শিক্ষা, কোরাণ শিক্ষা, কুকথার খেউড়, সাম্প্রদায়িক রেষারেষি, খুনোখুনি, দাঙ্গা, লুঠতরাজ, লুন্ঠন, লেখক হত্যা, লেখক তাড়ানো, ব্লগার হত্যা- চলছে, চলবে ।