লেখকঃ এনায়েত ইসলাম
গোষ্ঠীস্বার্থ ব্যক্তি, বাজার, ন্যায়বিচার ও শান্তির জন্যে প্রতি হুমকি। আদিম কালে দূর্বল, অদক্ষ, অবিকশিত মানব সমাজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য দলবদ্ধ ভাবে বসবাস, চাষাবাদ, শিকার করা অতীব প্রয়োজন ছিলো। একসাথে থাকা মানে শক্তি সাহস দুটোর পালেই হাওয়া লাগানো। এক সময় যা ছিলো অচেনা পরিবেশ ও প্রাকৃতিক হুমকি মোকাবেলার কৌশল, আজ বিবর্তনের ছোঁয়ায় মানুষ যেমন বদলেছে তেমনি বদলেছে তাঁর গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে চলার প্রবর্তনা।
গোষ্ঠীবদ্ধতা আজ আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সুযোগ সুবিধাতে সর্বোচ্চ ভাগ বসানোর আদিম কৌশলের বিবর্তন রূপ মাত্র। গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার বিষয়টি আজ এতটাই সুপরিকল্পিত, শৃংখলাবদ্ধ যে এই বিষয়ে তদবির করা এখন একটি লোভনীয় পেশা। যাঁদের কাজই হচ্ছে সরকারের কাছ থেকে গোষ্ঠীর গরিষ্ঠ ভাগটুকু নিশ্চিত করা। উন্নত অনুন্নত সব রাষ্ট্রেই এই গোষ্ঠী স্বার্থ সংশ্লিষ্টরা ক্রিয়াশীল। বাংলাদেশে সড়ক দূর্ঘটনা জনিত হতাহতের বিষয়ে আইনের ধারা প্রয়োগে শিথিলতা বাংলাদেশের শ্রমিক গোষ্ঠীর অনূকুলে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে কেউ বেপোরোয়া গাড়ি চালিয়ে কোন পথচারীকে হত্যা করলেও তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা যাবেনা। দেড় লক্ষ চালকের স্বার্থে ১৬ কোটি মানুষের নিরাপত্তাকে অবজ্ঞা করা হলো। এমন নয় যে সরকার বা নীতি নির্ধারকগণ সঠিক আইন করতে অক্ষম। বিশ্বের সব সরকারই এই গোষ্ঠীবদ্ধতার কাছে অসহায়; ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে হোয়াইট হাউজ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের গণভবন সস্তায় জনগণের বৃহত্তর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে থাকে।
গোষ্ঠীবদ্ধতার উন্মত্ততা এতটাই অস্পৃষ্ট যে এটাকে সুযোগ সুবিধা দিয়ে অনুগত করা গেলে প্রয়োজনে অনায়াসেই একটি সংগঠিত শক্তিকে কাছে পাওয়া যায়। সড়ক শ্রমিক ইউনিয়ন তেমন একটি সংগঠিত শক্তি। সরকার জনগণের অধিকার ততক্ষণই বিকিয়ে দিবে যতদিন না জনগণ তাঁদের অধিকারের প্রশ্নে সজাগ হবে। শুধু সরকারি সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রেই নয় শ্রম আইন, ট্রেড ইউনিয়ন করেও নিজেদের স্বার্থকে সংরক্ষিত করে থাকে তাঁরা। কোন শিল্পের জন্যে নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ করে শ্রমিক ইউনিয়ন নিজের বেতন ভাতা যেমন বৃদ্ধি করে থাকে তেমনি নতুন কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। চাকুরি ক্ষেত্রে প্রবেশের বেলায় নূন্যতম মজুরি যত উচ্চ হবে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান নতুন নিয়োগে তত বেশী অনাগ্রহী হবেন। মজুরি কাঠামোর সকল সুবিধা ভোগ করবেন যারা ইতিমধ্যে শ্রমিক বা ট্রেড ইউনিয়নে আছেন। একদিকে বেতন বাড়ালেন অন্যদিকে নতুন প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের রক্ষা করলেন।
এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, কোন গোষ্ঠী যদি নিজেদের কল্যান সাধনের প্রশ্নে একতাবদ্ধ হয়ে চেষ্টা চলায় তাঁদের ভাগ্য পরিবর্তনের তাতে দোষের কি আছে? স্বীকার করে নিতে হবে এটা তাঁদের অধিকার। প্রতিটা মানুষ আর জনগোষ্ঠীই চায় তাঁর স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে যাতে তাঁরা আরও সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। কিন্তু গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা যদি অন্যের খরচে চালিত হয় তাহলে অভিযোগের প্রশ্ন থেকে যায়। এ কারণে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থের হাত ততক্ষন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হওয়া চলবে যতক্ষন পর্যন্ত না অন্য কারো নাকে আঘাত করে।
চালকদের স্বার্থে আইনের যে শিথিলতা প্রদর্শন করা হলো তা দূর্ঘটনায় ভুক্তভোগীদের ন্যায় বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত করবে দুই স্তরে। প্রথমত, চালক জেনে যাবেন রাস্তায় তিনি যত বেপরোয়া ভাবেই গাড়ী চালান না কেন সরাসরি তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হবেনা। যদি মামলা হতেই হয় তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে। এক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তাগণ শ্রমিকগোষ্ঠীর তদবির আর হুমকির মুখে তদন্তের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারবেন না। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের দেশে যে দায়মুক্তির যে সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করেছে তা আইনত ভাবে আরও একবার পুষ্ট হবে। গনহত্যার বিচার না হওয়া(যদিও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে এবং কয়েকটি রায় কার্যকর করা হয়েছে), জাতির জনককে স্বপরিবারে হত্যার বিচার না হওয়া(বর্তমান সরকার রায় কার্যকর করলেও এখনো অনেকেই দেশের বাইরে দূর্দান্ত প্রতাপে অবস্থান করছেন), মন্ত্রী-এমপি হত্যা, জেনারেল-রাষ্ট্রপতি হত্যা, আর ইদানিংকালের চালকদের তাঁদের কৃতকর্মের আইনগত দায় মুক্তি সব একই সূত্রে গাঁথা। দেশের সব বড় বড় অপরাধ কখনো সাংবিধানিক, কখনো আইনগত দায়মুক্তি পেয়ে এসেছে গোষ্ঠীস্বার্থের চাপে। আজ আবার ব্যক্তি তথা সমগ্র জাতি ন্যায় বিচারের পথচলায় আবার হোঁচট খেলো। ব্যক্তির ন্যায় বিচার পাবার অধিকার গোষ্ঠীস্বার্থের চাপে বার বার নিষ্পেষিত।
আবার গোষ্ঠী বনাম গোষ্টীর দ্বন্দ্ব হতে পারে যদি স্বার্থের সংঘাত হয়। এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত সবল গোষ্ঠী জয়ী হবে। উদাহরণ স্বরূপ, অটোরিক্সা ও রিক্সা চলক গোষ্ঠীর কথা বলা যেতে পারে। রিক্সার প্যাডেলে লাগানো চালকদের পায়ে তাকালে বুঝা যায় রোদে পোঁড়া তামাটে বর্ণ ঐ পা দু’খানি কত হাজার মানুষকে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিরলস বয়ে নিয়ে গেছে। ক্লান্তি কখনোই বিকল্প নয়, অতি বৃদ্ধ থেকে কিশোর রিক্সাওয়ালা তা সবার জন্যেই প্রযোজ্য। বিশেষ করে অতি বৃদ্ধ, যিনি বয়সের ভারে নূহ্যমান তাঁর পক্ষে অতি নাদুস নুদুস আরোহীকে প্যাডেল করে নিয়ে যাবার যন্ত্রণা পরিমাপ করার জন্যে কোন আধুনিক যন্ত্রের দরকার নেই তাঁর ক্লান্ত ধুসর পাখানি, ভেঙ্গে যাওয়া বুক, রিক্সার হুটের মতোই কুজো হয়ে যাওয়া শরীর বলে দেয় কোন নরকে বসে সে সূধা পান করছে।
মফস্বল গুলোতে ইদানিং আশার আলো দেখা যায়। রিক্সাতে মটর লাগানো হচ্ছে যার ফলে আর প্যাডেল করার প্রয়োজন নেই। ফলে রিক্সাচালকগণ একটু মানবীয়, একটু আরামদায়ক পেশা গ্রহন করতে পারছে। একই সাথে তাঁরা অধিকতর কাজ করার প্রয়াস পাচ্ছে যার ফলে তাঁর আয় বাড়ছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ঢাকা শহরে এই মটরচালিত রিক্সা নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ অপচয় ইত্যাদি ইত্যাদি অভিযোগে নিষিদ্ধ করা হলো। আসল কারণ কি তা যে কোন রিক্সা চালককেই প্রশ্ন করলে জানা যায়। অটোরিক্সা ও টেক্সিচালকদের গোষ্ঠী এই নতুন মটর চালিত রিক্সাওয়ালাদের তাঁদের নিজেদের পেশায় হুমকি মনে করা শুরু করে। ফলে আইনের মাধ্যমে তাঁরা কর্তৃপক্ষকে দিয়ে বাধ্য করে যাতে ঢাকা শহরে কোন মটরচালিত রিক্সা না চলতে পারে। রিক্সা চালকদের ও সংগঠন আছে তবে তাঁরা অটোরিক্সা চালকদের মত ধনবান বা প্রভাবশালী নয়। ফলে দূর্বল আবার পরাজিত, সবল জয়ী। ক্লান্ত চরণ দু’খানি অনবরত কবরের পথ খুজে বেড়ায়।
সরকারি নীতি বৈষম্যমূলক, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস অটোরিক্সা ও অন্যান্য পরিবহনগুলো যথেচ্ছা ব্যবহার করতে পারবে কিন্তু রিক্সাচালকরা বিদ্যুৎ ব্যবহৃত মোটর ব্যবহার করতে পারবে না। ন্যায্য মূল্য দেবার পরেও আইন করে তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অমর্ত্য সেনের নোবেল জয়ী বইতে বলা হয়েছে, বাজারে খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতি নয়, আইন করে সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাওয়াই ১৯৪৩ সালে বাংলায় ও ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দূর্ভিক্ষের কারণ। সরকারের অনূগত গোষ্টিকে সুযোগ করে দিতেই বাজার কৃত্রিম উপায়ে অকেজো করা হয়েছিল। সেদিন ক্রয়ক্ষমতা ছিল , দেশে ছিল পর্যাপ্ত খাদ্য শস্য তবুও মানুষ ক্ষুধাকে আলিঙ্গন করতে বাধ্য হয়েছিল। ইতিহাস বার বার পুনরাবৃত্তি করলেও আমরা এ থেকে শিক্ষা নিতে অপারগ। ১৯৪৩ ও ১৯৭৪ সালে বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্যই লক্ষ লক্ষ মানুষ না খেয়ে মরেছে। আজও হাজার হাজার মানুষ হত্যার বধ্যভূমি বাংলার সড়ক গুলোতে প্রকৃত অপরাধীকে বিচারের আগেই দায়মুক্তির বন্দোবস্ত করা হলো। চালক মানেই দোষী তা নয় , সড়ক ব্যবহারকারী অন্যপক্ষের দোষও হতে পারে। কিন্তু দোষীর বিরুদ্ধে মামলা করা যাবেনা , বিশেষ করে চালকদের বিরুদ্ধে , এর মানে হলো আইন সবার জন্য সমান নয়। শক্তিশালী শ্রমিক গোষ্ঠীর স্বার্থ জনস্বার্থের ঊর্ধ্বে।
খুব ভালো লাগলো কথা গুলো,, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ,এমন কথা বলার মানুষ এখন আর বাংলাদেশে নাই।😢😢😢
@গাঙ চিল, সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ! কোনদিন এই সমস্যার সমাধান হবে বলেও আমি মনে করিনা। সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে , নীতি নিয়ে আলোচনা ,বিতর্ক চলতে থাকলে গোষ্ঠীদের সাথে শাসকের আপোষ করার ক্ষমতা কমে আসে। দুর্নীতি গুলো সহনীয় পর্যায়ে থাকে। পিঠ বাঁচিয়ে আর কতদিন চলা যায় , একদিন পিঠ দেয়ালে ঠেকবেই। মানুষ ঘুরে দাড়ায় এটাই মানুষের স্বভাব, বাংলাদেশ ও ঘুরে দাড়াবে।
বর্তমানে আমরা সবাই দূর্নীতি , নৈরাজ্য, প্রতিহিংসা….. ইত্যাদি নামক গোলক ধাঁধা এর মাঝে বসবাস করছি। আমরা যারা নির্যাতিত নিপীড়িত জনসাধারণ আছি আমরা সকলেই বুঝতে পারি যে আমরা শোষিত হচ্ছি ক্ষমতাশালী – বিত্তবানদের কালো হাতে।কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলেও সত্য যে , আমরা সকলেই জানি এবং বুঝি যে আমরা শোষিত – নিপীড়িত ও নিগৃহীত হচ্ছি শাসক গোষ্ঠীর শাসনের আঘাতে।প্রতিটি মানুষের হৃদয় প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত শাসকের কালো আঘাতে। তার পরেও আমরা সকলে নিরব। কারণ ষোলো কোটি জনতা পিট বাঁচিয়ে নিজেরাই বাঁচে।
শক্তিশালী শ্রমিক গোষ্টির স্বার্থ জনস্বার্থের উর্ধ্বে।