লেখক : প্রীতম চৌধুরী



বেশ আগেরকার কথা, নবম শ্রেণীতে ২য় সাময়িক পরীক্ষা দিচ্ছি। পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন আসল- 

” ইলেকট্রনের প্রতি-পদার্থ কোনটি? ” 

ক. প্রোটন খ.নিউট্রন গ. পজিট্রন ঘ. নিউট্রিনো 



উত্তর দিলাম- ক. প্রোটন। 

আমার সামনের বন্ধুটি বলল, ” এইটা মনে হয় পজিট্রন হবে। আমি পড়ছি। ” 



আমি তাকে এক রামধমক লাগালাম। বললাম- ” পরমাণুতে ইলেকট্রনের বিপরীত কি?? প্রোটন না, গাধা!! পজিট্রনতো হল রোবটের মাথার নাম। ( সদ্য অ্যাসিমভ পড়ে শেষ করেছিলামতো ) আমার কনফিডেন্স দেখে বন্ধুটিও উত্তর দিল প্রোটন। 



বলাই বাহুল্য, উভয়েই শূন্য পেলাম। এর কয়েকদিন পরেই ড্যান ব্রাউনের ‘ এঞ্জেল & ডেমনস ‘ বইটা পড়লাম। তখন নিউরনে অনুরণন হল, আসলে এই প্রতি-পদার্থ জিনিসটা কি??? 



কোন পরমাণুর ভিতরে ইলেক্ট্রন, প্রোটন যদি তাদের বিপরীত আধান  ধারণ করে তাহলে তাদেরকে এন্টি পার্টিকেল বলে। এরকম এন্টি পার্টিকেল দিয়ে তৈরী পদার্থের নাম এন্টি ম্যাটার। সাধারণ অবস্থায় ইলেক্ট্রনের আধান হয় মাইনাস (-)। কিন্তু এন্টিম্যাটারে এটার আধান হবে পজেটিভ(+ )। যেমনিভাবে কণা দ্বারা পদার্থ গঠিত হয় ঠিক তেমনিভাবে প্রতিকণা দ্বারা প্রতিপদার্থ গঠিত হয়। উদাহরণস্বরুপ, একটি প্রতিইলেকট্রন (পজিট্রন) এবং একটি প্রতিপ্রোটন মিলিত হয়ে গঠন করে একটি প্রতিহাইড্রোজেন পরমাণু । যেমন করে একটি ইলকট্রন ও প্রোটন মিলে তৈরি করে একটি হাইড্রোজেন পরমাণু । সাধারণভাবে আমরা জানি পদার্থ বা Matter হচ্ছে ইলেক্ট্রন(-ve), প্রোটন(+ve) ও নিউট্রন দিয়ে তৈরী [কেন্দ্রে (+ve) চারপাশে (-ve)]। প্রতিপদার্থ হচ্ছে এন্টিপ্রোটন(-ve), এন্টিনিউট্রন ও পজিট্রন(+ve), অর্থাৎ ভর একই কিন্তু চার্জ সম্পুর্ণ বিপরীত [কেন্দ্রে (-ve) চারপাশে (+ve)]। এই সাধারণ জিনিসটা [বোধহয় প্রতিজিনিস বলা ভাল ] বিজ্ঞানীদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ হচ্ছে এর অকল্পনীয় শক্তি উৎপন্ন করার ক্ষমতা। ধরুন, আপনি একটা কাঠের টেবিলের মাঝথেকে গোল করে খানিকটা অংশ কেটে নিলেন। আপনার হাতে থাকল গোলাকার একটা কাঠের টুকরা যেটা নিরেট (Solid) একটা অংশ আর টেবিলের মাঝে থাকল একটা গর্ত যার আয়তন আপনার হাতের কাঠের টুকরার সমান কিন্তু ফাঁপা [নিরেট (Solid) এর বিপরীত]। আর আপনার হাতের কাঠের টুকরাটা যদি টেবিলে জোড়া দেন তবে টেবিলটা তার আসল রূপ ফিরে পাবে। ধারণা করা হয় মহাবিস্ফোরনের [Big Bang] সময় শক্তির একটা অংশ পদার্থ আর প্রতিপদার্থ -তে পরিণত হয় [টেবিলে কাঠের টুকরা আর ফাঁপা অংশ]। সুতরাং এখন পদার্থ আর প্রতিপদার্থ যদি পরস্পরের সংস্পর্শে আসে তবে বিশাল শক্তি উৎপন্ন হবে [যেমন কাঠের টুকরাটা ভাঙ্গা জায়গায় জোড়া দিলে টেবিলটা তার আসল রূপ ফিরেপাবে]। 

কিরকম শক্তি উৎপন্ন হতে পারে তার আনুমানিক একটা উদাহরণ দেই। অক্টোবর ২০০০ সালে নাসা বিজ্ঞানীরা Antimatter Spacecraft এর নকশা প্রকাশ 
করেন। বর্তমানে মঙ্গলগ্রহে যেতে সময় লাগে ১১ মাস আর সেইসাথে বিপুল পরিমাণ জ্বালানী Antimatter Spacecraft তৈরী করা সম্ভব হলে সময় লাগবে ১ মাস (Speed বাড়বে ১১ গুণ) আর জ্বালানী লাগবে ০.০০০০০১ গ্রাম (a millionth of a gram) এ্যান্টিম্যাটার বা প্রতিপদার্থ। 
আপনারা এটম বোমার নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। এটম বোমায় ইউরেনিয়াম ভেঙে ক্রিপ্টন আর বেরিয়াম উৎপন্ন হয়। এই উৎপন্ন ক্রিপ্টন ও বেরিয়ামের মোট ভর, ইউরেনিয়াম এর মোট ভর থেকে সামান্য কম হয়। অর্থাৎ, অতি নগন্য পরিমান ভর হারায়। এই অতি নগন্য পরিমান হারানো ভরই, আইনস্টাইনের বিখ্যাত E = mc² সূত্র মতে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ উৎপন্ন শক্তি E , অতি নগন্য পরিমান হারানো ভর m এবং আলোর বেগ c= ৩ লক্ষ কি.মি. এর বর্গের গুণফলের সমান। 

ম্যাটার আর এন্টিম্যাটারের সংস্পর্শে এদের সম্পূর্ণ ভরই শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। 




এন্টি ম্যাটারের ধারনা তৈরি হওয়ার কারন হচ্ছে পদার্থবিদরা এন্টিম্যাটারের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছেন। ১৮৯৮ সালে জার্মান বিজ্ঞানী আর্থার শুস্টার প্রথম এন্টিম্যাটারের ধারনা দেন এবং এন্টিএটম বা প্রতিপরমানুর অস্তিত্ব অনুমান করেন। তবে তাঁর অনুমান নির্ভর তত্ত্বের অনেকাংশই পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা পরিমার্জন করেন। ১৯২৮ সালে বিজ্ঞানী পল ডিরাক তাঁর একটিগবেষণাপত্রে এন্টিম্যাটারের আধুনিক তত্ত্ব ব্যখ্যা করেন। এর ধারাবাহিকতায় শ্রডিঞ্জারের তরঙ্গতত্ত্বের আলোকে ইলেক্ট্রনের বিপরীত পদার্থ পজিট্রন তৈরির সম্ভাবনা দেখা যায় এবং ১৯৩২ সালে বিজ্ঞানী কার্ল ডি এন্ডারসন পজিট্রন আবিষ্কার করেন। পরবর্তিতে আরো কিছু পারমানবিক মূল কণিকা যেমন, এন্টিপ্রোটন, এন্টিনিউট্রন এবং এদের সমন্বয়ে এন্টি নিউক্লিয়াস তৈরি করা হয়। এন্টিনিউক্লিয়াস এবং পজিট্রনের সমন্বয়ে পরমানুর বিপরীত কণিকা এন্টিএটম বা প্রতিপরমানু তৈরি করা হয় ১৯৯৫ সালে। প্রযুক্তিগত উন্নতির সাথে সাথে গবেষণাগারে তুলনামূলক বড় আঙ্গিকে(সেই বড় আঙ্গিকের পরিমানও বেশ সামান্য) এন্টিম্যাটার তৈরি করা হয়। 

এন্টিম্যাটার তৈরির পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এটাকে টিকিয়ে রাখা। কারন একে যে পাত্রে রাখা হবে সেটা কোন না কোন পদার্থ দ্বারা তৈরি করতে হবে। ফলে সেই পদার্থ প্রতিপদার্থের সাথে মিলে নিশ্চিন্থ করে ফেলবে। তবে বিজ্ঞানীরা এই সমস্যার সমাধান করেন। তাঁরা বিশেষ স্থিতিশীল চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে তার ভিতরে এন্টিম্যাটার সংরক্ষণ করেন। চৌম্বকক্ষেত্র কোন পদার্থ দিয়ে তৈরি হয় না। এটা শুধুমাত্র একটি বলক্ষেত্র যেখানে প্রতিপদার্থ আকৃষ্ট হয়ে আটকে যায় এবং কোন পদার্থের সংস্পর্শে না আসতে পারায় সংরক্ষিত থাকে। 



বিগব্যাং এর ফলে যেমন পদার্থ দিয়ে আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে, সেরকমভাবে এন্টিম্যাটার বা প্রতিপদার্থ দিয়ে সৃষ্ট আরেকটা মহাবিশ্ব থাকার বিপুল সম্ভবনা রয়েছে যা দেখতে আমাদের মহাবিশ্বেরই প্রতিরূপ। 

তাই কোন দিন ঘুম থেকে উঠে যদি দেখেন হুবহু আপনার মত দেখতে কেউ আপনার দিকে তার বাম হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, ভুলেও হাত মিলাবেন না। কারণ ম্যাটার এবং এন্টিম্যাটার পরষ্পর সংস্পর্শে এলে উভয়েই ধ্বংস হয়ে যায় এবং Annihilation এর মাধ্যমে বিপুল পরিমান শক্তি উৎপন্ন হয়।