ছয় মাসে চার জন লেখক হত্যা

এই বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ইসলামি মৌলবাদীরা ৪ জন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, মানবতাবাদী, নাস্তিক লেখক, ব্লগার, ও সমাজকর্মীকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। ২৬শে ফেব্রুয়ারি মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় পেছন থেকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, নির্মমভাবে আহত হন তার স্ত্রী ও মুক্তমনা লেখক বন্যা আহমেদ। হত্যার পরে ইসলামি জঙ্গীগোষ্ঠী আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবং পরে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়। দেশে ও বিদেশে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠলেও এই মধ্যযুগীয় বর্বরতার নিন্দা জানানো দূরের কথা কোনরকম প্রতিক্রিয়া জানানো থেকে বিরত থাকে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করা বাংলাদেশ সরকার। একইভাবে অভিজিৎ রায়ের হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে তাদের আইনের আওতায় আনার ব্যাপারে নিষ্ক্রিয়তার পথ ধরে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ফলে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও হত্যাকারীরা রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে!

বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে রাতের অন্ধকারে হত্যার পর খুনীরা থেমে যায়নি। বরং বিচারহীনতার এই সংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে খুনীরা সাথে সাথেই শুরু করে দেয় পরবর্তী খুনের পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক আনসার বাংলার একটি স্লিপিং সেলের সদস্যরা ঢাকার যাত্রাবাড়িতে একটি বাসা ভাড়া করে পরবর্তী খুনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। চাপাতি ও অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় হাঁটা অনুশীলন করতে গিয়ে টহল পুলিশের কাছে অস্ত্র ও চাপাতি সহ ধরা পড়ে সেই স্লিপিং সেলের একজন সদস্য। যাত্রাবাড়ির মেসে ওঠা বাদবাকি স্লিপিং সেলের সদস্যরা একজনকে হারিয়েও পরিকল্পনা মোতাবেক আগাতে থাকে।

অভিজিৎ রায় হত্যার এক মাসের মাথায় ৩০শে মার্চ সকাল বেলা অফিসে যাবার পথে হত্যা করা হয় নাস্তিক ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে। খুন করে পালিয়ে যাবার সময়ে সাহসী পথচারীদের ভূমিকায় দুইজন হত্যাকারী ধরা পড়ে। হত্যায় অংশ নেওয়া দুইজনের বরাতে জানা যায়, তারা কখনই বাবুর লেখা পড়েনি, বাবু সম্পর্কে জানত না। হুজুরের নির্দেশে তারা বাবুকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। পুলিশ দুইজন আক্রমণকারীকে হাতে পেয়েও হত্যার সাথে জড়িত, মূল পরিকল্পনাকারীদের সনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনতে এযাবৎ সফল হয়নি। ওয়াশিকুর বাবুকে হত্যার দেড় মাসের মাথায় ১২ই মে সিলেটে সকাল বেলা অফিসে যাবার পথে বাসার সামনে হত্যা করা হয় মুক্তমনা ব্লগার, সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক অনন্ত বিজয় দাশকে। হত্যাকারীরা অনন্ত বিজয়কে জনসমক্ষে প্রায় পাঁচশ মিটার তাড়া করে বাসার নিকটস্থ পুকুর পারে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।

অনন্ত হত্যার পর ঢাকায় গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে ফেরার পথে মুক্তমনা লেখক, গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় কর্মী ও বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়কে (“নিলয় নীল”) অনুসরণ করে ইসলামি মৌলবাদীদের একটি দল। বিষয়টি টের পেয়ে পুলিশকে জানালেও পুলিশ দায়িত্ব এড়াতে একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) পর্যন্ত গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করে। ৭ই আগষ্ট শুক্রবার ভরদুপুরে নীলাদ্রির বাসায় ঢুকে তার সঙ্গী ও সঙ্গীর ছোটো বোনকে অস্ত্রের মুখে আটক করে তাকে আরেক ঘরে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি মুক্তমনা, ইস্টিশন, ধর্মকারী ব্লগ ও ফেসবুকে নিলয় নীল এবং এন সি নীল নামে লেখালেখি করতেন। অভিজিৎ রায়ের মতোই ওয়াশিকুর, অনন্ত, এবং নীলাদ্রি হত্যার দায়ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম গর্বভরে স্বীকার করে।

শুধু নাস্তিক লেখক নয় এই মৌলবাদীদের হাতে গত কয়েক বছরে খুন হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক থেকে শুরু করে প্রগতিশীল আরো কয়েকজন মানুষ। জঙ্গীবাদী কর্মকাণ্ডের অর্থায়নের জন্য আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ব্যাংক ডাকাতি পর্যন্ত করেছে, এবং ডাকাতির সময় ব্যাংকের ম্যানেজার সহ বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে।[১] এছাড়া ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে চট্টগ্রামের একটি নার্সিং কলেজের শিক্ষিকা অঞ্জলী রাণী দেবীকে হত্যাও তারাই করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।[২] হত্যার পাশাপাশি সর্বসাধারণ্যে ভয় জাগানোর জন্য এবং নিজ কর্মীদের ও উগ্র-মুসলমানদের উৎসাহ দেয়ার জন্য জঙ্গীরা নিয়মিত নতুন নতুন তালিকা ও হত্যার হুমকি প্রকাশ করে যাচ্ছে। নীলাদ্রি হত্যার পর ইত্তেহাদুল মুজাহিদিন নামক একটি জঙ্গীগোষ্ঠীর নামে ১৯ জনের একটি নতুন তালিকা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে পাঠিয়ে হুমকি দেয়া হয়; তালিকাটিতে প্রথমেই ছিল নীলাদ্রি’র নাম যা লাল কালি দিয়ে কাটা।

সরকারের ব্যর্থতা এবং উল্টো লেখকদের দোষারোপ

ঘোষণা দিয়ে ছয় মাসের মধ্যে চার জন লেখককে হত্যার পর বিক্ষোভের মুখে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ খোলে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ পুলিশ। আমাদের হতভম্ব করে দিয়ে এই সিরিয়াল হত্যাকাণ্ডের সুরাহা না করে হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করার জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী করা হয় আক্রান্ত ব্লগার ও লেখকদেরই।

নীলাদ্রি হত্যার দুইদিন পর ৮ই আগস্ট মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে ব্লগার হত্যার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশে এটা চলতে দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। জাতির পিতা আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। কাজেই সেই স্বাধীনতার চেতনাটা আমাদের সমুন্নত রাখতে হবে … দেশে এখন বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটছে এবং সরকার সেগুলো মোকাবিলা করছে। অন্তত আমাদের সরকার অলস বসে নেই।” ইসলামকে শান্তির ধর্ম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যারা ইসলামকে কলুষিত করছে তারা কোনো ধর্মে বিশ্বাসী হতে পারে না।” তিনি বলেন, “একদিকে তারা মানুষ মারবে, অন্যদিকে ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটবে। আমরা এটি হতে দেব না … অন্তত বাংলাদেশে হতে দেব না।”[৩]

প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ “তার সরকার অলস বসে নেই” এই বাক্যটি এতদিন পরে হলেও নিজ মুখে ঘোষণার জন্য। যদিও লেখক-ব্লগার হত্যার মহোৎসোব শুরু হবার পরেও কার্যত সরকারের কাজে-কর্মে এই ঘোষণার প্রতিফলন পাওয়া কষ্টসাধ্য, তারপরেও আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম এবার সত্যিই হয়তো সরকারের এতদিনের ‘আলস্য’ কাটবে, তারা হত্যাকারীদের ধরার চেষ্টা করবে, বাংলাদেশে অবস্থিত যাবতীয় জঙ্গীবাদের জাল ছিন্ন করে তাদের নির্মূলে সচেষ্ট হবে! আমাদের সে আশাতেও গুড়ে বালি, কেননা অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, সরকারের সমস্ত কর্তাব্যক্তিরা একসাথে যেন আলস্য কাটিয়ে নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন, তাদের গ্রেফতার ও শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে!

ধর্মানুভূতির রাজনীতির কারণে অভিজিৎ রায়ের হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী জনসমক্ষে কিছু বলতে পারেননি, তাকে গোপনে টেলিফোন করে অভিজিৎ রায়ের পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে হয়েছে। এমন গোপনীয়তার কারণ আমরা পরে জানতে পেরেছি তার সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়ের মুখ থেকে। অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নিয়ে সরকারের কার্যক্রমের সমালোচনা করে বন্যা আহমেদের রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের পরিপ্রেক্ষিতে জয় বলেছিলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি তার মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য এতটাই নাজুক যে প্রকাশ্যে তার কিছু বলা স্পর্শকাতর ছিল, তাই তিনি ব্যক্তিগতভাবে অভিজিতের বাবাকে সহমর্মিতা জানিয়েছিলেন। অভিজিৎ রায়কে ‘ঘোষিত নাস্তিক’ উল্লেখ করার পর রয়টার্সের ওই প্রতিবেদনে জয়কে উদ্ধৃত করে বলা হয়, “আমরা (আওয়ামী লীগ) নাস্তিক হিসেবে পরিচিত হতে চাই না। তবে এতে আমাদের মূল আদর্শের কোনো বিচ্যুতি হবে না। আমরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী।”[৪]

জয় ভুল বলেননি। আওয়ামী লীগ তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী হলেও নাস্তিকদের অধিকার রক্ষার জন্য কিছু করতে চায় না, কারণ তাতে তাদের ভোটে টান পড়ার সম্ভাবনা জাগে। ক্ষমতার লোভে তাই ধর্মনিরপেক্ষতার লেবাস পরে ইসলামি মৌলবাদীদের সুরে ধর্মীয় উগ্রতাকে আশকারা দেয়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগের নীতি। ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের উত্তাল সময়ে হেফাজতে ইসলাম যখন নাস্তিকদের ফাঁসির দাবিতে ঢাকা অভিমুখে লং মার্চ ঘোষণা করে তখনই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে চলমান আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য পুরো আন্দোলনটাকে আস্তিকতা-নাস্তিকতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। সে সময়ে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে প্রতিটি নাগরিকের চিন্তা ও বাক্‌স্বাধীনতার কথা স্মরণ করিয়ে না দিয়ে উল্টো বলেছিলেন—হেফাজতের দরকার নেই, তিনিই যথেষ্ট। নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসীর দাবিসহ ১৩ দফা দাবিতে ঢাকা লং মার্চের প্রাক্কালে ২০১৩ সালের ৩১শে মার্চ আওয়ামী লীগের এক সভায় শেখ হাসিনা ইসলামি দলগুলোর উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনাদের কোনো আন্দোলনে যাবার দরকার নেই। একজন মুসলমান হিসেবে আমি নিজেই যথাযথ পদক্ষেপ নেবো। যারা ইন্টারনেট পোস্ট ও ব্লগের মাধ্যমে ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার ব্যাপারে আমরা ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”[৫]

মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চালানোর অঙ্গীকার করা শেখ হাসিনার এই বক্তব্য প্রমাণ করে তিনি শুধু মুসলমানদের ধর্ম রক্ষার বিষয়টিই দেখবেন, দেখবেন শুধু মুসলমানদের ধর্মানুভূতি। ধর্মানুভূতির আড়ালে এই অনুভূতি আসলে ‘ইসলামধর্মানুভূতি’। অন্য কোনো ধর্মপালনকারী বা কোনো-ধর্মই-না-পালনকারীদের কোনো ধরণের অধিকার থাকার প্রশ্নই যেন আসে না মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে।

২০১৩ সালে আমরা অবাক হয়ে দেখলাম যে, ইসলামী মৌলবাদীদের কাছ থেকে সরকারী কর্তৃপক্ষ নাস্তিক ব্লগারদের তালিকা পাবার পর, কর্মকর্তারা তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন এবং সাথে সাথেই আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে এই তালিকার চারজন ব্লগারকে গ্রেফতার করে কোর্টে হাজির করেন। এর পরপরই প্রায় এক লাখ ইসলামিস্ট ঢাকার রাস্তায় মিছিল শুরু করে শুধু ‘নাস্তিক ব্লগারদের মৃত্যুদণ্ডের’ দাবিতেই নয়, বরং নতুন শিক্ষানীতি যেখানে নারীশিক্ষার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিলো সেটা বাতিলেরও দাবিতে। সরকার এবারও তাদের সাথে আপোস করে। সেই ২০১৩ থেকেই সরকার ইসলামিস্টদের একের পর এক প্রত্যক্ষ দাবি দাওয়া মেনে চলছে।

নীলাদ্রি হত্যার দুইদিনের মাথায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তাদের সাথে মিলে সংবাদ সম্মেলন করেন বাংলাদেশ পুলিশের প্রধান এ কে এম শহীদুল হক। তিনি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো লেখা না লেখার পরামর্শ দেয়াকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উপস্থাপন করেন সেখানে। । একই সাথে কারও লেখা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো হলে সে ক্ষেত্রে পুলিশকে তা জানানোর পরামর্শও দেন তিনি।[৬] পরপর চারটি হত্যাকাণ্ডের পরেও কেন পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে, কেন লিস্ট ধরে মারা ব্লগারদের নিরাপত্তার ব্যাপারে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই সেসব প্রশ্নের উত্তরে আইজিপি জানান, “তবে আমাদের যে জিনিসটা খেয়াল রাখতে হবে… আমাদের দেশে প্রচলিত আইনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা অপরাধ। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারীর সাজা ১৪ বছর। তবে কেউ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করলে তাকে হত্যা করতে হবে, তা মানা যায় না।” তিনি আরও বলেন, “পাশাপাশি যারা মুক্তমনা, লেখেন, তাদের কাছে এবং আপনারা যারা আছেন তাদের কাছে অনুরোধ, আমরা যেন সীমা লঙ্ঘন না করি। এমন কিছু লেখা উচিত নয়, যেখানে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে, বিশ্বাসে আঘাত আনে।”

একই দিনে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় যেসব ব্লগার মুক্তমনা পরিচয় দিয়ে ধর্মের বিরুদ্ধে লেখালেখি করে তাদের অপরাধী হিসেবে গণ্য করে গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বলা হয় এখন থেকে ব্লগাররা ব্লগে কী লেখেন সে বিষয়ে খোঁজ রাখবেন গোয়েন্দারা। যাঁদের ব্লগে ধর্ম বিষয়ে আপত্তিকর মন্তব্য, কটুক্তি পাওয়া যাবে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। এ ছাড়া যারা ব্লগারদের হত্যা করেছে তাদেরও দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[৭] এরই ধারাবাহিকতায় গত ১০ই আগস্ট দুপুরে ডিএমপি’র গোয়েন্দা ও অপরাধতথ্য বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “যারা ব্লগারদের হত্যার সঙ্গে জড়িত এবং যারা হযরত মুহাম্মদ (সা.), ধর্ম ও কোরআন নিয়ে যুক্তিহীনভাবে ব্লগে লেখালেখি করেন তাদের সকলকে আইনের আওতায় আনা হবে। কারণ যারা যুক্তিহীনভাবে ধর্ম নিয়ে ব্লগে লেখেন তারাও উগ্রবাদী।” স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও ব্লগারদের আটক করার কথা বলেছেন। এখানেই শেষ নয়, সরকারি কর্তৃপক্ষ ইসলাম-সমালোচক নাস্তিক লেখকদের শুধু বিচারের কথা বললেও, আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে, হেফাজতে ইসলামের সাথে সুর মিলিয়ে এই লেখকদের সরাসরি মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছে আওয়ামী ওলামা লীগ।[৮]

বাংলাদেশে যে সবার সমান বাক্‌স্বাধীনতা নেই তার প্রমাণ হচ্ছে, ইসলামি মৌলবাদীরা চার জন ধর্মসমালোচনাকারীকে হত্যা করার পরও সরকার ও পুলিশ হত্যাকারীদের বিচারের পরিবর্তে সোচ্চার হচ্ছে ধর্মসমালোচনাকারী ও বাক্‌স্বাধীনতায় বিশ্বাসী লেখকদের বিচার নিয়ে, আর সরকার সমর্থিত উগ্রবাদীরা আরো এগিয়ে গিয়ে উল্টো লেখকদেরই মৃত্যুদণ্ড চাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মুখে ব্লগার হত্যা সহ্য করা হবে না বললেও তার সরকারকে দিয়েই সাথে সাথেই আবার বলিয়েছেন যে আসলে তারা ব্লগারদেরকেই জেলে পুরতে আগ্রহী।

ধর্মানুভূতি ও বাক্‌স্বাধীনতা প্রসঙ্গে

বাংলাদেশের ইতিহাসে বাক্‌স্বাধীনতার উপর সবচেয়ে ভয়ংকর আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মানুভূতি এবং বাক্‌স্বাধীনতা প্রসঙ্গে মুক্তমনার অবস্থান আবারো স্পষ্ট করে তুলে ধরা উচিত বলে আমরা মনে করি। আমরা ধর্মানুভূতিকে অন্য আট দশটা অনুভূতির মতোই মনে করি, এবং অন্য অনুভূতির মতো এটাকে আহত করাও ন্যায্য মনে করি। বাংলাদেশের তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সরকার যখন ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে ২০১২ সালে একটি ওয়েবসাইট ও কয়েকটি ফেসবুক পাতা বন্ধ করে দিয়ে বর্তমানের এই ভয়ংকর সময়ের সূচনা করে তখন মুক্তমনা সম্পাদক অভিজিৎ রায় ধর্মানুভূতি প্রসঙ্গে লিখেছিলেন:

“পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যার সমালোচনা হয় না। ছাত্রদের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে কোন ঐতিহাসিক ভয় পান না এই ভেবে যে, চেঙ্গিস খানের সমালোচনা করা যাবে না, পাছে ‘চেঙ্গিসানুভূতি’ আহত হয়! কেউ ইতিহাস চর্চা করতে গিয়ে ভাবেন না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের অত্যাচারের কথা কিংবা জাপানী বর্বরতার কথা অথবা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর নৃশংসতার কথা বলা যাবে না। কেউ বলেন না, এতে করে কারো ইতিহাসানুভূতিতে আঘাত লাগছে, মামলা করে দেবে! প্রথম আলোর মত পত্রিকা যখন বিজ্ঞানের নামে আগডুম বাগডুম পরিবেশন করে, আমরা বলি না আমরা আদালতের শরণাপন্ন হব, আমাদের বিজ্ঞানুভূতি বিপন্ন। অথচ ধর্মের ক্ষেত্রে সব কিছু হয়ে যায় ব্যতিক্রম। ধার্মিকদের ভঙ্গুর অনুভূতি সামান্যতেই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ধর্মযুদ্ধের নামে বিধর্মীদের উপর কি ধরণের অত্যাচার করা হয়েছিলো তা বললে তাদের ধর্মানুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, পয়গম্বর-নবী-রসুল আর ধর্মের দেবদূতদের অমানবিক কার্যকলাপ তুলে ধরলে ধর্মানুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, নারীদের অন্তরিন করে তাদের অধিকার হরণ করা হয় তা বললে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, ধর্মগ্রন্থ গুলোতে বর্ণিত অবৈজ্ঞানিক আয়াত বা শ্লোক তুলে ধরলেও তারা আহত হন। আর ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করা হলে তো কথাই নেই; ঈশ্বর যে ‘খুঁটি ছাড়া আকাশকে ছাদ স্বরূপ ধরে রাখেন’ তা যেন চৌচির হয়ে তাদের মাথায় তৎক্ষণাৎ ভেঙ্গে পড়ে। ধর্ম সব সময়ই কৌতুকের বড় উৎস হলেও ব্যঙ্গ এবং কৌতুকবোধের ব্যাপারটা ধার্মিকদের সাথে সবসময়ই কেন যেন রেসিপ্রোকাল। অথচ, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি চলচ্চিত্র, খেলাধুলা বা অন্যান্য যাবতীয় বিষয়কে সমালোচনা, ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতে তাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। কেবল ধর্মের বেলাতেই গণেশ উল্টে যায় বরাবরই।”

ধর্মানুভূতিতে আঘাত বা ধর্মকে সমালোচনা করার অধিকার দেয়া তো দূরের কথা, বাংলাদেশ সরকারের চাপাতিধারী জঙ্গীদের উগ্রতার সাথে নাস্তিকদের ধর্মসমালোচনামূলক লেখাকে সমান করে দেখে হত্যাকারীদের অপরাধ লঘু করার চেষ্টা করছেন যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতাকে আমরা যেমন কঠোরভাবে সমালোচনা করছি, ধর্মসমালোচকদের বিচারের আওতায় আনার সরকারি চেষ্টাকেও আমরা তেমনি কঠোরভাবে সমালোচনা করছি। ধর্ম কেন যেকোনো কিছুর সমালোচনা এবং সার্বিকভাবে বাক্‌স্বাধীনতা প্রশ্নে মুক্তমনা সবসময়ই আপোষহীন। যে কারো যেকোনো আদর্শ, ধর্ম, মতামতকে সমালোচনা করলে বা কথা ও লেখার মাধ্যমে কারো অনুভূতিকে আহত করলে তাতে কখনোই কারো ক্ষতি হয় না। কিন্তু কাউকে হত্যা করলে, বা কারো সর্বজনীন-মৌলিক-মানবাধিকার হরণ করলে তাতে তার সরাসরি-ক্ষতি হয়। এমনকি অবৈধ তো দূরের কথা ধর্মের যাদৃচ্ছিক সমালোচনা বা ব্যঙ্গ প্রায় কখনোই কারো সরাসরি ক্ষতিরও কারণ হতে পারে না। কোনো ধরণের অনুভূতিতে আঘাত কোনো সরাসরি ক্ষতির মধ্যে তো পড়েই না, এমনকি স্রেফ ক্ষতির মধ্যেও পড়ে না। অনুভূতি আহত হলে কেউ সেটা বলতে পারেন, কলমের জবাব কলম দিয়ে দিতে পারেন, তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারেন, কিন্তু সেটার জন্য মামলা ঠুকে দিতে পারেন না, হত্যা তো কোন ছাড়। আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের মানবসভ্যতার মূল্যবোধ যেখানে এসে পৌঁছেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এসব মধ্যযুগীয় আইনকানুন এবং দমননীতি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা।

আইসিটি অ্যাক্ট

যে আইনের কথা বলে আজ ব্লগারদের ভয় দেখানো হচ্ছে—তাদের নিরাপত্তা প্রদানের বদলে, তাদের বাক্‌স্বাধীনতা রক্ষার বদলে—সেই ছদ্ম-ব্লাসফেমি আইন আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭তম ধারার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিষয় এখানে আমরা উল্লেখ করতে চাই। ২০০৬ সালে মেয়াদের শেষ সময়ে এসে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার সর্বপ্রথম ‘তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬’ প্রণয়ন করে। এই আইনের হাস্যকর, অযৌক্তিক ৫৭তম ধারাটি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ তাদের গত বারের মেয়াদের শেষ সময়ে এসে সংশোধন করে সেটাকে আরও ভয়াবহ রূপ প্রদান করে। ৫৭তম ধারার আপাত-অসংজ্ঞায়িত ‘অপরাধ’কে আমলযোগ্য, অজামিনযোগ্য, ও তাতে সর্বনিম্ন শাস্তির সীমা ৭ বছর করে তারা সংশোধিত আইনটি পাশ করে।

এ ধরনের আইনে নিরপরাধ ব্যক্তির হয়রানির আশংকা থাকে এবং সে আশংকা সত্যি করতে আমরা দেখেছি ব্লগার রাসেল পারভেজ, সুব্রত শুভ, মসিউর রহমান বিপ্লব, আসিফ মহিউদ্দীনকে গ্রেফতার করা হয়। মূলত হেফাজতে ইসলামকে সন্তুষ্ট করতে সরকার ধর্মানুভূতির অভিযোগ এনে তাদের গ্রেফতার করে। পাকিস্তানে আমরা জানি, জমিজমা সংক্রান্ত ঝামেলা হলেও অনেক সময় ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে মামলা ঠুকে ব্যক্তিবিশেষকে রাষ্ট্রীয় এবং মৌলবাদী ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়ার ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতাবাদী, নাস্তিকদের উপর এই সহিংসতার স্বরূপ উদ্ঘাটন না করে, যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বাংলাদেশ সরকার যদি আক্রান্তের উপর দায় চাপিয়ে, তাকে জেলে ঢোকানোর ভয় দেখিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চান তাহলে মুক্তমনাও তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চায় যে আজ আমরা আক্রান্ত হচ্ছি, আপনারা আমাদের দায়ী করছেন, একদিন আসবে যখন আমাদের সবাইকে মেরে কেটে সাফ করে আপনাদের উপর আক্রমণ শুরু করবে জঙ্গীরা। আসলে একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন যে, শাহবাগ আন্দোলনের সময় থেকে শুরু হওয়া এই নাস্তিক নিধনযজ্ঞে কিন্তু অ-নাস্তিকরাও যুক্ত হয়েছেন। নতুন নতুন হিট লিস্টে নাস্তিক ব্লগার থেকে শুরু করে শিক্ষক, লেখক, মন্ত্রী কেউই কিন্তু বাকি নেই আর।

এমতবস্থায় আমরা মুক্তমনা’র পক্ষ থেকে সরকারের কাছে নিম্নলিখিত দাবি জানাচ্ছি:

১) ব্লগার-লেখক-সমাজকর্মী হত্যাকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্টদের খুঁজে বের করে তাদের আইনের আওতায় আনুন। মৌলবাদী জঙ্গীদের সকল চক্রকে চিহ্নিত করে তাদের নির্মূল করুন। দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল গঠন করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করুন। বিচারহীনতাই মৌলবাদী জঙ্গীদের এভাবে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটাতে উৎসাহিত করেছে। বাংলাদেশে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের হত্যা চেষ্টার উপযুক্ত বিচার হয়নি, রাজীব হায়দারের উপর হামলাকারীদের ধরা হলেও বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়ের হত্যাকারীদের গ্রেফতারের ব্যাপারে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এবং গাফিলতি স্পষ্ট প্রতীয়মান।

২) মৌলবাদী জঙ্গীদের হিটলিস্টে থাকা সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।

৩) বাক্‌স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকার পরিপন্থী পিনাল কোডের ২৯৫-ক ধারা সংশোধন করুন। অসাংবিধানিক তথ্যপ্রযুক্তি আইনের (ICT Act) সাতান্ন ধারা বাতিল করুন।

৪) পুলিশের মহাপরিচালক, ডিএমপি কমিশনার, মন্ত্রী, আমলা থেকে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্বহীন কথাবার্তা বন্ধ করতে হবে। হত্যার দায় কলমের ঘাড়ে দিয়ে হত্যাকারীর অপরাধ লঘু করার চেষ্টা বন্ধ করুন।

৫) দেশ থেকে ধর্মান্ধতা ও জঙ্গীবাদ নির্মূলের লক্ষ্যে হেফাজতে ইসলাম, আওয়ামী ওলামা লীগ, জামায়াতে ইসলাম সহ ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী দলগুলোকে তোষণের নীতি পরিহার করুন। বাংলাদেশকে মৌলবাদের হাত থেকে বাঁচাতে এদের বিরুদ্ধে জনগনকে সম্পৃক্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিন।

তথ্যসূত্র:

১। http://www.banglanews24.com/fullnews/bn/390825.html
২। http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article982653.bdnews
৩। http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/597073/
৪। http://www.dhakatribune.com/bangladesh/2015/may/11/situation-too-volatile-comment-avijit-murder
৫। www.ndtv.com/world-news/bangladesh-pmsheikh-hasina-pledges-to-punish-online-insults-against-islam-517688
৬। http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1008802.bdnews
৭। http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2015/08/10/254553
৮। http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article949541.bdnews