পাকিস্তান আমলের মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাসের পাঠ্য বইয়ে কিভাবে পাকিস্তানের জন্ম হ’ল তা লিখিত ছিল এভাবেঃ

“ সকল দিক দিয়া উপমহাদেশের মুসলমানদের অধঃপতন ঘটিয়াছিল সেদিন। তারপর স্যার সৈয়দ আহম্মদ আব্দুল লতিফ ঘুম ভাংগাইয়া দেন মুসলমানের। বলেন, ইংরাজী শিখিয়া লইয়া যে করিয়া হউক ন্যায্য অধিকার ফিরিয়া পাইতে হইবে। নইলে হিন্দুরা সকল কিছু আত্মসাৎ করিয়া নিবে। শির উঁচু মুসলমান জিন্দা রহো জেহাদী জোশে-ওয়াহাবি-ফারাইজি-খেলাফতের ঝান্ডা তোলে কওমী নিশান। হিন্দুর ভাষা বাংলা ছাড়ো, আরবী,উর্দু,ফারসি ইসলামি জবান লও মুখে-সারা দুনিয়ার এক জাতি মুসলমান। কোনো পৌত্তলিক কাফের,ইহুদি,হিন্দু হইতে পারে না তাহার দোস্ত। ইংরেজ নয়,ব্রাহ্মণ্য হিন্দু আসল শত্রু মুসলমানের,ইসলামের। তাই চাই পাকিস্তান-মুসলমানের জানমাল হক একিদার রক্ষাকবচ। ডাইরেক্ট এ্যাকশন-হাত মে ছুরি মুখে পান লড়কে লেংগে পাকিস্তান।–এই ভাবে কায়েম হয় ইসলামের পাকভূমি পাকিস্তান-ইসলামি হুকমত,সাধের পাকিস্তান। পাকিস্তান পায়েন্দবাদ। নারায়ে তকবীর আল্লাহু আকবর”।

ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ হ’ল ঠিকই কিন্ত পাকিস্তান আমলের এ ইতিহাস পাঠ নেতা-নেত্রীদের ভোলানো গেল না; এখনো হয়ত যায়নি। বিশ্বাস না হ’লে দু’ একটি উদাহরণ দিইঃ

১। স্বাধীন বাংলাদেশে যশোরে এক বিদেশী সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে প্রশ্ন করেন, “ স্বাধীন বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের ভাবনাচিন্তা কী?”। তাজউদ্দিন বলেছিলেন, “ হ্যা, নিশ্চয়ই বাংলাদেশে আটকে পড়া সংখ্যালঘু অবাংগালীদের সকল মানবিক অধিকার নিশ্চিত করা হবে”। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু তো আটকে পড়া অবাংগালীরা হবেন- এটা তাজউদ্দিন বুঝলেও কোন আওয়ামী লীগ নেতা বুঝেছিলেন কি? এমনকি বাম কমরেডরাও? বরং তাজউদ্দিনের আমলে ১৩৭ জন পাকিস্তানপ্রেমিক কর্মকর্তাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, বংগবন্ধু কার উপদেশে তাদেরকেই বাংলাদেশের প্রশাসনের হর্তাকর্তা করলেন?

২। মন্ত্রীসভায় আপত্তি উঠেছিল, যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, সেখানে ইসলামি সম্মেলনে বংগবন্ধুর যাওয়া ঠিক হবে না। তবু বংগবন্ধু কেনো গিয়েছিলেন ? কার উপদেশে?

৩। ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কেবল ইসলামি ফাউণ্ডেশন হ’লো, হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ফাউন্ডেশন করা হ’লো না কেন?

৪। আমাদের মজলুম জননেতা ভাসানি “হককথা” নামে পত্রিকা বের করলেন তখন। ভাসানীর “হককথা” পত্রিকার কিছু শিরোনাম , “ বাংলাদেশে ধুতির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে”, “ দেশত্যাগী ভারতীয়রা এসে নিজেদের জমিজমা ফেরত চাইছে” ইত্যাদি। তখন মওলানা সাহেব মাঝে মাঝেই হুমকি দিতেন, “দালাল আইন” তুলে না নিলে আন্দোলন শুরু করবেন, “নইলে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে”; এক সময়ের আদর্শ গুরু ভাসানী সাহেবের কথায় যাদের নামে নির্দিষ্ট গুরুতর অপরাধ নেই, তাদের “সাধারণ ক্ষমা” ঘোষণা করা হয়-আর এ সুযোগেই রাজাকার-আলবদরসহ দাগী অপরাধীরাও স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে “সাধারণ ক্ষমা”র সুযোগ নেয়।

৫। ৭২ সালে কতগুলো দুর্গাপূজা মন্দিরে হামলা হয়েছিল, সে উপাত্ত কি কারো কাছে আছে?

৬। আর আমাদের একদার মিচকে মুক্তিযোদ্ধা জিয়া তো বাংলাদেশকে “পাকিস্তানের অধিক এক পাকিস্তান”-ই শুধু নয় “পাকিস্তানের অধম এক পাকিস্তানে” পরিণত করেন। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা উচ্ছেদ করে “ বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম” চিরস্থায়ীভাবে যুক্ত করেন। তার ধারাবাহিকতায় রাস্ট্রধর্ম ইসলাম। তার ধারাবাহিকতায় আজকের তেঁতুল শফী হুজুর আর আওয়ামী ওলামা লীগের দাবীনামা।

রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই বলে গেছেন , “কার নিন্দা করো তুমি, মাথা করো নত, এ আমার এ তোমার পাপ”।

( তথ্য সূত্রঃ ১। প্রবন্ধ “যে গাছ রুয়েছি তার এই ফল হবে- যারা থেকে গেলাম- ডঃ বিপ্লব বালা
2। দেশভাগঃ স্মৃতি আর স্তব্ধতা- সম্পাদনা সেমন্তি ঘোষ )