ব্লগ, ব্লগার শব্দগুলো এক সময়ে অপরিচিত ছিল, এরপর সেলিব্রেটি হলো এবং তারপর চাপাতির মুখে নিপতিত হলো। অপরিচিতি অবস্থা থেকে সেলিব্রেটি হয়ে চাপাতির মুখে পড়ে যাওয়ার সময়ে অনেকেই এর মাধ্যমে নিজেকে পরিচিত করতে চেয়েছে, সেলিব্রেটি হয়েছে এবং এক সময় সব কিছু অস্বীকার করে হাওয়ায় গা ভাসিয়ে বলছে ব্লগার মানেই হলো ধর্মবিদ্বেষি।

পালাবদলের এই সময় যুদ্ধাপরাধী বিরোধী গণজাগরণ আন্দোলন এবং এর অব্যবহিত পরের কালপঞ্জিকা। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে তারুণ্যের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ গণজাগরণ আন্দোলন শুরু হলে রাতারাতি ফেসবুকে লাইক দেওয়া প্রজন্ম নিজেদেরকে ব্লগার হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করে। তারপর যখন মাহমুদুর রহমান, আমার দেশ আর হেফাজতে ইসলাম আসলো তখন অনেকেই নিজেদের রাতারাতি ভিন্ন সুরে গাইতে শুরু করল। অস্বীকার করতে শুরু করল একদা তারাই ছিল স্বঘোষিত ব্লগার।

দেশে হেফাজতে ইসলামের কার্যক্রম দৃশ্যমানভাবে নাই যদিও তবু তারা রেখে গেছে যে ধ্বংসস্তুপ তার ওপর দাঁড়িয়ে ব্লগার শব্দটি অনেকেরই কাছে এখনও ধর্মবিদ্বেষের প্রতিশব্দ। যদিও সাধারণভাবে ব্লগ মানে অনলাইন দিনপঞ্জিকা আর ব্লগারেরা তার লেখক।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করছি খুব সাধারণ এক ঘটনার। যে ঘটনা সাধারণ হলেও সামগ্রিক বার্তার দিক থেকে তাৎপর্যবহ বলেই মনে হয়। অনন্ত বিজয় হত্যাকান্ডের দিন সিলেটে ছিলাম। ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে অনন্ত রেখে জিন্দাবাজার আসলাম। অনন্তের মৃত্যুর সময়ে সিলেটজুড়ে রোদ নেমেছিল আর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে হঠাত করে দেশব্যাপি ভূমিকম্প এবং এরপর সিলেটজুড়ে বৃষ্টি নামল। মেঘের গুড়গুড় শব্দ আর বৃষ্টির আগমনে বৃষ্টি থেকে নিজের মাথা বাঁচাতে একটা জায়গায় আশ্রয় নিলাম।

চার-পাঁচ জন লোকের অবস্থান সেখানে এবং একটা ছেলে হঠাত বলে ওঠল আল্লাহর কী কুদরত দেখো এই রোদ আর এই বৃষ্টি! তখন সিলেটের একটা অনলাইন নিউজ পোর্টালে কাজ করে এমন একটা ছেলে তীব্র শ্লেষে বলে ওঠল- কই আল্লাহর কুদরত কই, এটাকে ত উনারা বলবে ব্লগারদের কুদরত!

আমি খেয়াল করে দেখলাম এরকম চিন্তাধারার মানুষের সংখ্যা অগণন, যারা ব্লগার মানেই অস্পৃশ্য অথবা অবাঞ্চিত কিছু মনে করে। তাই মিডিয়ায় যখন ‘ব্লগার খুন’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয় তখন মানুষজনের প্রতিক্রিয়া হয় খুব স্বাভাবিক। ভাবখানা এমন ব্লগার মরেছে, মানুষ ত মরেনি; মানুষ মরলে না হয় একটু হাহাকার করা যেত!

মাহমুদুর, আমার দেশ, হেফাজতে ইসলাম যুগ শুরুর পর অনেকের কাছে ব্লগ মানে ভীতিকর একটা নাম। অনেকেই ব্লগার মরলে সাধারণভাবে দেখতে শুরু করে, তাদের মৃত্যুই যেন ভবিতব্যই। এ লোকগুলোর মধ্যে অনেকেই আছে ধার্মিক, অনেকে উগ্র ধর্মান্ধ মৌলবাদী এবং অনেকে নিজেরা ধার্মিক না হলেও ধর্মের আফিমে গলা ডুবিয়ে জাবর কাটে।

আশঙ্কার কথা, এ দলে আছে প্রশাসন এবং সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও। তাই যখন একের পর এক ব্লগার হত্যা করা হয় তখন প্রশাসন হয়ত ধর্মের অবমাননা হবে এমন কারণে খুনীদের ধরতে আন্তরিক হয় না। অভিজিৎ রায় হত্যার সময়ে পুলিশ অদূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও তারা নড়ে না কারণ কে জানে এসব হত্যার মাধ্যমে ধর্ম কায়েম হচ্ছে এসব ভাবছে কিনা! প্রধানমন্ত্রী পুত্র-উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ব্লগার হত্যাকে আর অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে নসিহত প্রদান করেন।

অভিজিৎ রায় হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী অভিজিৎ রায়ের বাবা অজয় রায়কে ফোন দিয়ে স্বান্তনার বাণী শোনান, একাধিক মন্ত্রী চুপি চুপি অজয় রায়ের বাসা গিয়ে কথা বলেন কিন্তু মিডিয়াকে সেগুলো থেকে আড়াল রাখেন কারণ এখানে তারা ধরেই নিয়েছেন যদি প্রকাশ হয় তবে এর মাধ্যমে তারা তাদের সুসম্পর্ক স্থাপনের উদ্দিষ্ট লোকদের বিরাগভাজন হতে পারেন।

ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টদের প্রতি স্বাভাবিক আচরণ করলে, তাদের বেঁচে থাকার নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিলে সরকারের গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিগণ কাদের বিরাজভাজন হবেন? খুব সহজ উত্তর- ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের! তাহলে এরাই সরকারের উদ্দিষ্ট জনগণ যাদেরকে আপন করে নিতে মরিয়া তারা? অথচ এ প্রসঙ্গে একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, ২০১৩’র গণজাগরণ আন্দোলনের সময়ে ইসলামিস্ট মৌলবাদী ধর্মান্ধদের হাতে রাজীব হায়দারের খুনের ঘটনার পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজীবের বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার এ বাড়ি পর্যন্ত যাওয়াকে কোনভাবেই আন্তরিকতার প্রকাশ হিসেবে দেখছি না কারণ রাজনৈতিক এ নেত্রীর চোখমুখে তখন আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নেওয়া মানুষজনদের সমর্থন আদায়ের লোভ কাজ করছিল। যা তিনি এবং তার দল খুব ভালভাবে কাজে লাগাতে পেরেছিল- এটা প্রমাণিতই।

আওয়ামী লীগ, সরকার, প্রশাসন, প্রধানমন্ত্রী পুত্র-উপদেষ্টারা সবাই ব্লগারদের প্রতি সহানুভূতিশীল না হয়ে এড়িয়ে চলাকে রাজনৈতিক আচার আর ধর্মের প্রতি তাদের মমত্ববোধ হিসেবেই জ্ঞান করছেন ধারণা করি। ফলে একের পর এক ব্লগার খুন হলেও তাদের বিকার নাই, নাই তদন্তে অগ্রগতি, নাই বিচার শুরু নিয়ে বক্তব্যও। অথচ তারা যা খেয়াল করে না তা হলো এই খুন হয়ে যাওয়া, হতে যাওয়া লোকগুলো সব সময়েই প্রগতির পথের লড়াকু যোদ্ধা, এরা গোঁড়ামির বিরুদ্ধে স্রোতের বিপরিতে হলেও দাঁড়াতে জানে। আর যারা এদেরকে খুন করছে তারা কোনভাবেই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ভোটার হিসেবে নিজেদের নাম লেখাবে না। কারণ এরা দল হিসেবে আওয়ামী লীগকেও ধর্মবিরোধী বলে মনে করে। তাই যতই অতি ধার্মিক লেবাস পরিধান আর মদীনার সনদের বাস্তবায়নের কথা সরকার প্রধানের মুখ থেকে বের হোক না কেন তারা তাদের পুর্বেকার সিদ্ধান্ত থেকে বের হবে না, হওয়ারও নয়!

দেশে একের পর এক ব্লগার ও মুক্তচিন্তার মানুষদের খুন করা হচ্ছে। এ খুনের ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়, ধারাবাহিক ঘটনা। এ পর্যন্ত কেবল ব্লগ লিখে পরিচিতি পাওয়া এমন পাঁচ জন লোককে হত্যা করা হয়েছে, এর বাইরে আছে মুক্তচিন্তার মানুষদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও, আছে আক্রমণের ঘটনা। এসব ঘটনার মধ্যে কেবল রাজীব হায়দারের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মামলা বিচারের পর্যায়ে আছে যদিও অনেক আসামি এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর বাকিগুলো নিয়ে মাতামাতি নেই, প্রশাসনেরও নেই কোন কার্যকর উদ্যোগ।

ব্লগারদের ওপর হামলা ও হত্যাকাণ্ডের খতিয়ান নিয়ে যদি দাঁড়াই তাহলে দেখা যায়- ১৫ জানুয়ারী, ২০১৩ আসিফ মহিউদ্দীনের ওপর হামলা হলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩ রাজীব হায়দার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫ অভিজিৎ রায়, ৩০ মার্চ, ২০১৫ ওয়াশিকুর বাবু, ১২ মে, ২০১৫ অনন্ত বিজয় দাশ এবং আপাত সর্বশেষ ৭ আগস্ট, ২০১৫ নিলয় নীলকে হত্যা করে জঙ্গি মৌলবাদীরা। লক্ষ্যণীয় বিষয়, সবগুলো হামলার ধরন একই এবং কারণও একই। বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদকে এখানে আলোচনা আনলাম না কারণ আলোচনা কেবল ব্লগারদের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছি। অবস্থা এমন নিলয় নীল এই তালিকায় যে সর্বশেষ ব্যক্তি এটা বলে দিতে কাউকে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না কারণ দেশের সরকার, প্রশাসন খুনীদের ধরতে আন্তরিক নয়।

ইসলামিস্ট জঙ্গিরা এ হামলাগুলো চালিয়েছে তার প্রমাণ এদের সকলে আগে থেকেই প্রাণনাশের হুমকি পেয়ে আসছিলেন। এবং হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও আল-কায়েদা বার্তা দিয়ে নিহত ব্লগারদের হত্যার দায় স্বীকার করে। ফলে দেশে জঙ্গি নাই সরকারের এ ঘোষণা যে ফাঁকা বুলি তা আবারও প্রমাণ হয়।

ব্লগারদের একের পর এক হত্যা নিয়ে সরকারের মধ্যে ভাবান্তর নেই তার প্রমাণ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ব্লগারদের নিরাপত্তা নিয়ে তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কিছু নাই এর প্রমাণ অনেকবার দিয়েছেন তিনি। ব্লগারদের হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন- “ব্লগারদের যারা হত্যা করছে আমার কাছে মনে হয়, তারা এক ধরনের চিন্তাভাবনা নিয়ে করছে” [বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ২১ মে, ২০১৫, বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) আয়োজিত এক সংলাপে ]। এ থেকে সহজেই অনুমেয় সরকার কীভাবে দেখছে বিষয়টিকে।

দেশে ব্লগারদের খুনের ঘটনার পর পরই আলোচনায় চলে আসে ৮৪ জন ব্লগারদের কথিত এক হিটলিস্ট। গণজাগরণ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে এ তালিকা নিয়ে জোর প্রচার চালিয়েছে জামায়াতে ইসলাম, হেফাজতে ইসলাম, ওলামালীগ, বিলুপ্ত ঘোষিত সিপি গ্যাং এবং ফেসবুকে বিভিন্ন ইসলামিস্ট গ্রুপ এবং পেজগুলো। ফলে অনেকেই মনে করছে তালিকা করে করে বুঝি এ সংখ্যার ব্লগারদের হত্যা করাই হবে, এর বাইরের সবাই নিরাপদ? কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আগের করা এ তালিকায় গত দুই বছরে অনেক নাম যুক্ত হয়েছে। যার সবিশেষ প্রমাণ ওয়াশিকুর বাবু ও নিলয় নীল। ৮৪ জনের তালিকায় না থাকলেও তারা জঙ্গি মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন, প্রাণ হারিয়েছেন।

সরকারের গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিগণ ও প্রশাসনের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিরা যখন ব্লগার নিরাপত্তা নিয়ে ভাবিত নন তখন খুনীরা আস্কারা পেয়ে যায় এবং লাশের মিছিলে যুক্ত হয় আরও কিছু লাশ। ফলে জীবদ্দশায় নিলয় নীল যখন তার নিরাপত্তার জন্যে থানায় জিডি করতে যান তখন পুলিশ কর্মকর্তারা তাঁকে উপদেশ দেন দেশ ছেড়ে চলে যেতে। এরচেয়ে বড় হতাশা, এরচেয়ে বড় আফসোস আর কী হতে পারে? সে পুলিশ কর্মকর্তা কোন ব্যক্তি হিসেবে কথাগুলো বলেননি, বলেছিলেন পুলিশের হয়ে। তিনিই দেশের পুলিশ প্রশাসনের প্রতিনিধিত্ব করছেন যখন তার গায়ে জড়ানো থাকে ইউনিফর্ম। খেয়াল করলে দেখবেন এমন মানসিকতার পুলিশ কর্মকর্তা সারাদেশে অগণন যারা ব্লগার আর অনলাইন এক্টিভিস্ট নাম শুনলেই ভাবে এদের কী দরকার দেশে থাকার!

সরকারের মতো পুলিশ প্রশাসনও তাহলে ধরে নিয়েছে ব্লগার হত্যা জায়েজ? অথচ সাধারণ বোধসম্পন্ন যে কেউই অনুধাবণ করবেন পুলিশ প্রশাসনের কাজ কাউকে উঠকো নসিহত প্রদান নয়; গণমানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা। এটা কারও প্রতি তাদের অনুকম্পা প্রদর্শন নয়; পেশাগত দায়িত্ব পালন!