nn
[ নিলয় নীল এর শক্তিশালী স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ]

কোন একটা দেশ জাতি যখন পতনের দিকে পেছনের দিকে এগিয়ে যায়, কোন একটা গোষ্ঠী ও সমআদর্শিক মানুষের চেতনার জগৎ যখন বারংবার ঝাটকায় কোনঠাঁসা হয় অসুন্দরের দ্বারা তখন সেই সময়ের সেই দেশ জাতির জনগনের সামনে একগুচ্ছ ট্রাজেডি মঞ্চায়স্থ হয়, তাবৎ পৃথিবী দেখে বাস্তবতা বিরোধীতার নির্মম পরিহাস যার পেছনে কাজ করে সেই দেশের সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক অসততা-অন্যায়-বিশ্বাসঘাতকতা। ভারতীয় উপমহাদেশে অপরিমেয় সম্ভাবনার বীজ বুঁনে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল সূদীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছর পূর্বে। স্বাধীনতা অর্জনের পরে, অতীত অন্ধকারের ইতিহাসের সময় পেরিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশ যখন সামনের দিকে মানবিকতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন বিপরীতে আমাদের দেশটি বেছে নিচ্ছে অমানবিকতা, অসহিষ্ণুতা, কুসংস্কার, অপবিজ্ঞান, ধর্মাষ্ঠতা, মৌলবাদ। এই হাতিয়ারসমূহ গলা টিপে ধরেছে মুক্তবুদ্ধির চেতনাসমূহকে, খুন করে চলছে মুক্তবুদ্ধির মানুষদেরকে। যার সদ্য সংযুক্তি নিলয় নীল এর বর্বরোচিত হত্যাকান্ড। বাংলাদেশ চির পরিচিত বাংলাদেশ দিনে দিনে যেনো বাংলাস্তান হয়ে যাচ্ছে।

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বর্বরতা-নির্মমতায় সরাসরি অংশ নেয়া বেশ কিছু দেশ আজ পৃথিবীর চমৎকার মানবিক দেশে পরিনত হয়েছে। তারা তাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ধ্বংযজ্ঞের ওপর মানব-মন্দির তৈরী করছে। উদাহরণ হিসেবে জাপান-জার্মানীর কথা বলা যায়। মুক্তবুদ্ধির চর্চা হচ্ছে সর্বত্র। ইওরোপীয় ইতিহাসের পথ পরিভ্রমণ করলে দেখা যায় শিল্প-সাহিত্য-স্থাপত্য-দর্শনের ঐশ্বর্যের পাশাপাশি আছে জাতি-গোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মাত্রার যুদ্ধ-বিগ্রহ, আছে ধর্মীয় পাশবিকতা, বিজ্ঞানের বিরোধীতায় অন্ধকারের অভিপ্রাস। আমরা সবাই কম বেশি সে ইতিহাস জানি, জানি আজকের ইওরোপের উন্নত দেশগুলোর উন্নতির পেছনকার কারণ, আর বেশ পিছিয়ে থাকা সমস্যাবহুল দেশগুলোর ব্যাপারেও রাখি খবর। উভয়ক্ষেত্রেই একটা সাধারণ পদক্ষেপ ভূমিকা রেখেছে, বিষয়টি হচ্ছে, ধর্ম-মৌলবাদ ও বিজ্ঞান-প্রগতি থেকে কে কোনটাকে প্রাধান্য দিয়ে গ্রহণ করে এগিয়েছে। বেশ কিছু দেশ এখনও খ্রীষ্টানধর্মের ধূর্তামীর শিকার, কয়েকটি দেশ ইসলামাইজেশনের প্রভাবে রুগ্নদশা ভোগ করছে। বাকিরা বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে প্রযুক্তিক উন্মেষে প্রগতির পথে হাটছে। সেসব দেশ এখন বিজ্ঞান ও মানবিকতার ভেতরেই (যা কখনই ধর্মের অংশ ছিল না) নৈতিকতা ও মূল্যবোধ (যা ধর্ম নিয়ত অপহরণ করার চেষ্টায় লিপ্ত) আবিষ্কার করে চর্চা করে যাচ্ছে।

কিন্তু বাংলাদেশে আমরা ঠিক কি দেখতে পাচ্ছি? শরীয়াহ, মদীনা সনদ, হেফাজতি-দেওয়ানবাগী পীরবাদপ্রীতি, মাদ্রাসাশিক্ষা এসব কার অণুষদ? – ধর্মের, এদেশের প্রেক্ষাপটে আরও স্পষ্ট করে বললে ইসলামধর্মের, যার জন্ম হয়েছিল দেড় হাজার বছর পূর্বে, সংস্কারবিরোধী হলেও যে ধর্ম ঠিকই বিবর্তিত হয়ে আরও অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, পশ্চাৎ দিকে তার ভয়ংকর গতি। এমন কি হবার কথা ছিল? ১৯৭১ এ পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস গনহত্যার শিকার বাংলাদেশ সেক্যুলার চেতনায় সংবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করেছিল, যার রুপরেখা রচনায় ভূমিকা রেখেছিলেন তখনকার উদার-অসাম্প্রদায়িক-মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা। দুইযুগের শোষণের অবসানকালে একটা অভূতপূর্ব আঘাত, তার পরে সৌর্যময় স্বাধীনতা অর্জন, স্নিগ্ধ-শ্যামল নদীবিধৌত এই দেশটি তো হওয়ার কথা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিময় দেশ, সুখি দেশ। কিন্তু এত বছর হলো দেশ দিন দিন যেন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। সংখ্যা লঘুরা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। সুদীর্ঘকালব্যাপী আদিবাসী পাহাড়ীরা ধর্ষিত হচ্ছে। শিশু নির্যাতন বাড়ছে। আমরা জানি এসব কিসের ফলশ্রুতিতে ঘটছে। সবচেয়ে বেশি সংখ্যা লঘু যারা, প্রগতিশীল-মানবতাবাদী-নাস্তিকেরা যাদেরকে জনগনের ধর্মান্ধতা ঘৃণা করতে শেখাচ্ছে তাদেরও যেন এদেশে ঠাঁই। তাদের নিশ্চিহ্নকরণেও যেন কারওই কিছু যায় আসে না। তবে তাদের হত্যাকে জায়েজ করার জন্য স্বউৎসাহী লোকের অভাব হয় না।

ঠিক এখানেই আসে পরিহাস ও পরিতাপের বিষয়টি। আমরা, ১৬ ডিসেম্বরকে জন্ম দিতে মহত্তম আত্মত্যাগ স্বীকার করা ১৪ই ডিসেম্বর ভুলে গেছি। সমুদ্রবক্ষ মুক্তবুদ্ধির মনীষীদের কথা ভুলে গেছি। বাংলাদেশ হয়ত তখনও তাদের যোগ্য ছিল না। আমরা তখনও তাদের গুরুত্ব বুঝতে পারি নি। কিন্তু পাকিস্তানী হায়েনারা ঠিকই পেরেছিল। তারা জানত স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা যেমন ভূমিকা রেখেছেন, যুদ্ধ পরবর্তী দেশ গঠনে, জাতির বিবেক রুপায়নে, দেশকে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মজবুত করায় তাদেরই শক্তি-সাহস-জ্ঞান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাই তারা সকল বুদ্ধিজীবীকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। তারা সফল যে হয়েছিল সেটা এখনকার বাংলাদেশকে দেখলে ঠিকই বোঝা যায়। সকল পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতা এড়িয়ে নিজোদ্যোগে বেড়ে ওঠা আজকের প্রজন্মের মুক্তবুদ্ধির মানুষদেরকেও হত্যা করা হচ্ছে। লিস্ট করে তাদের নিশ্চিহ্ন করণের মহোচ্ছব লেগেছে যেন। কারা করছে এখন খুন? এদেশেরই যুবকেরা। যেসব মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা, প্রগতিবাদী নাস্তিকেরা তাদের নিজ নিজ কর্মজীবনে দেশ জন্য ভূমিকা রাখার পাশাপাশি এদেশের অগ্রগতির মৌলিক ও শিকড়ে প্রথিত বাধাসমূহ দূর করতে জীবন উৎসর্গ করছে, প্রতিদানে তাদেরকে খুন করা হচ্ছে, সংখ্যাগরীষ্ঠ অকৃতজ্ঞ জনগন তাদের অজ্ঞতার দরুণ তাদের ঘৃণার চোখে দেখে। ৭১ এর বুদ্ধিজীবীরা শহীদের মর্যাদা পায়, এ যুগের অমিতসম্ভাবনার পরিশ্রমী সৎ দেশপ্রেমিকেরা করুণাও পায় না, এর চেয়ে বড় পরিহাসের কিছু কি থাকতে পারে?

স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শক্তির জীবিত কুলাঙ্গারদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পুনরায় জনপ্রিয়তা লাভ করে দেশের সংস্কৃতি-মনন-রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা লাভ, মৃত প্রেতাত্মাদের দেখিয়ে দেওয়া মওদুদিবাদের মত হিংস্র-আদর্শিক দর্শন স্বাধীনতাত্তোরকালে নতুন দেশ পুনর্গঠনে যেমন বাধা দিয়েছে এবং দিচ্ছে, তেমন স্বাধীনতার সবটুকু সুফল ও অর্জনকে কড়ায়ৎ করে ফেলেছে ও ফেলছে। এদেশে জামায়েতে-ইসলামের মত দেশবিরোধী দলের নাগপাশ এর বিস্তার প্রথম ধরা পরেছিল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্ব দেয়া যুদ্ধাপরাধী বিরোধী আন্দোলনে, এরপরে আবারও একবার বিষয়টি সকলের সামনে উঠে আসে সারাদেশ ব্যাপী, সকলস্তরের প্রাতিষ্ঠানিক ও সেবাসংগঠনে তাদের শক্তিশালী কাঠামো এর উপস্থিতির অস্তিত্ব আবিষ্কারে। তারা শুধু ধর্ম-চিন্তার বাঙ্গালী-অভিযোজনাকেই বিভৎসরকমভাবে পরিবর্তিত করে নি, তারা শিক্ষা-সংস্কৃতি-চিত্তবিনোদনে পাশ্চাৎ ও ক্ষেত্র বিশেষে পশ্চিমা মোড়কে মওদুদিবাদ এর মত জঙ্গীবাদী দর্শনের অদৃশ্য অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে, এখনও ঘটাচ্ছে, যা পরবর্তিতে হিযবুত তাহেরীর, জেএমবি এবং অধুনা আনসার-উল্লা-বাংলা টীম এবং আনসার আল ইসলাম এর মত শত শত ইসলামিক সন্ত্রাসী দল সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। যখন সারা বিশ্বে সকল ধর্ম (ও তাদের সকল রুপেরঃ অহিংস-হিংস্র, মডারেট- সহীহ- মৌলবাদী) এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সকল ধর্মের ভয়ংকর বাধ্যবাধকতা-অন্যায়-অমানবিক দিক সমূহ মানুষ বর্জন করা শুরু করেছে, ধর্মের জায়গায় মানুষেরা প্রাকৃত প্রকৃতি-মানবপ্রেম (মানবধর্ম) ও বিজ্ঞানে জীবনের মানে ও শান্তি খুঁজে পাচ্ছে সেখানে কোন একটি ধর্মের বিকৃততম রুপকে কিভাবে একটা দেশের জনগোষ্ঠী অলক্ষ্যে-বা-সচেতনভাবে গ্রহন করে যাচ্ছে? কেন সবাই এইসব অপরাধমূলক কর্মকান্ড ও ভয়ংকর দূরভিসন্ধি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এক শ্রেণির দেশপ্রেমিক মুক্তমনাদের রাষ্ট্রীয় দমন ও ধর্মরক্ষাহেতু খুন করাকে জায়েজ ঘোষণা দিচ্ছে? উত্তরটা সহজ, দেশে ভন্ডের সংখ্যা বেড়েছে, স্ববিরোধী মডারেটদের সংখ্যা বেড়েছে যারা সকলে ভেতরে বাইরে মৌলবাদ তোষণ-বিস্তারে ভূমিকা রাখছে। ভন্ডামীর শিকার হয়ে হওয়া গোল্ডফিশ স্মৃতির গিনিপিগেরা ভন্ড হয়ে আজ নিজেরাই ভন্ডামী শুরু করেছে।

এই ভন্ডামীর পাশাপাশি বাংলাদেশ ও বাঙ্গালী জাতির আছে বিশ্বাসঘাতকতার এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। জামাত-বিএনপি এর মত জন্মগতভাবেই দেশবিরোধী দলগুলোর বাইরে, বর্তমান সরকারী দল আওয়ামী লীগও ঠিক একই কাজ করছে তাদের মুক্তিযুদ্ধপূর্ব ও মুক্তিযুদ্ধকালীন ইমেজ কাজে লাগিয়ে ‘মন্দের ভাল’ চরিত্রে, যে দলকে ক্ষমতায় আনতে বুকের রক্ত দিয়েছে দেশপ্রেমিক বুদ্ধিদীপ্ত মানুষেরাই। ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রতিশ্রুতির মৌলিক কাজগুলো তারা এতটুকুও কি করতে পেরেছে? সেক্যুলার আদর্শের কথা বলে যারা রাজনীতির মাঠ-ময়দান প্রকম্পিত করে তারাই যখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে আগুন দেয়, মৌলবাদের প্রতক্ষ্য তোষণ-সমর্থন ও জঙ্গিবাদী তৎপরতায় উৎসাহদান করে, প্রথাবিরোধী প্রগতিবাদী মানুষদের লিস্ট খুনিদের হাতে তুলে দেয়, জনগনকে সোনার বাংলা গঠনের ঐতিহাসিক ফিনিক্স স্বপ্ন দেখিয়ে মানুষের জান-মাল রক্ষার মৌলিক অধিকার ও মত-প্রকাশের সর্বাধিক জরুরী স্বাধীনতায় সংবিধান লংঘন করে হস্তক্ষেপই শুধু নয়- সাংঘর্ষিক আইন দিয়ে ধর-পাকড় ও শাস্তি প্রদান করে তখন বাংলাদেশের প্রাগৈতিহাসিক ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস আরেকবার আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়। এ বিশ্বাসঘাতকতা শুধু তো জনগন ও একটা বিশেষ গোষ্ঠীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের চারটি স্তম্ভের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা যা একটি বৈষম্যহীন দেশ গড়ায় পরিকল্পিত, লাখ শহীদের পূন্য আত্মত্যাগের অবদানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা যারা বৈষম্যহীন দেশের স্বপ্ন দেখে চোখ মুদেছিল, এ বিশ্বাসঘাতকতা স্বাধীনতা উত্তর প্রতিটি প্রজন্মের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা যারা আজ কুসংস্কার-মৌলবাদ-অপবিজ্ঞান-সাম্প্রদায়িকতা-অসহিষ্ণুতায় আড়ষ্ঠ, এ বিশ্বাসঘাতকতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সাথে যারা জন্ম নিয়ে জানবে তাদের দেশ একটা মধ্যম আয়ের মানের মননের সদা-উদিয়মান দেশ এ জন্ম নিয়েছে। এত বিশ্বাসঘাতক ভন্ডের মাঝে যারা প্রকৃত মানবিক, পরিশ্রমী দেশপ্রেমিক, সৎ নাগরিক তারাই সবচেয়ে নির্মম বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে একে একে খুন হয়ে যাচ্ছে।

শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আজাদ থেকে শুরু করে নিলয় নীল, ধর্মোন্মাদদের বলির সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশ কি জানে- আদতে মুক্তবুদ্ধিকেই মারা হচ্ছে? সরকার কি জানে- স্বাধীনতা বিরোধী, দেশবিরোধীদের বিরুদ্ধের অতন্দ্র প্রহরীদের মেরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আহত করা হচ্ছে? এদেশের শিক্ষিত সমাজ কি জানে- কুসংস্কারবিরোধী কর্মকান্ডের কান্ডারীদের মেরে- বিজ্ঞানচর্চার প্ল্যাটফরম বিনির্মানের শ্রমিকদের মেরে- এদেশে আসলে বিজ্ঞানশিক্ষার বিকাশকে ব্যহত করা হচ্ছে। একে একে সবাইকেই কি নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে? যদি এমন হয়, সবাই শেষ, কেউ যদি না থাকে, তখন বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ কিভাবে তৈরী হবে? নাকি গ্যালাক্সি ট্যাবে একজন নাস্তিকের অবস্থান ট্র্যাক করে খুন করাটা এদের কাছে নাসার দূর গ্যালাক্সিতে পৃথিবীর মত বাসযোগ্য গ্রহ খোঁজার মিশনের চেয়ে মহৎ কাজ? যে নারী নিজ উদ্যোগেই সকল প্রতিকূলতা পেরিয়ে মাদাম কুরি, ভেলেন্তিনা তেরেস্কোভা, ওয়াসফিয়া নাজরীন, ফ্রিদা কাহলো, হেলেন কেলার হবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে তাদেরকে ঘর-গৃহস্থলিতে কাজে বাধ্য রাখা, যৌনতা আর সন্তান জন্মদানের মেশিন বানানোই বহির্বিশ্বের সাথে তাল মেলানো? ধর্মকে বেঁচে, বিক্রি করে বিকৃততম, হিংস্রতম করতে যারা সোচ্চার ও জনপ্রিয় তাদের হাতেই কি ৭১-এর বাংলার অভিশপ্ত চেতনার মুক্তি?

মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার রাজীব হায়দার ধর্মের নোংরা দিকটিকে জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন, দেশের কলঙ্ক দূর করার জন্য শাহবাগে প’রে রয়েছেন, এই দেশ তাকে কিছু দিতে পারবে না বরং তার ক্ষতির সম্ভাবনা আছে জানার পরেও দেশকে ভালবেসে গেছেন। অনন্ত বিজয় দাশ এর মত নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানমনস্ক বিজ্ঞানশিক্ষক আর হয়ত এদেশ পাবে না। সমাজ-সরকার কোন সাহায্য করবে না জেনেও ভিনদেশে তুলনামূলক নিরাপদ আশ্রয় করে নেবার আগেই এদেশ তাকে হত্যা করেছে। ওয়াশিকুর বাবুর মত একটি টগবগে তারুণ্যের সরল মানবতাবাদী দার্শনিককে মারতে তার চিরচেনা গলিতে ওৎ পেতে অতর্কিত হামলা করেছে মুসলিম হায়েনারা। পুরো পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় নেবার সুযোগ ছিল যে বিজ্ঞানীর, দেশের জন্য আবেগী সে সন্তানটিকে, বিজ্ঞানলেখক অভিজিৎ রায়কে দেশের সংস্কৃতি-প্রগতির প্রতিনিধিত্বকারী উৎসবে প্রিয়তম মানুষটির পাশে ধর্মোন্মাদদের চাপাতীর কোঁপে শত শত ভীত-পরাজিত মানুষের মাঝে খুন হতে হয়েছে। যে ছেলেটা সমাজের কুসংস্কার দূর করতে “বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি” প্রতিষ্ঠা করেছে, সকল অন্যায়-অবিচার-বৈষম্যর প্রতিবাদে যে রাজপথে সোচ্চার থেকেছে, সাধারনকে সংগঠিত করেছে সেই নিলয় নীলকে নিজ গৃহে পরিবার-পরিজনকে বন্দী করে হত্যা করা হয়েছে। কয়েকমাসের ভেতরে চারজন দেশপ্রেমিক মুক্তবুদ্ধির মানুষকে হত্যা ও দেশবাসী ও সরকারের নির্লিপ্ততা-নির্লজ্জতা দেখে ‘এরপরে কে’ এই প্রশ্ন করাই যেন এখন অবান্তর প্রশ্ন হয়ে দাড়িয়েছে। এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কি হতে পারে?

বাংলা মা তার আঁচলে লুকিয়ে রাখতে পারছে না তার এ সময়ের সৎ-সাহসী-পরিশ্রমী সন্তানদের। তাদের রক্তে রঞ্জিত তার বক্ষ-বদন। তাঁর সম্ভ্রম তো ৭১-ই এর লুন্ঠিত হয়েছে, অশ্রু মোছার জন্য যতটুকু বস্ত্র দরকার ততটুকুতেও অসুরের লোলুপ দৃষ্টি। মুক্তবুদ্ধির মানুষদের হয়ত শেষ আছে এ দেশে, অসুরদের নেই, অসুরদের কারখানা সবখানে। যারা বাংলা মাকে সম্ভ্রম ফিরিয়ে দিতে চায়, মানবিকতা-বিজ্ঞান-প্রগতির বুননে তাকে পরাতে চায় পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট বস্ত্র, আজ অসুরদের হিংস্র থাবায় এদেশে সেইসব সন্তানেরা ক্ষত-বিক্ষত। শ্যামলা-বর্ণ বাংলা মা বুঝি আবার উলঙ্গ হয়ে পরছে, অস্তিত্বের সংকটে পরা বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির মহৎ প্রাণ মানুষদের বধ্যভূমির ওপরে উড়ছে যেন বাংলাস্তানের রক্তাক্ত নিশান।