তথ্য আর বক্তব্যের মাঝে অনেক ফারাক। তথ্যের অনেক উৎস থাকতে পারে , বক্তব্য কিন্তু যার-যার তার-তার। তথ্য আর বক্তব্যের সূত্র উল্লেখ করার ব্যাপারেও পদ্ধতিগত পার্থক্য থাকে লেখকদের মাঝে। হুমায়ুন আজাদ কোথাও অন্যের বক্তব্যকে নিজের বলে চালাননি। যারা যারা আজাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন তারা রেফারেন্সিং, সাইটেশন(Citation) পদ্ধতির ভিন্নতা, কোটেশন বনাম প্যারাফ্রেজিং, প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি সোর্সের সাইটেশন স্টাইলের ভিন্নতা ইত্যাদি বিষয়গুলো না জেনেই দাবীগুলো করেছিলেন। পাতার পর পাতা চুরির অভিযোগ করার পর ‘ছফার জবানবন্দীতে মৃণাল নাথের একটা প্রবন্ধ’ তারা হাজির করেছেন বটে তবে বাদবাকী দাবীগুলোর একটা নিয়েও তারা কয়েক লাইন চুরির প্রমাণও আমাদের সামনে হাজির করতে পারেননি।

(১/)অন্য কোনও লেখকের বক্তব্যকে দুই ভাবে নিজের লেখার ভেতর আনা যায়। হয় কোট করে অথবা প্যারাফ্রেজিং করে। কোট করে লেখা মানে অপর লেখকের বক্তব্যকে হুবহু লিখে তাকে কোটেশন মার্কের মাঝে আবদ্ধ করতে হয়। আর প্যারাফ্রেজিং মানে হচ্ছে অপর লেখকের বক্তব্যের মূল অর্থ অপরিবর্তিত রেখে নিজের মত করে লেখা। তবে কোট করা হোক অথবা প্যারাফ্রেজিং করা হোক অপর লেখকের বক্তব্যটুকু উল্লেখ করার পর সাইডনোটে বা ফুটনোটে অথবা বইয়ের শেষে এপেন্ডিক্সে তথ্যসূত্র (সাইটেশন) উল্লেখ করতেই হবে।

সাইটেশন পদ্ধতির কোনও ইউনিভার্সাল স্ট্যান্ডার্ড নেই, বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরিকৃত অনেকগুলো স্ট্যান্ডার্ড আছে এক্ষেত্রে। Colin Neville এর লেখা Complete guide to referencing and avoiding plagiarism বই থেকে এমন কিছু গাইডলাইনের নাম উল্লেখ করে দিচ্ছিঃ

• Name–date (Harvard)
• American Psychological Association (APA) style of referencing
• Modern Language Association of America (MLA) style of referencing
• Modern Humanities Research Association (MHRA) style
• The Chicago (reference list) style (Turabian)
• Council of Science Editors (CSE)

এই পদ্ধতিগুলোর ভিন্নতা নিয়ে আলোচনা এই প্রবন্ধে করবো না। বরং সাইটেশনের নিয়মাবলী নিয়ে আজ মোটা দাগে কথা বলব। কারণ আমাদের আলোচনা সাহিত্যের বইয়ের সাইটেশন নিয়ে, সায়েন্টিফিক জার্নালের সাইটেশন নিয়ে না।

এখন কথা হচ্ছে অপর লেখকের বক্তব্য নেয়ার সময় সাইটেশন করতে হয় কিভাবে?
>অপর লেখকের নাম উল্লেখ করতে হবে।
>সেই লেখকের কোন বই/প্রকাশনা থেকে নেয়া হচ্ছে সেটা উল্লেখ করতে হবে।
>সেই বই মুদ্রণের সময়কাল, প্রকাশনীর নাম ও ঠিকানা ইত্যাদি উল্লেখ করতে হবে।
>যে লেখা থেকে থেকে নেয়া হচ্ছে তার কত নং পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হল তা উল্লেখ করতে হবে।
এখন কথা হচ্ছে সাইটেশন করার উপরের নীতিমালাগুলোর সবগুলো মেনে চলার বাধ্যবাধকতা আছে শুধুমাত্র গবেষণাপত্রের (থিসিস পেপার) ক্ষেত্রে। সাহিত্যের বইয়ের ক্ষেত্রে এই সাইটেশন পদ্ধতি অনেক ঢিলেঢালা। হুমায়ুন আজাদের বইগুলো কিন্তু সাহিত্যের বই। নিঃসন্দেহে সাইটেশন করার সময় সবগুলো তথ্য উল্লেখ করা ভালো। কিন্তু তার মানে এই না যে পৃষ্ঠা নং বা প্রকাশনীর নাম না লিখলে প্লেইজারিজমের দায়ে অভিযুক্ত করা যায়।

ব্যাখ্যা করে বললে, ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে ধরুন, আপনি আপনার বইতে কোনও কিছু বোঝানোর সময় কুদ্দুসের বক্তব্য লিখেছেন। এখন আপনি আপনার লেখায় উল্লেখ করলেন কুদ্দুসের বক্তব্যটা কুদ্দুসের কোন বইয়ের কত নাম্বার পৃষ্ঠায় পেয়েছেন। অথবা কি করলেন, কুদ্দুসের বক্তব্য কুদ্দুসের নাম উল্লেখ করেই লিখলেন কিন্তু কুদ্দুসের কোন বইয়ের কত নং পৃষ্ঠা থেকে নিয়েছেন সেটা উল্লেখ করলেন না। এখন কথা হচ্ছে কোন বইয়ের কত নং পৃষ্ঠা থেকে নিয়েছেন সেটা উল্লেখ না করলে কি প্লেইজারিজম হয়? অবশ্যই না। কারণ এক্ষেত্রে আপনি কিন্তু কুদ্দুসের বক্তব্যকে নিজের বলে চালাচ্ছেন না, কুদ্দুসের বক্তব্যকে কুদ্দুসের নাম উল্লেখ করেই লিখেছেন।

ইবনে ওয়ারাকের বইতে সাইটেশন পদ্ধতি আর আজাদের বইতে সাইটেশন পদ্ধতির পার্থক্য হচ্ছে ওয়ারাক তাঁর বইতে অন্য যেসব লেখকের বক্তব্য ব্যবহার করেছেন সেগুলোর ক্ষেত্রে লেখকের নাম, বইয়ের নাম, পৃষ্ঠা নং সব উল্লেখ করেছেন আর হুমায়ুন আজাদ তাঁর বইতে যেসব অন্য যেসব লেখকের বক্তব্য ব্যবহার করেছেন সেগুলোর ক্ষেত্রে লেখকের নাম উল্লেখ করেছেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রে সেই লেখকের বইয়ের নামও উল্লেখ করেছেন কিন্তু বাদবাকি তথ্য উপস্থাপনের প্রয়োজন মনে করেননি। এই পার্থক্য আসলে শুধু ওয়ারাক বনাম আজাদ না, পাশ্চাত্য বনাম উপমহাদেশীয়। হুমায়ুন আজাদ তার আমার অবিশ্বাস বইতে তো বটেই অন্যান্য বইগুলোও অনুরূপভাবে সাইটেশন করেই লিখেছেন। শুধু আজাদ না, বাংলাভাষার অন্যান্য অধিকাংশ লেখকের সাইটেশন পদ্ধতি আজাদের মতই।

কয়েকটা উদাহরণ দেখা যাকঃ
(i)

তখনকার কবির একটা শ্লোক মনে পড়ে-
“আমার হৃদয় আমারি হৃদয়
বেচি নি তো তাহা কাহারও কাছে
ভাঙাচোরা হোক, যা হোক তা হোক,
আমার হৃদয় আমারি আছে।”

>>এই লাইনগুলো আছে রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি বইয়ের ভগ্নহৃদয় প্রবন্ধে। পাঠক খেয়াল করুন রবীন্দ্রনাথ পৃষ্ঠা নং উল্লেখ তো পরের কথা, লেখকের নামই উল্লেখ করেননি। শুধু কোট করেছেন লাইনগুলো। তার মানে কি এই কারণে রবীন্দ্রনাথকে লেখা চোর বলা যাবে?

(ii)

একজন আধুনিক ইংরেজ কবি শরৎকে সম্ভাষণ করিয়া বলিতেছেন,
‘তোমার ঐ শীতের আশঙ্কাকুল গাছগুলোকে কেমন যেন আজ ভূতের মত দেখাইতেছে; হায় রে, তোমার ঐ কুঞ্জবনের ভাঙা হাট, তোমার ঐ ভিজা পাতার বিবাগী হইয়া বাহির হওয়া! যা অতীত এবং যা আগামী তাদের বিষণ্ণ বাসরশয্যা তুমি রচিয়াছ। যা-কিছু ম্রিয়মাণ তুমি তাদেরই বাণী, যত-কিছু গতস্য শোচনা তুমি তারই অধিদেবতা।’

>>প্রিয় পাঠক খেয়াল করুন, রবীন্দ্রনাথ এখানে ইংরেজ কবির নাম বলেননি, উপরন্তু প্যারাফ্রেজিং করেছেন। তার মানে কি রবীন্দ্রনাথ লেখাচোর?

(iii) নিজের পৈত্রিক ধর্ম(জুদাইজম) সম্বন্ধে হাইনের তিক্ত মন্তব্যঃ

‘ঐ তো কোন ধর্ম নয়, একটা গজব মাত্র।’

স্বর্গ আর নরক সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনি(হাইনে) এক জায়গায় বলেছেন,

‘যৌবনে ঘাসের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতাম, লোকে স্বর্গের এত যে ঐশ্বর্যের কথা বলে সত্যই কি তা সব স্বর্গে আছে! থাকলে কই তা থেকে ত কিছুই মাটিতে ঝরে পড়ে না, যেমন একটা মুক্তোর দুল, কিংবা হীরার একটা হার নিদেনপক্ষে এক আধখানা কেকের টুকরো; বরং পড়ে ত শিলা, বরফ বা বা সাধারণ বৃষ্টি ফোঁটা। এতো ঠিক নয়–মনে মনে বলতাম।’

>>উপরের দুইটা উদাহরণই আবুল ফজলের বই থেকে নেয়া। ফজল হেইনের কোন বই থেকে বক্তব্যগুলো নিয়েছেন তা লেখেননি। এমনকি আমি আবুল ফজলের কোন বই থেকে এই উদাহরণ নিয়েছি তাও লেখিনি। তার মানে কি আমি এবং আবুল ফজল দুইজনই প্লেইজারিজম করেছি?

(iv)

“চিরকাল রবীন্দ্রনাথ এমন এক নারীর সন্ধান করে গেছেন যিনি তাঁর রোমান্টিকতাকে স্পর্শ করবেন। সেই আশা থেকে শুরু করে নতুন বৌঠান, কেউ সেই নারী হতে পারেননি। কেউ উচ্চারণ করতে পারেনি, পথ যদি বাঁধে বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী। ক্রমশ তিনি সম্পর্কের গ্রন্থিগুলো বন্ধনহীন করার দিকে ঝুঁকলেন।”

>>উপরের লাইনগুলোতে সমরেশ মজুমদার কিন্তু ‘পথ যদি বাঁধে……’ অংশটুকু কোট করেননি, এমনকি এইটাও বলেননি এই লাইনটুকু কার লেখা। তিনি ধরেই নিয়েছেন তাঁর পাঠক তা জানেন। এখন সমরেশ মজুমদার যে নাম, কোটেশন কিছুই করলেন না তার মানে কি তিনি লেখা চোর?

২/ এতক্ষণ সরলভাবে কথা বলেছি সাইটেশন পদ্ধতি ও তার ভিন্নতা নিয়ে। এবার আসা যাক তথ্য বা বক্তব্যের উৎস নিয়ে। কিছু তথ্য থাকে যেটা কোনও নির্দিষ্ট গবেষণা সংস্থা, স্ট্যাটিসটিকাল ব্যুরোর নিজস্ব। এই তথ্যগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই সেই সংস্থার নাম ও অন্যান্য তথ্য উল্লেখ করতেই হবে। আবার কিছু তথ্য থাকে যেগুলো আবহমানকাল থেকে প্রচলিত, এক্ষেত্রে সাইটেশনের বাধ্যবাধকতা তেমন একটা থাকে না।

এখন বক্তব্যের উৎস সাধারণত দুই রকমের হয়।
> বক্তব্য নেয়া হচ্ছে সরাসরি কোনও লেখকের বই বা কোনও প্রকাশনা থেকে
একে বলে প্রাইমারি সোর্সিং বলে। উপরে উল্লেখিত সাইটেশনের নিয়মাবলী প্রাইমারি সোর্সিং এর বেলায় প্রযোজ্য।
>যার বক্তব্য নেয়া হচ্ছে সেটা তাঁর বই থেকে না নিয়ে, অপর কোনও লেখকের বই থেকে নেয়া হলে তাকে সেকেন্ডারি সোর্সিং বলে। সেকেন্ডারি সোর্সিং এর সাইটেশন নিয়ে অনেকের ভুল ধারণা থাকে। উপরে উল্লেখিত নিয়মাবলী সেকেন্ডারি সোর্সিং কিভাবে প্রয়োগ হবে সেটা নিয়ে একটু পরে বলবো। আপাতত সেকেন্ডারি সোর্সিং ব্যাপারটা ভালোমত বোঝা দরকার।

ধরুণ আপনি আপনার লেখায় প্রাসঙ্গিক হিসেবে আবুলের একটা বক্তব্য ব্যবহার করতে চাচ্ছেন। এখন আপনি আবুলের লেখা হয়ত সরাসরি পড়েছেন অথবা পড়েননি। আপনি আবুলের এই বক্তব্য পেয়েছেন বাবুলের লেখা কোনও বইতে। যেখানে বাবুল আবুলের এই বক্তব্যের পাশে সেটা কোন বই কত পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে সেটাও উল্লেখ করেছেন।[ অর্থাৎ বাবুল ঠিকভাবেই সাইটেশন করেছেন] এভাবে আবুলের বক্তব্য বাবুলের লেখা থেকে নেয়াটা হচ্ছে সেকেন্ডারি সোর্সিং।

এখন কথা হচ্ছে আপনি তাহলে আবুলের বক্তব্যটির সাইটেশন কিভাবে করবেন?

> আবুলের বক্তব্যের পাশে শুধু আবুলের কোন বই কত পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে শুধু সেইটুকু উল্লেখ করবেন?

>নাকি আবুলের বক্তব্য, আবুলের কোন বই কত পৃষ্ঠা থেকে নেয়া এবং এই পুরো ব্যাপারটা যে বাবুলের বই থেকে ধার নেয়া সেটাও উল্লেখ করবেন? অর্থাৎ বাবুলের বই-পৃষ্ঠা নং উল্লেখ করবেন সাথে?

উত্তর হচ্ছে হ্যা এবং না দুইটাই। এক্ষেত্রে কিভাবে সাইট করবেন তা নির্ভর করছে আবুলের বক্তব্য বাবুল তাঁর বইতে কিভাবে উপস্থাপন করেছিলেন তার উপর। কারণ এক্ষেত্রে বাবুল হচ্ছেন সেকেন্ডারি সোর্স। আমরা ইতোমধ্যে আলোচনা করেছি, প্রাইমারি সোর্সের কোটেশন আর প্যারাফ্রেজিং নিয়ে। সেকেন্ডারি সোর্সে কোটেশন আর প্যারাফ্রেজিং হলে সাইটেশনের নিয়ম কি হবে?
>হয়ত আবুলের বক্তব্য হুবহু লিখে তাকে কোটেশন মার্কে আবদ্ধ করেছেন বাবুল। যদি হুবহু কোট করাই হয়ে থাকে তবে আবুলের বক্তব্য সাইটেশন করার সময় বাবুলের নামও উল্লেখ করার বাধ্যবাধকতা আপনার একেবারেই নাই।
হুবহু কোট করা হয়ে থাকলে কেনও সেকেন্ডারি সোর্সের নাম উল্লেখ করার বাধ্যবাধকতা নাই সেটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছিঃ
ধরা যাক, আপনি কবিতার কাব্যরসের গুণাগুণ নিয়ে একটা লেখা লিখছেন। আপনি ভাবলেন এই সম্পর্কে কবিগুরুর মন্তব্য আপনার লেখায় যোগ করতে পারলে ভালোই হয়।

“প্রকৃতির নিয়ম-অনুসারে কবিতা কোথাও স্পষ্ট কোথাও অস্পষ্ট, সম্পাদক এবং সমালোচকেরা তাহার বিরুদ্ধে দরখাস্ত এবং আন্দোলন করিলেও তাহার ব্যতিক্রম হইবার জো নাই। চিত্রেও যেমন কাব্যেও তেমনি—দূর অস্পষ্ট, নিকট স্পষ্ট; বেগ অস্পষ্ট, অচলতা স্পষ্ট; মিশ্রণ অস্পষ্ট, স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট। আগাগোড়া সমস্তই স্পষ্ট, সমস্তই পরিষ্কার, সে কেবল ব্যাকরণের নিয়মের মধ্যে থাকিতে পারে; কিন্তু প্রকৃতিতেও নাই, কাব্যেও নাই। অতএব ভাবুকেরা স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট লইয়া বিবাদ করেন না, তাহারা কাব্যরসের প্রতি মনোযোগ করেন।”

–সাহিত্য। কাব্যঃ স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট (পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলীর জন্মশতবার্ষিক সংস্করণ-ত্রয়োদশ খণ্ড, পৃ-৮২৬-৭)

এখন এই লাইনগুলো আপনি খুঁজে পেয়েছেন কোনও একজন লেখকের বইতে যেখানে তিনি হুবহু কোট করেছেন রবীন্দ্র রচনাবলীর জন্মশতবার্ষিক সংস্করণ থেকে। এক্ষেত্রে আপনার লেখায় রবীন্দ্রনাথের নাম, তাঁর বইয়ের নাম-পৃষ্ঠা নং উল্লেখ করাই যথেষ্ট (কারণ রবীন্দ্রনাথ এক্ষেত্রে প্রাইমারি সোর্স)। আপনি হুবহু কোট করা অবস্থায় কার লেখা থেকে নিয়েছেন সেটা উল্লেখ করলে ভালো কারণ বক্তব্যে ভুল থাকলে দায়ভার আপনার উপর সরাসরি বর্তাবে না, কিন্তু কার লেখা থেকে রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্যটুকু নিয়েছেন উল্লেখ না করলে বলা যাবে না আপনি প্লেইজারিজম করেছেন। কারণ রবীন্দ্রনাথের এই লাইনগুলো শুধু আপনি যেখান থেকে নিয়েছেন সেখানেই না, অন্তত আরও দশ-বিশ জন লেখকের লেখায় হুবহু কোট করা অবস্থায় পাওয়া যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্য কে কে কোট করেছেন সেগুলো সব খুঁজে বের করে আপনার লেখায় উল্লেখ করাটা আপনার দায়িত্বের মাঝে পড়ে না। এভাবে খুঁজে বের করাটা সম্ভবও হয় না অনেক ক্ষেত্রে। এই কারণেই সেকেন্ডারি সোর্সের কোটেশনের সাইটেশন উল্লেখ না করলে সেটা প্লেইজারিজমের মাঝে পড়ে না।

>হয়ত আবুলের বক্তব্য প্যারাফ্রেজিং করেছেন বাবুল। অর্থাৎ মূল অর্থ ঠিক রেখে নিজের মত করে লিখেছেন বা অনুবাদ করেছেন বাবুল। আবুলের বক্তব্য প্যারাফ্রেজিং করা মানে কিন্তু সেটা আর আবুলের একার বক্তব্য রইল না। সেটা আবুলের বক্তব্যের মোডিফায়েড ভার্সন অথবা সেটাকে বলা যায় আবুল-বাবুলের যৌথ বক্তব্য। এক্ষেত্রে আপনাকে আবুল-বাবুল প্রত্যেকের নাম, বই নাম-পৃষ্ঠা সবই উল্লেখ করতে হবে অবশ্যই।
উদাহরণ দেই,

“নন্দনতত্ত্ব(Aesthetics) সম্বন্ধে এজরা পৌন্ডের একটা কবিতা আছে। বিষয়টি এই যে, একটি মেয়ে চলছিল রাস্তা দিয়ে, একটা ছোটো ছেলে, তালি দেওয়া কাপড় পরা, তার মন উঠলো জেগে, সে থাকতে পারল না, বলে উঠল, ‘দেখ চেয়ে রে, কী সুন্দর।’ এই ঘটনার তিন বৎসর পরে ঐ ছেলেটারই সঙ্গে আবার দেখা। সে বছর জালে সার্ডিন মাছ পড়েছিল বিস্তর। বড় বড় কাঠের বাকসে ওর দাদাখুড়োরা মাছ সাজাচ্ছিল, ব্রেসচিয়ার হাটে বিক্রি করতে পাঠাবে। ছেলেটা মাছ ঘাঁটাঘাঁটি করে লাফালাফি করতে লাগল। বুড়োরা ধমক দিয়ে বললে, ‘স্থির হয়ে বোস।’ তখন সে সেই সাজানো মাছগুলোর মাথার উপর হাত বুলোতে বুলোতে তৃপ্তির সঙ্গে ঠিক সেই একই কথা আপন মনে বলে উঠল ‘কী সুন্দর।’ কবি বলছেন শুনে ‘I was mildly abashed!’
সুন্দরী মেয়েকেও দেখো, সার্ডিন মাছকেও; একই ভাষায় বলতে কুন্ঠিত হোয়ো না। ‘কী সুন্দর।’ এ দেখা নৈর্ব্যক্তিক—নিছক দেখা;…।”

–সাহিত্যের পথে। আধুনিক কাব্য। রবীন্দ্র-রচনাবলী, বিশ্বভারতী সংস্করণ ত্রয়োবিংশ খণ্ড, পৃ-৪২৫-৬

উপরের এই আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ নন্দনতত্ত্ব সম্বন্ধে আলোচনা করতে যেয়ে এজরা পাউন্ডের কবিতা থেকে প্যারাফ্রেইজ করেছেন। সুতরাং কেউ যদি উপর লাইনগুলোকে শুধু এজরা পাউন্ডের বক্তব্য হিসেবে চালিয়ে দেয় সেটা সরাসরি ভুল হবে। একে বলতে হবে এজরার বক্তব্যের রবীন্দ্রনাথ ভার্সন।
আবার আমি নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কে এজরা পাউন্ডের এই বক্তব্যের রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক প্যারাফ্রেইজ করা বাক্যগুলো হুবহু কোট করেছি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বই থেকে। কিন্তু হাবিবুর যেহেতু রবীন্দ্রনাথ থেকে প্যারাফ্রেইজ করেননি, তিনি রবীন্দ্রনাথের বই থেকে হুবহু কোট করেছেন সুতরাং হাবিবুরের নাম উল্লেখ করতে আমি এখানে বাধ্য ছিলাম না। তাই ইচ্ছা করেই হাবিবুরের কোন বই থেকে রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্য নিয়েছি সেটা উল্লেখও করলাম না। 😛

হুমায়ুন আজাদের অনেক লেখাতেই এমন প্রাইমারি, সেকেন্ডারি সোর্সিং এর দেখা মেলে, দেখা মেলে ভিন্ন লেখকের বক্তব্যের প্যারাফ্রেইজ। এমন উদাহরণ শুধু উপমহাদেশের প্রায় সব লেখকই না, বিদেশি লেখক থেকেও অসংখ্য দিতে পারব। শিবলি আজাদ, ইমতিয়াজ মির্জা, ওয়াহিদুজ্জামান আর পিনাকী ভট্টাচার্যের মত ‘উচ্চডিগ্রিধারীরা’ সাইটেশন পদ্ধতির ভিন্নতা সম্পর্কে ইন ডেপথ আইডিয়া না নিয়েই (নাকি জেনেও ইচ্ছাকৃতভাবে?) প্রমাণ ছাড়াই হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে যে দাবীগুলো করেছিলেন তার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের নিম্নোক্ত কথাগুলো যথাযুক্তঃ

“…আমার বয়স তখন ঠিক ষোল…আমি অল্পবয়সের স্পর্ধার বেগে মেঘনাদধের একটা তীব্র সমালোচনা লিখেছিলাম। কাঁচা আমের রসটা অম্লরস—কাঁচা সমালোচনাও গালিগালাজ। অন্য ক্ষমতা যখন কম থাকে তখন খোঁচা দিবার ক্ষমতাটা খুব তীক্ষ্ণ হয়ে উঠে। আমিও এই অমর কাব্যের উপর নখরাঘাত করিয়া নিজেকে অমর করিয়া তুলিবার সর্বাপেক্ষা সুলভ উপায় অন্বেষণ করিতেছিলাম।”

-জীবনস্মৃতি (রবীন্দ্র-রচনাবলী, বিশ্বভারতী সংস্করণ সপ্তদশ খণ্ড, পৃ-৩৫৪)

কৃতজ্ঞতাঃ
১/www.plagiarism.org
২/ The complete guide to referencing and
avoiding plagiarism- Colin Neville
৩/ False Feathers(A Perspective on Academic Plagiarism)- Debora Weber-Wulff
৪/ ORIGINALITY, IMITATION, AND PLAGIARISM – Caroline Eisner and Martha Vicinus
৫/ Joint Ventures: Authorship, Translation, Plagiarism — Fritz Gutbrodt
৬/ My Word!( PLAGIARISM AND COLLEGE CULTURE)–Susan D. Blum
৭/The Plagiarism Allegation in English Literature from Butler to Sterne — Richard Terry