আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ইস্যুতে শেষ পর্যন্ত কঠোরই হলো আওয়ামী লীগ। তাঁকে মন্ত্রী পদ থেকে অপসারণ, দল থেকে বহিষ্কারের পর সংসদ সদস্য পদ বাতিলের জন্যে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধও জানিয়েছে তারা। পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে আওয়ামী লীগ ধীরে সুস্থে কাজ করেছে। লতিফ সিদ্দিকীকে বাদ দিতে তারা পিছপা হয়নি যদিও দীর্ঘদিন দলে ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের দুর্দিনেও কাজ করেছেন দলের স্বার্থে, তবুও।
প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে কূটনৈতিক সফরকালে গত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে নিউইয়র্কে বসবাসরত টাঙ্গাইলের অধিবাসীদের সঙ্গে এক সভায় বিভিন্ন বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। লতিফ সিদ্দিকীর অপরাধ তিনি হজ নিয়ে মন্তব্য করেছেন, মন্তব্য করেছেন তাবলীগ জামায়াত নিয়ে, মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এবং যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিয়ে। তাঁর মন্তব্যে নাখোশ হয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো, ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনৈতিক নেতাগণ, আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে মানববন্ধন হয়েছে, মিছিল হয়েছে, সমাবেশ হয়েছে, সমালোচনামূখর হয়েছে স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ধর্মাশ্রয়ী বক্তাদের পাশাপাশি সেক্যুলার ভাবধারার পরিচিত বক্তারাও। অনেকে আবার তাঁর ফাঁসি চেয়েছেন, কেউ কেউ দোররা মারতে চেয়েছেন, কেউ কেউ পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যু নিশ্চিত করতে চেয়েছেন।
খেয়াল করলে দেখা যায়, আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে ধর্মের চেতনাটি এত গভীরভাবে প্রোথিত যে নিজে ধর্ম পালন না করলেও তারা সব সময় নিজেদেরকে অতি ধার্মিক হিসেবে পরিচিত করতে পছন্দ করে। ধর্ম আচরণে নয় সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রচারের অনুষঙ্গ। এমন পরিস্থিতিতে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় অনুষ্ঠান হজ নিয়ে মন্তব্যকে তাদের অনেকেই সাধারণভাবে নেয়নি। এক্ষেত্রে বরাবরের মতো উগ্রতা প্রকাশিত হয়েছিল।
হজ বর্তমানে সৌদি আরবের জন্যে একটা অন্যতম ব্যবসায়িক উপকরণ এটা অনেকেই জানে কিন্তু মুখে আনলে পাপ এমন ধারণা পোষণ করে থাকে। সবাই জানে বিনা খরচে কেউ হজ পালনের সুযোগ পায় না এবং পাবেও না কিন্তু এ কথা মুখে আনলেই সমূহ বিপত্তি। একইভাবে তাবলীগ জামায়াতের লোকজন কাজকর্ম ফেলে রেখে মাসের পর মাস ধর্ম প্রচার অথবা ধর্মশিক্ষার পথে নিজেদেরকে নিয়োজিত করে- এখানে ধর্ম প্রচার, ধর্ম শিক্ষাকে বলা যাবে কিন্তু কাজকর্ম ফেলে রেখে সফরের প্রসঙ্গ বলা যাবে না। অঘোষিত এক সীমাবদ্ধতা এখানে আরোপ করা। এখানেই লতিফ সিদ্দিকী সত্য কথাটি বলেছেন বলে অনেকেই গোস্যার এ গোস্যার প্রকাশ এত উগ্রভাবে যে প্রচলিত ‘শান্তির ধর্মের অনুসারিগণ’ অশান্তি সৃষ্টি করে হলেও বিহিত করতে চেয়েছেন।
সজীব ওয়াজেদ জয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য, প্রযুক্তি উপদেষ্টা। তিনি আস্তে আস্তে রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন। তবে তাঁর এ সক্রিয় হওয়া যতটা না মাঠে থেকে, তারচেয়ে বেশি উত্তরাধিকারী রাজনৈতিক দৃষ্টান্ত। তিনি দেশের বাইরে থাকেন এবং দূরে থেকেও দলের সবার মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছেন ইতোমধ্যেই। মাঝে মাঝে দেশে এসে নিজস্ব বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন। আওয়ামী লীগে এখন পর্যন্ত তার উল্লেখযোগ্য এবং একমাত্র ‘অবদান’ নবম সংসদ নির্বাচনের আগে তারুণ্যকে উদ্ধুব্ধ করার মতো ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণা। আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের অনেক ‘এনালগ’ চিন্তাধারার মানুষদের মধ্যে এ ধারণা পৌঁছে দেওয়া কম বড় কথা না। এর বাইরে দলে আর কোন অবদান আছে- এটা অনেক কট্টর আওয়ামী লীগারই হয়ত বলতে পারবে না। তিনি আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত নেতা এবং দলের নবীন-প্রবীণ সবাই এটা মেনে নিতে অনেকটা বাধ্য! তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলা মানে এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে কথা বলা। লতিফ সিদ্দিকী নিউইয়র্কে বসে কথা বলেছেন সুতরাং ঢাকায় এর প্রতিবাদ, প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য; হয়েছেও।
যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন ত তারা সরাসরি এর প্রতিক্রিয়া না জানালেও ধর্মভিত্তিক অন্যান্য দলগুলোকে মাঠে নামাবে। জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে কথা বলা মানে তাদের ভাষায় ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা, ইসলামের বিরুদ্ধাচারণ করা। সুতরাং ঘাড়ের ওপর ঠায় মাথাটা রাখা দায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে বাধ্য, হয়েছেও। ফলে অপ্রত্যক্ষভাবে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টার মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে দিতে মরিয়া।
এমন পরিস্থিতিতে সারা দেশের খুব কম সংখ্যক মানুষ ছিল যারা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর পক্ষে কথা বলবে। সোশ্যাল সাইট ফেসবুকে তাঁর পক্ষে কিছু বলা হয়েছে কিন্তু এখানেও ট্যাগের সংস্কৃতি। নাস্তিক বলে আখ্যা দিয়ে পেছন থেকে ছুরিকাঘাতের চেষ্টা চলেছে, চলছে।
ইত্যবসরে দেশের প্রথম সারির কিছু পত্রিকা লতিফ সিদ্দিকীর দুর্নীতির খতিয়ান প্রকাশে নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখে। যথারীতি নেতৃত্বে ছিল দৈনিক প্রথম আলো। তারা এমনভাবে একের পর এক সংবাদ প্রচার করতে থাকে যাতে করে তাঁকে ধর্মবিরোধী প্রমাণের পাশাপাশি শীর্ষ দুর্নীতিবাজ হিসেবেও প্রচার করা হয়। অবস্থা এমন সুযোগ পাওয়া গেল। যেহেতু তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রচার আছে এ সুযোগে আরও কিছু ইস্যু সৃষ্টি করে ব্যবসায়িক ধান্দায় সফল হওয়া। মিডিয়া এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছে, নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাঁকে মন্ত্রীত্ব থেকে অপসারণ করা হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক মামলা হতে থাকে, মামলার পর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতে থাকে, এবং একই সঙ্গে চলতে থাকে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে ফাঁসি, শিরচ্ছেদ, দোররা মারা, পাথর ছুড়ে মেরে হত্যা, জুতা মারার হুমকিসহ বিবিধ উগ্রবাদের প্রকাশ। দল হিসেবে ইসলাম পসন্দ এটা প্রমাণ করতে এরপর তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কথিত ধর্মবিরোধিতা আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র পরিপন্থি কীনা আমার জানা নাই!
প্রাণনাশের হুমকি, মামলা, গ্রেফতারী পরোয়ানা বহিষ্কারজনিত অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেকেই ধারণা করেছিলেন লতিফ সিদ্দিকী আমেরিকা থেকে দেশে ফিরবেন না কিন্তু তবু তিনি দেশে ফেরেন এবং আইন ও আদালতের প্রতি সম্মান জানিয়ে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণের পর তাঁকে জেলে পাঠানো হয়। ধর্মের ঢাক অতি উচ্চস্বরে বেজে ওঠেছিল বলে অনেকেই তাঁর মামলা লড়তে অস্বীকৃতি জানানোর পরেও সাহসী আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া তাঁর মামলা লড়েন এবং আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে এক সময়ে উচ্চ আদালত থেকে জামিনপ্রাপ্ত হন। তাঁর জামিন প্রাপ্তির পর আবারও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ধর্মান্ধরা, ফিবার হত্যার হুমকি দেয়, মিছিল হয় বায়তুল মোকাররমে। প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেওয়ার পরেও সরকার সে সব হুমকিদাতার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো এ সময়ে তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিলের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে।
জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরিন শারমীন চৌধুরী ১৩ জুলাই, ২০১৫ নির্বাচন কমিশনকে চিঠি লিখেন, নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে চিঠি লিখেন, উদ্দেশ্য একটাই সংসদ সদস্যপদ বাতিল। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে স্পিকার যেখানে নিজেই নিষ্পত্তি করতে পারতেন লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদের বৈধতা সেখানে তিনি কেন নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি লিখতে গেলেন? বলা যায় তাঁর দল আওয়ামী লীগের অপ্রত্যক্ষ প্রভাব কারণ দল থেকে বহিষ্কারের পর খোদ দলীয় সাধারণ সম্পাদক একাধিকবার বলেছেন দল থেকে বহিষ্কারের মাধ্যমে লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ বাতিল হবে। তার ওপর আছে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সহযোগি সংগঠন আওয়ামী ওলামা লীগের বিরোধিতা, তারা লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে তাঁর ফাঁসির দাবি পর্যন্ত জানিয়েছিল। জাতীয় সংসদের অভিভাবক হিসেবে যেখানে সংবিধান ও কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ি চলার কথা সেখানে মাননীয় স্পিকার সরকারী দল কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে পড়েন বলে অনুমেয়।
এমন না যে, এরকম ঘটনা আগে ঘটেনি। এর আগে একাধিকবার দল কর্তৃক বহিষ্কারের পরেও সংসদ সদস্য পদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছিল এবং স্পিকার নিজেই সেটা নিষ্পত্তি করেছেন। উদাহরণ হিসেবে এখানে উল্লেখ্য যে, বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর চারদলীয় জোটের আমলে অষ্টম জাতীয় সংসদে বিএনপির টিকিটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আবু হেনাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তখন আবু হেনার সদস্য পদ রাখার সিদ্ধান্ত দেন তৎকালীন স্পিকার মুহম্মদ জমিরউদ্দিন সরকার। দল থেকে বহিষ্কৃত হলেও তার সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়নি।
একইভাবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে নবম জাতীয় সংসদেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। সাতক্ষীরা-৪ আসন থেকে নির্বাচিত এইচ এম গোলাম রেজাকে তার দল জাতীয় পার্টি বহিষ্কার করলেও তার সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকে এবং এটাও নিষ্পত্তি করেন তৎকালীন স্পিকার।
এখানে অনেকেই উদাহরণ হিসেবে আনেন বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য মেজর আখতারুজ্জামানের দল থেকে বহিষ্কারের পর তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়েছিল সে প্রসঙ্গ। এখানে সূক্ষ্ম একটা বিষয় আছে মেজর আখতারের সংসদ সদস্য পদ বাতিল বিষয়ে। তিনি দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেননি কিন্তু দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংসদে যোগ দিয়েছিলেন- যা ‘ফ্লোর ক্রসিং’ হিসেবে পরিগণিত হয়। দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংসদে যোগদানের কারণে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়েছিল; দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়টি এখানে ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনও নির্বাচনে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রার্থী মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দেন তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে।
এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ি সংসদ সদস্য পদ শূন্য কিংবা বাতিলের জন্যে মাত্র দুইটি কারণের কথা বলা হয়েছে এবং সেগুলো হচ্ছে- দল থেকে পদত্যাগ এবং সংসদে দলের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া। আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর ব্যাপারে এ দু’টোর কিছুই হয়নি। তিনি দল থেকেও পদত্যাগ করেননি এবং দলের বিরুদ্ধেও ভোট দেননি।
এখানে যুক্তি আসতে পারে পদত্যাগ আর বহিষ্কারের পরিণতি একই, দলে নাই। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, পদত্যাগ যেখানে ইচ্ছাকৃত সেখানে বহিষ্কার আরোপিত অর্থাৎ চাপিয়ে দেওয়া। আর চাপিয়ে দেওয়া বিষয়টি অনেকক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের পরিপন্থি হতেও পারে। হয়ত এ দিক লক্ষ্য করেই সংবিধানের ৭০ (১) অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের স্বার্থকে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
প্রশ্ন আসতে পারে, সংসদ নির্বাচন দলীয় নির্বাচন এবং সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ছাড়া অধিকাংশই দলীয় প্রার্থী দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে থাকেন। এখানে উল্লেখ্য, কাউকে দলের প্রার্থী এবং দলের নির্ধারিত প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে এমন বিধিবদ্ধ নিয়ম নাই। দল কাউকে মনোনয়ন দিলে তিনি দলীয় প্রার্থী আর না দিলে স্বতন্ত্র হিসেবেও নির্বাচন করা যায়। বাংলাদেশের যোগ্য সকল নাগরিকদের পক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ ও অধিকার সংরক্ষিত। সুতরাং কাউকে দলের হয়ে এবং কোন দলের বরাদ্ধকৃত প্রতীকে নির্বাচন করতেই হবে এমন বাধ্যবাধতা নাই। এখানে নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তবে দলের প্রার্থী হলে দলের প্রতি আনুগত্যের বিষয়টি অলিখিতভাবে থেকেই যায়, এটা মান্য করে করে থাকে অনেকেই। অমান্য করার একটা পন্থা হলো পদত্যাগ।
পদত্যাগ হতে পারে দু’রকমের। প্রত্যক্ষ পদত্যাগ এবং অপ্রত্যক্ষ পদত্যাগ। প্রত্যক্ষ পদত্যাগ তাকেই বলা যায় যখন কেউ সরাসরি লিখিত কিংবা মৌখিকভাবে ঘোষণা দিয়ে কোন দল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। অপ্রত্যক্ষ পদত্যাগ হতে পারে যখন কেউ নিজে কোন দল থেকে লিখিত আকারে পদত্যাগপত্র দাখিল করল না কিন্তু অন্য কোন দল গঠন করল বা কোন জোটে কোন দলের নামে নিজেকে উপস্থাপন করল। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্না আওয়ামী লীগের কাছে কোন পদত্যাগ পত্র দাখিল করেননি কিন্তু নিজে অন্য দল বা জোট গঠন করেছিলেন। মাহমুদুর রহমান মান্নার বিষয়টি অপ্রত্যক্ষ পদত্যাগ হিসেবেই ধরা যায় কারণ তিনি ঘোষণা দিয়েই অন্য দল বা জোট গঠন করেছিলেন যা দলের প্রতি আনুগত্যকে সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করে।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর সংসদীয় এলাকার মানুষকজন তাঁকে কোন প্রতীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি। প্রতীক পেলে তিনি আওয়ামী লীগের অন্য সবার মতো নৌকা প্রতীকই পেতেন। তার আগের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়েই নির্বাচন করেছিলেন এবং তাঁর এলাকার মানুষজন তাঁকে ভোট দিয়েছিল।
প্রশ্ন আসতে পারে ভোটারেরা আদতে কাকে ভোট দেয়? প্রার্থী, না-কী প্রতীক? অনেকেই বলে থাকেন আমাদের মানুষজন আসলে প্রতীক দেখেই ভোট দেয়। এটা আমাদের পিছিয়ে পড়া চিন্তাভাবনার সমার্থক বলেই মনে হয়। যখন কেউ বলে প্রতীক দেখে মানুষজন এখনও ‘কলাগাছ’কেও ভোট দেয়। এ কথার মধ্যে কিছুটা সত্যতা যে নেই তা বলব না, তবে এটা সর্বক্ষেত্রে সত্য বলা হলে সচেতন ভোটারদের অশ্রদ্ধা করা হয়। সংখ্যায় কম হলেও সচেতন ভোটারদের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের পর বলা যায় এখানে আছে সবচেয়ে সুন্দর সত্য। প্রতিটি ব্যালট পেপারে শুরুটা হয় প্রার্থীর নাম দিয়ে, এরপর প্রতীক। নির্বাচন কমিশন সুচিন্তিতভাবে প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। আমরা উন্নত হলে হয়ত এক সময় কেবল নাম থাকবে, প্রতীক থাকবে না। এটা খুব বেশি দুরের পথ যে তা বলা যায় না!
কোন প্রার্থী যখন নমিনেশন দাখিল করেন তখন তিনি ব্যক্তি হিসেবে দাখিল করেন এরপর এক সময় রাজনৈতিক দলগুলোর অনুরোধে দলীয় প্রতীক বরাদ্ধ হয়, স্বতন্ত্রদের ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীকের বিষয়টি থাকে না। খেয়াল করলে দেখা যায়, এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ জানায় ব্যক্তিকে প্রতীক বরাদ্ধ দিতে; প্রতীককে দিয়ে ব্যক্তি পরিচয়কে পরিচিত করা হয় না। এর বাইরে ব্যক্তি আর প্রতীক বরাদ্ধের মধ্যকার সময়ের ব্যবধান দৃশ্যমান। নির্বাচন কমিশন ব্যক্তিকে নির্বাচনে যোগ্য-অযোগ্য ঘোষণা করে, প্রতীককে নয়। কারণ প্রতীকের বিষয়টি নির্ধারিত। নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্যে আলাদা আলাদা প্রতীক নির্ধারণ করে রেখেছে। প্রতীকের বিষয়টি নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত, এর বাইরে যাওয়া হয় না কিন্তু নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে প্রার্থী কে হবে তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা রাখে না; নাগরিকদের যোগ্য যে কেউই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে।
এখানেই ক্রম অনুযায়ি ব্যক্তি মূখ্য। প্রতীকে সিল না মেরে যদি কোন ভোটার প্রার্থীর নামের ওপর সিল মারে সেক্ষেত্রে ভোট বাতিল হয় না। ফলে কোনোভাবেই বলা যায় না ভোটারেরা প্রতীককে ভোট দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক যখন ফলাফল ঘোষিত হয় তখন ব্যক্তিকে বিজয়ী-বিজিত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। নির্বাচিত হওয়ার পর যখন সংসদ সদস্য পদে শপথ পড়ানো হয় তখন বলা হয়- “আমি … (নাম উল্লেখ করতে হয়) শপথ করিতেছি যে…”। এ শপথবাক্য পাঠকালীন সময়ে কোথাও প্রতীকের উল্লেখ নেই। প্রতীক কেবল ভোটারদের ভোট প্রদানের সুবিধার্থে, এর বেশি কিছু নয়।
এছাড়াও নমিনেশন দাখিল, যোগ্য-অযোগ্য নির্ধারণ সবখানেই ব্যক্তি মুখ্য, প্রতীক নয়। আর যখন প্রতীক বরাদ্ধ হয় তখন প্রার্থীকে প্রতীক বরাদ্ধ দেওয়া হয়, প্রতীককে প্রার্থী বরাদ্ধ দেওয়া হয় না।
সুতরাং অবিসংবাদিতভাবে বলা যায়, আওয়ামী লীগ থেকে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে বহিষ্কার করা হলেও তিনি সংবিধানের ৭০(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ি তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিল তথা আসন শূন্য হওয়ার কারণ নাই। কারণ সাংসদ হিসেবে তিনি ব্যক্তি আবদুল লতিফ সিদ্দিকী শপথ নিয়েছিলেন এবং এ শপথবাক্য পাঠের সময়ে কোথাও প্রতীকের উল্লেখ ছিল না।
এবার দেখি, দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার কারণে ‘সংসদে নির্বাচিত হইবার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা’ সংক্রান্ত সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের আওতায় তিনি পড়েন কিনা? উল্লেখ করা প্রয়োজন, সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ নির্বাচনের আগে-পরে উভয় ক্ষেত্রেই তথা সব সময়ের জন্যে প্রযোজ্য।
সংবিধানের ৬৬ [সংসদে নির্বাচিত হইবার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা] (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-
“২) কোন ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি
(ক) কোন উপযুক্ত আদালত তাঁহাকে অপ্রকৃতিস্থ বলিয়া ঘোষণা করেন;
(খ) তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হইবার পর দায় হইতে অব্যাহতি লাভ না করিয়া থাকেন;
(গ) তিনি কোন বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন; (ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে”
এক্ষেত্রে দেখা যায় উল্লেখিত অনুচ্ছেদ তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য।
আরও দেখি- তিনি কি সংবিধানের ৭০ [রাজনৈতিক দল হইতে পদত্যাগ বা দলের বিপক্ষে ভোটদানের কারণে আসন শূন্য হওয়া] অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছেন?
“৭০। কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরুপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি-
(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা
(খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন,
তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না”।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী তাঁর দল থেকে পদত্যাগ করেননি, দলের বিপক্ষে সংসদে ভোট দেননি। তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন দলীয় সিদ্ধান্তে, এখানে তাঁর হাত ছিল না কোনভাবেই। আমাদের সংবিধান কি দল থেকে বহিষ্কৃতদের নিয়ে কিছু বলেছে? সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদ এ সম্পর্কে কিছু বলেনি, আর ৭০ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হয়নি।
তাহলে স্পিকার কখন নির্বাচন কমিশনকে সিদ্ধান্ত দিতে লিখতে পারেন? স্পিকার তখনই নির্বাচন কমিশনকে লিখবেন যখন অনুচ্ছেদ ৭০ ও ৬৬(২) লঙ্ঘিত হবে বলে দৃশ্যমান হবে। স্পিকারের এ লিখার জন্যে তাঁকে সংবিধানের ৬৬(৪) অনুচ্ছেদ ক্ষমতা দিয়েছে। যেহেতু সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০ ও ৬৬(২) লঙ্ঘিত হয়নি সেহেতু স্পিকার নিজেই এর নিষ্পত্তি করতে পারতেন, আগে যেমন সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার করেছিলেন।
এবার দেখি সংবিধানের ৬৬(৪) অনুচ্ছেদ যে কারণে স্পিকার সিদ্ধান্তের জন্যে নির্বাচন কমিশনকে লিখবেন সেখানে কী বলা হয়েছে? “কোন সংসদ-সদস্য তাঁহার নির্বাচনের পর এই অনুচ্ছেদের (২) দফায় বর্ণিত অযোগ্যতার অধীন হইয়াছেন কিনা কিংবা এই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোন সংসদ-সদস্যের আসন শূন্য হইবে কিনা, সে সম্পর্কে কোন বিতর্ক দেখা দিলে শুনানী ও নিষ্পত্তির জন্য প্রশ্নটি নির্বাচন কমিশনের নিকট প্রেরিত হইবে এবং অনুরূপ ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হইবে”।
দল থেকে বহিষ্কারের প্রথম প্রহর থেকেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলে আসছেন দল থেকে বহিষ্কারের কারণে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু তাঁর সে বক্তব্য যতটা না সংবিধান কর্তৃক পালনীয় বিষয়গুলোকে সমর্থন করে তারচেয়ে বেশি জবরদস্তিমূলকভাবে দলীয় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া। যার প্রমাণ পাওয়া যায় আওয়ামী লীগ নেতা ও অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিন সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এবং জাতীয় সংসদের সরকার দলীয় চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজের বক্তব্যে। তারা উভয়েই সংবিধানের আলোকের তাদের বক্তব্য রেখেছিলেন।
জাতীয় সংসদের সরকার দলীয় চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ সংসদ ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “লতিফ সিদ্দিকীর সদস্যপদ থাকছে। সাংসদের সদস্যপদ বাতিলের বিদ্যমান যে আইন, তা তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ তিনি দলের বিরুদ্ধে ভোট দেননি, পদত্যাগও করেননি। “দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে সংসদে কিছু করেননি। যে কারণে তার বিষয়টি ‘ফ্লোর ক্রসিংয়ে’ পড়েনি।” (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর,১৪-১০-২০১৪)
আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বলেছেন- ‘আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়নি। কারণ সংবিধান অনুযায়ী দুটি কারণে যেকোনো সংসদ সদস্যের সদস্যপদ বাতিল হয়। যার কোনোটিই লতিফ সিদ্দিকীর ক্ষেত্রে ঘটেনি। সংসদ সদস্যপদ বাতিল হওয়ার জন্য যে দুটি কারণ থাকে তার একটি হলো দলের বিরুদ্ধে সংসদে ভোট দেওয়া। অপরটি হলো যে দল থেকে ওই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন সেই দল থেকে পদত্যাগ করলে। কিন্তু তিনি কোনোটিই করেননি। তাই বুঝতে হবে, তার সদস্যপদ আছে। আর মনে রাখতে হবে দল সংসদ সদস্য প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়। কিন্তু নির্বাচিত করে সংসদীয় এলাকার জনগণ। তাই দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও তিনি স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে সংসদে সংসদীয় এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন।’ (সমকাল, ০৩-০৭-২০১৫)
ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরাগভাজন হতে চায় না বলে আওয়ামী লীগ আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে যে কোন মূল্যে সংসদ থেকে সরিয়ে দিতে চায়। এই দলগুলোর দাবির মুখে মন্ত্রীত্ব থেকে তাঁকে অপসারণ করেছিল বলে জোর প্রচার। দেশের বাইরে কেউ কোন অপরাধ কিংবা বক্তব্য দিলে দেশে সে ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হয় কিন্তু সারা দেশে দায়ের হওয়া অগুণতি মামলার ক্ষেত্রে এ বাধ্যবাধকতা মানা না হলেও লতিফ সিদ্দিকীকে দীর্ঘদিন জেলে থাকতে হয়েছিল মূলত এসব উগ্র, ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির কারণেই। দলগুলোর আরও দাবি ছিল সংসদ সদস্য পদ বাতিল করতে হবে এবং ফাঁসি দিতে হবে। ফাঁসির বিষয়টি সরকারের হাতে নেই বলে তারা অন্য দাবি সংসদ থেকে বিতাড়নের কাজটি করতে চাচ্ছে।
স্পিকার নিজেই যেখানে এ ইস্যুর সমাধান করতে পারতেন সেখানে তিনি নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়েছেন এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ জানানো হয়েছে সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণা করতে- এসব তার প্রমাণ।
প্রশ্ন হলো এমন পরিস্থিতিতে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী কি ‘ন্যায়বিচার’ পাবেন? প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মুখে পড়া লতিফ সিদ্দিকী হারিয়ে যাননি তার প্রমাণ প্রথম থেকেই রেখে চলেছেন। তিনি তাঁর বক্তব্য থেকে সরে আসেননি। নানাবিধ হুমকি থাকলেও দেশে ফিরে এসেছেন, আত্মসমর্পণ করেছেন এবং আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে লেখা এক চিঠিতে বলেছেন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো কষ্টকল্পিত আর দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়টিকে চিহ্নিত করেছেন ভুল হিসেবে।
তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেই কীনা এমন পারেন, পারছেন! তবে কে জানে আর কতখানি পারবেন? যোদ্ধাদের পুরো জীবনই সম্ভবত যুদ্ধে কাটাতে হয়। যোদ্ধারা হারে, জেতে। তবে তাদের জয়গুলো কাঙ্ক্ষিত; চিরকালীন!
দেশটার রাজনীতি চলে ধর্মের ভিত্তিতে, সেখানে মন্ত্রী মহাশয়ের কথায় ভোটের ময়দানে দলের ক্ষতি হতে পারে। সেই কারনে দল তার বিপক্ষে তো যাবেই।
সত্য কথা বলেছেন , সহমত ।
ষড়যন্ত্র থীয়োরিস্টদের মত বলি, আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে একটা সুযোগ দেয়া হয়েছিলো, নতুন জীবন শুরু করবার জন্য। তিনি আমেরিকায় এসে, নিরাপদে বসে সে মঞ্চ রচনা করেওছিলেন। দেশের জন্য সকল ভালো এবং মন্দ কর্ম ছাপিয়ে, সকল সম্ভব্য হুলিয়া ফুলিয়া ছাড়িয়ে, ধর্ম বিদ্বেষী যুক্তিবাদী মন্তব্য করে আমেরিকার রাজনৈতিক আশ্রয়ের যোগ্যও হয়েছিলেন। কিন্তু হিসাব গন্ডগোল হয়ে গেলো যখন তিনি দেশে ফিরে যাবার মত কান্ডটি করলেন। এখন তো ফক্কা হয়ে গেলেন। দেশের বাইরে থাকলে অন্ততপক্ষে ধর্মের অসারতা নিয়ে বক্তৃতা ফক্তৃতা করে টু পাইস কমাতে পারতেন, এখন তো আম ছালা দুটোই সঙ্কটে। তিনি কি গুড ফর নাথিং হয়ে গেলেন না’কি? খুব, মানে খু-উ-ব বড় কোন পুরস্কারের জন্য কি খেলছেন তিনি?
ঝানতে মন্চায় 🙂
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী তো সাধারণ নাগরিক নন যে, নিজে যা ভাল ভাবেন বা বুঝবেন তা বলবেন।। তার কথার অনেক দাম। তিনি একজন মন্ত্রী, আওয়ামী লিগের কর্মকর্তা। তার মুখ দিয়ে, ধ্রমের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবেনা, তিনি যতই সত্য কথা বলুন না কেন। দেশটার রাজনীতি চলে ধর্মের ভিত্তিতে, সেখানে মন্ত্রী মহাশয়ের কথায় ভোটের ময়দানে দলের ক্ষতি হতে পারে। সেই কারনে দল তার বিপক্ষে তো যাবেই। আর তার বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তার বিচার আগে হউক।ধর্মান্ধরা তো তার মুন্ডুপাত করবেই।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী যুক্তরাস্ট্রে এক আলোচনা সভায় হজ্বের উৎপত্তির কারণ সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত অভিমত দিয়েছেন, যা একমাত্র কারণ না হলেও অবশ্যই অন্যতম একটি কারণ হতে পারে। হজ্বের কারনে বাংলাদেশের মত গরীব দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ হয় একথাও ফেলনা নয়। কিন্তু তারপরেও বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় এধরনের মন্তব্য রহিম-করিম বা যদু-মধুর করা আর দেশের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রীর করার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। যে দেশের প্রান্তিক জনগন থেকে শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত ধর্মীয় গোঁড়ামী রয়েছে সেই দেশের একজন মন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় এভাবে তার মতামত প্রকাশ করলে তার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এতোদিন বাংলাদেশে বাস করে, মেঠো রাজনীতি করে কেউ যদি এধরনের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া আঁচ করতে না পারেন তাহলে তার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি কেমন তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থাকে।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে সংসদ থেকে সরিয়ে দেয়ার যে উদ্যোগ আওয়ামী লীগ নিয়েছে তা ন্যায় কি অন্যায়, অথবা তা দলের গঠনতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা চলছে, ভবিষ্যতেও চলবে। যেহেতু দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর গতি-প্রকৃতি মূলত শীর্ষ নেতৃত্বের ইচ্ছার অধীন তাই দুঃখজনক হলেও এক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায়ের হিসাবের চেয়ে নেতার ইচ্ছাটাই আসল নিয়ামক। তবে বড় মাপের দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহার করে কেউ দেশে রাজনীতি করুক, তিনি অনেক বড় মুক্তিযোদ্ধা হলেও এমন ধারণার বিস্তার কখনই কাঙ্ক্ষিত নয়, চিরকালীন হওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না।
সরিয়ে দেওয়ার কারণ যদি হয় দুর্নীতি এখানে আমার কোন বক্তব্য থাকবে না। লক্ষ্যণীয় বিষয়, যখনই হজ, তাবলীগ জামায়াত, সজীব ওয়াজেদ জয় এবং জামায়াতে ইসলামি সম্পর্কে তিনি কথা বললেন তখনই কিছু মিডিয়া অথবা বলা যায় অধিকাংশ মিডিয়া তাঁর দুর্নীতি খুঁজতে মরিয়া হয়ে ওঠল। এটা সুযোগ বুঝে মিডিয়ার ঝাঁপিয়ে পড়ার মানসিকতা ছাড়া আর কিছু নয়। যখন রাজপথে, টিভিতে, সভা-সমাবেশে লতিফ সিদ্দিকীর কল্লা চাইছে অনেকেই তখনই মিডিয়া তার ব্যবসাকে সামনে নিয়ে আসলো।
দুর্নীতিবাজ কেউ এমপি, মন্ত্রী কিংবা অন্য যে কোন পদে থাকুক এটা আমরা চাই না কিন্তু তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার কারণ সে দুর্নীতি নয় কথিত ধর্ম অবমাননা।
এখন আওয়ামী লীগ যে প্রক্রিয়ায় তাঁর সংসদ সদস্যপদ বাতিল করতে চাচ্ছে সেটা নজিরবিহীন। কারণ এমন বহিষ্কারের পরেও এর আগে দুইজনের সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়নি। স্পিকার নিজেই তাঁর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, ইসিতে পাঠানো হয়নি। তাছাড়া সরকার ও আওয়ামী লীগের দুইজন গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তির বক্তব্যও বলছে বহিষ্কারের কারণ এমপিত্ব যাবে না।
আপনার সাথে একমত যে খুব-সম্ভব দুর্নীতির কারণে আবদুল লতিফ সিদ্দিকির পদ যায় নি, কারণ বাংলাদেশের সাধারণ মান অনুযায়ী দুর্নীতিবাজ আরও অনেকেই তাদের পদ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু সিদ্দিকির বিরুদ্ধে দুর্নীতি আর ক্ষমতার অভিযোগকে কোন অবস্থাতেই খাট করে দেখার উপায় নেই। দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি, তা তিনি যত বড় মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তমনা হন না কেন, সমর্থনযোগ্য নন; এরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেই দেশের জন্য মঙ্গল। প্রশ্ন ওঠা উচিত নেতা কেন দুর্নীতি করেছেন; কেন বা কখন মিডিয়া তার দুর্নীতির খবর প্রকাশ করেছে করেছে সে প্রশ্ন অবান্তর।
তার মানে লতিফ সাহেবের সংসদ সদস্যপদ থাকতে কোন বাধা নেই। এর বিপক্ষে কোন ধারা/মত থাকলে সেটাও জানতে আগ্রহী। এই দেশের আকাশে যত তারা, আইনের তত ধারা।
বর্তমান সংসদ হচ্ছে দশম সংসদ। এর আগের দুই সংসদ অর্থাৎ অষ্টম ও নবম সংসদে এরকম পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল এবং সে ইস্যুগুলোও ছিল একই- দল থেকে বহিষ্কার। ফলাফলের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে সে দুই সাংসদের সদস্যপদ বাতিল হয়নি। স্পিকার নিজেই এর সমাধান দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে স্পিকার সিদ্ধান্তের জন্যে ইসিকে চিঠি লিখেছেন, ইসি আবার আওয়ামী লীগকে চিঠি লিখেছে, আওয়ামী লীগ তার জবাবে পদ বাতিলের জন্যে অনুরোধ জানিয়েছে।
দল থেকে বহিষ্কার নজিরবিহীন নয়। কাছাকাছি দুই সংসদে এমন ঘটনা ঘটেছিল এবং দুই ক্ষেত্রেই কারও এমপিত্ব বাতিল হয়নি। এক্ষেত্রে এর আগের সংসদের বিএনপির মেজর আখতারের প্রসঙ্গ আসবে না, কারণ আখতার দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদে যোগ দিয়েছিলেন বলে সেটা ফ্লোর ক্রসিংয়ের আওতায় পড়েছিল।