পৃথিবীতে প্রাণের প্রথম বিকাশ-এই ঘটনাটিকে আমরা মোটামুটি ৪টি তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারিঃ
১.Theory of Special Creation/সৃষ্টিবাদ:এই তত্ত্বানুসারে পদার্থবিজ্ঞান কিংবা রসায়নবিজ্ঞানের বিশ্লেষনী ক্ষমতার বাইরে কোন এক অতিপ্রাকৃত শক্তি জীবন সৃষ্টির জন্য দায়ী।স্প্যানিশ সাধু Father Sauraz এই তত্ত্বের খ্রীষ্ট ধর্মীয় ব্যাখ্যা দেন, ঈশ্বর ৬ দিনে সবকিছু সৃষ্টি করেনঃপ্রথম দিন আলো,দ্বিতীয় দিন আকাশ,তৃতীয় দিন জমি ও গাছ, চতুর্থ দিন চাঁদ, তারা ও সূর্য, পঞ্চম দিন মাছ ও পাখি এবং সবশেষে ষষ্ঠ দিনে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী তৈরী করেন।আবার হিন্দু ধর্মমতে, ব্রক্ষ্মা এক তুড়িতেই মহাবিশ্ব তৈরী করেন। তবে আধুনিক জীবাশ্মবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান এগুলোর কোনটিকেই সমর্থন করেনা।
২.Cosmozoic Theory/Theory of Panspermia/বহির্জগতে প্রাণের উৎপত্তিঃ “Panspermia” হল গ্রীক শব্দ যার অর্থ “সর্বত্র বীজ” (seeds everywhere) । আরহেনিয়াস ও রিখটার এই তত্ত্বের প্রবর্তন করেন।তাদের তত্ত্বানুসারে, পৃথিবীর বাইরে প্রথম প্রাণের উৎপত্তি হয়, যার বীজ মহাজাগতিক পরিভ্রমণের মাধ্যমে পৃ্থিবীতে এসে পৌছায় ও পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ ঘটায়। কিন্তু প্যান্সপারমিয়া তত্ত্বটি সম্বন্ধে সর্বপ্রথম গ্রীক দার্শনিক Anaxagoras (500 BC – 428 BC) ধারণা করেছিলেন। যদিও তার ধারণা আধুনিক প্যান্সপারমিয়া তত্ত্বের থেকে একটু আলাদা ছিল-
“All things have existed from the beginning. But originally they existed in infinitesimally small fragments of themselves, endless in number and inextricably combined. All things existed in this mass, but in a confused and indistinguishable form. There were the seeds (spermata) or miniatures of wheat and flesh and gold in the primitive mixture; but these parts, of like nature with their wholes, had to be eliminated from the complex mass before they could receive a definite name and character.”
প্যান্সপারমিয়া হাইপোথিসিসটা (panspermia hypothesis) তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে-
Lithopanspermia (interstellar panspermia) –
এই তত্ত্বানুসারে, একটি গ্রহের পৃষ্ঠ থেকে প্রভাব বহিষ্কৃত শিলা স্থানান্তরযান হিসেবে জৈব উপাদান এক সৌরজগত থেকে অন্য সৌরজগতে ছড়িয়ে দেয়।
Ballistic panspermia (interplanetary panspermia) –
এই তত্ত্বানুসারে, একটি গ্রহের পৃষ্ঠ থেকে প্রভাব বহিষ্কৃত শিলা স্থানান্তরযান হিসেবে, জৈব উপাদান একই সৌরজগতের এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহ ছড়িয়ে দেয়।
Directed panspermia –
এই তত্ত্বানুসারে জীবনের বীজ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন উন্নত বহির্জাগতিক সভ্যতার মাধ্যমে অন্য গ্রহে স্থানান্তরিত হয়েছে বা এই বীজ পৃথিবী থেকে মানুষের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য কোন গ্রহে ছড়িয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হয়।
প্যান্সপারমিয়া হাইপোথিসিস অনুসারে পৃথিবীর বাইরে প্রথম প্রাণের উৎপত্তি হয়, যার বীজ মহাজাগতিক পরিভ্রমণের মাধ্যমে পৃ্থিবীতে এসে পৌছায় ও পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ ঘটায়।
এবার একটি উল্কাপাতের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করি-
বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন এই উল্কা খন্ডটি খুব সম্ভবত একটি গ্রহাণুর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ১৬ মিলিয়ন বছর আগে মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং এটি ১৩,০০০ বছর আগে পৃথিবীর এন্টার্কটিকাতে অবতরণ করেছে। অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করে, ছবিটির উপরে এবং কেন্দ্র জুড়ে রড আকৃতির কাঠামো ক্ষুদ্র জীবাশ্ম ব্যাকটেরিয়া হতে পারে।
আপাতদৃষ্টিতে পৃ্থিবীপৃষ্টে উল্কাপাতের ঘটনা এই তত্ত্বকে জোরাল করে তোলে, কেননা এই তত্ত্বের সমর্থকরা বলতেই পারেন,উল্কার মাধ্যমে বহিঃজাগতিক প্রাণবীজ পৃ্থিবীতে এসেছে। কিন্তু দেখা গেছে,উল্কাপিন্ডে প্রাপ্ত অ্যামাইনো এসিড ও পৃ্থিবীতে প্রাপ্ত অ্যামাইনো এসিড অনেকখানি আলাদা।আলাদা এই কারনে,যেখানে পৃ্থিবীর সকল জ়ীবে বামাবর্তী অ্যামাইনো এসিড পাওয়া যায়,সেখানে উল্কাপিন্ডে ডানাবর্তী ও বামাবর্তী দুই ধরনেরই অ্যামাইনো এসিড পাওয়া যায়।এছাড়া উল্কাপিন্ডে এমন কিছু অ্যামাইনো এসিড পাওয়া গেছে যার সাথে পৃ্থিবীতে প্রাপ্ত অ্যামাইনো এসিডের কোন মিল নেই।এই তত্ত্বের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছেন কার্ল স্যাগান আর শকোভস্কি।তাদের হিসেবানুসারে,প্রাণবীজগুলোর নূন্যতম আকার হতে হবে ১ মাইক্রন, অন্যথায় তারা জ়ীবনধারনের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গাণু ধারণে সমর্থ হবেনা।এখন আমরা ধরে নিলাম, প্রাণবীজগুলোর আকার ১ মাইক্রনের বেশি,সেক্ষেত্রে মহাজাগতিক পরিবেশগত অবস্থা যেমন অতি উচ্চ অথবা নিম্ন তাপমাত্রা, শক্তিশালী বিকিরণ,বায়ুশূন্যতা,দূরত্ব ইত্যাদি কারনে তাদের নিজ আবাসস্থল থেকে পৃ্থিবীতে আসার মধ্যবর্তী সময়ে টিকে থাকার সম্ভাব্যতা শূন্যর কাছাকাছি।অপরদিকে, আবার আমরা যদি ধরি, প্রাণবীজগুলোর আকার ১ মাইক্রন এবং এই প্রাণবীজগুলো পৃ্থিবীতে এসে পৌছাবে।এক্ষেত্রে স্যাগান-শকোভস্কির হিসেব অনুসারে, ১০০ কোটি বছরে এই প্রাণবীজগুলোর পৃ্থিবীতে কেবলমাত্র একবার এসে উপস্থিত হতে হলে,আমদের ছায়াপথের ১০০টি প্রাণধারণক্ষমতাসম্পন্ন গ্রহকে একসাথে ১০০ টন প্রাণবীজ ছুড়তে হবে।যেখানে আমাদের ছায়াপথে পৃথিবী ছাড়া অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায়নি, সেক্ষেত্রে উপরোক্ত শর্ত পূরণ করে প্রাণবীজগুলোর পৃ্থিবীতে আসার সম্ভাব্যতা শূন্যর খুব কাছাকাছি বলে মনে করা হয়।তাই,এই তত্ত্বকেও আমরা বাতিল করে দিতে পারি। কিন্তু বর্তমানে প্যান্সপারমিয়া তত্ত্বের বেশ কিছু প্রমাণ বিজ্ঞানীরা খুজে পেয়েছেন।
প্যান্সপারমিয়া তত্ত্বের প্রমাণসমূহঃ
I. ব্যাকটেরিয়া মহাশূন্যে নিম্নলিখিত কঠিন পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে ।
• অতিবেগুনি রশ্মি বিকিরণ
• প্রোটন গোলাবর্ষন (Protons bombardments)
• শীতল
II. উল্কাখন্ডের জৈবনিক উপাদান ধারণের প্রমান ।
• অ্যামিনো অ্যাসিড
• ব্যাকটেরিয়া
• কার্বন
III. ব্যাকটেরিয়া সুপ্ত অবস্থায় দীর্ঘসময় বেঁচে থাকতে পারে ।
IV. মঙ্গল পৃথিবীর থেকে অধিক নিরাপদ (less bombardments and less gravity)
V. সৃষ্টির আদিতে মঙ্গল পৃথিবীর মত অত উত্তপ্ত ছিল না।
VI. যখন পৃথিবীতে অক্সিজেনের অভাব ছিল তখন মঙ্গলে অক্সিজেন ছিল।
এসব প্রমাণের জন্য নতুন করে এই তত্ত্বটি বৈজ্ঞাণিক মহলে প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেছে।
৩.Theory of Abiogenesis/Spontaneous Generation Theory/স্বতঃজননবাদঃ এই তত্ত্বকে দুইটি প্রস্তাবনা দ্বারা আলোচনা করা যায়:
• প্রথম ক্ষেত্রে Johannes Baptista Van Helmont(1579-1644) প্রস্তাব করেন, যেকোন অজৈব বস্তু থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নতুন প্রাণী অর্থাৎ জ়ীবন তৈরী হতে পারে।কিন্তু Van Helmont এর পূর্বেই এরিস্টটল,ডেমক্রিটাস এর মত মনিষীরা কোন কোন ভাবে এই মতকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।জীবনের স্বতঃস্ফৃর্ত বা আপনা আপনি উৎপত্তি্র ধারণা কিন্তু বহু প্রাচীন। এর প্রমাণ এরিস্টটলের লেখাগুলোতেও পাওয়া জায়। যদিও এ কথা তার জানাই ছিল যে জীব থেকেই জীবের উৎপত্তি হয়, তবুও এরিস্টটল কোন কোন ছোট প্রাণী স্বতঃস্ফৃর্তভাবে উদ্ভূত হয় বলে বিশ্বাস করতেন। তার বিখ্যাত বই প্রাণীজগতের ইতিহাস (Historia Animalium) এ ধরনের একটি বিবরন দিয়েছেনঃ
“অধিকাংশ মাছের জন্ম ডিম থেকে হয়ে থাকে। তবে এমন কিছু মাছ আছে যেগুলোর জন্ম হয় কাদা ও বালি থেকে। একবার নিডোসের কাছে একটি পুকুর শুকিয়ে যায় এবং এর কাদাও শুকিয়ে যায়। তারপর বেশ কয়েকদিন পর বৃষ্টিতে পুকুরটি ভরে যায়। এতে দেখা গেল নানা রকমের মুলেট জাতীয় ছোট মাছ। কাজেই এটি পরিষ্কার যে কিছু মাছ স্বতঃস্ফৃর্তভাবে জন্মায়। তার জন্য ডিম বা যৌন ক্রিয়ার দরকার হয় না।”
এদিকে Anaximander আবার বাতাসকে জীবনের একক কারন হিসেবে প্রস্তাব করেন।Van Helmont বিশ্বাস করতেন, পুরুষের ঘামমিশ্রিত জামা আর গম যদি ২১ দিন বাক্সবন্দী করে রাখা হয় তবে সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে (বাক্সে আগে থেকে অন্য কোন ইঁদুর থাকবেনা) ইঁদুরের বাচ্চার জন্ম হবে।একইভাবে শিশির থেকে পতঙ্গ, পনির থেকে প্রজাপ্রতি,পঁচনশীল মাংস থেকে পোকা(Maggot) স্বতঃস্ফূর্ত উৎপত্তি হয় বলে বিশ্বাস করা হত।
• প্রথম প্রস্তাবনার বিকল্প হিসেবে বলা হয়,একটি প্রজাতি আরেকটি ভিন্ন প্রজাতি থেকেও সৃষ্টি হতে পারে।উদাহরন হিসেবে ফিতা কৃমির কথা বলা হয়ে থাকে যা কিনা ভিন্ন একটি প্রজাতি(পোষক দেহের কথা বোঝানো হয়েছে) থেকে সৃষ্টি হয় বলে মেনে নেয়া হয়। এই তত্ত্বের ক্ষেত্রে,দেখা যেত একটি শুকনো পুকুর বর্ষায় মাছে পূর্ণ হয়ে গেছে,যদিও বাইরে থেকে কোন মাছের সেখানে পৌছানোর কোন সম্ভাবনাই ছিলনা।তাই সাধারন মানুষ খুব সহজেই এই ধারনায় বিশ্বাস করত।কিন্তু,প্রকৃতপক্ষে আগের মৌসুমের মাছের যে ডিমগুলো গ্রীষ্মের শুষ্কতায় টিকে গেছে তারা এই ঘটনার জন্য দায়ী এবং এই ঘটনাকে সঠিকভাবে ব্যাক্ষা করার জন্য যে ধরনের মাইক্রোস্কোপ দরকার তা তখন ছিলনা।
Van Helmont এক্সপেরিমেন্টের সাহায্যে তার তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন।তিনি তার পরীক্ষায়,পাঁচ বছর একটি উইলো(Willow) গাছ লালন করেন এবং দেখান যে, গাছের বৃদ্ধির সঙ্গে পরীক্ষায় ব্যবহৃত মাটির পরিমান নগন্য পরিমানে কমেছে।তার মানে দাড়ায়,একটি অজৈব বস্তু মাটি থেকে জ়ীবন তথা গাছের বিকাশ হচ্ছে।কিন্তু বিধিবাম,তখন যে সালোকসংশ্লেষণের কথা কারো জানা ছিল না! স্বতঃজননবাদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম William Harvey(1578- 1657)বলেনঃ ‘omnia ex ovo’(ডিম থেকে জীবন)।কিন্তু তিনি আবার এটিকে স্বতঃজননবাদের একটি রূপ বলে বিবেচনা করেছেন।পরবর্তীতে Francesco Redi আক্ষরিক অর্থেই এই ধারনাকে চ্যালেঞ্জ করেন।তিনি কতগুলো পুরো খোলা, আংশিক খোলা ও আবদ্ধ পাত্রে পঁচনশীল মাংস নেন।যে পাত্রগুলো ঢাকা ছিল তাতে মাছি বসতে পারেনি(ডিম দিতে পারেনি), তাই সেখানে পোকা জন্মাতে পারেনি,কিন্তু আংশিক ও পুরো খোলা পাত্রগুলোতে মাছি বসতে সমর্থ হওয়ায় পোকা জন্মাতে দেখা যায়।তাহলে, দেখা গেল,মাছির সাহায্য ছাড়া কেবল মাত্র পঁচনশীল মাংস থেকে জ়ীবনের বিকাশ ঘটতে পারেনা।তবে স্বতঃজননবাদের বিপরীতে সবচেয়ে আলোচিত ভূমিকায় ছিলেন লুই পাস্তুর।পাস্তুর আরেক বিজ্ঞানী F.A.Pouchet এর স্বতঃজননবাদ সম্পর্কিত কাজকে চ্যালেঞ্জ করে ১৮৬৪ সালে ফরাসী একটি বিজ্ঞান কমিশনের সামনে প্রমান করেন স্বতঃজননবাদ সঠিক নয়।এছাড়া তার বিখ্যাত Swan Necked Flask Experiment ও উল্লেখযোগ্য।এই পরীক্ষায় তিনি এমন ফ্লাস্ক ব্যবহার করেন যার গলা S আকৃতির বা রাজহাসের মত। এই বিশেষ ফ্লাস্কে তিনি প্রথম পুষ্টি পদার্থ নিয়ে পর্যাপ্ত তাপ দেন যাতে করে এর ভেতর কোন অনুজীব টিকে থাকতে না পারে।পরবর্তীতে তিনি এই ফ্লাস্ককে সাধারন পরিবেশে রেখে দেন।এখন যদিও এই ফ্লাস্কে বাতাস ঢুকতে পারবে কিন্তু কোন অনুজীব ঢুকতে পারবেনা কারন তা নিচের চিত্রের মত S আকৃতির গলায় আটকে থাকবে।তাই,যত দীর্ঘ সময় ধরেই এই ফ্লাস্ক রেখে দেয়া হোক না কেন তাতে কখনই কোন অনুজীব তৈরি হবেনা।
সুতরাং, সব মিলিয়ে এই তত্ত্বটিকেও আমরা সঠিক বলে মেনে নিতে পারছিনা।
৪.Chemical Theory of Origin of Life/Abiogenesis/জৈবরাসায়নিক তত্ত্ব/অজীবজনিঃ এই তত্ত্বানুসারে,পৃথিবীর আদিম পরিবেশে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে জীবনের বিকাশ হয়েছে।এই তত্ত্বের বিশদ বিবরনের আগে আমাদের উচিত আলোচ্য রাসায়নিক বিক্রিয়ার উপাদান ও পৃথিবী নামক এই অদ্ভুত গ্রহের কিভাবে উৎপত্তি হল তা নিয়ে কিছু কথা বলা।সরলভাবে বলতে গেলে,বিজ্ঞান আমাদের দেখিয়েছে, পদার্থগুলোর জটিল ও জটিলতর কাঠামোর স্ব-সংঘটনের ফলে তৈরি হয়েছ আমাদের এই মহাবিশ্ব। মহাবিস্ফোরনের ফলে যে মৌলিক কণিকাগুলোর সৃষ্টি হয়েছিল তাদের স্ব-মিলনের ফলেই গড়ে উঠেছে অনু-পরমানু,নক্ষত্র আর ছায়াপথ।প্রথম প্রজন্মের নক্ষত্রগুলোতে ভারী ভারী মৌল যেমন কার্বন,নাইট্রোজেন,অক্সিজেন সৃষ্টি হয়েছিল যা পরবর্তীতে নাক্ষত্রিক জীবনচক্রের মাধ্যমে উৎক্ষিপ্ত হয় মহাশূন্যে এবং এই মৌলগুলোই পৃথিবীর বুকে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল।তাই আমরা বোধহয় বলতে পারি,যেহেতু আমরা সবাই সৃষ্টি হয়েছি নক্ষত্রভস্ম(Stardust)থেকে তাই আমরা সবাই নক্ষত্র!আরও ভারি মৌলগুলো তৈরি হয়েছিল সুপারনোভা বিস্ফোরনে।তারপর ক্রমান্বয়ে এরা অভিকর্ষ বলের কারনে তৈরি করেছে নতুন নক্ষত্র ও গ্রহ।সুতরাং,আমরা পৃথিবী নামক গ্রহ ও এই গ্রহে জীবন বিকাশের প্রয়োজনীয় রাসায়নিক বিক্রিয়ার ভিত্তিপদার্থ কিভাবে এলো তার একটি সরলীকৃ্ত রূপ দেখলাম।এখন আমরা দেখতে চাই,এই রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো কিভাবে জীবন তৈরি করল ও সম্ভাব্যতার মাপকাঠিতে তা কতটুকু সঠিক।
রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো কিভাবে জীবন তৈরি করল সে প্রশ্নের আগে আমাদের জানা দরকার এই রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো কোন পরিবেশে সংঘটিত হয়েছে।প্রাচীন পৃথিবীর পরিবেশ কোনভাবেই আজকের পৃথিবীর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়।আজকের পৃথিবীর মত অক্সিজেনের প্রাচুর্য ছিল না,সঠিকভাবে বলতে গেলে বায়ুমন্ডলে কোন মুক্ত অক্সিজেনই ছিল না, ছিল হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, হিলিয়াম,মিথেন, অ্যামোনিয়ার মত গ্যাস।তাপমাত্রা ছিল ৫০০০-৬০০০ ডিগ্রীর কাছাকাছি।ওজন স্তরবিহীন পৃথিবীর বুকে সূর্য খুব সহজেই পৌছে দিতে পারত অতিবেগুনি, গামা, এক্স রশ্মি এবং সেই সাথে অতি বৈদ্যুতিক বিকিরনের কথাও উল্লেখযোগ্য।এখন আসা যাক,এই পরিবেশে কিভাবে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো জীবনের ভিত্তি গড়ল।ঠিক এরকম পরিবেশ, সেই সাথে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, উল্কাপাত- দীর্ঘসময় ধরে এই ঘটনাগুলো তৈরী করে বিভিন্ন অক্সাইড এবং কার্বাইড।এই অক্সাইড এবং কার্বাইডগুলো গুরুত্বপূর্ণ, কারন আজকের দিনেও আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত বিভিন্ন অক্সাইড এবং কার্বাইড এর সম্বনয়ে হাইড্রোকার্বন তৈরী করে যা জীবন তৈরীর জন্য অত্যাবশ্যকীয়।মজার ব্যাপার হচ্ছে, একটু আগেই বলা হয়েছে বায়ুমন্ডলে কোন মুক্ত অক্সিজেনই ছিল না, তাহলে মনে হতেই পারে, অক্সাইড তৈরী হল কিভাবে? আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, Scientific American এর অগাস্ট,২০০৯ সংখ্যায় David Biello তার ‘The Origin of Oxygen in Earth’s Atmosphere’ প্রবন্ধে বলেছেনঃ But one thing is clear—the origins of oxygen in Earth’s atmosphere derive from one thing: life. ব্যাপার হচ্ছে, অক্সাইড তৈরীর জন্য মুক্ত অক্সিজেন যে অত্যাবশ্যকীয় এমনটি নয়। অক্সিজেন সমৃদ্ধ সালফেট অথবা এই ধরনের পদার্থগুলো বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় খুব সহজেই অক্সাইড তৈরী করতে পারে। তাহলে সন্দেহাতীত ভাবেই আমরা পৃথিবীর আদিম পরিবেশে অক্সাইড, কার্বাইড ও এই ধরনের পদার্থ পেতে পারি যারা পরবর্তীতে হাইড্রোকার্বন তৈরী করে, ক্রমান্বয়ে এই হাইড্রোকার্বনগুলো একটি আরেকটির সাথে যুক্ত হয়ে, তৈরী করে জটিল জৈব পর্দাথের, এই জৈব পর্দাথগুলো আরও বিকশিত হওয়ার পথে ঝিল্লীবদ্ধ হয়ে এনজাইম ধারনে সমর্থ্য হয়।এনজাইম যেহেতু আসতে পারল তাই বিপাক ক্রিয়ায় (Metabolism) বাধা রইল কই? আর এভাবেই জলজ পরিবেশে অকোষীয় জ়ীবনের বিকাশ ঘটল যারা পরবর্তীতে বংশগতি সঞ্ছারন, পরিব্যক্তি-প্রকরণের সাথে, পৃথিবীর ইতিহাসে জ়ীবন নামের এক অসাধারন অধ্যায়ের তৈরী করল।মোটাদাগে, এই হল জ়ীবন তৈরীর জন্য রাসায়নিক তত্ত্ব আর এই তত্ত্বটিই সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য।
[Precambrian stromatolites এর মধ্যে Siyeh গঠন, “Glacier National Park” । 2002 সালে, বৈজ্ঞানিক জার্নাল Nature এ প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয় এইসব ৩.৫ (বিলিয়ন বছর বয়সী) ভূতাত্ত্বিক জীবাশ্ম cyanobacteria মাইক্রোবের থাকে, এর মানে দাড়ায় তারা নিকটতম পৃথিবীতে পরিচিত জীবনের প্রমাণ]
তাহলে আমরা ঘরে বসেই জৈবরাসায়নিক তত্ত্বের সাহায্য ম্যাগি ন্যুডলস এর মত খুব সহজে জ়ীবন তৈরী করে ফেললাম একথা বলার কারন, উপরের আলোচনায় বললাম, এটা এল, ওটা হল, তারপরই জীবন তৈরী হয়ে গেল,আসলে খুব সরল করে জৈবরাসায়নিক তত্ত্বকে তুলে ধরতে গিয়েই এই অবস্থা।কিন্তু আমার তত্ত্ব উপস্থাপনার হাল যাচ্ছেতাই হলেও তত্ত্ব কিন্তু যাচ্ছেতাই নয়। কারন জগত কাপানো অনেক পরীক্ষা আর দৃষ্টান্তই একে সমর্থন করে। এখন সরলীকৃত রূপ থেকে আমরা এই তত্ত্বটির প্রেক্ষাপট, গ্রহনযোগ্যতার পেছনের যুক্তি, এই সবকিছু থেকে তত্ত্বটির প্রকৃতি দেখাতে চেষ্টা করব।
এই তত্ত্বের প্রেক্ষাপট বলতে গেলে বলতে হয় ওপারিন-হালডেনের কথা।রাশান বিজ্ঞানী Alexender I. Oparin, ১৯২২ সালে তার ‘জ়ীবনের উৎপত্তি’ বইয়ে আমরা উপরে যে সরলীকৃ্ত তত্ত্বের কথা বললাম ঠিক সেইরকম কথাই বলেন, পৃথিবীর বুকে জলজ পরিবেশে বিভিন্ন রাসায়নিক পর্দাথের বিবর্তনে প্রানের বিকাশ ঘটে এবং সেই সমস্ত সরল প্রাণের বিবর্তনের মাধ্যমে জীবন আজকের রূপে পৌচেছে। আবার J.B.S. Halden-ও ঠিক একই রকম তত্ত্বের কথা প্রকাশ করেন। তাদের দুজনের নামানুসারে তাই জৈবরাসায়নিক তত্ত্বকে ‘ওপারিন-হালডেন তত্ত্ব” বলা হয়।
চলবে …
আমার খুবই জানতে ইচ্ছে হয়,
১। ব্ল্যাকহোল, সিঙ্গুলারিটি, বিগব্যাঙ-এর পূর্বে কি ছিল এবং সেই পূর্বের পরিবেশটা সৃষ্টি হল কিভাবে?
২। বিভিন্ন জড় পদার্থের জটিল রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলে প্রাণের উদ্ভব ঘটে। এই জড় পদার্থগুলো সৃষ্টি হল কিভাবে?
৩। এখন কেন পৃথিবীতে এধরনের রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলে নতুন কোন জিবনের উদ্ভব ঘটছে না বা গবেষকগণ কেন পরিক্ষাগারে এমন রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রাণ সৃষ্টি করতে পারছেন না?
বেশ আগ্রহ ভরে পড়বার মত আর সহজবোধ্য। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
ধন্যবাদ।
সাজ্জাদকে অভিনন্দন। পৃথিবীর বুকে জীবনের খেয়া। নামটিও চমৎকার। তাহলে panspermiaর বাংলাকে কি বহির্জাগতিক প্রাণতত্ত্ব বলা যাবে? পরবর্তী অধ্যায়গুলির অপেক্ষায়।
বহির্জাগতিক প্রাণতত্ত্ব বাহ ভালো লাগলো অনুবাদটা। আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
খুবই আগ্রোহদ্দীপক বিষয়। প্রাণের উৎপত্তির প্রাচীন ধারণাগুলো থেকে শুরু করেছেন বলে প্রেক্ষাপটটাও সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
আর লেখায় অনেক তথ্য কোটেশন ইত্যাদি এসেছে। সেগুলোর তথ্যসূত্র (বা রেফারেন্স) যুক্ত করলে লেখাটি সম্পূর্ণতা পাবে।
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। পরবর্তী পর্বগুলোতে রেফারেন্স যুক্ত করে দেয়া হবে।
মুক্তমনায় স্বাগতম। চমৎকার লিখেছেন। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষা রইলো।
ধন্যবাদ।
লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
লেখাটা পড়ি আর মনে মনে বলি- বনে যদি ফুটলো কুসুম, নেই কেন সেই পাখি
—- এমন একটি লেখায় অভির মন্তব্য থাকবেনা তা ভাবতে যে বড় কষ্ট হয়। লেখাটিতে অভিজিতের “প্রাণের প্রাণ জাগিছে তোমার প্রাণে” লেখার প্রভাব অনেকটাই আছে বোধ হয়।
কিছু বানান টাইপো আর দাড়ি কমায় স্পেইস না থাকায় পড়তে কিছুটা অসুবিধে হয়েছে। একটু সময় করে এডিট করে নিলে ভাল হয়।
চমৎকার একটি লেখা উপহার দেয়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আসলে এই বিষয়ে আমার একটা বই এবছর বই মেলায় বের হয়েছে। আর অভিজিত দাদা নিজে আমার বই এর সফট কপি পড়ে দেখেছিলেন। এজন্য এরকম একটা জটিল বিষয় নিয়ে বই সম্পূর্ণ করার ধৈর্য্য হয়েছিলো।
ধন্যবাদ। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় …
ধন্যবাদ