২৬ শে মে এখানে এসে পৌছলাম । পেছনে ফেলে এলাম আমার আর শুভর মৃত্যু পরোয়ানা । বেঁচে থাকার জন্য দেশ ছাড়তে হয় শুনেছিলাম , কিন্তু সে পথে হাটতে সময় লেগে গেল দুটা বছর । যে বাতাসের ঘ্রাণ না নিলে ঘুমতে পারতাম না সে বাতাস আজ কেবলই স্মৃতি । ঢাকার কোলাহলের অভ্যস্ততা ছেড়ে নীরব নিস্তব্ধ প্রায় একাকী জীবনে কেমন আছি এই প্রশ্ন নিজেকে করার সাহস নেই আমার । হৃদয়ের আকুতিটা কে সান্ত্বনা দিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছি । ভয় হয় এই বুঝি সে বিদ্রোহী হয়ে আমাকে ওলোটপালট করে দিয়ে দেশে ফিরে জেতে চাইবে ।

বেলা গড়িয়ে প্রায় এক মাস হতে চলেছে । আজ ১৭ ই জুন । এখানকার আকাশটা ভারী বেরসিক । গ্রীষ্মের সূর্যটা কে উঁকি মারতে দিচ্ছে না । তিন কামড়ার ঘরের বাইরে গেলে হাড়ের ভেতর পর্যন্ত ঠান্ডা টের পাওয়া যায় । গত পরশু বাসের দুটা কার্ড কিনেছি । ইচ্ছে হলে পুরো শহর ঘুরে বেড়াতে পারি । কিন্তু ইচ্ছেগুলো মনমরা হয়ে আছে । ওরাও বুঝেছে, শহরটা আপন হতে সময় লাগবে ।

ফেইসবুকের পাতায় চোখ বুলাই । বই পড়ি , মাঝে মাঝে গেইম খেলার বৃথা চেষ্টা করি । কিছুই হয় না । বারবার মনে পরে যায় , অভিজিৎ দার কথা।

এই তো সে দিন, শুভ যখন মেসেজ দেখিয়ে বলল, দাদা আড্ডায় ডেকেছে , যাবি ? কি প্রচণ্ড খুশি হয়েছিলাম আমি ।

“অবিশ্বাসের দর্শন‘ বইটি তে আত্মা নিয়ে চমৎকার একটা অধ্যায় আছে । পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম । আড্ডায় মে-ডাম-মে-ফি, জৈন ধর্ম, অদ্বৈত দর্শন নিয়ে নিয়ে আলোচনা হবে , জমানো কৌতূহলের উত্তরগুলো এক এক করে জেনে নেব ।

সেই রাতে যখন দাদার নিথর দেহটা ঢাকা মেডিক্যাল এর নীচতলায় দেখলাম তখন কি অনুভূতি হয়েছিল , ভেতরটা কতটা দুমড়ে মুচড়ে গেছে লিখে বোঝাতে চাই না । ওটা আমার ভেতরেই থাক ।

ওয়াসিকুর এর সাথে বহুবার দেখা হয়েছে । কোন এক অজানা কারণে আড্ডার নীরব দর্শক ছিল ছেলেটা । হয়ত চুপ থাকাটাই ওর স্বভাব ছিল , অথবা খানিকটা লজ্জা পেত । ঠিক জানা নেই আমার । ওর মৃত্যুটা আমাকে বারবার ভাবিয়েছে । কোন দিন আমার জানা হবে না , কী সে উপলব্ধি , যে উপলব্ধিতে ও অন্ধদের বায়বীয় অনুভূতিতে বারবার আঘাত করতে চাইত ? অলীক কোন শক্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে চাইত , কেনই বা ও ভ্রান্তির দরজা ভেঙে বেরিয়েছিল ।

অন্তত বিজয় এর সাথে পরিচয় শুধুই তার লেখায়। আমার আলসেমী আর তার স্বল্পভাষী স্বভাবের জন্যই হয়ত ইনবক্স আলাপচারিতাটা খুব একটা এগোয়নি । তাছাড়া দুজনের লেখার ধরন ,বিষয়বস্তুতে মতভেদ থাকায় সাবলীল আলাপচারিতার পথটাও সরল হয়ে ওঠেনি কখনো । তবুও জানতাম একজন মেধাবী লেখক ধীরে ধীরে তার আলো ছড়াচ্ছেন । রাজীব হায়দার , অভিজিৎ রায় , ওয়াসিকুর বাবুর পরে তিনিও আজ কেবলই আতীত ।

এই মেধাবী মানুষগুলোর হত্যা হয়েছে । সত্যিকার অর্থে এরা শুধু মাত্র চারটা মানুষ নন । তারা চার জনই চারটা ভিন্ন ধারার ধারক । তারা প্রত্যেকেই এক একটা নদীর মত। তাদের প্রত্যেকের চিন্তা , মেধা, লেখার আলাদা আলাদা প্যাটার্ন ছিল। এই গুণাবলী দুর্লভ ।একথা সত্যি যে পূর্বজদের আবিষ্কৃত তত্ত্বগুলো উপস্থাপন, সম্প্রসারণ, সংশোধন নিয়েই ওনারা কাজ করছেন এবং খুব অল্প সময়ে কাজের সফলতাও পেয়েছেন । বিশেষ করে অভিজিৎ রায় এই ক্ষেত্রে শতভাগ সফল। এরা বিকশিত হয়ে একদিন সমুদ্র হতে পারত।
সাধারণ কার মৃত্যুর সাথে এখানেই তাদের মৃত্যুর পার্থক্য । সক্রেটিস, হাইপেশিয়া, নাগীব মাহফুজ, হুমায়ুন আজাদদের মৃত্যুতে দেশের যে ক্ষতি হয়, সে ক্ষতি পূরণ হতে শত সহস্র বছর লেগে যায় । ততদিন দেশ নিষ্ফলা বিরানই থেকে যায়।
যে দেশে গুণীর কদর হয় না সে দেশে গুণী জন্মায় না, আর যে দেশে গুণীর হত্যা হয় সে দেশ বর্বরদের দখলে চলে যায়।

মুসলিম দেশগুলোতে ভিন্ন ধারার সৃজনশীল মানুষরা এখন বিলুপ্তপ্রায় হতে চলেছে। পাকিস্তানে মাত্র দুমাস আগেই সাবিন মাহমুদের হত্যা হল । সেখানকার শিল্পীরা বেশিরভাগই ভারতে আশ্রয় নিয়েছে বাকিরা ইউরোপ অ্যামেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছে।
শুধু মাত্র ব্লগ লেখার অপরাধে সৌদি আরবে রাইফ বাদাউয়ী কে ১০ বছরের জেল দিয়েছে সৌদি আদালত।

ইরানী পরিচালক জাফর পানাহি পরিচালিত সিনেমাগুলো বিশ্ববাসীর ভূয়সী প্রশংসা কুরালেও তার নিজের দেশেই সেগুলো নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে । ইরানের মেধাবী চলচিত্রকাররা নিজ দেশেই অবাঞ্ছিত হয়ে এখন প্রবাসে চলচিত্র নির্মাণ করছে । একই অবস্থা তাদের লেখক , সাহিত্যিক , চিত্রকর , শিল্পীদেরও । নভেল বিজয়ী লেখিকা শিরীন ইবাদী কেও দেশ ছাড়তে হয়েছে। সোমালিয়া ,সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান এর বর্তমান অবস্থা গুণী বেড়ে ওঠার অনুকূলে নেই ।

কনফুসিয়াসের এক ছাত্র চি কুন তাকে একবার জিগ্যেস করেছিল , সৈন্যবাহিনী খাদ্যশস্য ও জনগণ – এই তিনের মধ্যে যদি একটি বাদ দিতে বলা হয় , তাহলে আপনি কোনটি বেছে নেবেন?

কনফুসিয়াসের উত্তর ছিল , সৈন্যবাহিনী ।
টুইটারে আনসার বাংলা নামধারী হত্যাকারীরা লিখেছে , তারা রক্তের দাগ শুকাতে দেবে না । আবার তারা হত্যা করতে যাচ্ছে !

হজ্ব প্রথার সমালোচনা করায় সরকারের এক জন প্রভাবশালী মন্ত্রী তার মন্ত্রিত্ব হারিয়ে বর্তমানে জেলে আছেন । চার ব্লগার লেখকদের হত্যার বিচারে স্থবিরতা বিরাজ করছে । এসব দেখে শুনে মনে হচ্ছে , সরকার সম্ভবত রাষ্ট্রীয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে । কনফুসিয়াস বিচক্ষণ ছিলেন ।

ধর্মান্ধরা নাগীব মাহফুজ কে ছুরি মেরে হত্যা করতে চেয়েছিল। ছুরির আঘত নিয়ে লিখতে কষ্ট হত , তবুও আমৃত্যু লিখেছেন ।

বন্যা আহমেদ তার লেখায় অভিজিৎ রায় সম্পর্কে লিখেছেন ,

// আমি নিশ্চিত জানি অভি কে যদি বলা হত যে তুমি হয় এভাবে যা বিশ্বাস কর তার জন্য অকালে জীবন দাও অথবা লেখালিখি বাদ দিয়ে অনেক দিন বেঁচে থাক, আমার দৃঢ় ধারণা সে প্রথমটাই বেছে নিত//

মুক্তমনা লেখকরা জানে মৃত্যু খুব কাছেই । তবুও আনসার বাংলার হুমকিতে কি তাদের লেখালিখি বন্ধ হয়েছে ? তারা কি পেরেছে তাদের তাদের বিশ্বাস তাদের এত দিনের চর্চিত জ্ঞান বিসর্জন দিয়ে বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে ? তারা কি পেরেছে সমাজ কে আলোকিত করার দায় থেকে পিছু হটতে ?

না তারা পারেনি । তারা বেঁচে থাকার জন্য লড়ছে , সেই সাথে লেখা চালিয়ে যাচ্ছে । যে নক্ষত্র আলো ছড়াতে জন্মেছে আজ তারা হারিয়ে গেলে ,বাংলাদেশে সাইবেরিয়ার শীতকালীন দিনের মত আধারে নিমজ্জিত হবে । পরে থাকবে হায়না আর কিছু রুগ্ন অথর্ব দাস ।