Avi_Bonya_Paris2011

আজ ১০০ দিন।

১০০ দিনই কেন গুনছি, ১০১ নয়, ১০২ নয়, ১০৩ নয় তা কোন যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারবো না। এ কি মেট্রিক পদ্ধতির পরিমাপের সাথে সংলগ্নতা, নাকি আমাদের রাউন্ড নম্বরের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ, নাকি প্রথম ত্রিপদী সংখ্যার বিশালত্বে প্রবেশ? আসলে এর যৌক্তিক মানে তো একটাই -অভি চাপাতির কোপের আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে রাস্তায় নিথর হয়ে পড়ে যাওয়ার পর পৃথিবীটা ১০০ বার ঘুরেছে নিজের কক্ষপথে। সাড়ে চারশো কোটি বছরে আমাদের ছোট্ট পৃথিবীটা তো কত লক্ষ কোটিবারই ঘুরেছে নিজের চারদিকে, সেখানে একশো’বার বার ঘুরলেই কী আর দু’শো আট বার ঘুরলেই বা কী? সব দিনই তো সমান।
আসলেই তো, কিছুতেই কিছু এসে যায় না।

একেকজন একেকভাবে স্মৃতিচারণ করে, আমাদের মেয়ে মাস, দিনের হিসেব করে না। প্রতি বিষ্যুদবার ঘুম থেকে উঠেই তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। সেই বিষ্যুদবারে ক্লাস থেকে বেরুতে বেরুতে কীভাবে, কখন, ঠিক কোন জায়গাটায় খবরটা পেয়েছিলো তা মনে পড়ে যায়। তবে এটুকু বলতে পারি যে এই একশো দিনে বুকের ভিতরে জমাটবাঁধা কষ্টটা একটু আলগা হয়ে আসতে শুরু করলেও, হাহাকার করা শূন্যতাটার ব্যাপ্তি কিন্তু একটুও কমে নি। এখন আর নিয়ম করে আতঙ্কের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হয় না, ঠিক রাত সাড়ে তিনটায় ঘুম ভেঙে গিয়ে আঁধারের বিশালতা মাপতে হয় না, সারাদিন আর একটা কথাও না বলে পাথরের মত নিথরভাবে বসেও থাকি না। অনেকে বলেন, জীবনের চাকা নাকি অমোঘ নিয়মেই ঘুরতে শুরু করেছে। আমি চাই বা না চাই তাকে থামানোর কোনো উপায় নেই। কিন্তু চারদিকে নিরন্তর এক শূন্যতা বিরাজ করে, এই একশো দিনে কেমন করে যেন আমি এই শূন্যতার অসীম চাদরটা হাত দিয়ে ছুঁতে শিখেছি, কান পেতে শুনতে শিখেছি নীরবতার শব্দ। সময়ের কাঁটা যেন একই সাথে খুব দ্রুত এবং খুব ধীরে ঘুরে চলে। কখনো আতঁকে আঁতকে উঠি নিথর নীরবতায় থমকে থাকা ঘড়ির কাঁটাটা দেখে, আবার কখনো মনে হয় নীরবতার নিরবচ্ছিন্ন কাঁটাতার ভেদ করে আমার একান্ত এই জায়গাটায় কেউ যেন প্রবেশ না করে। পরক্ষণেই আবার মনে হয়, গত ১৩টা বছর এত দ্রুত কেটে গেলো কেমন করে, চোখের নিমেষে কি করে সবকিছু ওলট পালট করে দিয়ে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায় মানুষের জীবন।

মহাজগৎটা যে র‍্যান্ডম, আমার চারপাশের ঘটনাগুলো যে ইতস্তত, বিক্ষিপ্ত তা তো জানতামই। পরম উদ্দেশ্য বলে কিছু নেই, কপাল বলে কিছু নেই, নেই কোন অলৌকিক হাতের নির্দেশনা আমার জীবনের উপর। উদ্দেশ্য বিধেয় সব কিছুই এই জগতেই, সবকিছুই এই জীবনটাতেই সীমাবদ্ধ। ব্যক্তি আমার কী হলো বা না হলো তা নিয়ে বিশ্বজগতের কোনো মাথাব্যথাই নেই, নেই ইতিহাসের, নেই নিয়তি বা ঈশ্বর নামের কোনো অদৃশ্য মহাশক্তির। আসলে এখানে কোনো মাথাই নেই তো আর ব্যথা আসবে কোথা থেকে? এ প্রসঙ্গে রিচার্ড ডকিন্সের কথাগুলো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে কতো জায়গাতেই তো লিখেছি যে, “আমাদের চারপাশের বিশ্বজগতে বিদ্যমান বৈশিষ্টগুলো দেখলেই বোঝা যায় এর মধ্যে কোনো পরিকল্পনা নেই, উদ্দেশ্য নেই, নেই কো্নো শুভাশুভের অস্তিত্ব; আসলে অন্ধ করুণাবিহীন উদাসীনতা ছাড়া এখানে আর কিছুই নেই।”

জীবনের সবচেয়ে সঙ্কটময় অবস্থায় এসে এই কথাগুলোই আজ অদ্ভুতভাবে শক্তি জোগায়।

আমার খুব কম বয়সী এক নিকটাত্মীয়ার স্বামী মারা গেছে হার্ট এ্যাটাকে কিছু দিন আগে। সে এই র‍্যান্ডমনেসের কথা শুনলেই খেপে ওঠে। তার একটাই কথা: আমারই এমন হলো কেনো? আমি কী করেছি যার জন্য আমার এমন শাস্তি পেতে হলো? র‍্যান্ডমনেস বা পৃথিবীর উদাসীনতার কথা ভাবলে তার খুব অসহায় লাগে।

কী অদ্ভুতভাবেই না কাজ করে আমাদের মাথার নিউরনগুলো! ছোট্টবেলা থেকে মাথায় গেঁথে থাকা পাপ-পুণ্যের হিসেব, কোনো অলৌকিক শক্তির শাস্তি দেওয়ার বিধানগুলো জীবনের প্রতি পদে পদে ধরে আমাদের। আর তা থেকে ‘আমিই কেনো?’ বা ‘আমিই বা নই কে্নো?’ বা ‘আমার কোন পাপে এমনটা হলো?, এই ধরনের বৃত্তগুলোর মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকি আমরা।

সব পাওয়ার পর হারানোটা খুব কষ্টের। আমাদের ছোট্ট মাথাটা খালি ঘুরেফিরে কী হারিয়েছি, কতটা হারিয়েছি, কেমন করে হারিয়েছি তার হিসেব করতে থাকে। যখন ভাবি, আমি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে হারিয়েছি, কোনো ছোট্ট বিষয় নিয়ে রাতের পর রাত তর্ক করার সাথীকে হারিয়েছি, সুখদুঃখ মান অভিমান ভাঙ্গা-গড়া ঝগড়া ভালোবাসায় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে থাকা জীবনটা হারিয়েছি, তখন কাঁদতে না চাইলেও চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। গত তেরো বছরে দুজন দুজনকে হাতে লেখা কয়েকশো চিঠির গাট্টি খুলে পড়তে বসি, চোখের জলে ভাসি। কিন্তু তার পরক্ষণেই আবার ভাবি যে উদাসীন এই জগতের ইতস্তততার শিকার তো যে কোন সময়ই যে কেউ হতে পারে, সে হলে আমিই বা নই কেনো? মুহূর্তের ব্যবধানে সব হারানোর শোকের অতলতায় তলিয়ে যেতে যেতেও মনে হয় আমি তো একা নই, এরকম ঘটনা তো আরো ঘটেছে, ঘটছে, ঘটবে। এটাই শক্তি যোগায়, বলে ওরা পারলে আমিও পারবো জীবনের চপোটাঘাতগুলো মেনে নিতে!

যখন ধর্ষিত গারো মেয়েটাকে দেখি পত্রিকার পাতায়, চাকমা মেয়েদের একের পর এক ধর্ষণের খবর পড়ি, আইসিসের দাসি করে আটকে রাখা ইয়াজিদি নারী বা সাগরে ভেসে থাকা পাচারকৃত অসংখ্য নারী পুরুষের ছবি দেখি, তখন আসলেই বুঝতে পারি প্রকৃতির ইতস্ততার অর্থ। অন্যায়, অত্যাচার, কুসংস্কারাচ্ছন্ন দানবীয় পাশবিকতা তো অন্যান্য আমাদের মধ্যে সদা বিদ্যমান। তার শিকারও হয়েছে হাজার হাজার মানুষ, ইতিহাস জুড়েই তো আছে তার সাক্ষী। আর অভির মত যারা এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে তারা তো সমাজের ‘স্ট্যাটাস ক্যো’র বলি হয়েছে সব যুগেই। মন মানতে না চাইলেও মাথা দিয়ে তো বুঝি আমি একা নই, আমার মতো অবস্থায় বা আমার চাইতেও অনেক অনেক ভালোবাসাহীন অসহায় অবস্থায় আছে এই পৃথিবীর বহু মানুষ। ওরা পারলে আমিই বা পারবোনা কে্নো?

অভির মৃতদেহটা এভাবে ঢাকা মেডিকেলে দান করলাম কীভাবে সেটা নিয়েও আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেছেন, খুব আন্তরিকভাবেই জিজ্ঞেস করেছেন, আমার এটা করতে খারাপ লেগেছে কিনা? না লাগে নি, খারাপ তো লাগেই নি, ভালো লেগেছে, এখনো লাগে। মনে হয়েছে আমাদের শরীরটা পচে-গলে মাটিতে মিশে যাওয়ার চেয়ে যদি মানুষের কাজে লাগে তাতেই তো অভির উদ্দেশ্য সফল হবে। সেও তো তাইই চেয়েছিল, এই ছোট্ট কাজটাও তো আমার বা অভির ধারণ করা আদর্শেরই বহিঃপ্রকাশ। এই প্রশান্তিটাও আসে সেই জীবনদর্শন থেকেই। অভি লরেন্স ক্রাউসের এই কথাটা খুব পছন্দ করতো যে, আমরা সবাই নক্ষত্রেরই সন্তান। সে তার শেষ বই শূন্য থেকে মহাবিশ্বে এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লিখেছে, “এই জায়গায় এসে একটি মজার তথ্য উল্লেখ করব, আর তথ্যের অভিব্যক্তিটি এতোই শক্তিশালী যে, এটা আমাদের মত কাঠখোট্টা বিজ্ঞান লেখকদেরও কাব্যিক করে তোলে প্রায়শই। বিষয়টা হল-বিগ ব্যাং থেকে সবকিছুর শুরু বলে আমরা জানি। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, মহাবিস্ফোরণের পর মুহূর্তে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম কিংবা লিথিয়ামের মত মৌল তৈরি হলেও আমাদের জীবনের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে মৌলগুলো-কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন এবং লৌহ-এগুলো কিন্তু সে সময় তৈরি হয় নি। এগুলো তৈরি হয়েছে অনেক অনেক পরে কোনো না কোনো নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণ থেকে, যাদের আমরা মহাকাশে সুপারনোভা বলে জানি। ‘অনেক অনেক পরে’ বলছি কারণ, বিজ্ঞানীরা গণনা করে দেখেছেন, প্রথম নক্ষত্র তৈরি হয়েছিল বিগ ব্যাং ঘটার অন্তত ৭৫ কোটি বছর পরে। আর তারকার বিস্ফোরণ-মানে সুপারনোভার মত ব্যাপার স্যাপার ঘটতে সময় লেগেছিল আরো অনেক। তবে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল-আমাদের কার্বনভিত্তিক দেহ, কিংবা দেহের অভ্যন্তরে ক্যালসিয়াম দিয়ে গঠিত হাড় তৈরি হতে পেরেছে, কেননা সুদূর অতীতে কোনো না কোনো নক্ষত্র নিজেদের বিস্ফোরিত করে তার বহির্জগতের খোলস থেকে এই জীবনোপযোগী মৌলগুলো ছড়িয়ে দিয়েছিল মহাশূন্যে। অনেক পরে সেই মৌলগুলো শূন্যে ভাসতে ভাসতে জড়ো হয়েছে সূর্য নামক এক সাদামাঠা নক্ষত্রের চারপাশে ঘূর্ণনরত এক সুনীল গ্রহে, এবং শেষ পর্যন্ত তৈরি করেছে প্রাণের বিবর্তনীয় উপাদান। আমাদের ছায়াপথের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে অন্তত ২০ কোটি নক্ষত্র এভাবে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে, হয়তো আমার আপনার ভবিষ্যৎ জন্মকে সার্থক করে তুলবে বলে। আমরা সবাই আসলে নক্ষত্রের ধূলি-স্টারডাস্ট । এর চেয়ে কাব্যিক অনুরণন আর কীই বা হতে পারে?”

সে যে্নো প্রতিধ্বনিত করেছিলো কার্ল সাগানের কসমস-এর সেই অমর পঙক্তিগুলোর, যা কাব্যগুণে এতোটাই সমৃদ্ধ যে রূপকথার মহাকাব্যের মতোই শোনা যায়:
“The nitrogen in our DNA, the calcium in our teeth, the iron in our blood, the carbon in our apple pies were made in the interiors of collapsing stars. We are made of star stuff.”

মৃত্যুই যদি সব কিছুর শেষ হয়, এরপরে যদি আর কিছু না থাকে, পরকালের কোন প্রাপ্তি নয় এই জীবনের কাজের মধ্যেই যদি আমাদের বেঁচে থাকা হয় তাহলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দুয়ারে এই জৈবিক দেহটাকে সঁপে দেওয়াই তো সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত কাজ। কফিনের চার দেওয়ালের মধ্যেই হোক, পুড়ে গিয়েই হোক আর সাদা কাফনে জড়ানোই হোক শেষ পর্যন্ত মানুষের নশ্বর দেহটাতো পচে গলে প্রকৃতিরই অংশ হয়ে যাবে। আর যে নক্ষত্রের ধূলিকণাগুলো, অণু পরমাণুগুলো এতদিন আমাদের দেহ গড়েছিল তারা আবার উন্মুক্ত হয়ে গড়বে নতুন কোন জীবের দেহ। প্রকৃতির চক্র এভাবেই তো ঘুরতে থাকে।

আরজ আলী মাতুব্বর তাঁর উইলে মরণোত্তর দেহদান নিয়ে তাঁর চিন্তা ও আদর্শ এভাবেই লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন,‘আমি আমার মৃতদেহটিকে বিশ্বাসীদের অবহেলার বস্তু ও কবরে গলিত পদার্থে পরিণত না করে, তা মানব কল্যাণে সোপর্দ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। আমার মরদেহটির সাহায্যে মেডিক্যাল কলেজের শল্যবিদ্যা শিক্ষার্থীগন শল্যবিদ্যা আয়ত্ত করবে, আবার তাদের সাহায্যে রুগ্ন মানুষ রোগমুক্ত হয়ে শান্তিলাভ করবে। আর এসব প্রত্যক্ষ অনুভূতিই আমাকে দিয়েছে মেডিকেলে শবদেহ দানের মাধ্যমে মানব-কল্যাণের আনন্দলাভের প্রেরণা।‘

তাঁর এবং এমনি আরো অনেকের অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, প্রয়োজনীয়তা এসব তুলে ধরে অভি মুক্তমনায় একটা ব্লগও লিখেছিলো, সেখানে সে আহ্বান জানিয়েছিলো সবাইকে এব্যাপারে এগিয়ে আসার। ( https://blog.mukto-mona.com/2012/08/22/28869/) এবং সেখানে সে জানিয়েছিলো যে, সে নিজেই মরণোত্তর দেহদান করেছে। তার এই ইচ্ছাটা বাস্তবায়ন করে আমাদের দুজনের মতাদর্শের প্রতি আমি আস্থা পুনর্ব্যক্ত করেছি, সাথে তার লড়াইয়েরও অসম্মান হতে দেই নি বলেই ভাবি। অভির বাবা, ড অজয় রায় অভির খুনের ২৪ ঘন্টার মাথায় এসে আমাকে হাসপাতালের আইসিইউ তে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ মা তুমি গুল্লুর (অভিকে গুল্লু ডাকেন উনি) দেহ নিয়ে কী করতে চাও, এ ব্যাপারে তোমাদের সিদ্ধান্ত কী ছিল? হাতে দুটো অপশন আছে, ধর্মীয় মতে দাহ করা যায় বা হাসপাতালে দান করা যায়। তোমরা নিশ্চয়ই প্রথমটা চাইবে না…’। আবারও শ্রদ্ধায় নত হয়েছি ওনার কাছে। আমার সাথে অভির সম্পর্কের সেই প্রথম থেকেই বাবা এভাবেই আমাদের সব কিছুতে সমর্থন দিয়ে গেছেন!

Avi_Bonya_LuzerneSwitzerland_2012 (3)

আমি নিশ্চিত জানি অভিকে যদি বলা হত যে তুমি হয় এভাবে প্যাশানের জন্য, যা বিশ্বাস কর তার জন্য অকালে জীবন দাও, অথবা লেখালিখি বাদ দিয়ে অনেকদিন বেঁচে থাকো, আমার দৃঢ় ধারণা সে প্রথমটাই বেছে নিত। গ্রিক পুরাণের এক চরিত্রকে নাকি দেবতারা বলেছিলো, সে কী বেছে নেবে, দীর্ঘ, নিরুত্তাপ জীবন, নাকি সংক্ষিপ্ত চরম উত্তেজনাপূর্ণ জীবন। সে বেছে নেয় দ্বিতীয়টা। অভিও সেটাই বেছে নিলো, চিরতরুণ, চিরযোদ্ধা হয়ে রয়ে গেলো আমৃত্যুই। আমি জানি আমি নিষেধ করলেও সে শুনতো না, বলতো এভাবে বেঁচে থেকে কী হবে! তারপরই হয়তো বরাবরের মত হেসে বলতো ‘তুমি খুব শক্ত মেয়ে, ইউ উইল বি অলরাইট’! আজকাল কেউ আমাকে স্ট্রং বললেই খুব বিরক্ত লাগে, আমি তো জেনে গেছি, নো ওয়ান ক্যান বি মোর স্ট্রং। নিয়তি মানুষকে চরম ধ্বংসের দিকেও নিতান্ত অবহেলাতেই ঠেলে দিতে পারে। কেউ উঠে দাঁড়ায়, কেউ হয়তো পথ হারায়। হেমিংওয়ে কোথায় যেন বলেছিলেন ‘Life breaks us all, but some emerge stronger at broken places.’

অনেকে বলেন আমার দায়িত্ব হচ্ছে অভির লড়াই চালিয়ে যাওয়া। এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। অভির সাথে আমার দার্শনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং তত্ত্বগতভাবে বেশিররভাগ ব্যাপারে একমত থাকলেও অমিলও ছিল। অভিরও ছিল আমারও ছিল। এসব নিয়ে এতটাই চুটিয়ে তর্ক বিতর্ক করতাম যে ছোটবেলায় আমাদের মেয়েটা ভাবতো আমরা শুধু ঝগড়া করছি। এগুলো যে তাত্ত্বিক তর্কাতর্কি তা বুঝতে তার অনেক সময় লেগেছে। আমরা এও বলতাম যে আমাদের দুজনের এতটা স্বাধীন মতামত আছে বলেই আমরা দুজন দুজনকে আরো শক্তি জোগাই। অভির লড়াই আমি চালাতে পারবো কিনা জানিনা, ওর মতো যোগ্যতাও আমার আছে কিনা তাও জানিনা। তবে আমি যে অভির অকাল মৃত্যুতে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার মতো করে আমার লড়াই চালিয়ে যাবো তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমার ধারণা অভি আজ বেঁচে থাকলেও আমাকে তাই-ই করতে বলতো। অভির হাসিমুখ যেনো অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো হয়ে চিরঞ্জীব হয়ে রইলো আমায় আলোকিত করবে বলে।

চলবে…