avijit15e

হুমায়ুন আজাদ, রাজিব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু,অনন্ত বিজয় দাশ এবং ….।

সহব্লগার অনন্ত খুন হওয়ার খবরটি অস্পষ্টভাবে সেদিন সাত সকলেই শুনলাম। মুক্তমনের মাহফুজ ভাই ফোন করে খোঁজ নিতে বললেন। আমি সাংবাদিক, তাই হয়তো আমার পক্ষে জানা সহজ। আমি পাগলের মতো সিলেটের সাংবাদিকদের টেলিফোন করতে থাকি। আরেক হাতে টিভি চ্যানেলের রিমোট চিপে একের পর এক সংবাদের স্ক্রলগুলো দেখতে থাকি। আমাকে কেউ বলুন, প্লিজ আমাকে বলুন, ব্লগার অনন্তর কি হয়েছে? তিনি এখন কোথায়?

এইসময় সিলেটের একজন সাংবাদিক আমাকে অনন্ত খুন হওয়ার খবরটি নিশ্চিত করেন। একটি ২৪/৭ ঘন্টার টিভি নিউজের স্ক্রলে একটু পরেই ব্রেকিং নিউজের স্ক্রল চলে আসে। লাল হরফের অক্ষরগুলো আমার চোখে জ্বালা ধরায়।

আমি পাল্টা কয়েকটি ফোন করে সহব্লগার কয়েকজনকে অনন্ত খুন হওয়ার খবরটি জানাই। অনেকেই এরই মধ্যে ঘটনাটি জেনেছেন বললেন। কয়েকজন বললেন, ফেসবুকে নাকি পোস্টও পড়ছে। আমি মুক্তমনায় ব্লগ পোস্ট দেওয়ার কথা বলি। নিরাপত্তার প্রশ্ন তোলেন কেউ কেউ।

আর ব্লগ বারান্দার বাইরে আজকাল শুনতে পাই, কেউ কেউ বলেছেন, এতো লেখালেখির কি দরকার? দেখলা তো, লেইখ্যা কিছু হয় না। বরং জান নিয়ে টানাটানি। মুর্খের দেশে এসব বিজ্ঞান চেতনা, হেনতেন লেখার কোনো দাম আছে? আর ব্লগাররাই বা আল্লা-রসুল নিয়া এতো বাড়াবাড়ি করে ক্যা? যতোসব নাস্তিকের দল!

তো, আমারো কি এখন থেকে পরিবারের কথা মেনে সাবধান হওয়া উচিৎ? আমাকে কতল করার কাল কখন, কোথায় হবে? ডিউটি সেরে বাড়ি ফেরার সময় রাতের বেলা গলির মুখে কি ঘাপটি মেরে থাকবে কোনো মৌলবাদের নাতি? নাকি সকাল, সকালই নূরানী লেবাসের চাপাতিতন্ত্র বাসার সামনে ঝাপিয়েঁ পড়বে আমার ওপর? অথবা তারা আমার শোবার ঘরেই সদলবলে ঢুকে কুপিয়ে জিহাদ কায়েম করে গেল, এমনো তো হতে পারে? তারা আমার গলা কাটার আগে আমি কি তাদের মুখগুলো একনজর দেখার সময় পাবো? আর অনিবার্য প্রশ্ন এই, তখন কি হবে আমার অনুভূতি?

এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আমার মনে পড়ে অভি দা’র কথা। অভি দা খুন হওয়ার দিনেও সহ ব্লগাররা একের পর এক টেলিফোন করে ঘটনার আদ্যপান্ত জানতে চাইছিলেন। আমি পাথুরে মুখ করে টিভি সেটের সামনে বসেছিলাম। লাইভ দেখাচ্ছিল। আমি ইচ্ছে করেই ওই রাতে ঢাকা মেডিকেলে যাইনি। বন্যা’দির রক্তাক্ত চেহারা, অভি দা’র মরদেহ, ইত্যাদি আমার পক্ষে সহ্য করা কঠিন। আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো। তবু পণ করে কাদিনিঁ। অফিস থেকে লেট নাইটে যারা ডিউটি করেন, তারা ফোন করে তথ্য চান। আমি অভিজিৎ রায় সর্ম্পকে, মুক্তমনা সর্ম্পকে একের পর এক তথ্য দিতে থাকি। ব্লগার কয়েকজনের ফোন নম্বর দেই।

খুব অস্থিরতার ভেতর ছটছট করে সেই রাত কাটে। সকাল হতেই আমি আবার টিভির সামনে বসি। কম্পিউটার খুলে অনলাইনে আপডেট জানতে চেষ্টা করি। এরপর টিএসসি’তে যাই। অভি দা’ খুন হওয়ার জায়গাটি দেখি। সেখানে তখনো কালো চাপচাপ রক্ত। কোরবানী ঈদের সময় গরু জবাইয়ের পর রক্ত জমে যেমন হয়,তেমন। জমাট রক্তে কালচে ফুটপাথের টাইলস। কারা যেনো সেখানেই গুচ্ছ গুচ্ছ তাজা ফুল দিয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের একটি চওড়া ব্যানার দেখি। লিখেছে, অভিজিৎরা হারলে বাংলাদেশ হারবে… এরকম। খানিক দূরে গাছের ছায়ায় বেঞ্চ পেতে পুলিশের কয়েকজন হাই তুলছেন।

আরো এগিয়ে রাজু ভাস্কর্যর সামনে যাই। ফেসবুক ইভেন্টের সূত্রে সেখানে কয়েকজন অভিজিৎ হত্যার বিচারের দাবিতে ব্যানার ধরেছেন। আমি কিছুক্ষণ ছাত্র-শিক্ষকদের বক্তৃতা শুনি। কয়েকজন ব্লগারকে দেখি শুকনো মুখে ঘুরছেন। পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় করি। শিল্পী সব্যসাচি দা’কে দেখি স্বপরিবারে এসেছেন। অনেকেই বন্যাদি’র খবর জানতে চান। খবরের লোক হলেও আমি তাদের বাড়তি খবর দিতে পারি না। শুধু এইটুকু জানাই, বন্যাদি’কে স্কোয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে, তার জ্ঞান ফিরেছে। বিদেশে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।

খুব বেশী বিচ্ছিন্নতা বোধ নিয়ে আমি যন্ত্রের মতো বইমেলায় যাই। আমার বইটি (পাহাড়ে বিপন্ন জনপদ, সংহতি প্রকাশন) কেমন চলছে, সে খবর নেই। আমার খুব একলা লাগে। বইমেলাটিকে মনে হয় প্রাণহীন, ভাঙা হাট। অফিসে গিয়ে অভিজিৎ হত্যার ওপর একটি ফলোআপ নিউজের তথ্য সংগ্রহ করি। নেট ঘেঁটে বিভিন্ন ব্লগে অভিজিৎ খুন হওয়ার প্রতিক্রিয়া নিয়ে সাইড স্টোরি করি।

পরদিন সকালে মুক্তমনের আফরোজা আপা ফোন করে প্রায় কেঁদে ফেলেন। টিভিতে তখন আবারো লাইভ দেখাচ্ছিল। অভি দা’র মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে আনা হবে। কালো রঙের মঞ্চটিকে ঘিরে প্রস্তুতি পর্ব চলছে। আমার ইচ্ছে হয়, একবার সেখানে ছুটে যাই। অজয় স্যারকে সাহস দেই। অভি দা’র কফিনটি ছুয়ে দেখি। আমার ভাবলাম, নাহ, থাক। এই সবে কি লাভ? তাছাড়া অভি দা কি আর মৃত দেহটিতে আছেন? অজয় স্যার আমাদের চেয়েও অনেক শক্ত।

আমি নোটবুক খুলে একটানে লিখতে থাকি। মুক্তমনে আমার পদার্পন। অভি দা’র সঙ্গে আমার পরিচয়। আমার ভাবনার শিক্ষকের সঙ্গে অবিরাম আলাপচারিতা, অসংখ্য টুকরো কথা দ্রুত অভ্যস্ত হাতে টাইপ করতে থাকি। আমার সকালের চা জুড়িয়ে যায়। আবার চা করি। আবার লিখি, নেট ঘেঁটে বেশকিছু লিংক জড়ো করি। আমাকে থামলে চলবে না। আমাকে আরো শত শত সংবাদ, নেপথ্য সংবাদ, তৎসংলগ্ন রিপোর্টারের ডায়েরি বাদেও এই সব নোটপত্র লিখতে হবে। সব লেখার কিবোর্ড/কলম চলবে…

সেদিন অফিসে গিয়ে অভি দা’র কন্যা তৃষার ফেসবুক নোট নিয়ে একটি হিউম্যান স্টোরি করি। ‘আমার বাবা বরাবরই সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় সোচ্চার ছিলেন। আমি তোমাকে ভালবাসি বাবা। তুমি আমার বন্ধু, আমার হিরো। মুক্তমনার সংগ্রাম চলবেই।’ …ওই রাত্রে ঘুমের ভেতর আবারো অভি দা হানা দেন। আমার ঘুম আসে না। খুব মশা কামড়ায়। বার বার মনে পড়ে আমার ছাত্র জীবনের কথা। প্রচণ্ড বিদ্রোহের কাল। আমি মোবাইল থেকে সেলিম রেজা নিউটন ভাইকে ইনবক্স করি। ভাই কি জেগে আছেন? অভি দা খুন হওয়া পর মন ভালো না… ইত্যাদি। তখুনি কোনো জবাব পাই না। নিউটন ভাই ছাত্র জীবন থেকেই আমাদের ভাবনা জগতের নায়ক। এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

তিনি জবার দেন আরো পরে। অভি দা’র বইগুলো ঢাকা থেকে কিভাবে কেনা যায়, নিউটন ভাই জানতে চান। আমি পড়ুয়া ডটকম ডটবিডি-এর কথা বলি। এরপর আরো সব ভাবনায় ঝিমুতে ঝিমুতে আমার রাতটুকু কাটে।

সকাল হতে না হতেই আবারো নোটবুক খুলে আমি লিথতে থাকি। অবিরাম লিখতে থাকি আমার চারপাশ। আমি লিখতে থাকি, আমরা লিখতে থাকি। এরই মাঝে খুন হন ব্লগার বাবু। তারপর সীমান্ত পেরুনোর প্রস্তুতির ভেতরেই খুন হন অনন্ত। বাবা পক্ষাঘাতের রোগি। অনন্ত টের পেয়েছিলেন, তিনি যখন-তখন খুন হবেন। এস্পার, কি ওস্পার অনিবার্য। তবু বাবাকে ছেড়ে নিরাপদ স্থানে যেতে তার কেবলই দেরী হয়ে যায়। …

তো এখন আর এইসব খুনের খবরে তেমন মর্মাহত হই না। গুরুচণ্ডালির স্মিতা ঘোষের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। প্রতিবাদী এবং চিন্তাশীল মানুষের এমন মৃত্যুই তো প্রাপ্য । দেশকাল ভেদে শাস্তিটা কিন্তু বদলায় না। কলম চলছেই…
__

পূর্ব কথন: আমি অভিজিৎ রায়ের লোক [লিংক]
__
ছবি: অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের স্থান, টিএসসি, ঢাবি, এএফপি