668wWIWiTL0j

তারিখটা মনে আছে সবার, ২১ আগস্ট! গ্রেনেড হামলা যেদিন হয়েছিল সেদিন শেখ হাসিনার সমাবেশ ছিল সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ কিন্তু তৎকালীন ক্ষমতাসীনেরা তার জবাব দিয়েছিল সন্ত্রাসের মাধ্যমে। ফলে অনেক প্রাণের বিনিময়ে শেখ হাসিনার প্রাণ রক্ষা হলেও আইভি রহমানসহ বিশোর্ধ লোক সেখানে প্রাণ হারিয়েছিলেন, আহত হয়েছিল অগণন লোক।

সে হত্যাকাণ্ড এবং শেখ হাসিনাকে প্রাণনাশের চেষ্টার পর বিএনপি-জামায়াত ছাড়া সারা দেশের মানুষ প্রতিবাদে মূখর হয়েছিল। নিন্দা জানিয়েছিল সে প্রাণনাশের অপচেষ্টাকে। এটা এখন ইতিহাস হয়ে গেছে কারণ এখনও সে বিচারকাজ সমাপ্ত হয়নি। ঢিমেতালে চলছে বিচার প্রক্রিয়া। প্রধান আসামিসহ অনেক আসামিই পলাতক।

২১ আগস্টের ন্যাক্কারজনক গ্রেনেড হামলার পর জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়েছিল। বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে আমরা জেনেছিলাম আওয়ামিলীগ নিজেরাই নিজেদের সমাবেশে হামলা করেছে। এমনও শুনেছিলাম- শেখ হাসিনা তাঁর ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন। যদি তারা নিজেরা সে গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনা না ঘটাত তাহলে শেখ হাসিনা কীভাবে বেঁচে যান- এমন অসংখ্য কুযুক্তি।

সুস্থ বোধসম্পন্ন যে কোন মানুষ সরকারি জোটের সে বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছিল স্বাভাবিকভাবে। পরবর্তিতে দেখা যায় গ্রেনেড হামলায় তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীসহ খোদ সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান জড়িত। তারেক রহমানের সৌভাগ্য কিংবা বাংলাদেশের দূর্ভাগ্য যে ক্ষমতায় থাকার কারণে তাঁর টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেনি কেউ। ফলে এক সময় চিকিৎসার জন্যে তিনি যুক্তরাজ্যে যেতে পেরেছেন ফখরুদ্দীন আর আড়াল থেকে কলকাটি নাড়ানো মঈনুদ্দিনের সহৃদয় সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদান্যতায়। এই মুহুর্তে গ্রেনেড হামলার আসামি তারেক রহমান ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ হিসেবে ইন্টারপোলের তালিকাভুক্ত হিসেবে বৃটেনে পলাতক অবস্থায় আছেন। তাঁর পারিবারিক রাজনীতির উত্তরাধিকারিত্বের কারণে তাঁকে গ্রেফতার করা সম্ভব না বলেই মনে হয়।

গ্রেনেড হামলার ‘জাস্টিফিকেশন তত্ত্ব’ দিয়ে অনেক দিন বিএনপি-জামায়াত রাজনীতি করতে পারলেও বর্তমানে তারা পারছে না কারণ একটাই পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে মনে হতো তাদের বুঝি পতন হবে না কোনদিন। এখন যেমন মনে হয় আওয়ামিলীগ সরকারের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে আওয়ামিলীগ কিংবা বিএনপি’র কাউকে দোষ দেওয়ার কিছু আছে বলে মাঝে মাঝে মনে হয় না কারণ ক্ষমতা এমনই যখন চেয়ার থাকে ততক্ষণ চেয়ার বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না মানুষ। এটাকে কেবল মোহ শব্দ দ্বারা সংজ্ঞায়ন সম্ভব না, হতে পারে এটাই পরম্পরা!

জাস্টিফিকেশন তত্ত্বের ইতিহাস সুদীর্ঘ। সব নিয়ে আলোচনা সম্ভব না, হয়ও না। এক্ষেত্রে মানুষ খুব কাছে থাকা উদাহরণগুলো সামনে আনে। আমাদের ইতিহাস বলে, আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের যারা ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে পুলিশ প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতেন তাদের পরিণতি হয় সবচেয়ে ভয়াবহ। বিএনপির আবদুল মতিন চৌধুরী ক্ষমতা ছাড়ার পর পুলিশ কর্তৃক রাস্তায় আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন, একই অবস্থা হয়েছিল মোহাম্মদ নাসিমেরও। মাঝে রফিকুল ইসলাম কিছুদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকলেও তাঁর এমন করুণ পরিণতি হয়নি কারণ এরপর থেকে তিনি আদতে রাজনীতির বাইরেই চলে যাওয়া একজন। লুতফুজ্জামান বাবরের পরিণতির কথা চিন্তা করলে দেখা যায় দীর্ঘদিন ধরে তিনি কারান্তরীন। তাঁর সময়ে অন্যায় আর সন্ত্রাস রাষ্ট্রীয় চরিত্র ধারণ করেছিল। গ্রেনেড হামলা, জঙ্গি উত্থান, অবৈধভাবে অস্ত্র আমদানি তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হয়েছিল বলে সংবাদমাধ্যমগুলোই বলছিল।

উল্লেখিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের কার্যকালে তারা পুলিশ প্রশাসনের যে কোন অন্যায়কে একবাক্যে জাস্টিফাই করতে পিছপা হতেন না। মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেননসহ শীর্ষ রাজনীতিবিদদের পুলিশ কর্তৃক প্রকাশ্য রাজপথে পেটানো হয়েছিল তখনও তারা আগপিছ না ভেবেই পুলিশের অন্যায়কে ন্যায় হিসেবে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন তারা। তাদের সে জাস্টিফিকেশন তত্ত্ব কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হয় নি, উলটো সময়ের ব্যবধানে সেটাই তাদের পথের কাঁটা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

আমরা নিশ্চিত না, এটা কী ক্ষমতার দম্ভ, নাকি মন্ত্রীদের পরম্পরাগত আচরন? ঐতিহ্যগতভাবে এটা চলে আসলে হয়ত আমাদের জন্যে সুখের কোন সংবাদ না। কারণ মন্ত্রী বদলালেও মন্ত্রীদের আচরণ বদলাবে না। ফলে ধারাবাহিকভাবে এসব চলতে থাকবে। হতে পারে দূর্বল মানসিকতা আর শুভবোধসম্পন্ন মানুষের অভাবের কারণে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা আমলাতন্ত্রের জালে আটকে পড়ার উদাহরণ। কারণ একটা নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে মন্ত্রী বদল হলেও আমলাবদল বা প্রশাসনবদল হয় না। অনভিজ্ঞ একজন লোক ক্ষমতায় বসার পর তাঁর অনভিজ্ঞতা ঢাকতে অন্যের ওপর নির্ভরশিল হয়ে পড়ে আর এ নির্ভরশিলতা যাদের ওপর তারা রুটিনমাফিক সবকিছু করতে অভ্যস্ত, এখানে জনমতের প্রতিফলন ঘটবে এটা চিন্তা করা হয়ত হাস্যকরই!

সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মানুষের চিন্তাধারা সম্পর্কে এদের বেশিরভাগ লোকই হয় অজ্ঞ থাকে, না হয়ে কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে থাকে। এটা অবিনাশি এক ধারা সম্ভবত, একই সঙ্গে আতঙ্কেরও। সম্ভবত এজন্যেই কেনেচি ওমেই বলেছেন- When politician and bureaucrats says the situation is under control; it was first warning sign. তারা বলে না কিছু, তারা দেখে না কিছু কিন্তু যখন বলে আর দেখে তখন আসলেই সব শেষ হয়ে গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক-বর্তমান সব মন্ত্রীদের আচরণ-বক্তব্য আর গৃহিত উদ্যোগ কেনেচি ওমেইয়ের সে বক্তব্যের প্রায়োগিকতা আর স্বার্থকতা প্রতিপন্ন করে।

জাস্টিফিকেশন তত্ত্বের প্রায়োগিক দিক একটা সময়ে কেবল রাজনীতিবিদ আর আমলাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এখন একে রাজনীতি সচেতন মানুষদের মাঝেও সঞ্চারিত হয়েছে। এই সময়ে যে কোন ঘটনা ঘটার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলো বিশেষত ফেসবুকে। এরপর টিভি চ্যানেল, পত্র-পত্রিকাসহ অন্যান্য মাধ্যমে। এরপরের ক্রমতালিকায় আসে রাজনীতিবিদ আর আমলারা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের বিচরণ থাকলেও এটা সাম্প্রতিক সময়ে মূলত রাজনীতি সংশ্লেষযুক্ত মানুষদের দখলে। এই রাজনীতি সচেতন মানুষেরা আবার বিভিন্ন দলে বিভক্ত। ঘটনার অব্যবহিত পর প্রথমেই তারা ভাবে নিজ নিজ দলের স্বার্থ, তারপর আসে অন্য প্রসঙ্গ। দলের ওপর কোন অপবাদ কিংবা দায় আসবে এমন আশঙ্কায় তারা দলবেঁধে তাদের এক্টিভিটি চালিয়ে থাকে। মজার ব্যাপার হলো, কিছু সময় পর যখন দলের পক্ষ থেকে যখন কোন বক্তব্য আসে তখন আবার তারা বেশরমের মতো ইউটার্ণ নিতেও পিছপা হয় না। মনে হতে পারে এই ইউটার্ণ নেওয়াটা তাদের জন্যে দৃষ্টান্তমূলক হতে যাচ্ছে কিন্তু আদৌ তা নয়! কিছু দিন পর নতুন কোন ঘটনা আবার প্রাথমিকভাবে দলের পক্ষে সাফাই এবং দলের নেতাদের পক্ষ থেকে বক্তব্য আসার পর ফি-বার ইউটার্ণ! এটা ভয়ঙ্কর এক চিত্র হলেও চলে আসছে অবিরত এবং কে জানে হয়ত চলবেও!

অতি সাম্প্রতিককালে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারী নিপিড়নের ঘটনা ঘটেছে। সে ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিল ঢাবি’র কয়েকজন ছাত্র। পরে পরিচয়ে দেখা গেলো তারা ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মি। ঘটনার পর পরই কেন্দ্রিয় ছাত্র ইউনিয়ন একে দলীয়ভাবে নেওয়ার চেষ্টা করে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করল। ফলে প্রাথমিকভাবে এ প্রতিবাদ কর্মসুচিতে যেখানে সব শ্রেণিপেশার মানুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ ছিল সেটা কমতে থাকল। তবু তারা তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রাখল। এই প্রতিবাদ কর্মসূচি চলতে থাকা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলো যেখানে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছিল সেখানে তারা একে অব্যাহত রেখে সামাজিক দায়িত্ব পালন করল।

অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলো সে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করলে এটা ছাত্র ইউনিয়নের নিজস্ব কর্মসূচিতে পরিণত হতো না। বাকি সবাই যখন আন্দোলনের নাটাই ছাত্র ইউনিয়নের হাতে তুলে দিলো তখন তারা ত সেটা নিয়ন্ত্রণ করবেই। এখানে তাদের দলীয় স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপার আসতে পারে, কারণ বাংলাদেশে এমন কোন আন্দোলনের ইতিহাস নেই যেখানে কোন না কোন রাজনৈতিক দল সুবিধা নিয়েছে।

সাম্প্রতিক উদাহরণ টানলে দেখা যায়, দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণআন্দোলন গণজাগরণ আন্দোলনেরও ফসল ঘরে তুলেছে সরকারি দল আওয়ামিলীগ। ফসল ঘরে তোলার পর এখন তারা এ আন্দোলনে নাই (অবশ্য এর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকতে পারে)। আওয়ামিলীগ ফসল ঘরে তোলার পর সামনে এসেছে বাম সংগঠনগুলো। ফলে এখন অনেকেই এ আন্দোলনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। যারা প্রশ্ন তুলছেন তাদের কথায় যেমন যুক্তি আছে ঠিক তেমনি যারা অব্যাহত রাখছেন তাদের কথায়ও যুক্তি আছে অবশ্যই, আমি যাচ্ছি না সে দিকে।

পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারীদের ওপর যৌন নিপিড়নের ঘটনায় দেশব্যাপি প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের ঝড় ওঠেছিল। অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলো আগেই এ আন্দোলনের নাটাই তুলে দিয়েছিল ছাত্র ইউনিয়নের হাতে। ফলে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সংগঠনের শতাধিক নেতাকর্মী রোববার (১০ মে) দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনারের কার্যালয়ের দিকে যাত্রা করেন। পথে একাধিক স্থানে বাধা পেলেও দুপুর ১টার দিকে তারা মিন্টো রোডে ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ের কাছে পৌঁছান।

জানা যায়, মিন্টো রোডের মোড়ে মিছিলকারীরা পুলিশের ব্যারিকেড দিয়ে বাধা দেয়। প্রতিবাদকারীরা তা অতিক্রমের চেষ্টা করলে পুলিশের ব্যাপক পিটুনির শিকার হন। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে ধস্তাধস্তির ঘটনাও ঘটে। পুলিশ লাঠিচার্জ করে, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে, জলকামানের মাধ্যমে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বিক্ষোভকারীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুঁড়ে মারে। নারী নিপিড়নের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে নারীসহ আহত হন অন্তত ২৫ জন। পুলিশ সেখান থেকে বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে আটক করে।

বিক্ষোভকারীদের বাধা দেওয়া, ধস্তাধস্তি এতটুকু পর্যন্ত অনেকেই স্বাভাবিক যে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি বলে আখ্যা দিতে চান। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলে বাংলাদেশের কোন কর্মসূচিই পুলিশি বাধা ছাড়া সমাপ্ত হয় না। কিন্তু এই বাধা দিতে গিয়ে পুলিশ যা করল সেটা অন্যায়, অবিবেচনাপ্রসূত আর ন্যাক্কারজনক। নারী নির্যাতনের প্রতিবাদি কর্মসুচিতে পুলিশ নিজেই এক নারীকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করল।

সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুক এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক চিত্রে দেখা যায়- একদিকে সীমানা বেষ্টনি, বাকি তিন দিকে পুলিশ! মেয়েটি একা, নিজেকে বাঁচানোর আর কোন পথ খোলা নেই। পুলিশ এগিয়ে আসছে লাথি দিতে; একজন নয়- একাধিক! এদিকে ভীত, আতঙ্কিত মেয়েটি দুই হাত উপরে তুলে রেখেছে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিমায়। কিন্তু তবু থেমে থাকেনি পুলিশ। চালিয়েছে নির্যাতন; নারী নিপিড়নের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এভাবেই নারী নির্যাতিত হলো। পহেলা বৈশাখের যৌন নিপিড়নের পর এবার পুলিশের বুটের আঘাতে!

এরপর দেখা গেলো একটি ছবি যেখানে দেখা যাচ্ছে আক্রান্ত নারী আগে পুলিশের রুলেটপ্রুফ রায়ট কারকে লক্ষ্য করে রাস্তার পাশে থাকা মাটির তৈরি ফুলের এক টব ছুঁড়েছেন। অনেকেই এই ফুলের টব ছুঁড়ে দেওয়াকে সামনে নিয়ে এসে পুলিশি হামলাকে জাস্টিফাই করতে ওঠেপড়ে লেগেছেন। অবস্থাটা এমন- ফুলের টব ছুঁড়ে মেরেছে বলে উচিত শাস্তি হয়েছে তাঁর। যারা আছেন এই জাস্টিফিকেশন তত্ত্ব কপচানোর দলে তারা খুব সহজেই ভুলে যান আমাদের পুলিশি চরিত্র। যখন পেট্টোলবোমায় আতঙ্কিত ছিল দেশ তখন পুলিশের তৎপর হলে দেশে দেড় শতাধিক লোক আগুনে পুড়ে মরত না, আহত হতো না সহস্রাধিক। যখন হেফাজতি তাণ্ডবে কাঁপছিল পুরো ঢাকা তখন পুলিশ তাদের টিকিটিও স্পর্শ করেনি, একদিক খালি রেখে তাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। যখন ঢাবি এলাকায় বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করেছিল জঙ্গিগোষ্ঠী তখন অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ ছিল নির্বিকার। যখন টিএসসিতে পহেলা বৈশাখের দিন নারীর ওপর যৌন সন্ত্রাস চালানো হয়েছিল তখনও সেখানে থাকা পুলিশের কোন ভূমিকাই ছিল না। সে ঘটনায় পুলিশি তদন্তে পুলিশকে দোষি স্যাব্যস্ত করা হয়েছে। এমন উদাহরণ দেওয়া যাবে ভুরিভুরি।

পুলিশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি। কিন্তু আমাদের পুলিশের ভূমিকাগুলো দেখলে মনে হয় তারা সরকারি সেবাদাস প্রতিষ্ঠানে পরিণত। ফলে এই ভুল বার্তা পৌঁছেছে সরকার সমর্থকদের কাছে। তারাও পুলিশের যে কোন ন্যাক্কারজনক ঘটনাকে প্রথম প্রহরেই জাস্টিফাই করতে নেমে পড়ে। তারাও ভুলে যায় পুলিশ ভুল করতে পারে। ফলে সামান্য এক ফুলদানি কিংবা ফুলের টব ছুঁড়ে মারা পরিণত হয়ে যায় নারী লাঞ্ছনার যথার্থ যুক্তি হিসেবে।

আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশ আর সরকারগুলোর বিরোধীমতকে দমনের জন্যে পুলিশের ওপর অতি নির্ভরশিলতার কারণে সময়ে সময়ে পুলিশ প্রশাসন একেকটা রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে নিজেদেরকে উপস্থাপন করেছে। এখন যেমন অনেক ক্ষেত্রে পুলিশকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি হিসেবে না ভেবে অনেকেই ভাবেন ‘পুলিশলীগ’ হিসেবে আগে তারা ছিল ‘পুলিশদল’ আর ‘পুলিশশিবির’। অবাক করা ব্যাপার, এখন যারা পুলিশলীগের আচরণকে সমর্থন করছেন সে তারাই আবার একদা পুলিশদল আর পুলিশশিবিরের বিরোধী ছিল। ক্ষমতার পটপরিবর্তনে তারা আবার তাদের মত পরিবর্তন করবে সে সহজেই অনুমেয় কারণ আগেকার পুলিশদল আর পুলিশশিবিরের সমর্থকেরা এখন পুলিশলীগের বিরোধি।

এটা হচ্ছে সেই ঘটনাগুলোর পুনঃমঞ্চায়ন যখন বিএনপির পুলিশ আওয়ামিলীগের নেতাকর্মিদের পেটাত আর বিএনপিপন্থিরা সে পেটানোকে জাস্টিফাই করত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আজকের পুলিশবন্ধুদের কাছে আগে পুলিশ ছিল শত্রু, এখন কেবল বন্ধুই নয় আত্মার অচ্ছেদ্য কেউ একজন হয়েছে। কোন এক সময় যে আবার শত্রু হবে না সে কেউ বলতে পারবে না। এ যেন বন্ধু-শত্রু; শত্রু-বন্ধু খেলা!

জাস্টিফিকেশন তত্ত্বে বিশ্বাসি যারা তারা এমন মানসিকতা ততদিন ধারণ করবে যতদিন তারা নিজেরা আক্রমণের শিকার না হয়। তাদের উদ্দেশে কিছু বলার নাই কারণ তারা নিজেরাই স্বপ্রণোদিত হয়ে তাদের নিজস্বতাবোধ বন্ধক দিয়ে রেখে নিজ নিজ দলের কাছে। দলের সর্বোচ্চ নেতা-নেত্রিরা যে কথা বলবে সেটাই হক কথা, সেটাই তাদের বক্তব্য।

তাদের উদ্দেশে তবু একটা কথাই বলি, আপনারা যারা তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলা পুলিশের উদ্ধত বুট আর অন্য দিকে সীমানা বেষ্টনিতে আটকা পড়ে অসহায় আত্মসমর্পণের মতো দুই হাত উপরে তুলে আশু নির্যাতন থেকে বাঁচতে কাতর দৃষ্টির একটা মেয়ে দেখার পরেও দেখছেন পুলিশের গাড়িতে একটা ঢিল ছোঁড়াকে ‘ভয়াবহ অপরাধ’ হিসেবে তাদের প্রতি একটাই বক্তব্য আপনারা হচ্ছেন সেই দলভুক্ত প্রজাতি যারা ধর্ষণের জন্যে নারীর পোষাককে দায়ি করে থাকে! দায়ি করা গোষ্ঠী থেকে আপনাদের পার্থক্যের জায়গা হলো আপনারা কথার মারপ্যাঁচ জানেন কিন্তু ধর্ষকসমাজের প্রতিনিধিরা এত কিছুর পরোয়া করে না, তাদের নীতি আর রীতি হলো- ডাইরেক্ট অ্যাকশন!

জাস্টিফিকেশন তত্ত্ব কপচানো যারা তারা সব ঘটনাকে নিজস্ব দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জাস্টিফাই করে যাবে। আশার কথা, এই শেণিভুক্ত মানুষদের বাইরেও কিছু মানুষ আছে যারা অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে এখনও দেখে। এরা সংখ্যায় কত তারচেয়ে বড় ব্যাপার হলো স্রোতের বিপরিতে দাঁড়িয়ে তারা তাদের কথা বলে যাচ্ছে। এদেরকে সংখ্যা দিয়ে না দেখে অন্তস্থ শক্তি দিয়ে দেখুন; এরাই সমাজ বদলের সুর তুলতে পারবে। পৃথিবীর সব আন্দোলন সব সময় সফল হয় না, সফল হতে হতে অনেক আন্দোলন আবারও ঘুমে যায়, জেগে ওঠে। এই ঘুম-জাগরণকালে তারা যে বার্তা পৌঁছায় মানুষের কাছে সেটা অবিনাশি। সুস্থবোধসম্পন্ন মানুষগুলো কোন না কোন সময় সে বার্তাকেই ধারণ করে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়!

হে অদ্ভুত, এই তোমাদের জাস্টিফিকেশন তত্ত্ব! অন্যায়কে জাস্টিফাই করার আগে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখো সে যোগ্যতা কী তোমরা ধারণ করো!