সব গানেই তো কিছু নিয়ম থাকে। সেই নিয়মগুলোকে একজন গায়ক/গায়িকা কতটুকু এদিক-সেদিক করতে পারেন ? নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে মুন্সিয়ানা চলে, কিন্তু নিয়ম ভেঙ্গে বেরিয়ে এলে, তখন একে নূতন নামে আখ্যা দিতে হয় । রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সে-রকমটি ঘটেনি। সুর পালটে দিয়েও , বলা দেয়া হচ্ছে রবীন্দ্র সঙ্গীত।
এই ধারা শুরু হয়েছে, রবীন্দ্র সঙ্গীতের উপর থেকে কপিরাইট উঠে যাবার পর। আগে যে, একটুখানি এদিক-সেদিক হয়নি , তা নয়। কিন্তু আমূল পালটে দিয়ে, একে রবীন্দ্র সঙ্গীত বলে চালিয়ে দেবার কথা কেউ ভাবতে পারত না তখন । যেহেতু কপিরাইট নেই, তাই পারছে । তা তারা করতেই পারেন । কিন্তু সুর পালটে দিয়ে; যে ধারা শুরু হয়ে গেছে, একে আর যে নামেই ডাকা হোক না কেন, রবীন্দ্র সঙ্গীত বলা যায় না। সুর পরিবর্তনকারীদের এইটুকু কাণ্ডজ্ঞান এখনও চোখে পড়েনি। তারা যা-নয়, তাকে তা-বানিয়ে দিয়ে; দিব্যি বলে যাচ্ছে , এই হল রবীন্দ্র সঙ্গীত । এ তো গেলে কাঠামোর কথা।
ভাবের কথা বলতে গেলে, আমার পক্ষে সবটুকু প্রকাশ করা সম্ভব নয়। খুব সংক্ষেপে, কোন একটি সমাজের মানস গঠনে, ঐ সমাজের নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক কাঠামোই নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। পণ্য, প্রতিযোগিতা, ফাস্ট লাইফ –নামক নানা উৎপাতে সমাজে যে দ্রুতগতির সঞ্চার হয়, তা সামন্ত সমাজে অকল্পনীয় ; তার মানে এ-ও , সে-সমাজে শোষণ পীড়ন ছিল না। ছিল। প্রসঙ্গ সেটি নয়। ধীর গতির সে-জীবনের ছাপ পাই, ভাটিয়ালী, ভাওইয়া সহ নানা লোকগানে । এই ধীর লয় নিয়ে, পণ্যবাহী সমাজে টিকে থাকা দায়; তাই ধীর লয়কে পালটে দিয়ে, একে পণ্যবাহী সমাজের প্রতিযোগিতামূলক আচরণের আভরণে ঢেকে, দ্রুত-গতি দানের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে গায়ককূলের মাঝেও । পণ্যবাহী সমাজ ভাবের ধার ধারে না, তার দরকার চাকচিক্য; এই চাকচিক্যের উৎকট প্রকাশ দেখতে পাই, বলিউডের গানসহ , পাশ্চাত্য গানে । আর ভাববাহী সামন্ত সমাজের ভাবের ছবিটা আমরা দেখতে পাই, সে-সময়কার কথা, সুর ও গায়কীর ভেতর।
ভাবের কথা থাক।
সুর সামান্য পালটে দিয়ে গাইবার স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, দিলীপ কুমার রায়।
রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিলেন, অন্তত একবার শুনে নিতে । রবীন্দ্রনাথ দিলীপ কুমারের কণ্ঠে গান শুনলেন। শুনে , বললেন, তুমি গেয়েছো ভাল, তবুও বলব গেয়ো না। ।
বাকী কথাগুলো আমার মনে নেই। একবার অনুমতি দিয়ে দিলে, এ ধারা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, তা ভেবেই হয়ত , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আতংকিত হয়ে পড়েছিলেন।
ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে নেই ।
তাঁর ‘সঙ্গীতচিন্তা’ থেকে ।
“আমার গান যাতে আমার গান বলে মনে হয় এইটি তোমরা কোরো। আরো হাজারো গান হয়ত আছে – তাদের মাটি করে দাও না, আমার দুঃখ নেই । কিন্তু তোমাদের কাছে আমার মিনতি – তোমাদের গান যেন আমার গানের কাছাকাছি হয়, যেন শুনে আমিও আমার গান বলে চিনতে পারি । এখন এমন হয় যে, গান শুনে নিজের গান কিনা বুঝতে পারি না। মনে হয় কথাটা যেন আমার , সুরটা যেন নয়। নিজের মুখে রচনা করলুম, পরের মুখে নষ্ট হচ্ছে, এ যেন অসহ্য। ”
জানকিনাথ বসুকে লেখা চিঠিতে, “গায়কের কণ্ঠের উপর রচয়িতার জোর খাটে না, সুতরাং ধৈর্য ধরে থাকা ছাড়া অন্য পথ নেই। আজকাল অনেক রেডিয়োগায়কও অহংকার করে বলে থাকেন, তাঁরা আমার গানের উন্নতি করে থাকেন। মনে মনে বলি, পরের গানের উন্নতি সাধনে প্রতিভা অপব্যয় না করে নিজের গানের রচনায় মন দিলে তাঁরা ধন্য হতে পারেন। সংসারে যদি উপদ্রপ করতেই হয় তবে হিটলার প্রভৃতির ন্যায় নিজের নামের জোরে করাই ভালো । ”
সেই তিনিই আবার সর্ব সাধারণের কথা বিবেচনায় রেখে বলেছেন, ” সকলেই আমার গান করুক, আমার গান সকলের জন্য, না গাইলে আমার মন আরো হাজারো গান হয়ত য়আছে – তাদের মাটি করে দাও না, আমার দুঃখ নেই। খারাপ করে । গান ঘরের মধ্যে মাধুরী পাওয়ার জন্য, বাইরের মধ্যে হাততালি পাবার জন্যে নয়। ওস্তাদ যাঁরা তাঁদের জন্য ভাবনা নেই; ভাবনা হচ্ছে যারা গানকে সাদাসিধে মনের আনন্দের জন্য পেতে চায় তাদের জন্য। যেমন তোমাদের টি-পার্টি যাকে বলে, সেখানে যারা সাহেবি মেজাজের লোক তাদের কানে কি ভালো লাগবে ? এখানে রবীন্দ্র হালকা গান, সহজ সুর, হয়ত ভাল লাগবে । তাই বলি আমার গান যদি শিখতে চাও, নিরালায়, স্বগত, নাওয়ার ঘরে, কিংবা এমনি সব জায়গায় গলা ছেড়ে গাইবে। আমার আকাঙ্খার দৌড় এই পর্যন্ত – এর বেশী ambition মনে নাই বা রাখলে।”
য়
শিল্পী হিসাবে ,একজন শিল্পীর আবেদন মনে রাখা যায় কি না, ভেবে দেখতে পারেন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীগণ।
( #Sneha Bhattacharjee Swarna এর স্ট্যাটাস থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘রঙ্গীত চিন্তা’ বিষয়ক উদ্ধৃতিগুলো নেয়া হয়েছে )
@আকাশ মালিক, ধন্যবাদ ভাই।
@গীতি দি, মনে হয়, বের হয়ে আসতে পারব না। ভাব আমাকে আচ্ছন্ন করতে না পারলে, ভাল লাগে না । ছন্দপতন হয়। আপনার দেয়া লিংক ধরে, গান শুনে আসলাম। শুনতে গিয়ে গান দেখাও হয়ে গেল । কণ্ঠ খুব ভাল, মিষ্টি , বাদ্যযন্ত্রও খুব খারাপ লাগেনি। আলোকসজ্জা বারবার বলছিল, আমাকেও দেখ , আমাকে দেখ। আবারও বলছি, গলা খুবই ভাল, তবুও কোথায় যেন ভাবের ছন্দপতন হয়েছে । হয়ত অভ্যস্ত , তাই।
@ভজনদা, আমার বেলায় ঘটে উল্টোটা। আমি গান শুনতে শুনতে কথা ভুলে যাই, তাল হারিয়ে ফেলি। ভাসতে থাকি; সুরের উপর। কিন্তু মন্তব্যে যে কথাটা বললেন, সেটাই সত্য। ‘আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি’ শোনার চেয়ে পড়লেই বরং বেশী করে ষ্পর্শ করে যায় । আর এখন তো মানুষ গান শুনতে যায় না, দেখতে যায়। উৎকট আলো, অঙ্গভঙ্গী ইত্যাদির সাথে কথা জুড়ে দিয়ে বাজার মাৎ করে দেবার আয়োজন। কথা হলো, গানে এত হৈচৈ ভাল লাগে না । হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানগুলোও শুনলে মনে হয় চুপচাপ শুনি, আর শুনতে শুনতেই শুরু হয় দহন । অথচ গণ সঙ্গীত । নিজেকে খুব পুরনো মনে হয়।
একজন মানুষের নিজের সৃষ্টি,তা তিনি যেমন বানিয়েছেন তেমনই থাকা উচিৎ।প্রতি মানুষের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য।নিজ সৃষ্টি কে বিকৃত হতে দেখলে সকলেরই কষ্ট হয়।সে কত আশা,উদ্যম,উৎসাহ নিয়ে কোনো কিছু তৈরি করে অন্যের কাছে পৌঁছে দেবে বলে এবং সেটাকে তেমন রূপেই গ্রহণ করবে সবাই এই ভেবে।
আমি বোধহয় পুরনো পন্থী, আমার অথেন্টিক ওয়ানই বেটার লাগে। রিমিক্স এ ঠিক সেই স্বাদ-গন্ধ খুঁজে পাই না
@তানবীরা, আমার মনে হয়, ভাবের ব্যাপারটা বড় একটা কারণ । ইদানিং গান শোনার চেয়ে দেখার বিষয় উঠছে । কেউ কেউ বলতেই পারেন, ভাল লাগছে। কারও সুখ চোখে, কারও সুখ মনে।
আমি এখন রবীন্দ্রসংগীত শোনার চেয়ে পড়াতেই বেশি আনন্দ পাই। কথা ও ভাবের মাধুর্য সুরে্র ও গায়কীর আবরণে কত গানে যে হারিয়ে গেছে তা বলাই বাহুল্য। তার উপরে শুরু হয়েছে মিডিয়ার পক্ষপাতিত্ব ও নিজেদের পছন্দের মানুষদের শিল্পী করে তোলার অশোভন প্রয়াস। এ দলবাজি বাংলাদেশে ও পশ্চিমবংগে সমান তালে পাল্লা দিয়ে চলেছে। বাংলাদেশে কিছু চ্যানেলে মালিকপক্ষের মানুষদের উৎকট উপস্থিতিতে কান ও চোখ উভয়ই ঝালাপালা। এ কোলাহলের মধ্যেও রবীন্দ্রসংগীত চর্চা কিন্তু থেমে নেই। বলা যায় রবীন্দ্রনাথ বেঁচে আছেন রবীন্দ্রসংগীতের মধ্যেই। রবীন্দ্র সৃষ্টির অন্যান্য বিষয়গুলো যেমন অনবদ্য ছোট গল্প, কিছু অসাধারণ উপন্যাস ও প্রবন্ধ, অসংখ্য অসাধারণ কবিতা কিন্তু গৌণভাবে উত্তর প্রজন্মের কাছে উপস্থাপিত হচ্ছে।
আর সে জন্যই কবি ও সাহিত্যিক সুনীল গংগোপাধ্যায়কে মৃত্যুর কিছুদিন আগে প্রশ্ন করলে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুর পরে কতদিন মানুষ তাঁকে মনে রাখবে যে ব্যাপারে তিনি সন্দিহান। কেননা, তিনি গান লিখে যাননি। রবীন্দ্রনাথের মতো এত বড় প্রতিভাকেই এখন গানের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে হচ্ছে মানুষের মনে।
রবি ঠাকুরের গান নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা জোর করে বন্ধ করে রাখা যাবে না। অনেকেই মনে করেন রবীন্দ্রনাথের কিছু কিছু গানের বাণী এত চমৎকার কিন্তু গাইতে হয় বড় ধীর লয়ে। কেউ কেউ শুনতে শুনতে ঘুমিয়েও পড়েন। কোন কোন শিল্পী সেগুলোকে দ্রুত তাল ও রক গানের মতো প্রচন্ড শব্দের ককটেল বানিয়ে দ্রুম দ্রুম ছাড়ছেন। ‘রক উইথ রবীন্দ্রনাথ’ নামে একটা সিডি-ও শুনতে হলো সেদিন। আমি বিশুদ্ধবাদী নই বলেই হয়তো – কিছু কিছু গান ভালোও লেগেছে। আমি গান বুঝিনা মোটেও। তাই আমার বক্তব্যে কারো রবীন্দ্রানুভূতিতে আঘাত লাগলে আমাকে রাবীন্দ্রিক ভাবে বকাঝকা করতে পারেন। তবুও কলম চলুক।
@ প্রদীপ দেব, মূল লেখায়, অল্প কথায় বলার চেষ্টা করা হয়েছে, ঘুম ঘুম আর দ্রুম দ্রুমের পেছনে কাজ করে উৎপাদন কাঠামো। রক কারও কারও ভাল লাগতেই পারে, সে ভাল লাগা নিয়ে কারও আপত্তি থাকা ঠিক নয়। কিন্তু রক বানিয়ে দিয়ে তাকে রবীন্দ্র সঙ্গীত বললে যে বড় অ-ন্যায় ( যা অতীতের ন্যায় নয় ) হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্র সঙ্গীত না বলে, বলা উচিত রক , গীতিকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
স্বপনদা, ধন্যবাদ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের এ কবিপক্ষে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে এ প্রবন্ধটির জন্য। রবীন্দ্রনাথ সুরের ব্যাপারে কতটা খুঁত খুতে ছিলেন সে নিয়ে আমার একটি লেখা আছে তা থেকে কিছু অংশ উল্লেখ করলামঃ
” (৬)
স্নান ঘরে যাঁরা গুনগুন করে গান করেন, তাঁদের নিরাশা হবার কোন কারণ নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করে গেছেন যে, তিনি অনেক গান স্নান ঘরে তৈরী করেছেন। এমনি একটি গান,” বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে আমার প্রাণে।” প্রেম পর্বের এ গানটি নিয়ে তিনি ১০ জুলাই ১৮৯৩ সালে শাহজাদপুরে বসে লিখেছিলেন,”
‘বড়ো বেদনার মতো’ গানের সুরটা ঠিক হয়তো মজলিসি বৈঠকি নয়। … এ-সব গান যেন একটু নিরালায় গাবার মতো। সুরটা যে মন্দ হয়েছে এমন আমার বিশ্বাস নয়, এমন-কি ভালো হয়েছে বললে খুব বেশি অত্যুক্তি হয় না। ও গানটা আমি নাবার ঘরে অনেক দিন একটু একটু করে সুরের সঙ্গে তৈরি করেছিলুম—নাবার ঘরে গান তৈরি করবার ভারি কতকগুলি সুবিধা আছে। প্রথমত নিরালা, দ্বিতীয়ত অন্য কোনো কর্তব্যের কোনো দাবি থাকে না–মাথায় এক-টিন জল ঢেলে পাঁচ মিনিট গুন্ গুন্ করলে কর্তব্যজ্ঞানে বিশেষ আঘাত লাগে না–সব চেয়ে সুবিধা হচ্ছে কোনো দর্শকসম্ভাবনা-মাত্র না থাকাতে সমস্ত মন খুলে মুখভঙ্গি করা যায়। মুখভঙ্গি না করলে গান তৈরি করবার পুরো অবস্থা কিছুতেই আসে না। ওটা কিনা ঠিক যুক্তিতর্কের কাজ নয়, নিছক ক্ষিপ্তভাব। এ গানটা আমি এখনও সর্বদা গেয়ে থাকি–আজ প্রাতঃকালেও অনেকক্ষণ গুন্ গুন্ করেছি, গাইতে গাইতে গভীর একটা ভাবোন্মাদও জন্মায়। অতএব এটা যে আমার একটা প্রিয় গান সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। ( ছিন্নপত্রাবলী)
কিন্তু স্নানের ঘরে গানে সুর লাগালেও এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে, রবীন্দ্রনাথ স্বরলিপি নিয়ে উদাসীন ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে গানের স্বরলিপি নিয়ে কতটা খুঁত খুঁতে ছিলেন তা নিয়ে একটি ঘটনা আছে।বন্ধু দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায় একবার কবিকে একটি গানের স্বরলিপি নিয়ে একটু দ্বিমত পোষন করে কবিকে লিখলেন; গানটি পূজা পর্বের সে বিখ্যাত গান “নিভৃত প্রাণের দেবতা”। গানটির “ভক্ত, সেথায় খোলো দ্বার” এর স্বরলিপি এভাবে করা আছেঃ
“ভ ক্ ত সে ৹ থা ৹ য়্ খো লো দ্বা ৹ ৹ র্”
দিলীপকুমার রায় একটু দ্বিমত করলে কবি লিখলেন (১০ নভেম্বর ১৯২৯), “ভক্ত। সেথায়। খোলো দ্বা। ০০র্। –এইরকম ভাগে কোনো দোষ নেই। কিন্তু তুমি যে ভাগ করেছিলে। র ০০। এটা চলে না; যেহেতু ‘র’ হসন্ত বর্ণ, ওর পরে স্বরবর্ণ নেই, অতএব টানব কাকে”।
এটি ছোট একটি উদাহরণ মাত্র; রবীন্দ্রসংগীতজ্ঞ হিসেবে যাঁরা নমস্য, সবাই রবিঠাকুরের সুর ও বানীর শুদ্ধতাকে মূল্য দিয়েছেন; তাই পরবর্তীতেও যাঁরা রবীন্দ্রসংগীতচর্চা করেন, সবাইকে দ্ধাবোধের সাথেই তা অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়।
এতদসত্বেও রবীন্দ্রনাথ নিজেই গানের শিল্পীদের গায়কীর একটু স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। এ নিয়ে বন্ধুপুত্র দিলীপকুমার রায়ের একটি গান প্রসংগেই রবীন্দ্রনাথ সাহানাদেবীকে লিখেছিলেন এপ্রিল ৪, ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে। গানটি “ হে ক্ষণিকের অতিথি”। রবীন্দ্রনাথে লিখেছেন,
“সেদিন মণ্টুর গান অনেকগুলি ও অনেকক্ষণ ধরে শুনেছি।… “হে ক্ষণিকের অতিথি” মণ্টু সেদিন গেয়েছিল-সুরের মধ্যে কোনও পরিবর্তন ঘটায় নি। তার মধ্যে ও যে ধাক্কা লাগিয়েছিল সেটাতে গানের ভাবের চাইতে ভঙ্গ… তার মধ্যে ও যে ধাক্কা লাগিয়েছিল সেটাতে গানের ভাবের চাইতে ভঙ্গি প্রবল হয়ে উঠেছিল। দেখলুম শ্রোতাদের ভালো লাগল। গানের প্রকাশ সম্বন্ধে গায়কের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অগত্যা মানতেই হবে–অর্থাৎ গানের দ্বারা গায়ক নিজের অনুমোদিত বিশেষ ভাবের ব্যাখ্যা করে–যে ব্যাখ্যা রচয়িতার অন্তরের সঙ্গে না মিলতেও পারে–গায়ক তো গ্রামোফোন নয়।” এখানে উল্লেখ্য,মণ্টু দিলীপ কুমার রায়ের ডাকনাম।
তাই রবীন্দ্রনাথের গানে কবি ছাড়া অপর কেউ সুরারোপ করবেন এমনতরো কথা কল্পনা করাও ছিল তখন দুঃসাধ্য। পঙ্কজকুমার মল্লিক-ই একমাত্র সুরকার, যাঁকে রবীন্দ্রনাথ অনুমতি দিয়েছিলেন তাঁর কথায় সুর সংযোজন করে গান গাওয়ার। পঙ্কজকুমার মল্লিক দুঃসাহসিক সেই ঝুঁকি নিয়েছিলেন, চূড়ান্ত সার্থকও হয়েছিলেন। ১৯৩৭-এ ‘মুক্তি’ ছবিতে ছিল পঙ্কজ মল্লিকের সংগীত পরিচালনায় ও স্বকণ্ঠে প্রথম গাওয়া ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটি। কবির অনেক কবিতায় সুরারোপ করেছেন পঙ্কজ মল্লিক, কিন্তু রেকর্ডে তার সবটা সংরক্ষিত হয়নি। তাই রবীন্দ্রনাথের গানের সাথে সংশ্লিষ্ট গুনী মানুষদেরকেও খুঁজে দেখার সময় হয়েছে।
ধন্যবাদ ভজনদা। আপনার লেখা থেকে অনেক মূল্যবান তথ্য জানতে পারলাম। বইটা সংগ্রহ করার ইচ্ছে জানিয়ে রাখলাম।
দু একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার হতো। শ্যামলতা ব্যানার্জির ‘মায়াবন বিহারিণী’ শুনতে কেমন লাগে? আধুনিক বাদ্যযন্ত্রে ভিন্ন আঙ্গীকে বা অন্য সুরে গান আমার তো খারাপ লাগেনা।
স্যরি, শিল্পীর নামটা সমলতা আচার্য হবে।
রোদ্দুর রায় শুনে দেখতে পারেন। ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য ।
@ স্বপন মাঝি ,
না, রোদ্দুর রায় ভাল পাইনে তবে Shreya Ghoshal | Nachiketaর পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে ভাল পাই।
@আকাশ মালিক, ভাই আপনার দেয়া লিংক ধরে ওখানে পৌঁছে, প্রায় ভূতলশায়ী হয়ে যাবার অবস্থা হয়েছিল। গানের ভাব ধরতে না পারলে; যা হয়, তার মৃদু প্রকাশ ঘটেছে গানে ; উৎকট প্রকাশ নাচে । আপনার ভাল লাগাকে আহত করার জন্য কিন্তু কথাগুলো বলিনি। তবে ধন্যবাদ দিচ্ছি, লিংকটা দেয়ার জন্য। জানা ছিল না, জানা হল।
স্বপন , আমার দেয়া লিংকটি শুনে মন্তব্য আশা করছি।
শ্যামলতা না, সোমলতা মালিক ভাই, আধুনিক বাদ্যযন্ত্রে ভিন্ন আঙ্গিকে আমার ও খারাপ লাগেনা। লিংকটি ঠিকমত দিয়ে থাকতে পারলে শুনে দেখুন। সোমলতার। অপূর্ব ।
https://www.youtube.com/watch?v=AxNzXDBU-wE&feature=em-share_video_user
@ গীতা দাস,
শিল্পীর নামটা সাথে সাথেই ঠিক করে দিয়েছিলাম দিদি । মন্তব্য এডিট করার সুযোগটা অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে রাখলে ভাল হত । অনেক সময় আমরা নিজের অজান্তে অনিচ্ছায় ভুল করে ফেলি । এদিকে এখনও মন্তব্যে ছবি বা স্ক্রিনশট বা ইউ টিউব ভিডিও দেয়ার কোন সুযোগ দেখছিনা । এক্সপ্লোরার দিয়ে খুললে লেখার শিরোনাম আসেনা তাই নির্দিষ্ট কোন লেখা খুঁজে বের করতে অসুবিধে হচ্ছে ।
যাক, আমার মনে হয় জগতের কোন কিছুকেই আমরা নিয়ম রীতির বাঁধনে আটকে রাখতে পারবোনা, যতই হারিয়ে যাওয়ার শোকে কাতর হই না কেন । আমিও একসময় এসব ঢং ভং যান্ত্রীক কান্ডকে যন্ত্রণা মনে করতাম । র্যাপ শুনলে মাথায় আগুন চড়ে যেত । আমার চিন্তায় ভাবনায় বিবর্তন পরিবর্তনের জন্যে মুক্তমনায় অভিজিৎ দা’র বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ক কিছু লেখা দায়ী । অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে, আজকের এই আধুনিক যন্ত্রের এই সুর এই তাল লয় শুনলে রবীন্দ্রনাথ কী মনে করতেন । আমি বলবো রবি ভালই পেতেন, খুশী হতেন, যতক্ষণ না গানের কথা ঠিক থেকেছে ।
‘জাগরনে যায় বিভাবরী’ এই গানটা একজন নুতন প্রজন্মের লোক (হয়তো কিশোর হবে) শুনে মন্তব্যে জানতে চেয়েছে ‘বিভাবরী’ শব্দের অর্থ কী ? আরেকজন জানিয়ে দিয়েছে এর অর্থ ‘রাত’ । এভাবেই রবীন্দ্রনাথ পৌছুবেন সকল যুগের সকল বাঙ্গালীর হৃদয় ও মানসে ।
স্বপন মাঝি, আপনার এই লেখার প্রতি কোন প্রকারের অশ্রদ্ধা বা আপনার মত ও ভাবনার সাথে আমার কোন দ্বিমত নেই । আলচনার ক্ষেত্রটি তৈ্রি করে দেয়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ । রবিকে নিয়ে লেখা চলুক আলোচনা সমালোচনা, গবেষণা হউক, তাতে আমরাই উপকৃত হবো ।
দিদি, এবার গানটা শুনা যাক-
জাগরনে যায় বিভাবরী
ছেলেমেয়ের বদৌলতে গানটি আগেই শোনা। আমারও আপনার মত অবস্থা ছিল। রবীন্দ্রসংগীত আগের এবং এখানকার কারও আধুনিকায়ণ করা , এখন দুটোই আমার চলে। তবে এখন সব ব্যান্ড সহ্য করতে পারি না। মাথা ধরে যায়।
স্বপন দারুণ একটা ইস্যু উপস্থাপন করেছে। দুয়েক বছর আগেও আমি স্বপনের দলে ছিলাম । এখন রবীন্দ্র নাথের একই গান বিভিন্ন ঢংযে শুনি আর উপভোগ করি।
রবীন্দ্রনাথ নিজেও অনেক বাউল গান ও বিদেশী গানের থেকে সুর ও কথা ধার করেছিলেন। গানের ক্ষেত্রে এটা কিন্তু অন্যায় নয় বলে জানি।
রবীন্দ্রনাথ অন্যের গানের কথায় সুর দিয়ে, রবীন্দ্র সঙ্গীত নির্মাণ করে যাননি, করেছেন নিজের গানে। সে কাজ যে কোন শিল্পীই করতে পারেন। আর করতে চাইলে, নিজেই একখানা গান লিখে করে ফেলা ভাল নয় কি? ধন্যবাদ, আপনার মন্তব্যের জন্য।
রবীন্দ্রনাথ অন্য সুরে গীত হলেও এটি কিন্তু প্রমান করছে যে, রবীন্দ্রনাথ এখনো প্রাসঙ্গিক।
সুর-অসুর প্রসংগে টিভিতে নচিকেতার একটি সাক্ষাৎকার দেখেছিলাম। তিনি বিশভারতীর সমালোচনা করে বলছিলেন, তারা এতো বছর ধরে যে ভাবে “বাধ ভেঙে দাও” গানটি গাইছে, তাতে আর যাই হোক, বাধ ভাংগা যায় না!
“রঞ্জনা আমি আর আসবো না” সিনেমায় কবির সুমন খুব সাহসের সংগে নতুন ঢংগে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রে রবীন্দ্র সংগীত করেছেন। এটি খুব প্রসংসাও পেয়েছে। ইতিবাচক নতুনকে মেনে নেওয়াই ভাল। জীর্ণ পুরাতনকে ভাসিয়ে দেওয়া রবী ঠাকুরেরই শিক্ষা।
সপন দা, অনেকদিন পর আপনার লেখা দেখলাম। আরো লিখুন।
—
[ফনেটিকে সব বানান ঠিকমত আসছে না। টাইপোর জন্য দু:খিত। ]
বিপ্লবদা, ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য । নতুন আঙ্গিকে গাওয়ার যে দাবী, তা হয়ত সময়ের ডাক । কিন্তু সেই সময় আর এ সময় তো এক কথা নয় । এই দুই সময়ের ( কথাগুলো সেই সময়ের , সুর এই সময়ের ) মিলনে যে জগাখিচুড়ি হচ্ছে, কারও কারও ভাল লাগতেই পারে, আবার নাও লাগতে পারে । আমার ভাল না লাগা নিয়ে একটুখানি আলাপ। এইটুকু। রোদ্দুর রায়ের ? শুনে , দেখতে পারেন । আবারও ধন্যবাদ কিছু তথ্য দিয়ে আলোচনা করার জন্য ।
স্বপন দা, সেটাই। রবী বুড়োর গান কখন কিভাবে গীত হবে, সেটি সময়ই ঠিক করে দেবে। সেখানে আমাদের মতো সৌখিন শ্রোতার মতামত ইচ্ছে নিরপেক্ষ। চলুক।