হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে মদ্যমাতাল উখিয়া। অসহায় করুণ নয়নে চতুর্দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে সে। হজম করার চেষ্টা করছে অতীতটাকে। নিজেই জানেনা, কঠিন এক বাস্তবতাকে আবিস্কার করে ফেলেছে সে। মদ হজম করা যায়, কখনো কখনো কোন বিষাক্ত জিনিসকেও হজম করা যায় কিন্তু কোন বিষাক্ত অতীতকে কোনভাবেই হজম করা যায়না। আর এজন্যই তাকে প্রতিনিয়ত হজম করতে হচ্ছে শক্তিশালী ইনজেকশান আর ওষুধ।
অসহায় দৃষ্টি নিয়ে অনেক দূর চলে যায় উখিয়া। আনিশার সেই সহজ সরল চাউনি আর অসম্ভব বিশ্বাসের মধ্যে এখনো সে মাঝে মাঝে দ্রবীভূত হয়ে যায়। সে চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে আনিশার দিকে।
আনিশা তার দিকে চেয়ে থাকা মাতাল তরুণকে জিজ্ঞেস করে, বলতো সোনা, তুমি মদ্যমাতাল কেন?
উখিয়াঃ কই মাতাল, তোমাকে দেখলে তো সব মাতলামি চলে যায়, হা হা হা।
আনিশাঃ দুষ্টামি করবানা। তোমার মাতলামি কিন্তু আর ভাল্লাগেনা। এসব না ছাড়লে কিন্তু আর কথাই বলবনা।
জেদ ধরে আনিশা, উপায়ান্তর না দেখে এক সময় কথা দিতে বাধ্য হয় উখিয়া। বলে, হুম ছেড়ে দিলাম।
হ্যাঁ, সত্যিই সে মদ ছেড়ে দিয়েছিলো, আস্তে আস্তে নিজেকে আবিস্কার করেছিলো আরেকটা শক্তিশালী নেশার মধ্যে। যে নেশা তাকে মদ ভুলতে সাহায্য করেছিলো। সে নেশা আনিশা।
সে তলিয়ে যায় গভীর এক অনুভূতিতে। আনিশার প্রতি গভীর প্রেমের অনুভূতি তাকে প্রতিনিয়ত যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল সেই স্বপ্নকে আজ আড়াল করেছে অস্পষ্ট এক দেয়াল। অন্ধকারে সেই দেয়াল হাতড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে অসুস্থ দুর্বল উখিয়া।
কিছুক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করলো সে। কিন্তু ঘুম আসছে না। আবার অতীতে ফিরে যায় সে। আনিশার কোলে মাথা দিয়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলছে সে, আর নেশাগ্রস্ত মানুষের মতই কোন যুক্তির আশ্রয় না নিয়েই মনে প্রাণে বিশ্বাস করছে, আসলেই ভালবাসা দিয়ে পৃথিবী জয় করা যায়।
সেই নেশায় ছিল কত অনুভূতি, কত স্বপ্ন, কত বাস্তবতা। উখিয়া আজ সেই নেশায় কোনভাবেই প্রবেশ করতে পারছেনা। উখিয়ার একটা অভ্যাস ছিল সে যেকোন বিশেষ দিবসে আনিশাকে ডায়রি উপহার দিত। ২০১৫ সালের ৮ মার্চে ও একটা ডায়রি দিয়েছিল। সে ডায়রিতে অনেককিছু লিখেছিল আনিশা।
হঠাৎ মনে পড়লো সে ডায়রির কথা। আনিশার মৃত্যুর পর তার বাড়ি থেকে সেটা এনে দিয়েছিল অনিমেষ। বালিশের নিচ থেকে ডায়রিটা বের করল সে। তারপর পড়তে লাগল আনিশার লেখা-
৮ মার্চ ২০১৫
অধিকার হচ্ছে কোহিনূরের মতো একখণ্ড হীরক। ওটা পুরুষের আয়ত্তে আছে। পুরুষ ওটাকে সযত্নে খুব শক্তভাবে বাক্সবন্দি করে রাখছে। সে বাক্সের চতুর্দিকে জ্বলন্ত অঙ্গারের ব্যবস্থা করেছে পুরুষ। এজন্য অধিকার পেতে হলে নারীকে আগে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়। ফলে প্রতিবছর ৮ মার্চ অগ্নিপরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু কোন নারীকে সেই অগ্নিপরীক্ষা দিতে দেখা যায়না বলেই অধিকার নামক সেই হীরক খণ্ডটি নারীর আয়ত্তে আসছেনা। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত পদার্থ হচ্ছে হীরক। এজন্যই অধিকার নামক হীরককে সমভাবে বণ্টন করা সম্ভব হচ্ছেনা। তাই নারী সমাজকে সমস্ত হীরক খণ্ডটি উদ্ধার করতে হবে। তারপর নারী পুরুষের মধ্যে সেটা সমভাবে বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। ওটা অর্ধেক করে পুরুষের কাছ থেকে আদায় করা যত কঠিন, তারচেয়ে সম্পূর্ণটা উদ্ধার করা বেশি সহজ। কেননা পুরুষ এর একতিল পরিমাণও লোভ সামলাতে নারাজ।
নারীর অধিকার আন্দোলনের মূল কারণ হচ্ছে, নারী কোন না কোনভাবে নির্যাতিত। নির্যাতনকারী যে পুরুষটি তার অস্তিত্বকে দিনের পর দিন অস্তিত্ববান করছে সেই পুরুষটি ও তো কোন না কোন মায়ের সন্তান। কোন মায়ের দুগ্ধ পান করেই তো তার কলিজা আজ বড় হয়েছে। সেই মা যদি দুগ্ধ পান করানোর সাথে সাথে সন্তানকে মনুষ্যত্বের শিক্ষা দিতেন তাহলে তো সমাজে কোন বখাটে, ধর্ষক জন্ম নিতো না। বুঝতে হবে নারী নির্যাতন করছেনা শুধু পুরুষ, নারী নির্যাতন করছে পুরুষতন্ত্র। আর এই পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখছে নারী এবং পুরুষ উভয়েই। তাই আগে নারীকে সচেতন হতে হবে। পুরুষতন্ত্র শিকড় থেকে নারীকে দুর্বল করে তোলে। যেকোন নির্যাতনের দৃশ্য দেখলেই বোঝা যায়, নির্যাতনকারী পুরুষটি সবল আর নির্যাতিত নারীটি দুর্বল। যদি প্রশ্ন করা হয়, নারীটি কেন দুর্বল, আর পুরুষটি কেন সবল? তাহলে তার উত্তর হবে এটাও অন্য কোন নির্যাতনের ফসল। কেননা যেকোন নেতিবাচক কাজের ফলাফল হয় নেতিবাচক।
আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত নারী যে নির্যাতনগুলির শিকার সেগুলো হলঃ
১) কোন মেয়ে স্কুলে যাবার পথে তাকে বখাটে উত্যক্ত করছে।
২) কোন মেয়েকে বাল্য বিবাহ দেওয়া হচ্ছে।
৩) ছোট থেকেই মেয়েকে ঘরে আবদ্ধ করার চেষ্টা চালানো হয়।
৪) মেয়েকে রান্নাঘরের কাজ করতে বাধ্য করা হয়।
৫) বিনোদন, আড্ডা থেকে মেয়েকে অনেক দূরে রাখা হয়।
৬) পরিবার ও সমাজের যে কোন নিয়ম মানতে মেয়েকে বাধ্য করা হয়।
৭) যেকোন অন্যায় সহ্য করার জন্য ধৈর্য ধরতে মেয়েকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
8) কোন ছেলে দ্বারা কোন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়।
৯) মেয়েকে শিক্ষিত হতে এবং মেয়ের যেকোন ধরনের যোগ্যতা অর্জনে বাবা-মায়ের সহযোগিতার ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হয়।
১০) পিতার সম্পত্তির ক্ষেত্রে মেয়েকে বঞ্চিত বা বৈষম্য করা হয়।
১১) যৌতুক প্রথার প্রচলন করে নারীর মর্যাদা ক্ষুন্ন করা হয়।
১২) সন্তান জন্মদানে নারীকে বাধ্য করা হয়।
১৩) সৌন্দর্য এবং ইজ্জত নারীর মাথার উপর চাপিয়ে দিয়ে নারীকে পণ্য বানানোর চেষ্টা চালানো হয়।
১৪) সৌন্দর্যকে বেশি মূল্যায়ন করে নারীর যোগ্যতার অবমূল্যায়ন করে নারী সমাজকে দুর্বল করা হয়।
শিকড় কেটে ফেলার জন্য নারী ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে থাকে। আর এই দুর্বলতাকে কাটিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তিলে তিলে বাধাগ্রস্ত হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি জোগানো নারী সমাজের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। এজন্য নারীর চিন্তাকে বিকশিত করা সবার আগে দরকার। সে যদি বুঝতে পারে সে নির্যাতিত তাহলে তার সমাধানও খুজবে। মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার জন্য নারীকেই তার রাস্তা খুজে বের করতে হবে।
৯ মার্চ ২০১৫
আজ আমার জন্মদিন। উখিয়া কেক নিয়ে আমাদের বাসায় আসে। আমার অনেক বন্ধু বান্ধবীও আসে। কেক কাটার পর আমরা সবাই বাইরে বেড়াতে যাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক্ষণ আডডা দেওয়ার পর সবাই যার যার বাসায় রওনা হই। পথে কয়েকটা বখাটে ছেলে আমার পথ রোধ করে। আমি সাথে সাথে একটা অটোরিক্সায় উঠে বাসায় পৌছাই। আমি নিজের মতো করে বসবাস করতে পারছিনা। এ বিষয়গুলোর সমাধান কি? আনিশা তোমাকে কৌশলী হতে হবে। তোমার রক্ষা তোমাকেই করতে হবে।
২৬ মার্চ ২০১৫
আজ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু স্বাধীনতার কোন গন্ধও আমার শরীরে লাগছেনা। গতকাল একটা কাপড়ের দোকানে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে লাল-সবুজ শাড়ি কিনতে গিয়েছিলাম। একা গিয়েছিলাম, কারণ আমি ভেবেছিলাম, সেখানে আমার নিরাপত্তার কোন প্রশ্ন আসেনা। কিন্তু দোকানদার আমার দিকে যেভাবে তাকালো তাতে মনে হল, তার সামনে কাঁচা তেতুলের ভান্ডার দেখে সে জ্বিব সামলাতে পারছেনা। আমাকে প্রশ্ন করল, আপা, আপনি কি বিবাহিত? আমি বললাম, হ্যা, আমি দুই সন্তানের মা। অথঃপর মিথ্যা কথা বলে তাকে বোঝাতে হল, আমি কাঁচা তেতুল না, বাসি তেতুল। ফলে সে তার জ্বিভ সামলানোর চেষ্টা করছে। আমি উপায়ান্তর না দেখে দামদর না করেই কোন রকমে একটা শাড়ি কিনে চলে আসি। আজ সারাদিনে আমি সে দৃশ্য একবারও ভুলতে পারিনি। আজ কি আমি একবারও স্বাধীন ছিলাম? ধন্য পুরুষের জগৎ !
সম্পুর্ণ ডায়রি লিখা হয়নি। অনেক পাতা খালি রয়ে গেছে। লেখাগুলো পড়ে উখিয়ার চোখ দিয়ে যে অনর্গল জল প্রবাহিত হচ্ছে সেটা খেয়াল করেনি সে। হঠৎ আরেকটা যন্ত্রণা যোগ হল তার যন্ত্রণাকাতর মানসিকতার মধ্যে। একটা তাগিদ অনুভব করল সে। এ ডায়রিটা লিখে শেষ করতে হবে। হাসপাতালে বসেই একটা কলম যোগাড় করল সে, আনিশার অসমাপ্ত লেখা সমাপ্ত করার জন্য।
২৯ এপ্রিল ২০১৫
১৪ এপ্রিল ২০১৫, ১লা বৈশাখ ১৪২২ বাংলা। নববর্ষ উদযাপনের জন্য আমি আনিশাকে নিয়ে বেড়াতে বের হই। আর এ জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আমাদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। কেননা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে নববর্ষ পালন করা, সেটা এক অন্যরকম অনুভুতি। আমরা অনেক বন্ধু বান্ধব মিলে সেখানে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎ একদল ছেলে এসে আমাদের সাথের মেয়ে গুলোর উপর ঝাপিয়ে পড়ে। আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখতে পাই, ছেলেগুলো মেয়েদের পরিহিত জামা কাপড় টেনে খুলে ফেলছে। আম রা বাধা দিতে যাই। ওরা আমাদের উপর চড়াও হয়। এতে আহত হই আমি এবং আমার বন্ধুরা। এত মানুষর ভিড়ের মধ্যে কোন মেয়ের কোন কান্নার শব্দ শুনা যাচ্ছেনা। তাছাড়া ছেলেদের একদল ভুভু বাজাচ্ছে। আরেক দল মেয়েগুলির উপর হামলে পড়ছে। তখন আমি খেয়াল করলে বুঝতে পারি এই ঘটনাগুলি পৃথক পৃথক জায়গায় হচ্ছে এবং এটা পরিকল্পিত। বারবার মেয়েগুলিকে রক্ষা করার চেষ্টা করছি। হঠাৎ চেয়ে দেখি আনিশা নেই। ভিতরটা অজানা আশংকায় ধুক ধুক করছে। পাগলের মতো চতুর্দিক খুঁজতে থাকি। কিন্তু কোথাও দেখতে পাইনা। সারাদিন সারারাত খুঁজে যখন পাইনি, তখন পাগলের মতো হয়ে যাই আমি। যেখানে পাবার আসা ছিল সেখানেই যোগাযোগ করেছি। কোন লাভ হয়নি। অসহায় আমি ঘরে ফিরে আসি। অসহ্য যন্ত্রণায় আবার মদ খুজি। হঠাৎ বন্ধু অনিমেষ জানায়, আনিশাকে পাওয়া গেছে। মাতাল আমি মাথায় খুব সুস্থি অনুভব করি। তখন পাগলের মতো ছুটেছি আনিশার কাছে। সারা বাড়ি ভরা মানুষ গমগম করছিল। কাউকেই তোয়াক্কা না করে দ্রুত ঢুুকে পড়ি ভিড়ের মধ্যে। জীবনের সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হই তখন। আমার সামনে ছিল আনিশার মরদেহ। বিশ্বাস করিনা বলে চেতনা হারাই। আর কিছু মনে নেই আমার। অনেক রাতে জ্ঞান ফিরলে দেখি পাশে বন্ধু অনিমেষকে। তাকে শুধু একটা প্রশ্ন করি, এমন হল কেন রে…….?
অনিমেষ শুধু বলেছিল, পরদিন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসবে, তখন দেখা যাবে।
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এসেছিল। রিপোর্টে লেখা ছিল গনধর্ষণ। আসামি ধরা পড়লে তাদের জবানবন্দী থেকে জানা যায়, এগারজন আনিশাকে ধর্ষণ করেছে।
আজ নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। আনিশা প্রায়ই বলতো, প্রতিদিন যে মেয়েগুলোকে ধর্ষণ করা হচ্ছে, সে মেয়েগুলির দোষ কি? পুরুষ মেয়েদেরকে কখনো তেতুল বানায়, কখনো মধু বানায়। নারী নিয়ে পুরুষের এত মাথা ব্যাথা কেন? যে আট নয় বছরের শিশুগুলিকে ধর্ষণ করা হয়, এরাও কি তেতুল, এরাও কি মধু? ছিঃ, ঘৃণা করি এই পুরুষতন্ত্রকে।
আমি হাসতাম তার কথায়। ভাবতাম ওটা ওর আবেগের কথা, দুদিন পরে ঠিক হয়ে যাবে। আজ বুঝতে পারছি, সে ঘৃণা কতটুকু গভীর ছিল।
প্রতিটি মেয়েই কোন না কোন পুরুষের সন্তান, প্রতিটি মেয়েই কোন না কোন ভাইয়ের বোন, প্রতিটি মেয়েই কোন না কোন স্বামীর স্ত্রী, প্রতিটি মেয়েই কোন না কোন প্রেমিকের প্রেমিকা। তবু নারীর উপর এত অবিচার কেন? নাকি নারীকে শুধু ভোগের জন্য আমরা আপন ভাবি? আমি আজ আমার ধর্ষিতা প্রেমিকার জন্য ঘৃণা করি আমাকে, ঘৃণা করি আমার পৌরুষত্বকে। যে পৌরুষত্ব কোন মেয়ের ধর্ষক হতে পারে, যে পৌরুষত্ব মেয়ের হত্যাকারী হতে পারে। আমি পারিনি আনিশা, তোমাকে বাঁচাতে, তোমার মুক্তি দিতে। আমি এক ব্যার্থ প্রেমিক, এক ঘৃণিত প্রেমিক।
হঠাৎ দরজার শব্দে চেতনা ফিরে আসে উখিয়ার। দেখে অনিমেষ রুমে ঢুকছে। লেখা বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পড়ে উখিয়া।
অনিমেষ : উখিয়া…..
উখিয়া : বল
অনিমেষ : কেমন লাগছে?
উখিয়া: বুঝতে পারছিনা, বোধ হয় আর মদও হজম হবেনা।
অনিমেষ : ভেবেছিস কিছু?
উখিয়া: নাহ (দীর্ঘশ্বাস)
অনিমেষ :আগে ভাল হয়ে নে, তারপর ভাববি।
উখিয়া: আমি আর ভাল হবনা।
অনিমেষ : কেন? ডাক্তার কি কিছু বলেছে?
উখিয়া: হুম, মারাত্বক নেশায় কিডনি, পাকস্থলি, ফুসফুস সবকিছুর অবস্থাই খারাপ।
অনিমেষ : আনিশার হতাকারীদের বিচার হবে। ওদের মৃত্যুদন্ড হবেই।
বিদ্যুৎ চমকের মতো উঠে বসে উখিয়া,তারপর হঠাৎ নীরব হয়ে যায়। খুব ধীর গতিতে বলে, ওরা দোষ করেছে, ওদের শাস্তি হবে। ওরা হত্যা করেছে, ওদের মৃত্যুদন্ড হবে। আমি কি দোষ করেছি? আমার শাস্তি হচ্ছে কেন? আনিশার কি দোষ ছিল? তার মৃত্যুদন্ড হল কেন? জানিস অনিমেষ, এ ধর্ষণ শুধু আনিশাকে না, এ ধর্ষণ সকল নারীকে। এ ধর্ষণ নারীর সকল আপনজনকে, এ ধর্ষণ সুস্থ সমাজকে, সচেতন জাতিকে, সুন্দর একটা রাষ্ট্রকে। আনিশাকে হত্যা করা মানে আমাকে হত্যা করা,আমার জীবনকে বিষাক্ত করে দেওয়া। হু হু করে কেঁদে ফেলে উখিয়া।
বাইরে ঝড়ো বৃষ্টি হচ্ছে। অনিমেষ দেখতে পায় উখিয়ার চোখের জল আর বাইরের বৃষ্টির জল একাকার হয়ে গেছে।
অধিকার হচ্ছে কোহিনূরের মতো একখণ্ড হীরক। ওটা পুরুষের আয়ত্তে আছে। পুরুষ ওটাকে সযত্নে খুব শক্তভাবে বাক্সবন্দি করে রাখছে। সে বাক্সের চতুর্দিকে জ্বলন্ত অঙ্গারের ব্যবস্থা করেছে পুরুষ। এজন্য অধিকার পেতে হলে নারীকে আগে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়। ফলে প্রতিবছর ৮ মার্চ অগ্নিপরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু কোন নারীকে সেই অগ্নিপরীক্ষা দিতে দেখা যায়না বলেই অধিকার নামক সেই হীরক খণ্ডটি নারীর আয়ত্তে আসছেনা। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত পদার্থ হচ্ছে হীরক। এজন্যই অধিকার নামক হীরককে সমভাবে বণ্টন করা সম্ভব হচ্ছেনা। তাই নারী সমাজকে সমস্ত হীরক খণ্ডটি উদ্ধার করতে হবে। তারপর নারী পুরুষের মধ্যে সেটা সমভাবে বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। ওটা অর্ধেক করে পুরুষের কাছ থেকে আদায় করা যত কঠিন, তারচেয়ে সম্পূর্ণটা উদ্ধার করা বেশি সহজ। কেননা পুরুষ এর একতিল পরিমাণও লোভ সামলাতে নারাজ…
অসাধারণ লেখা… মুগ্ধ হলাম লেখক!
১) চলো ভাই ঘণ্টা বাজাই।
২) ঘণ্টা কোথায় ভাই?
১) দেখচ্ছনা উপরে বাঁধা আছে।
২) অত উপরে উঠে বাজাবো কি করে ?
১) সবাইকে ডাকো, একজনের পিঠে আরেক জন উঠে ঘণ্টা বাজাও।
২) ঠিক ব্লেছ ভাই, সবাইকে ডাকি, কিন্তু উপরে উঠে ঘণ্টা বাজাবে কে ?
১) যাদের সাহস আছে।
২) তাহলে আমি উপরে উঠবো।
১) দেখ দেখ আমাদের দিকে কারা আসছেঃ
৩) আমরা এসেছি, ভয় নাই, আমরা তোমাদের সাথে আছি। উঠো, ঘণ্টা বাজাও।
কে একজন ঘণ্টা বাজাতে আরম্ভ করলো।
২) সাবাস পুরুষ, তোমাকে ধন্যবাদ।
কোন রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী কর্মকর্তা না হয়ে রাজনৈতিক দলের কর্মী হয়ে যায় তখন সে দেশের নারীর নিরাপত্তা থাকবে না এটাই স্বাভাবিক । কেবল মাত্র আইনের সঠিক প্রয়োগ ও ন্যায় বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই আপনার উল্লেখিত ১৪ টা নির্যাতনের ১২ টাই বন্ধ করা সম্ভব ।
বাকি দুটার বিষয়ে কিছু করার নেই কারণ নারীর রূপ নারীর শ্রেষ্ঠ অহংকার ।
মেয়েরা যখন হাসি দিয়ে প্রশ্রয় দেয় তখন কিন্তু ব্যাপারটা মিউচ্যুয়াল, ধর্ষন নয়, তাই না?
ধর্ষণ বলতে আমি বুঝি কোন নারীকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে সঙ্গমে বাধ্য করা সেটা যে ভাবেই হোকনা কেন । তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে স্পর্শ করা ও তাকে উদ্দেশ্য করে ভাল আথবা বাজে মন্তব্য ছুড়ে দেওয়া কে বলা অসভ্যতা । আর নারীকে যে কোন পরিস্থিতিতে শারীরিক ও মানসিক ভাবে আঘাত করাকে বলা হয় নির্যাতন । এর প্রত্যেকটিকে আইনের দৃষ্টিতে পুরুষের অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয় এবং এসব অপরাধের ভিন্ন ভিন্ন শাস্তিও রয়েছে ।
নারীর প্রতি কিছু পুরুষের পাশবিক আচরণের একটি অন্যতম কারণ হতে পারে হীনমন্যতাবোধ , নারীর কাছে নিজেকে সঠিক ভাবে উপস্থাপন করার মত স্মার্টনেস এর অভাব থেকেই এর উৎপত্তি ।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি নারীর চোখে মুগ্ধটা সৃষ্টির মধ্যেই রয়েছে সত্যিকার পুরুষ জন্মের স্বার্থকতা ।
” প্রাণ যদি মোর ফিরিয়ে দেয় সেই তুর্কী চাওয়ার মনচোরা
একটি কালো তিলের লাগি বিলিয়েদেব সমরকান্দ ও বোখারা । ” ——- কবি হাফিজ ।
কখনো আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে কিনা জানি না।না এই রকম নোংরা মন নিয়ে বাঁঁচতে হবে।যখন ওই ভদ্রপল্লিতে হয়ে গেছে এই ঘটনা তখন ভাবেন বাকি যায়গায় কি হচ্ছে? যখনি স্কুল কিংবা কলেজের পাশে বাইক নিয়া দাড়িয়ে থাকে মেয়ে দেখলে বাজে কথা শুরু হয়।তখন কিন্তু মেয়েরা ও একটু হাসি দিয়ে তাদের প্রশয় দেয় তখন কিভাবে নিবেন এই বিষয়টা?
তখন সাধারণ মানুষ কিভাবে প্রতিবাদ করবে?
গোটা সমাজটা বিষাক্ত? আমরাই প্রতিবাদ করি আমরাই উস্কানি দেই।
কলম চলুক।
চমৎকার! জেগে উঠার সময় অনেক আগেই হয়েছে। কেবল সময়ের অপেক্ষা।
উখিয়া আর অনিমেষদের সবাইকে নিয়ে জেগে উঠার সময় এসেছে।