মহুয়ার কথা মনে পড়ে…….! গাছে গাছে নতুন পাতা গজাতে শুরু করেছে। বাতাসে বৃষ্টিভেজা আমেজ, কখনো ঝলমলে রোদে ভরপুর প্রকৃতি আবার কখনো মেঘ-বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে! আজ মেঘলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে হঠাৎ-ই ওর কথা মনে হলো। অদ্ভুত ভালোবাসা তৈরি হয়েছিলো মহুয়ার জন্য, আমার মনের এই ছোট দুনিয়াতে। দিনবদলের তালে মহুয়া হারিয়ে গেছে! শুধু শুকনো পাতার মতো মনের জমিন লেপ্টে পড়ে আছে ওর ফেলে যাওয়া টুকরো স্মৃতি।

মহুয়া আমার স্টুডেন্ট ছিলো। ক্লাস ফোরে পড়া এই মেয়েটি যেন বিষন্নতার এক কঠিন উপমা! তার ময়াময় চাহনির ওপাশে কোথায় যেন আমি মেঘলা আকাশ দেখেছিলাম! পড়ানোর প্রথম দিনেই ওর বুদ্ধিমত্তার পরিধিটা টের পেয়েছিলাম ভালো করে। মেয়েটি তার সমসাময়িক অন্যান্য ছেলেমেয়েদের তুলনায় যথেষ্টই বুদ্ধিমতী। বড় চোখদুটিতে সরলতা নেই। তার বদলে রয়েছে এক ধরণের তীক্ষ্ণতা আর তার আড়ালে রয়েছে এক নিঃষ্পাপ বিষন্নতা, যা একই সাথে মেয়েটির প্রতি সহনুভূতির জন্ম দেয় আবার দূরত্বও সৃষ্টি করে।

একদিনের ঘটনা। যথারীতি মহুয়াকে পড়াতে বসেছি। শুরু থেকেই খেয়াল করছি ও অন্যমনষ্ক। বারবার একটা অংক বোঝাতে গিয়েও বোঝাতে পারছিলাম না। এমনসময় বিরক্ত ও রাগত স্বরে বলে বললাম, “তোমার মাথায় একটুও বুদ্ধি নেই। তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না।” হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটি এক মূহুর্তেই মলিন হয়ে গেলো। অসহায় স্বরে বললো, “আমাকে সবাই বকে। আব্বুও বকে। আম্মুর কথা বললেও সবাই বকে। আমার মা থাকলে কখনো বকতো না।” তারপর সুনসান নীরবতা….আগের সপ্রতিভ ভঙ্গিতে ফিরে গিয়ে আবার বলল, “কেন বকো আমাকে? কে বলেছে আমার মাথায় বুদ্ধি নেই? এই যে ঘরের এত কাজ করি, এতে বুদ্ধি লাগে না? এই যে ঘর গুছাই, ঝাঁট দেই, রান্না করি। এ সব কি বুদ্ধি ছাড়া হয়? আমি বুদ্ধু কথাটা ঠিক না। আর কখনো বলবে না।” ওর শেষ প্রগলভতা আমাকে হাসতে বাধ্য করলেও, প্রথম দিকের অসহায় কন্ঠস্বরের মাঝে লুকানো বিষাদ আর নিঃসঙ্গতা আমাকে সেদিন ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিলো।

মহুয়া সম্পর্কে পুরোটুকু জেনেছি আরো পরে। ওকে আমার যে বান্ধবি ঠিক করে দিয়েছিলো, তাকে জিঙ্গেস করে যা জানলাম তার জন্য আমি আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না। ঘটনাটা এরকম- মহুয়ার মা বেঁচে আছেন। ও যখন ২য় শ্রেণীর ছাত্রী তখন ওর মা বাবার ডিভোর্স হয়ে যায়। মহুয়ার বাবা ছিলেন একটা দুশ্চরিত্র মানুষ। এ নিয়ে ওর মার প্রতিবাদ আর পরষ্পরের মধ্যে কথা কাটাকাটির সমাপ্তি ঘটে ডিভোর্সের মাধ্যমে।

“মহুয়াকে কেন ওর মা সাথে নিয়ে গেলো না?”- এই প্রশ্নের উত্তরে বান্ধবি যে শব্দটি উচ্চারণ করেছিলো তা হলো “ঘৃণা”। মহুয়ার বাবার প্রতি তীব্র ঘৃণার কারণেই নাকি ওর মা ওকে অস্বীকার করেছে। বুঝতে পারলাম বাবার প্রতি ঘৃণা আর মায়ের প্রতি একইসাথে করুণা ও অভিমান, এবং সেই সাথে মায়ের ভালোবাসার প্রতি শিশুসুলভ আকুতি মহুয়ার মধ্যে দ্বিমুখী মনোভাবের জন্ম দিয়েছে। পুরো ঘটনাটা জানার পর বাচ্চটার প্রতি সহানুভূতি এবং স্নেহ, আর ওর মা বাবার উপর তীব্র বিতৃষ্ণা আমার সমগ্র অনুভূতিকে দখল করে নিয়েছিলো। মহুয়ার মা বাবা তাদের নিজস্ব সুখের জন্য যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, একবারো ভেবে দেখেন নি, সেই সিদ্ধান্তে তাদের সন্তানের পরবর্তী জীবনের উপর কতটুকু প্রভাব বিস্তার করবে। একবারো ভাবেন নি তাদের সন্তানের অতি সংবেদনশীল কচি মনকে এই সিদ্ধান্ত কতখানি আলোড়িত করবে? তাদের সন্তানের কথা তারা যদি নাই ভাবতেন তবে কেন এই প্রতিকূল পৃথিবীর প্রতিকূল পরিবেশে তাকে আনা হলো- আমি ভেবে পাইনি।

যে সন্তান বাবা মার ভালোবাসার ফসল হয়ে পৃথিবীতে আসে না, আসে শুধুমাত্র বংশরক্ষার তাগিদ থেকে, সে সন্তান তার পরবর্তী জীবনে তার পৃথিবীতে কতটুকু ভালোবাসার স্বাক্ষর রাখতে পারবে?- তা কজন মা বাবারা ভাবেন? একবারো কি তাঁরা ভাবেন না যে, একটি ভঙ্গুর পরিবারের শিশু সন্তানটি তার বাবা মার প্রতি কি রকম মানসিকতা নিয়ে বড় হচ্ছে? ভালো থাকুর মহুয়ারা। মাথা উচু করে বাঁচুক ওর মতো মেয়েরা। এক মহুয়া তুমি প্রতিনিধিত্ব করো শত শত মহুয়াদের ভালো থাকার। তোমাদের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা আর অনেক অনেক শুভ কামনা।