প্রিয় দর্শক-শ্রোতা, আমার নাম রাফিদা আহমেদ বন্যা এবং আমি অ্যামেরিকান অ্যাথিস্টস কে ধন্যবাদ দিতে চাই আমাকে সুযোগ করে দেয়ার জন্য, আপনাদের সবাইকে বলতে, আমার ব্যক্তিগত সংগ্রামের কথা, ধর্মীয় চরমপন্থার বিরুদ্ধে। যদিও আমি এখনো জখম কাটিয়ে উঠার পথে আছি, তারপরও আমার কিছু চিন্তা লেখার চেষ্টা করেছি, আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করার জন্য।
আমার স্বামী, আমার প্রয়াত স্বামী, ডঃ অভিজিৎ রায় এবং আমি বাংলাদেশী-মার্কিন নাগরিক, নাস্তিক এবং পেশায় সফ্টওয়্যার প্রকৌশলী এবং আমরা ইসলামী সন্ত্রাসের সাম্প্রতিক শিকার, বাংলাদেশে। কয়েক সপ্তাহ আগে অভিজিৎ ও আমি আমাদের দেশ, বাংলাদেশে গিয়েছিলাম দেশটির জাতীয় বইমেলায় যোগ দিতে। বইমেলাটি অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায়, প্রতি বছর, পুরোটা ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে, এবং হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন মেলায় আসে। এটি একটি ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান যাতে আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপন করি, ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে। বইমেলায় যোগ দেয়াটা বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমার ও আমার স্বামীর জন্য, কারণ আমরা দুজনেই বাঙালি লেখক ও ব্লগার। আমরা লিখতাম বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদ নিয়ে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, আমার স্বামী লিখেছিল ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে। আমরা ভেবেছিলাম ইতিমধ্যেই অনেক কিছু লেখা হয়ে গেছে ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষাগুলোতে, এই বিষয়ে। সুতরাং আমাদের লক্ষ্য ছিল ছড়িয়ে দেয়া, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের কথা, মৌলবাদ-বিরোধিতার কথা, বাংলাদেশে আমাদের মাতৃভাষায়।
যেখানে আমি মাত্র একটি বই লিখেছিলাম, যার বিষয় ছিল প্রাণের বিবর্তন, আমার স্বামী সেখানে দশটি বই লিখেছিল ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে, গত ১২টি বছর ধরে। সে ছিল আরো সিরিয়াস, আরো সৃষ্টিমুখর লেখক, আমার তুলনায়। এছাড়া সে তৈরি করেছিল মুক্তমনা নামে প্রথম অনলাইন প্লাটফর্ম, ২০০১ সালে, বাংলায়। অভিজিতের বইগুলোর বিষয় ছিল প্রাণের উৎপত্তি, মহাবিশ্ব কিভাবে শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে তা। সে লিখেছিল সমকামিতার পেছনের বিজ্ঞান নিয়ে বই। সে এমনকি খুব সাহিত্যিক একটি বই লিখেছিল যার বিষয় ছিল নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আর্জেন্টিনীয় নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো’র সম্পর্ক।
কিন্তু, তার দুটি বই যাদের শিরোনাম ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ এবং ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ অনেক মনোযোগ কেড়েছিল। একদিকে, এগুলো তাকে অতিমাত্রায় জনপ্রিয় করেছিল প্রগতিশীল তরুণদের মাঝে। অন্যদিকে, এগুলো তার বিরুদ্ধে জাগিয়েছিল ইসলামী মৌলবাদীদের সহিংসতা ও ক্রোধ।
ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখ যখন আমরা অনেক আলোকিত এবং জনাকীর্ণ বইমেলা ছেড়ে আমাদের গাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম, তখন অভিজিৎ এবং আমাকে নির্মমভাবে আক্রমণ করে ইসলামী মৌলবাদীরা। আমাদেরকে বার বার আঘাত করা হয় চাপাতি দিয়ে, রাস্তার ধারে। আমার মাথায় চারটি ছুরিকাঘাতের জখম আছে, আমার বুড়ো আঙুলও কেটে ফেলা হয়েছে। আমার দুই হাতেই বেশকিছু জখম আছে এবং স্নায়ু ও শিরা সারিয়ে তোলার জন্য আমাকে কয়েকবার অপারেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। হ্যাঁ, আমার মাথাও কামাতে হয়েছে, জখমগুলোর চিকিৎসা করার জন্য।
কিন্তু আমার স্বামীর এত ভাগ্য ছিল না। সে ই ছিল আসল লক্ষ্য আততায়ীদের, যারা তাকে কুপিয়ে হত্যা করতে সফল হয়েছে। অনেক দর্শক ছিল বইমেলায়, আশেপাশে, কিন্তু তারা এতই ভীত ছিল যে কেউ আমাদের সাহায্য করেনি। অবশেষে একজন তরুণ ফটোসাংবাদিক পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দ্রুত এসে আমাদেরকে হাসপাতালে নেয় যেখানে অভিজিৎ মারা যায়।
দুর্ভাগ্যজনক যে, বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত ঘটনাটি সম্পর্কে একটি বাক্যও বলেনি। অভিজিৎ ছিল আমার সহ-মুক্তচিন্তক, আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, আমার স্বামী এবং আমার জীবনসঙ্গী। তাকে হত্যা করা হয়েছে কারণ সে লিখেছিল বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ নিয়ে, নাস্তিকতা নিয়ে, এবং লিখেছিল ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে। তার জীবন শেষ হয়েছে, আমার জীবন ওলট পালট হয়ে গেছে।
এই বার্তাটি যখন তৈরি করছি, তখন শুনলাম আরেকজন বাংলাদেশী ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে আজ সকালে, একই ভাবে কুপিয়ে একই কারণে। আমার মনে হয় আপনাদের মাঝেও একজন আছেন, শ্রোতাদের মাঝে, আসিফ মহিউদ্দিন নামে, যাকে কোপানো হয়েছিল একইভাবে, কিন্তু ভাগ্যক্রমে সে বেঁচে গেছে। কিন্তু এমন নয় যে, আমাদের গল্প একেবারে অনন্য। এমন হত্যার ঘটনা ঘটেছে বারংবার, প্রত্যেক দিন, বিশ্বের সবখানে। কিন্তু বাংলাদেশ সবসময় এমন ছিল না। এটা তুলনামূলক নতুন একটি দেশ যা ধর্মনিরপেক্ষতার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ধর্মীয় মৌলবাদ এদেশে ভালভাবে আসন গেড়েছে, অন্য অনেক দেশের মতোই গত কয়েক দশকে যা বিশ্বের অন্যত্রও দেখা যায়। অসংখ্য মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে মুখ খুলে কথা বলার জন্য।
আমরা বারবার দেখেছি যে, কথা মৌলবাদী-দেরকে ভীত করে তোলে। কিন্তু তারা আমাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত করতে পারে, আমাদেরকে নিরব করার চেষ্টা করতে পারে তাদের যত অস্ত্র আছে সব দিয়ে, কিন্তু আমাদেরকে ধ্বংস করতে পারবে না কারণ, প্রিয় সহ-নাস্তিকবৃন্দ, আমাদের কথাকে হত্যা করা সম্ভব নয়। ধন্যবাদ।
একটি মানবিক পৃথিবীর জন্য…
শুভ কামনা।
আজ কতদিন পর মুক্ত মনায় ঢুকে কেমন খালি লাগছে বুঝাতে পারছি না। অনেক ভেবেছি। আর কি হবে। অভিজিৎ নাই। আবার অনেক দিন চেষ্টা করেও ঢূক্তে পারিনি। ধন্যবাদ @ কাজি রাহমান আপনি এমন করে না সাহায্য করলে মুক্ত মনায় ঢুক্তে পারতাম না। প্রবেশ করেই বন্যা আহ্মেদ এর লেখা যারপরনাই মন টাও খারাপ হয়ে গেলো। কত স্মৃতি যে মনে পড়ছে।
অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার এই সংস্কৃতির শেষ কোথায়?
অভিজিতের চরম অন্যায্য হত্যাকান্ডের পরপর একটি মন্তব্য লিখেছিলাম যে বাংলাদেশে তার হত্যার সুষ্ঠু বিচার যে হবে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিৎ। কারণ, পাকিস্তানে যে ব্লাসফেমির অভিযোগে অভিযোগ (অভিযোগ যদি ডাহা মিথ্যাও হয়)এনে কাউকে হত্যা করলে তার বিচার হয় না, সেটি যেমন একটি প্রতিষ্ঠিত অপ্রিয় সত্য, ঠিক ত্দ্রুপ বাংলাদেশেও অভিজিৎদের হত্যার বিচার যে হয় না সেটিও সবার জানা। কঠিন এ নিরাশার মধ্যে একটি ক্ষীণ প্রত্যাশা ছিল, সেটি হ’ল অভিজিতের পাসপোস্টের বিশেষত্বের কারণে বিচার হলে হতেও পারে। তাই বলবো যদি আপনাদের পক্ষে সম্ভব হয় তবে সেদিক থেকে সরকাররের উপর চাপ প্রয়োগের কোন সুযোগ থাকলে সেটি কাজে লাগানোর চেষ্ট করুণ। সেটা অভিজিতের জন্য যতটা না দরকার তার চেয়ে অনেক বেশী দরকার দেশকে রক্ষার জন্য। দেশকে পাকিস্তান হবার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। আমার কোন শত্রুর জন্যও পাকিস্তানের মত দেশ কামনা করি না কখনও।
– পামাআলে
উনার চোখের দিকে চেয়ে সেই অভিশপ্ত রাতের আভাষ পেলাম যেন । সত্যি বিশ্বাস মানুষকে কতটা নৃশংস বানায় ভাবনারও বাইরে ।
আপনাদের দেখে কোন ভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না । সব পারার এই দেশে কিছুই হয় না । আর মুক্তমনা হলে তো কোন কথাই নাই । তখন মুক্তমণারা হয়ে যায় সংখ্যালুঘু , মানুষ নয় এখানে ।
আমার মনে হয় যারা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে তারা কোন খানেই ভালো অবস্থায় নেই । বাংলাদেশে তো এই চর্চার যাবনিপাত হতে চলছে ।
এমন একটা তান্ডবের পরও আপনার ঘুরে দাড়ানোটা আসলে একটা দুর্দান্ত বিষ্ময় । আপনার ঘুরে দাড়িয়ে নতুন করে শুরু করাটা সত্যিই দুর্দান্ত র্টানিং পয়েন্ট । আমার মত ঝিমিয়ে পড়া এক তরুনকে জেঁগে ওঠার প্রচন্ড এক ধাক্কা দিলেন কিছু করার ।
অভি অথবা বন্যা’কে নিয়ে কিছু দেখলে এত কষ্ট লাগে যে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। বন্যার বক্তব্য আগেই শুনেছি তবু এখানে দেবার জন্য ধন্যবাদ। ভবিষ্যতে রেকর্ডগুলো কাজে লাগবে। আমরা সবাই একসাথেই আছি এবং থাকবো।
ধর্মমুক্ত সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে…
আমাদের কলম চলছে, চলবে।
আজ রাফিদা আহমেদ বন্যার ভিডিও দেখে এবং লেখা পড়ে মনে খুব বড় একটা দাগ কেটে গেল। কেবলই মনে হচ্ছে মৌল্বাদীরাই কি এই বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করবে? তাদের শাসনে কি আমাদের চলতে হবে? এই বিশ্বের রাষট্র নায়কেরা কেন এই বিষয়টা গুরুতব দিচ্ছেনা। রাজধ্ররম পালনের সাথে সাথে মানব্ধ্ররমও যথাযথ ভাবে পালন করা উচিত বলে মনে ক্রি। গত ১০.০৪.২০১৫ তারিখে বন্যা আহ্মেদের লেখায় আমি কিছু মন্তব্য করেছিলাম, এখন বলতে চাই যে, রাষ্ট্র এই ব্যাপারে সঠিক পদক্ষে নিক।
This courage and determination will go a long way.
অনুবাদটি আরো পরিশীলিত হলে ভালো হতো।
বন্যাদির প্রত্যয়টুকু সাহস যোগাচ্ছে। জয় হোক মুক্তমনা!
বেশ কিছুদিন আগেই ভিডিওটা দেখেছি। বন্যাদি’র দৃঢ় মনোবলের কথা আর কী’ই বা বলবো। শুধু ভাবছি আর দেখছি, অভিজিৎ রায় হত্যা ইস্যুটি কীভাবে মেইন্সট্রিম থেকে একটু একটু করে নেই হয়ে যাচ্ছে। হত্যার বিচার পাওয়ার নিশ্চয়তা একইভাবে ম্রিয়মাণ। জানিনা, ভবিষ্যতে কি হবে, কিন্তু এখন বাংলাদেশে এই হত্যার এই অপরাধের সুষ্ঠু বিচারের আশা আর করিনা।
অনুবাদটিও চমৎকার হয়েছে। ভিডিওটি দেখেছিলাম! বন্যাদি, এখন কেমন আছেন জানিনা…ভালো নেই সেটা বুঝি। ভরসা দেবো আশা দেবো এমন সামর্থ্য নেই, দুঃসাহসও নেই। কাজ শেষে বাড়ি যখন ফিরি, অভিজিৎ দা সামনে এসে দাঁড়ান! দুঃসহ স্মৃতি গুলো থেকে নিজেকে আড়াল করতে কৃত্রিম ব্যস্ততা কখনো কখনো তৈরী করতে হয় আমাকে। তারপরেও আছেন অধ্যাপক অজয় রায়! কোনভাবেই কি তাঁর মুখটাকে ভুলে তাকতে পারি আমি….! তাঁর সাথে যে অনেক স্মৃতি আছে আমার! তবে ঐ যে শেষে বললেন, “কিন্তু আমাদেরকে ধ্বংস করতে পারবে না কারণ, প্রিয় সহ-নাস্তিকবৃন্দ, আমাদের কথাকে হত্যা করা সম্ভব নয়।” মুক্তমত প্রকাশের স্বাধীনতা, সত্যপ্রকাশ ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ বিনির্মানে অবিচল থাকবো সেটা বলতে পারি। চলতে পথে ভুলভ্রান্তি হবে, সেটা শুধরে নেবার জন্যে এইযে মুক্তমনার ছাঁয়ায় যে আসর বসে সে আসরে থাকবো আপনাদের পাশে। চিন্তা ও বিশ্লেষনের ব্যবচ্ছেদে তা শানিত হবে, পাবে পূর্নতা। এভাবেই বিজয়ী হবেন আমাদের অভিজিৎ দা। ভালো থাকুন বলবো না আর, থাকুন যুদ্ধের ময়দানে আপনার সহযোদ্ধাদের সাথে। বিজয়ী আপনাকে হতে হবে।
আমিই অভিজিৎ……………………
ভিডিওটি আগেই দেখেছিলাম এবং আমার ফেইসবুকে টেগও করেছিলাম। আজ আবার বাংলা ট্রান্সকিপটি পড়লাম আর মনকে পুড়ালাম। এ ছাড়া যে আমাদের আর কিছুই করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা নেই!
শোকে সহস্র কোটিবার আবারো শোকাতুর হলাম।
জয়তু বন্যা ।
জয় আমাদের অনিবার্য,ইতিহাস বার বার এই সাক্ষী-ই দেয়।
জয় বাংলা।