গ্রীষ্মকালে বিনা পয়সায় আনন্দ নেয়ার সহজতম জায়গা হলো লেকের পাড়। টরন্টো শহরের থেকে যে দিকেই যাই না কেনো, লেকের সংস্পর্শ পাওয়া যাবেই। আর এই বিনা পয়সার আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেই বা কে? আমার মতো মধ্যবিত্ত মানুষের অভাব নেই টরন্টো শহরে। লং উইকএন্ডই হোক আর রেগুলার উইকএন্ডই হোক, লেকের পাড়ে গেলেই দেখা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ বিভিন্ন উপায়ে আনন্দ করছে। কেউ মাছ ধরছে, কেউ সাঁতার কাটছে, কেউ ঘুড়ি উড়াচ্ছে, কেউ দৌঁড়াচ্ছে, কেউ বারবিকিউ করছে, কেউ ছবি তুলছে, আনন্দ করার উপাদানের কোনো অভাব যেনো নাই। সবার মধ্যেই একটা ফূর্তি ফূর্তি ভাব।

এরকমই এক গ্রীষ্মের বিকালে খুব মাছ ধরতে ইচ্ছা হলো আমার। তবে সেটা কানাডার টরন্টোতে নয়, আমেরিকার মায়ামি শহরের উপ শহর পেমব্রোক পাইনে। বছরের অধিকাংশ সময়ই ওখানে গরম থাকে। মজার ব্যাপার হলো ওই শহরের অবস্থান টরন্টো শহরের ঠিক বিপরীত। ওখানে চারিপাশে শুধু সমুদ্র। বাসা থেকে বিশ মিনিট ব্যবধানে ছিলো হলিউড বীচ। প্রাই বেড়াতে যেতাম ওখানে। কারণ ওই একটাই। বিনা পয়সায় বীচের বাতাসে গা ভাসানো। তবে মাছ ধরতে বীচে নয়, গিয়েছিলাম ছোট্ট একটা পার্কে । সেই পার্কে ছিল কৃত্রিম এক লেক। অসংখ্য মাছ সাঁতার কাটছে সেখানে। মাছ ধরার বন্দোবস্তও ছিলো খুব ভালো। পিয়ার করা ছিলো। সেখানে বসে বসেই মাছ ধরা যেতো। কিন্ত, সমস্যা হল ইচ্ছা হলেও পার্কের নির্ধারিত সময়ের বাইরে থাকা যেতো না।

সন্ধ্যা সাড়ে আটটা ছিল পার্ক বন্ধের সময়। ঠিক আটটা থেকে শুরু হতো পার্ক কর্মকর্তাদের দফায় দফায় জানানি দেয়া। ঠিক সাড়ে আঁটটায় পার্কের গেট বন্ধ। ইছছা থাকা সত্ত্বেও আর একটুকু থাকতে পারতাম না। তবে হ্যাঁ, কোনো পুলিশ ওখানে পাহারায় ছিলো না। ছোট্ট একটা সাইনবোর্ডে শুধু লেখা ছিলো, “নিয়ম ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে আইন গত ব্যবস্থা নেয়া হবে।“

এখানে মোটামুটি সবাই আইন মেনে চলে। ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। তবে, সেটা শতকরা হারে আমাদের দেশের তুলনায় অনেক কম।
ক্যানাডায় এখন চলছে বসন্ত। সাদা চাদরে ঢাকা বরফ গলে উন্মোচন করেছে ঘাসের চাদর। প্রতিটি গাছের কুড়ি বের হওয়া শুরু হয়েছে। এখনও লেকের পারে যাবার সময় আসেনি। তাতে কি? বসন্তের হাওয়া যে আজ সবার মনে-প্রানে দোল খাচ্ছে।

প্রবাসী জীবনে দেশের সাথে একাত্ম হয়ে দেশের আনন্দ নিতে পারাটা যেন এক ভাগ্যের ব্যাপার। সেরকমই এক ঘটনা ঘটলো আজ। নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। একেতো উইকএন্ড, তার উপর বাংলাদেশের সাথে পাকিস্থানের ক্রিকেট খেলা। বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য $১২০ ডলার খরচ করে একটা ডিজিটাল বক্স কিনেছিলাম। সেইটার বদৌলতে আজ সরাসরি বাংলাদেশ থেকে ক্রিকেট খেলার সম্প্রচার দেখতে পাচ্ছি। আনন্দ রাখার যেন জায়গা নাই। মনে হচ্ছিলো আমি যেন স্টেডিয়ামেরই একজন দর্শক। ওদের সাথে তালে তাল মিলিয়ে আমিও যেন চিৎকার করছি, আনন্দে আত্মহারা হয়ে লাফ দিচ্ছি।

ঠিক এরকম একটি মুহূর্তে হঠাৎ করে একটা কথা মনে হলো। আমার মতো কোটি কোটি বাংলাদেশি আজ এই খেলা উপভোগ করছে। স্টেডিয়াম কানায় কানায় ভরা মানুষ দিয়ে। কত সুন্দর একতাবদ্ধ হয়ে সারি সারি তরুণ, যুবক থেকে শুরু করে সব বয়সীরা খেলা দেখছে। যদিও মেয়েদের সংখ্যা কম, তবুও কিছু মেয়ে সাহস করে খেলা দেখতে এসেছে স্টেডিয়ামে। ধন্যবাদ জানাই তাদেরকে। অবশ্যই মেয়েরা আসবে এবং স্টেডিয়ামে পুরুষের পাশাপাশি বসে খেলা দেখবে। আমি মেয়ে বলে আমাকে বাসায় বসে টেলিভিশনের মাধ্যমে খেলা দেখতে হবে, আর তুমি ছেলে বলে স্টেডিয়ামে যেয়ে সরাসরি খেলা দেখতে পারবে, এ বৈষম্যটাকে সমাজ থেকে দূর করতে হবে। এ দায়িত্ব আমাদের সবারই।

আজ সবাই যেন একই আশায় প্রহর গুনছে। সবাই জীবন বাজি রেখেই যেনো বাংলাদেশের বিজয় চাচ্ছে। আমার ভাইয়েরা আজ কতো প্রানবন্ত। তাদের চোখে মুখে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। আজ কেন নেই সেই হায়েনার চাহনি?

পহেলা বৈশাখের ঘটনায় আমরা মর্মাহত, আমরা লজ্জিত। এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে, কিন্তু আগে আমরা এরকম দিনের আলোর মতো পরিষ্কার চিত্র দেখতে পাই নাই। ভাসা ভাসা কিছু খবর পেতাম দৈনন্দিন পত্রিকা আর লোকমুখে। আজ ইন্টারনেটকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছিনা। কে, কখন, কীভাবে এবং কার উপর চড়াও হয়েছে, সবই আমরা দেখতে পাচ্ছি।

এখানেই কি এর শেষ? এই ঘটনার বিচার না হলে এ যে চলতেই থাকবে? একদিকে যেমন তাদের বিচার দরকার, তেমনি অন্যদিকে তাদের উন্নত মননশীল চর্চার বন্দোবস্ত করতে হবে। তাদেরকে কাজে লাগাতে হবে। তাদেরকে ব্যস্ত রাখতে হবে বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কর্মসূচীতে বাধ্যতামূলক অংশগ্রহনের মাধমে। সেই সাথে বিনোদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

আমাদের তরুণ সমাজ পারে না, এ রকম কোনো কাজ নাই। আজও আমার চোখে ভেসে উঠে সেই ধ্বংসস্তূপের দৃশ্য, সেই উদ্ধারের কাজে হাত বাড়ানো সব তরুণেরা। পদ্দা নদীতে নৌকাডুবি হলে কিম্বা ঘূর্ণিঝড়ে ঘরবাড়ি হারা দূর্গতদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় কারা? এই আমাদের তরুণ সমাজ। আরও কি আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে যে, তোমরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তোমরাই পারো একটা নতুন সমাজ তৈরি করতে।

তবে আমাদের সমস্যা কোথায়?

আমারতো মনে হয় সমস্যা আমাদের মাথার উপরের ছাতা। যে ছাতার নিচে আমরা একতাবদ্ধ হয়ে বসবাস করছি সেই ছাতার লাঠিটা কেনো যেনো মজবুত না। লাঠিটা যাদের উপর ভর করে দাড়িয়ে আছে তাদের সহস্র প্রলোভনে সে আজ টলোমলো। দীর্ঘদিন ধরে তাকে শান দেয়া হয় না। ফলে লোহার মতো শক্ত মেরুদণ্ড নিয়ে আজ সে দাঁড়াতে পারছেনা।

আজ বুঝতে পারছি কেনো ছোট্ট একটি সাইন বোর্ডই এ সমস্ত দেশের নিয়ম মানার জন্য যথেষ্ট।

এ সমস্ত দেশের মানুষেরাতো আমাদের মতই রক্তমাংসে গড়া মানুষ। এরাও আমাদের মত আনন্দ উচ্ছ্বাস করে, বিনোদন করে, সারা বছর কাজ করে বছরের একটা সময় দূরে কোথাও অবকাশে যায়। শুধু ওদের ধরনটা আমাদের থেকে ভিন্ন। এরাও যে সুযোগ পেলে সুযোগের অপব্যবহার করে তার প্রমাণও আছে। কিন্তু পরিমান অনেক কম। কারণ ওরা যে ছাতার নিচে বসবাস করছে সেই ছাতাটা অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী। ছাতার লাঠিটাকে ওরা শত বছর ধরে আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে লোহার মত শক্ত করেছে। সেই লাঠি তার মেরুদণ্ড কখনও বাঁকা করে না। লাঠি জানে তার প্রতিটি কাজের জন্য তাকে জবাব দিতে হবে তারই ছায়ায় যারা আশ্রিত।