মহাত্মা গান্ধী একদা এক কালী মন্দিরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেদিন পশুবলি হচ্ছিল কালী মন্দিরে। রক্তের স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল রাস্তা। এত অজস্র রক্ত দেখে গান্ধিজী শিউড়ে উঠলেন। বললেন, এত রক্ত কেন? তাঁর সাথে আরেকজন লোক ছিল। সে বলল, মন্দিরে পশুবলি হচ্ছে ত, এসব পশুর রক্ত। গান্ধীজির মন কেঁদে উঠল অসহায় পশুগুলির জন্য। তিনি বললেন, আহা, হত্যা করার সময় না জানি পশুগুলি কেমন বোধ করে!নিরীহ পশু হত্যা করলে যে দেবতা খুশি হয় সে দেবতা কেমন দেবতা? অন্য লোকটি বলল, উচ্চস্বরে ঢোল বাজানো হয়, আর পাঁঠাগুলি ভেঁ-ভেঁ করে চিল্লাতে থাকে। ঢোলের বাজনার তলে হারিয়ে যায় পাঁঠাগুলির চিৎকার চেঁচামেচি; ঢোলের বাজনার জন্য ব্যথা পাওয়ার অবকাশই পায় না পাঁঠারা।
বলির পশুদের আর্তচিৎকার, ওদের তাজা রক্তের স্রোত ধর্মান্ধদের মনে উল্লাস সৃষ্টি করে। পশুরা মরণযন্ত্রণায় যত বেশি চিৎকার করে, যত বেশি রক্তে ভেসে যায় ধরণী, যত বেশি ধড়ফড় করে ওদের যাতনাকাতর অসহায় শরীর তত বেশি মজা পায় ধার্মিক, তত বেশি পূণ্য হয় তাদের।

এমনই একটি ঘটনা ঘটে গেল টিএসসি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেইটে। পহেলা বৈশাখের দিনে বর্ষবরণের উৎসবে আসা কয়েকটি মেয়ের বস্ত্রহরণ করে নেয় ৩০-৩৫ জন যুবকের এক বা একাধিক সংঘবদ্ধ দল। মাঝখানে কয়েকটি মেয়ের কাপড়-চোপড় খুলে নিচ্ছে বেশ কয়েকটি লোক। অসভ্য কথা বলছে সেই মেয়েদেরকে। তাদের শরীরের নাজুক ব্যক্তিগত অংশে ঘৃণ্যভাবে হাত দিচ্ছে। আর তা দেখছে চারিদিক থেকে ঘিরে থাকা অনেকগুলো লোক। তারা এই অসভ্যতার ছবি তুলছে, ভিডিও করছে। আর কেউ কেউ ভুভুজেলা বাজাচ্ছে যাতে আক্রান্ত মেয়েদের আর্তচিৎকার বাইরে থেকে কেউ শুনতে না পায়। ভুভুজেলার বাজনায় নেকড়েদের নেকড়েমিতে উল্লাস আরো বেড়েছে হয়ত। পরে জানতে পারলাম, আওয়ামীলীগের সোনার ছেলেরা ঘটিয়েছে এই বীরত্বপূর্ণ ঘটনা। আজ প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজো কোনো কথা বললেন না এই ব্যাপারে। গণমাধ্যমে আজো বললেন না, এই নেকড়েদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে, বললেন না- এই নেকড়েমির বিচার করা হবে। নির্লিপ্ত পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে ত কোনো অভিযোগ কখনোই থাকে না তাদের।

কোথাও কোনো মেয়ে ধর্ষিত হলে অনেকেই বলে, মেয়েটির পোশাকই দায়ী ধর্ষণের জন্য, ধর্ষকটি নয়। মেয়েদের উত্তেজক ও খোলামেলা পোশাক নাকি পুরুষদের উদবুদ্ধ করে ধর্ষণ করতে। অনেক নারীও এমন কথা বলে থাকে। পোশাকই যদি ধর্ষণের জন্য দায়ী হয় তাহলে ত প্রতিদিন হাজার হাজার পুরুষের ধর্ষিত হবার কথা। হাজার হাজার পুরুষ রাস্তাঘাটে খালি গায়ে ঘুরে বেড়ায়। উত্তেজক পোষাকের জন্য কোনো মেয়ে কেন তাদের গিয়ে ধর্ষণ করে না? বেদ্বীন ও ইহুদী নছরার দেশগুলিতে মেয়েরা গরমকালে কাপড় পরে না বললেই চলে। এই রকম পোষাকে মেয়েরা স্বাচ্ছন্দে ও স্বাধীনভাবে সর্বত্র চলাফেরা করে। কই কেউ ত এসে তাদের ধর্ষণ করে না! এসব দেশে ন্যুড বীচ রয়েছে অনেক। কখনো শুনিনি এসব দেশের কোনো বীচে কোনো মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে। কোনোদিন শুনিনি, কোনো ন্যুড বীচে কোনো ন্যুড মেয়ের উপর হামলে পড়েছে কোনো পুরুষ। বেদ্বীন দেশের রাস্তায়, ভীড়ে, বা কোনো জায়গায় মেয়েদের সংক্ষিপ্ত পোষাক বা শরীর নিয়ে কোনো রকমের বাজে মন্তব্য করতে শুনিনি কোনো বিদেশীর মুখে।এসব দেশেও বাজে কথা বাঙালি বা অন্য কোনো দেশী মমিনরা বলে। প্রকাশ্যে উত্তক্ত করতে পারে না আইনের কারণে। আড়ালে আড়ালে বাজে কথা বলে। ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতার পোশাক নয়, ধর্ষকের মানসিকতা দায়ী।

আমার পরিচিত এক মেয়ে স্বাভাবিক পোশাক-আশাক পরে। কিন্তু বাংলাদেশে গেলে সে বোরকা পরে। কারণ রাস্তায় নাকি তাকে ছেলেরা অশালীন কথা বলেছিল তার শরীর নিয়ে। তার পর থেকে দেশে গেলে সে বোরকা পরে রাস্তায় বের হয়।বেদ্বীন দেশে যে পোশাক পরে মেয়েটি নিরাপদ নিজের মাতৃভূমিতে সেই একই পোশাক প’রে সে রাস্তায় অপমানের শিকার হয়। সেদিন আমি একজনের বাসায় গিয়েছিলাম স্লিভলেস জামা পরে। সে আমাকে পরে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেছে, বাসায় তার স্বামী আছে, তার ছেলে বড় হচ্ছে এই রকম অবস্থায় আমার উচিত হয়নি হাতাকাটা জামা প’রে তাদের বাসায় যাওয়া। আমার তাকে জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করছিল, মেয়েদের হাত দেখলেই কি তার ছেলে ও স্বামীর হামলে পড়তে ইচ্ছে করে? রাস্তায় বের হলেই ত সংক্ষিপ্ত পোশাকের অনেক মেয়ে দেখা যায়। তাদের উপর কি ওরা হামলে পড়ে? পরে আর জিগ্যেস করিনি। এদের সঙ্গে কথা বলাই বৃথা।
সেদিনের ঘটনায় আক্রমণকারী প্রতিটি পুরুষই ছিল মমিন। আক্রান্ত মেয়েগুলিকে মমিন হায়েনাদের যৌন লালসার থাবা থেকে বাঁচাতে প্রাণ বাজি রেখে এগিয়ে এসেছিল তিন মালাউন যুবক লিটন নন্দী, অমিত দে ও সুমন সেনগুপ্ত।। একবার ভেবে দেখুন, ঘটনা যদি উলটো হতো আজ বাংলাদেশের পরিস্থিতি কী হতো?

যে মেয়েগুলির উপর নির্যাতন হলো কী হবে এই মেয়েদের? এরা কীভাবে স্বাভাবিক হবে? আক্রমণকারী জন্তুগুলির মুখে দেখলাম পিশাচের হাসি। কুকুরের মত লকলক করছে ওদের জিহ্বা। অনেকগুলি হায়েনার ধারালো নখ, ঘৃণ্য থাবা এসে পড়ছে এক একটি অসহায় মেয়ের গায়ে। মেয়েটি হাত দিয়ে নিরুপায়ভাবে ঢেকে রাখতে চাইছে তার বুক। এই দৃশ্য দেখছি কি আমরা আজ বাংলার মাটিতে? ৭১’এ পাক হানাদাররা আমাদের ৩০ হাজার নারীর সম্ভ্রমহানী করেছিল। গ্যাংরেইপ করেছিল অনেক নারীকে। স্বাধীন বাংলার মাটিতে প্রকাশ্য দিবালোকে ১৫-২০জন মেয়ের কাপড় খুলে তাদের খুবলানো কি তার চেয়ে জঘন্য ব্যাপার নয়?

বিচার চাইছি না কারুর কাছে। থাবা হত্যার বিচার চাইছি না, হুমায়ুন আজাদ হত্যার বিচার চাইছি না, অভিজিৎ হত্যার বিচার চাইছি না, বাবু হত্যার বিচার চাইছি না, এই মেয়েগুলির সম্ভ্রমহানীর বিচার চাইছি না।। আমরা বিচার চাই আর ক্ষমতার শীর্ষে যারা বসে বসে লুটেপুটে খাচ্ছে তারা আমাদের বিচার চাওয়া দেখে ব্যাপক বিনোদন লাভ করে। শুধু লিটন নন্দী, অমিত দে ও সুমন সেনগুপ্ত এই তিন অসম সাহসী যুবকের প্রতি মনের গভীর থেকে শ্রদ্ধা ও সেল্যুট জানাচ্ছি।