বাংলা গানের পাঁচ দিকপালের একজন হচ্ছেন রজনীকান্ত। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ বা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সমমানের হয়তো তিনি ছিলেন না। কিন্তু, তারপরেও তাঁর অবদান বিশাল। বাংলা গানকে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি।
১৮৬৫ সালে সিরাজগঞ্জে জন্ম তাঁর। দীর্ঘ আয়ু তিনি পান নি। মাত্র পয়তাল্লিশ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। রবীন্দ্র প্রতিভার তীব্র উদ্ভাসন তখনও হয় নি, তুমুল জনপ্রিয় দ্বিজেন্দ্রলাল রঙ্গমঞ্চ কাপাচ্ছেন নাটক আর নাট্যসঙ্গীত দিয়ে। অতুলপ্রসাদ তখন লক্ষ্ণৌ শহরে লচা-ঠুংরির ধাঁচে বাংলা গান বাঁধছেন। আর নজরুলের তখনও আগমন ঘটে নি গানের রঙ্গমঞ্চে। এমনই এক সময়ে ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নীরবে বিদায় নেন রজনীকান্ত। তখনও তাঁর বিধাতার প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই, অভিমান নেই। গলার ক্যান্সারে কথা বন্ধ, তারপরেও অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে ঈশ্বর বন্দনায় লিখছেন,
আগুন জ্বেলে, মন পুড়িয়ে
দেয় গো পাপের খাদ উড়িয়ে
ঝেড়ে-ময়লা-মাটি, করে খাঁটি
স্থান দেয় অভয়-শ্রীচরণে।
রজনীকান্তের জীবিতকালে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিতর্কিত ও নিন্দিত লেখক, দ্বিজেন্দ্রলাল ছিলেন রবীন্দ্র অনুরাগীদের ঘৃণা ও সমালোচনার পাত্র, অতুলপ্রসাদ তাঁর সমাজ বহির্ভূত প্রণয় এবং পরিণয়ের কারণে ছিলেন উপেক্ষিত এবং পরবাসী। একমাত্র রজনীকান্ত ছিলেন অসমালোচিত, অজাতশত্রু, অনিন্দিত। তাঁকে যে সবাই ভালবাসতো একথা তিনি নিজেও লিখে গেছেন।
‘আমাকে দেশসুদ্ধ লোকে কেমন করে যে ভালবাসলে তা বলতে পারি না। আমার মলিন প্রতিভাটুকুর কত যে আদর করলে।’
বিনয়ের কারণে নিজের প্রতিভাকে মলিন ভেবেছেন তিনি। কিন্তু দেশের মানুষের প্রতিভা চিনতে ভুল হয় নি। সেই প্রতিভার কারণেই তাঁর প্রতি এই অফুরন্ত ভালবাসা ছিলো মানুষের।
গানই ছিলো তাঁর প্রাণ। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে থাকার সময়েও ক্রমাগত গান গেয়ে গেছেন তিনি, লিখেছেন, সুর করেছেন। হাসপাতালের শেষ দিনগুলিতে মৃত্যু শয্যায় থাকার সময়ে দেখতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেনও সেই অনুরোধ শুনে। রবীন্দ্রনাথ এলে রজনীকান্ত তাঁকে গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন।
সুস্থ যখন ছিলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান গাইবার সক্ষমতা ছিলো তাঁর। কেউ একজন তাঁর সম্পর্কে লিখে গেছেন, ‘রজনীকান্তের গান গাহিবার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। ক্রমাগত পাঁচ-ছয় ঘণ্টা এক সঙ্গে গান গাহিয়াও তিনি ক্লান্তি বোধ করিতেন না। তন্ময় হইয়া যখন স্বরচিত গান গাহিতেন তখন তিনি আহার-নিদ্রা, জগৎ-সংসার সবই ভুলিয়া যাইতেন, বাহ্যজ্ঞানশূন্য হইতেন।’
কণ্ঠের এই অতিব্যবহারই হয়তো কণ্ঠনালীতে ক্যান্সার জন্ম দেয় তাঁর।
অন্যের গান গাওয়ার চেয়ে স্বরচিত গানের প্রতিই তাঁর আগ্রহটা বেশি ছিলো। সে কারণেই কিশোর বয়স থেকেই নিজে গান বাঁধার চেষ্টা করতেন। তাৎক্ষণিকভাবে গান রচনা করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিলো তাঁর। তাঁকে ভেবেচিন্তে গান লিখতে কেউ দেখে নি কখনো। এ বিষয়ে বাসুমতী পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেন লিখেছেন,
এক রবিবারে রাজশাহীর লাইব্রেরীতে কিসের জন্য যেন একটা সভা হইবার কথা ছিল। রজনী বেলা প্রায় তিনটার সময় অক্ষয়ের বাসায় আসিল। অক্ষয় বলিল, ‘রজনীভায়া, খালি হাতে সভায় যাইবে? একটা গান বাঁধিয়া লও না।’ রজনী যে গান বাঁধিতে পারিত, তাহা আমি জানিতাম না; আমি জানিতাম, সে গান গাহিতেই পারে। আমি বলিলাম, ‘এক ঘণ্টা পরে সভা হইবে, এখন কি গান বাঁধিবার সময় আছে?’ অক্ষয় বলিল, ‘রজনী একটু বসিলেই গান বাঁধিতে পারে।’ রজনী অক্ষয়কে বড় ভক্তি করিত। সে তখন টেবিলের নিকট একখানি চেয়ার টানিয়া লইয়া অল্পক্ষণের জন্য চুপ করিয়া বসিয়া থাকিল। তাহার পরেই কাগজ টানিয়া লইয়া একটা গান লিখিয়া ফেলিল। আমি তো অবাক। গানটা চাহিয়া লইয়া পড়িয়া দেখি, অতি সুন্দর রচনা হইয়াছে। গানটি এখন সর্বজন পরিচিত-
তব চরণ নিম্নে উৎসবময়ী শ্যাম-ধরণী সরসা;
উর্ধ্বে চাহ অগণিত-মণি-রঞ্জিত নভো-নীলাঞ্জনা,
সৌম-মধুর-দিব্যাঙ্গনা শান্ত-কুশল-দরশা।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ছিলেন রজনীকান্তের পরম হিতাকাঙ্ক্ষী। রজনীকান্তের গানগুলো নিয়ে সংকলন প্রকাশের ইচ্ছা ছিলো তাঁর। রজনীকান্ত তখন রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন পেয়ে গেছেন। তারপরেও তাঁর গীত সংকলন প্রকাশের জন্য সংশয়ে ছিলেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। এর মূল কারণ হচ্ছেন সুরেশচন্দ্র সমাজপতি। এই ভদ্রলোক খুব নির্দয় সমালোচক ছিলেন। গান প্রকাশ করলেই এই লোক তাঁর সমালোচনার তীক্ষ্ণ বাণ দিয়ে রজনীকান্তকে ঘায়েল করে ফেলবেন, এই ভয় তাড়া করে ফিরতো অক্ষয়কুমারকে।
এর থেকে পরিত্রাণের আশায় এক বুদ্ধি বের করেন অক্ষয়কুমার। একদিন জলধর সেনকে দিয়ে তাঁর বাড়িতে সমাজপতিকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে আনেন। রজনীকান্তের পরিচয় প্রকাশ না করেই তাঁকে গান গাইতে বসিয়ে দেওয়া হয়। এই এক বসাতেই রজনীকান্ত মুগ্ধ করে ফেলেন সমাজপতিকে। অক্ষয়কুমার সেই ঘটনা নিয়ে লিখেছেন, ‘প্রাতঃকাল কাটিয়া গেল, মধ্যাহ্ণ অতীত হইতে চলিল, সকলে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় সংগীত সুধাপানে আহারের কথাও ভুলিয়া গেলেন। কাহাকেও কিছু করিতে হইল না; সমাজপতি নিজেই গানগুলি পুস্তকাকারে ছাপাইয়া দিবার কথা পাড়িলেন।’
আর এর ফলে প্রত্যন্ত রাজশাহী থেকে রজনীকান্ত এসে পরিচিত হয়ে যান কেন্দ্রভুমি কোলকাতায়।
রজনীকান্তকে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। একটা গানের জন্ম বৃত্তান্ত শোনানোর জন্যই এতো কিছু ভূমিকা।
স্বদেশী আন্দোলনের সময় বহু স্বদেশী গান রচিত হয়েছে। দ্বিজেন্দ্রলাল লিখেছেন অকাতরে, লিখেছেন অতুলপ্রসাদ, লিখেছেন রবীন্দ্রনাথও। রজনীকান্তেরও একটা স্বদেশী গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় সেই সময়। হাটে-মাঠে-ঘাটে, সবখানে এই গান গাওয়া হতো তখন। সেই গানের জনপ্রিয়তা আজতক একই রকমই রয়েছে। গানটি আমাদের সবারই জানা। মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই। এই গানটির সুরকার দুজন। রজনীকান্ত এবং জলধর সেন। জলধর সেনের ভাষ্যেই এই গানের জন্ম কাহিনি শুনি আমরা।
তখন স্বদেশীর বড় ধুম। একদিন মধ্যাহ্ণে একটার সময় আমি ‘বসুমতী’ আপিসে বসিয়া আছি, এমন সময় রজনী এবং শ্রীমান অক্ষয়কুমার সরকার আপিসে আসিয়া উপস্থিত। রজনী সেই দিনই দার্জিলিং মেলে বেলা এগারোটার সময় কলিকাতায় পৌঁছিয়া অক্ষয়কুমারের মেসে উঠিয়াছিল। মেসের ছেলেরা তখন তাহাকে চাপিয়া ধরিয়াছে, একটা গান বাঁধিয়া দিতে হইবে। গানের নামে রজনী পাগল হইয়া যাইত। তখনই গান লিখিতে বসিয়াছে। গানের মুখ ও একটা অন্তর লিখিয়াই সে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে। সকলেই গানের জন্য উৎসুক; সে বলিল – ‘এই তো গান হইয়াছে, চল জলদার ওখানে যাই। একদিকে গান কম্পোজ হউক, আর একদিকে লেখা হউক।’ অক্ষয়কুমার আমাকে গানের কথা বলিলে – রজনী গানটি বাহির করিল। আমি বলিলাম ‘আর কই রজনী?’ সে বলিল, ‘এইটুকু কম্পোজ করিতে দাও, ইহারই মধ্যে বাকিটুকু হইয়া যাবে।’ সত্য সত্যই কম্পোজ আরম্ভ করিতে করিতেই গান শেষ হইয়া গেল। আমরা দুইজনে তখন সুর দিলাম। গান ছাপা আরম্ভ হইল; রজনী ও অক্ষয় ৩০/৪০ খানা গানের কাগজ লইয়া চলিয়া গেল।
সন্ধ্যার সময় … বসিয়া আছি , এমন সময় দূরে গানের শব্দ শুনিতে পাইলাম। গানের দল ক্রমে নিকটবর্তী হইল। তখন আমরা শুনিলাম, ছেলেরা গাহিতেছে, ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই।’ গান শুনিয়া সকলে ধন্য ধন্য করিয়াছিল; তাহার পর ঘাটে মাঠে পথে নৌকায় দেশ-বিদেশে কতজনের মুখে শুনিয়াছি।’
মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
মাথায় তুলে নে রে ভাই;
দীন-দুঃখিনী মা যে তোদের
তার বেশি আর সাধ্য নাই।
ঐ মোটা সুতোর সঙ্গে, মায়ের
অপার স্নেহ দেখতে পাই;
আমরা, এমনি পাষাণ, তাই ফেলে ঐ
পরের দ্বারে ভিক্ষা চাই।
ঐ দুঃখী মায়ের ঘরে, তোদের
সবার প্রচুর অন্ন নাই;
তবু, তাই বেচে কাচ, সাবান, মোজা,
কিনে কল্লি ঘর বোঝাই।
আয়রে আমরা মায়ের নামে
এই প্রতিজ্ঞা করব ভাই;
পরের জিনিস কিনব না, যদি
মায়ের ঘরের জিনিস পাই।
আমার দেশ আমার মা এই দেশমাতা ছেরে পরদেশের গোলামী করব না
ফরিদ ষ্যাঁড় যে কোথা থেকে কেমন করে এসব ইতিহাস তুলে আনেন।
ভালো কাজ করলেও গালি খাওয়া লাগে। কী যে দুনিয়া পড়লো!!
ঘোর কলিকাল!
মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
মাথায় তুলে নে রে ভাই;
দীন-দুঃখিনী মা যে তোদের
তার বেশি আর সাধ্য নাই।
রজনীকান্তের দু’একটা গান শুনেছিলাম বটে, তবে এত কিছু জানতাম না তার ব্যাপারে। বেশ আগ্রহোদ্দীপক চরিত্র, খুবই প্রতিভাবান মানুষ।
দারুন লাগল। লেখার জন্য অফুরন্ত ধন্যবাদ।
আমার ঘরের সোনার ফসল অন্যেরা করে ভোগ
আর আমি এতই নির্বোধ যে তা বুঝতে পারি না…..
কতো অজানারে!
ধন্যবাদ আপনাকে।
ফরিদ ভাইয়ের কলমে ইতিহাস প্রাণ পায়।
ধন্যবাদ ফরিদ ভাই।
কলম চলুক।
রজনীকান্তের গানের এই চরনগুলি মায়ের নামে কি গভীর ভালবাসা দেশের মানুষের প্রতি ফুটে উঠেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
“কিন্তু আজও আমরা সত্যিকারের ঘরের জিনিস পেলাম না “
ফরিদ আহমেদের লেখা এক নিঃশ্বাসে না পড়ে উপায় কি। অনেকদিন পর গানটি শোনার সুযোগ লেখার সাথে বোনাস পেলাম।
কবি ও গীতিকার রজনীকান্ত সেনের সম্বন্ধে ফ্রিদ আহ্মেদ্দের লেখাটি প্রে খুব ভালো লাগলো এবং ক্যেক্টি ঘটনা জানতে পারলাম। রজনীকান্ত সেন মহাশয় আরও বেশী দিন বেঁচে থাকলে বাংলা গানের ঝুলিকে অনেক বেশী সমবৃদ্ধ করতে পারতেন। তার গানের ভাষা সহজ স্রলতার জন্য সবার কাছে স্মাদৃত হন। ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গান্টি সব্দেশীকাতার জন্য বিখ্যাত।
ফরিদ ভাই,
এই গানটি আমার প্রিয় গানগুলির একটি! তবে আমি বিশেষতঃ রজনীকান্তে আক্রান্ত না হইলেও ফরিদীয় সাহিত্যজ্বরে ইদানীং প্রায় কাবু বলিতে পারেন! আ্যন্টি ফরিদ প্যারাসিটামল বাজারে এখনো নাই….! কাজেই আশু জ্বরমুক্তির কোন সম্ভাবনা দেখিতেছি না!…..