অভিকে মেরে ফেলার পর ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলসমুহে খবর দেখা এখন একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। কারন ওই একটাই, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের আপডেট নেওয়া, কখন খুনিরা ধরা পরবে তা দেখা। এই খবর দেখে কোনো দিন হই আশাবাদী, আবার কোনো দিন হই প্রবলভাবে আশাহত।
বাংলাদেশের এই খবর এখন নিয়মিত দেখার সুবাদে একটি খবর দারুণভাবে আমাকে আলোড়িত করে। মনে করিয়ে দেয় পুরনো কিছু স্মৃতি। শরীরের ভিতর একটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, নিজেকে প্রশ্ন করেতে ইচ্ছে হয় আমি কি ২০১৫ সালে জীবিত আছি, নাকি যীশুর জন্মের আগের সময়ে বসবাস করছি? এই আমরা কোথায়, কোনদিকে যাচ্ছি? কে হবে আমাদের আলোর পথের দিশারী? কে আমাদের কুসংস্কার থেকে বের করে আনবে? অভির মতো মানুষকেও তো আমরা ধরে রাখতে পারলাম না।
অনেক বছর আগের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র পড়াশুনা শেষ করেছি। কোথায় চাকুরি-বাকুরি খুঁজবো তার পরিবর্তে বিয়ের পিড়িতে বসতে হলো। এর জন্য অবশ্য আমি নিজেই দায়ী। এক সহপাঠীর সাথে প্রেম করছিলাম তখন আমি। প্রেম করার বদৌলতে যাতে অবাধে মেলামেশা করার সুযোগ না পাই, সে কারণে বিয়ের বন্দোবস্ত নেওয়া হল দুই পরিবারের গোল টেবিল বৈঠক থেকে। তারপর যা হয়, অতি দ্রুত পুত্র সন্তানের মা হলাম। চিন্তাশক্তির বিকাশ তখনো হয় নাই সেভাবে। পাছে লোকে কিছু বলে এই ভয়েই সারাক্ষণ থাকতাম। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস ছিলো না বললেই চলে। এর কারণ ওই একটাই, জ্ঞানের স্বল্পতা, অভিজ্ঞতার অভাব। বই পড়ার প্রতি অনাগ্রহ ছিলো তখন। যতোটুকু জ্ঞান আহরণ করেছি তা মনে হয় ঐ পড়ুয়া ছেলেটার সাথে বসবাস করার সৌভাগ্যে। যাইহোক, ব্যক্তি-স্বাধিনতার ক্ষেত্রে সচেতন ছিলাম প্রচণ্ডভাবে। সব কুসংস্কারকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবো এটিই ছিলো প্রতিজ্ঞা। কিন্তু, সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার আমাদের পরিবারে ঢুকিয়ে দেবার ইচ্ছার কমতি ছিলো না দুই পরিবারের কারো মধ্যেই। ছেলের কপালে কালো টিপ না পরানও, গলায় তাবিজ না ঝুলানো, ছেলের ডাক নাম বাংলায় নির্বাচন করা, ইত্যাদি নানা কারনে অসন্তুষ্ট করেছি বাড়ির মুরুব্বিদের।
এক দিনের ঘটনা, ছেলের বয়স তখনো চল্লিশ দিন হয় নাই, শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি এলাম। তখন মাগরিবের আযান হচ্ছে, ছেলে আমার শুরু করলো কান্না। কোনো ভাবেই তাকে থামাতে পারছিনা। আমার আম্মা কোনো কথা না বলে কতোগুলো শুকনো মরিচ ছেলের পেটে ঘষে তারপর সেগুলোকে পোড়ালেন। পোড়ানোর সময় মরিচগুলো অনেক শব্দ করছিলো। সেই শব্দ শুনে এসে আমাকে বললেন যে, তোমার ছেলের উপর অনেকের কুনজর পড়েছিলো। রাগ হয়ে আমাকে বললেন, “তোমাদের বলি সন্ধ্যার সময় বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বাইরে বের হবেনা, এ সময় শয়তান ঘোরাঘুরি করে চারিদিকে। আমার কথা তো শুনবে না তোমরা।“ কোন কথা না বলে মা যা বললেন তাই করলাম। ছেলের সুস্থতাই ছিলো তখন একমাত্র কাম্য, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চাওয়ার মতো সাহস বা মনোবল কোনোটাই তখন ছিলো না।
কিছুদিন আগে চাকুরীর সুবাদে ‘Health and Safety‘ -র উপরে একটা course করতে গিয়ে জেনেছি কখন, কেনো এবং কীভাবে আমাদের খাদ্যে বিষক্রিয়া হয়। এর সাথে সন্ধ্যায় বা সকালে বের হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
এতোসব ঘটনা মনে পড়লো আমাদের বহু আকংখিত পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন দেখে। এই সেতু নির্মাণে সিংহভাগ অর্থদাতা দেশ চীন। বিশ্বে চীনের অর্থনৈতিক শক্তিশালী অবস্থানে সম্পর্কে কে না জানে। জ্ঞানবিজ্ঞানের এমন কোনো দিক নাই যেখানে চীন পিছিয়ে আছে। অথচ সেই তারাই কী করলো?
দুটি গরু, দুটি ছাগল, এবং দুটি মোরগের জবাই করা রক্ত পদ্মা নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে এই সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করতে হলো তাদের। আর আমরাও সেটা মহা উৎসবে পালন করলাম। না করেই বা উপায় কী? আত্মনির্ভরশীল না হওয়া পর্যন্ত এরকম চলতেই থাকবে। মনে মনে ভাবছি দেশটি আত্মনির্ভরশীল না হলে কী হবে, এই সেতুর বদৌলতে কতজন তো আত্মনির্ভরশীল হয়ে যাবে। কেউ বাড়ির মালিক হবে, কেউ জমির মালিক হবে, কেউ নিজস্ব ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হবে, কেউ বা সন্তানকে পড়াতে বিদেশে পাঠাবে।
ঘটনার কি আর শেষ আছে? এইতো গতকাল ঘটলো আরও এক ঘটনা, নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দে হিন্দু ধর্মালম্বীদের পূণ্য স্নান। ভিড়ের চাপে পদদলিত হয়ে ১০ জন নিহত হল। খবর যখন দেখছিলাম, মনে হল পানির থেকে মানুষের সংখ্যাই বেশি। বিশুদ্ধতার প্রশ্ন এখানে নিরর্থক। যদিও পানি ছিল কচুরিপানায় নিমজ্জিত এবং কাদামাটি যুক্ত ঘোলাটে, তবুও পুণ্য স্নান যদি স্বর্গে যাবার নিশ্চয়তা দেয়, তাহলে সেখানে সামান্য কচুরিপানা আর ঘোলাটে পানি কোনো বিষয়ই না। কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস এখানে এতোই শক্তিশালী যে তারা কেউই দেখতে পারছে না যে ওই পানিতে কোনো পুন্য নেই, বরং ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাস গিজগিজ করছে।
জানি না, কখন আমরা এইসব কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের অন্ধকার জগৎ থেকে বের হয়ে এসে আলোর পথ দেখবো।
লেখাটা পড়া এবং কষ্ট করে মন্তব্য করে উৎসাহ দেবার জন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
একবার নেপাল বেড়াতে গেছিলাম। একটা কালো বিড়াল রাস্তা কাটলো বলে ড্রাইভার রাস্তা ছেড়ে আমাদেরকে মেঠো পথে ঘুরিয়ে নিয়ে গেলো অনেক খানি পথ, পাহাড়ের ভিতর দিয়ে …… এটা আমি দেখি ইউরোপীয়ানরাও খুব মানে। সাথে ফ্রাইডে দ্যা থার্টিন্থ
“দুটি গরু, দুটি ছাগল, এবং দুটি মোরগের জবাই করা রক্ত পদ্মা নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে এই সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করতে হলো তাদের। আর আমরাও সেটা মহা উৎসবে পালন করলাম।”
ছোট বেলায় ঠাকুমার মুখে গল্প শুনেছি যে পুল ( ব্রিজ/সেতু) করতে শিশুর রক্ত লাগবে বলে স্বপ্নে আদেশ আসত। ভাগ্য ভালো যে কোন হুজুর বলেনি যে সেতুর জন্য কাফেরের বা নাস্তিকের রক্ত লাগবে।
আফরোজা আক্তার এর লেখা পড়ে ভালো লাগলো। কুসংসকার ও ধর্মীয় আন্ধতবতায় এখনো আমরা ঢুবে আছি। সে কম বা বেশী হোক। হাজারো বছর ধ্রে আমাদের মজ্জায় মজ্জায় কুসংস্কারগুলি বাসা বেঁধে আছে। এগুলিকে অত সহজে তাড়ানো যাবেনা। ধর্ম আন্ধতবতার জন্য এই কুসংস্কারগুলি আমাদের ম্নের ভিতর বাসা বেঁধে আছে। ভারতীয় উপমহাদেশ তথা দক্ষিণ-পশচিম এশিয়ায় এর প্রাবাল্য বেশী, ইউরোপ ও আন্যান্য দেশে (ক্যাথলিক স্মপ্রদায় ছাড়া) মানুষ কুসংস্কারকে ত্যাগ ক্রেছে। কারান তারা প্রকিত শিক্ক্ষা পেয়েছে ও বৈজঞানিক চিন্তাধারার সাথে সঙ্গতি রেখে জীবন্ধারা প্রবাহীত করে। আমরা এখনো পিছনের দিকে তাকিয়ে চলি। এখানে হিন্দু, মুস্লিম, বউদ্ধ ও খৃষ্টান কোন ভেদ নেই। সবাই কুসংস্কার ও ধর্মীয় আন্ধতবতায় আচ্ছন্ন। আমাদের প্রকিত শিক্ষয়ার প্রয়োজন।
কুসংস্কারগুলি নানা রূপে নানা রঙ্গে, মানুষের মধ্যে ফিরে আসে যুগে যুগে। জলপড়া, তেলপড়ার মতো কুসংস্কারগুলি হয়তো আজকাল আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৌলতে স্থিমিত হয়েছে কিন্তু নতুন সংযোজনও হচ্ছে নতুন কুসংস্কার। ডাক্তার কাছে গিয়েই আমরা চাপাচাপি শুরু করি একটা ভিটামিন সিরাপ প্রেসক্রাইভ করার জন্য অথচ এই ভিটামিন সিরাপ হলো একধরণের গুড়ের রস যার আসলেই শরীর সবল করতে বা শরীরের ঘাটতি পুরণ করার কোন ক্ষমতাই নেই। বাচ্ছার মেধা বাড়াতে হরলিক্স আর কমপ্লানের মতো জিনিষ বাচ্ছাদের অনেক বাবা-মা জোর করে গেলান, অথচ অনেকেই এগুলির পুষ্টিগুন সম্পর্কে বিজ্ঞ হয়েও অজ্ঞ।
আপনি আরও বেশি করে মুক্তমনায় লিখুন সেই আশা রাখছি।