যে বিষয়টির অবতারনা করতে যাচ্ছি, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সেটি নতুন কোন বিষয় নয়, নয় অধিকাংশ ধর্মমুখী দেশের প্রেক্ষাপটেই, তা হলোঃ ধর্মবাদীদের বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞানমনস্কতা দখলের অপচেষ্টা। ধর্ম ও বিজ্ঞান মূলগতভাবেই সাংঘর্ষিক জেনেও এই স্ববিরোধী চেষ্টা তারা করে যায় নিজেদের অপরিবর্তনযোগ্য ধর্মকে সময়োপযোগিতা ও আধুনিকতার খোলস পরানোর জন্য। কিন্তু বিজ্ঞানমনস্কতা তো কোনো খোলস নয়, বরং এক ধরণের আদর্শ ও এক ধরণের চিন্তনকাঠামো যা শুরু হয় আগ্রহের সবকিছুকে প্রশ্ন করা দিয়ে, যা মানুষকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি-উপকরণসমুহ ব্যবহার করে সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টায় নিয়োজিত রেখেছে মানব সভ্যতার শুরু থেকেই। বিজ্ঞানমনস্কতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ন দিক হলো বর্জন করতে পারা, যা কিছু বিজ্ঞানসিদ্ধ নয়, প্রামাণিক নয় তেমন সবকিছুকে; যার ভিত পর্যবেক্ষণ-পরীক্ষা-প্রমাণ নির্ভর নয়, বরং বিশ্বাস নির্ভর যা মৌলিকভাবেই বিজ্ঞানের সাথে সংঘর্ষপূর্ণ। আমার আজকের রচনার অন্যতম বিষয় হচ্ছে- ধর্ম ও বিজ্ঞানের এই বিশ্ববিদিত বৈপরীত্য থাকা সত্ত্বেও কিভাবে আমাদের দেশের ধর্মমনস্ক লেখকেরা বিজ্ঞানের কিছু বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করে লেখালেখি করে নিজেদের বিজ্ঞানলেখকের মর্যাদায় আসীন করে? তাদের এই দ্বিমুখী অবস্থান কেন একই সাথে স্বাদর্শবিরোধী ও অসততা? এবং কেন আমাদের দেশের পশ্চাৎমুখী সেকেলে মানদন্ড এসব ভন্ডকে উচুঁতে তুলে ধরে যাদেরকে পেছনে ফেলে আমাদেরকে আলো হাতে সেই পথের অভিযাত্রী হতে হবে যে পথ বিনির্মাণের জন্য আজীবন কাজ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন অভিজিৎ রায় এর মত প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্ক সত্ত্বা, আমাদের পৃথিবীর আরেকটি প্রিয় নক্ষত্র।

স্ববিরোধীতা ও ভন্ডামীর প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে, বিজ্ঞানমনস্ক কারা সেটা জেনে নেয়াটা জরুরী। আমরা কাদেরকে বিজ্ঞানমনস্ক বলব? শুরুতেই উদাহরণ টানা যাক। আমার অন্যতম প্রিয় সাহিত্যিক-কবি-প্রাবন্ধিক হুমায়ুন আজাদ, যাকে বাংলাদেশীরা অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন ভাষাবিদের মর্যাদা দেয়, যিনি ছিলেন একজন অনন্য বিজ্ঞানমনস্ক মনীষী, যদিও তাঁর শিক্ষা ও কর্ম জীবনের বিষয় মৌলিক বিজ্ঞান ছিল না, তিনি ছিলেন বাংলার শিক্ষক। অন্যদিকে হুমায়ূন আহমেদ একজন পিএইচডি ডিগ্রীধারী বিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও আমরা তাকে বিজ্ঞানমনস্ক বলতে আপত্তি জানাই। কারণ সরল, বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখা করা আর বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া এক কথা নয়, বাংলা-সাহিত্যে পড়ালেখা করেও একজন বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারেন, ব্যক্তিজীবন ও ব্যক্তিচৈতন্যে বিজ্ঞানকে লালন করে, অন্ধভাবে কোন কিছু বিশ্বাস-আন্দাজ না করে বিজ্ঞানের ওপর আস্থা রেখে, কৌতুহলী দৃষ্টিতে কোনকিছু পর্যবেক্ষণ করে তার প্রামাণিক-যাচাই হবার আগ পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্তে না এসেও একজন ব্যক্তি বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারেন। ঠিক এ কারণেই একজন ধর্মবাদী, তা সে যতই বিজ্ঞানবিষয় বই লিখুক না কেন, কখনই নিজেকে বিজ্ঞানমনস্ক বলার যোগ্যতা রাখে না, সে বরং একজন স্ববিরোধী ভন্ড, মূলত একজন বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞানমনস্কতারই শত্রু।

বাংলাদেশে শিল্পী-সাহিত্যিক ও সৃজনশীল বিষয়ে কাজ করা মানুষের কাজের সমালোচনায় তার ব্যক্তিক জীবন-আদর্শ-চেতনাকে আলাদা রাখা হয়। বিষয়টা এমন যে, তাদের শিল্পকর্ম-সাহিত্য এর সাথে ওসবের কোনো সম্বন্ধ নাই। অর্থাৎ একজন মানুষের কাজ তার ব্যক্তিত্ব-ভাবনা-উপলব্ধির প্রতিফলন নয়, যেন ওসব দৈবভাবে পাওয়া, যেমনটি পেয়ে এসেছিলেন ধর্মপ্রবর্তকেরা, এযুগের ভন্ড-পীরেরা। কিন্তু আমরা জানি, এটা কখনই সম্ভব নয়। যদি একজন মানুষের কাজের মাঝে তার সার্বিক ব্যক্তিমানসের প্রকাশ না ঘটে, উল্টো দিক থেকে বললে, একজন মানুষ তার ব্যক্তিমানস থেকে যদি তার কাজের জন্ম না দেয় সেক্ষত্রে আমাদেরকে সেসব মানুষের ব্যক্তিত্ব ও কাজকে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করে কিছু সিদ্ধান্তে উপনিত হতে হবে, তাদের গ্রহনযোগ্যতা নিরুপণে।
প্রথমতঃ এ দুটি অবিচ্ছিন্ন বিষয়কে তারা কেন আলাদা করে? অর্থাৎ তারা কেন তাদের ব্যক্তিমানসের পরিমন্ডলের বাইরে নিজেদের কাজের উপনিবেশ স্থাপন করে?
দ্বিতীয়তঃ তাদের এ ধরণের স্বকীয়তাহীন কাজের উদ্দেশ্য কি এবং এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া বা ফলাফল কি? এবং
তৃতীয়তঃ এদেরকে ঠিক কি কারণে বর্জন করা উচিত?

যারা নিজেদের কাজের সাথে ব্যক্তিচেতনার মেলবন্ধন ঘটায় না তারা মূলত বিষয়টা সচেতনভাবেই করে থাকে। এবং তার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। দেইল্লা রাজাকার কেন আল্লামা সাঈদী হয়ে ওঠে এদেশে তা আমরা সকলেই জানি, দেশদ্রোহী থেকে মুসল্লিদের প্রিয় ওয়াজী হয়ে ওঠাটা শুরুতে এদেশে তার অস্তিত্ব রক্ষার্থেই হতে হয়েছিল, তারপরে পুরোটাই ছিল ধর্মোব্যবসার নিমিত্ত। আমরা জানি রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী কিভাবে হেফাজত তোষণকারী হয়ে ওঠে। নারী নেত্রী ফরিদা আকতার ব্যক্তিজীবনে কমিউনিজম ও নারীমুক্তির কথা বলে কিভাবে হেফাজতের ১৩ দফায় মিনমিনিয়ে সুর মেলায়। এই যে ভেতরে একটা কিছু লালন করা, বাইরে ভিন্নকিছুর খোলশ পরা এবং বলা ও করার সময় আরেক রুপ ধারণ করা, এই বিচ্ছিন্নতার মূল কারণ এটাই- অসততা। এদেশে প্রগতিশীল আন্দোলন ও বিজ্ঞান আন্দোলনের উন্মেষের নামে ভেতরে ভেতরে যা হচ্ছে সে ক্ষেত্রটিতেও আমার পর্যবেক্ষণ মতে উপরের উদাহরণগুলোর সাথে বেশ খাপ খায়। এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরু থেকে মুক্তির চেতনার পাশাপাশি যে জাতিক চরিত্রটি একই সাথে বেড়ে উঠেছিল তা হলো স্ববিরোধিতা। যার রুপ ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল বড় ও ভয়ংকর একটা সংখ্যাগোষ্ঠীর দেশদ্রোহীতা, যাদের আমরা রাজাকার নামে চিনি। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে এই স্ববিরোধীতা ভিন্ন ভিন্ন রুপে দেশে আবির্ভুত হয়েছে, এবং সেই দেশদ্রোহী গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। বিজ্ঞান-শিক্ষার প্রসারের নামে আকাশ-পাতাল কর্মযজ্ঞের পাশাপাশি বিজ্ঞানের অস্তিত্ববাচক বিষয় ‘বিবর্তনবাদ’ যেন পড়ানো না হয় সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেক্যুলার সেক্যুলার বলে মুখে ফেনা তোলা রাষ্ট্রযন্ত্রে আধুনিক শিক্ষা নয় বরং জঙ্গিবাদীতার সূতিকাগার মাদ্রাসা শিক্ষাকে উৎসাহিত করা হয়েছে, রাজধানী ঢাকাকে মসজিদের শহর করা হয়েছে। ধর্মের দাওয়াত দেয়ার মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে বোমাবাজি-গুপ্তহত্যা-সাম্প্রদায়িক হামলার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করছে জেএমবি, হিযবুত তাহেরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এর মত জঙ্গিবাদী ধর্মোন্মাদী সংগঠন। এভাবেই এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ত্বকে অস্বীকার করা জামায়াতে ইসলাম এর পাশাপাশি অধিকাংশ বড় রাজনৈতিক দলই প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষ্য মদদে কয়েকটি প্রজন্মকে স্ববিরোধী করে তুলেছে চিন্তা-চেতনা-আদর্শ-ব্যক্তিজীবনে।

এই প্রজন্মসমূহের অধিকাংশের না আছে উদার দেশাত্মবোধ, না আছে ধর্ম সম্পর্কে যথাযথ ধারণা, না আছে বিজ্ঞানমনস্কতা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাদ্রাসা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বুয়েটের শিক্ষক-কাম-ধর্মমনা বিজ্ঞানলেখক পর্যন্ত এই প্রজন্মের সদস্যের ছড়াছড়ি। এদের অনেকে তাদের স্ববিরোধীতা সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদেরকে আমরা অন্ধ বলি, ক্ষেত্রে বিশেষে ধর্মান্ধ, আর বাকি যারা স্ববিরোধীতা সম্পর্কে সচেতন থেকেও কাজ করে যান সেসব শিক্ষিতজনদের আমরা (ইসলামি) শিক্ষাবিদ, (ধর্মবাদী) বিজ্ঞান লেখক, (বাজারী) সাহিত্যিক, (হিজাবী) শিল্পী, (হেফাজতি) সমাজ কর্মী এমন বিভিন্ন পরিচয়ে অভিহিত করি। এদের স্ববিরোধীতা কখনও তাদের কোনো কাজে জনগনের সামনে প্রকাশ পায়, কখনওবা তাদের ব্যক্তিজীবন ও ব্যক্তিচেতনার কারণে বিস্ফোরিত হয়। তখন সবাই যেন আকাশ থেকে পড়ে! ভাবটা এমনঃ হঠাৎ করে উনি এমন খারাপ হলেন কেন? আবার হাতেগোনা কিছু প্রকৃত জ্ঞানী-মানুষ বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না, কারণ এই আপাতদৃশ্যমান পরিবর্তনকে তারা অতীতেই সম্ভবপর ধরে নিয়েছিলেন, কারণ তারা জানেন ব্যক্তিচেতনা ও তার কাজ-কাজের উদ্দেশ্য অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এদের মত করে এইসব অসৎ স্ববিরোধী মানুষগুলোকে চিনি না বলে আমরা চানাচুর বিক্রেতাকে বাংলার মার্কুয়েজ বলে পারলে কাঁধে তুলে নাচি, আর আমৃত্যু ব্যক্তিচেতনাকে কর্মে-কথনে-লেখায়-আন্দোলনে ফুটিয়ে তোলা বিজ্ঞানবিষয়ে পড়া-গবেষণা করা একজন পলিম্যাথকে একজন অনন্য মুক্তমনা অভিজিৎ রায়কে তার সৎ-স্পষ্টবাদীতার জন্য খুন করে গণমাধ্যমে তাকে শুধুমাত্রই একজন ব্লগার বলে অভিহিত করি। এভাবেই আমাদের জনপ্রিয়তার দুর্বল মানদন্ড আমাদের দেশকে স্ববিরোধী-ভন্ডদের অভায়ারণ্যে পরিণত করে।

আমাদের দেশের দিকে তাকালেই প্রতিটি সেক্টরে এই স্ববিরোধী ভন্ডামীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যার পেছনের উদ্দেশ্য ও সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়াও আমরা দেখতে শুরু করেছি। এদেশে বিজ্ঞানচর্চার দিকে নজর দেয়া যাক। বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের ধর্মও আছে, ইসলাম। এই ঈমানদার রাষ্ট্রে তাই বিজ্ঞান ও মুক্তচর্চা নয় বরং অসাম্প্রদায়িকতার মাথা খেয়ে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনাটা বেশি ধর্তব্য। নব্য পদক্ষেপ ৫০০শত মডেল মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা। তবুও দেশকে আধুনিক ও সেক্যুলার চিত্রায়ণের জন্য কিছু কাজ করা হচ্ছে, বেসরকারী উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজিত বেশকিছু অলিম্পিয়াড-প্রতিযোগীতার জনপ্রিয়তা সম্পর্কেও আমরা কম বেশি অবগত যদিও এমন বেশ কিছু বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ প্রশ্নবিদ্ধ। পাশাপাশি দেশবিরোধী ও ধর্মকে উপজীব্য করে রাজনীতি ও ব্যবসা করা গোষ্ঠীসমূহও বিজ্ঞানচর্চার টোপ ফেলে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহীদের তাদের মৌলবাদী পথের পথিক করছে। এভাবেই জামায়াতে-ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের মত এইসব গোষ্ঠীর কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে স্কুল-মাদ্রাসা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল-বুয়েট ছেয়ে গেছে। এদের এজেন্টরা যেখানেই বিজ্ঞান-বিষয়ক কোনো উদ্যোগ এর সন্ধান পায়, সেখানেই মুখোশ পরে অনুপ্রবেশ করে নিজেদের স্বার্থ-সিদ্ধির উপযোগী-কাঠামো তৈরি করে নেয়। অজ্ঞানীরা জানেও না তারা মৌলবাদের বিষাক্ত ছোবলের আয়ত্ত্বের ভেতরে শ্বাস নিচ্ছে।

আরেকটি মাঝামাঝি গোষ্ঠী আছে এদেশে, যাদের ভাব ও ব্যঁজনা দেখলে মনে হয় তারাই এদেশে বিজ্ঞানচর্চার দায়িত্বভার হাইজ্যাক করেছে, বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরীর ঠিকাদারিত্ব নিয়েছে। এই জনপ্রিয় গোষ্ঠীকে ঠিক মধ্যপন্থী বলা যাবে না, কারণ ধর্ম ও বিজ্ঞানের আলোচনায় এরা কখনও ধর্মকে টানে না। বিজ্ঞানের বিপরীতে তারা যে শব্দটা ব্যবহার করে সেটি হলো ‘কুসংস্কার’। এর মানে এই নয় যে তারা ধর্মকে ‘কুসংস্কার’ বলছে, বরং এর মানে এই যে, তারা ধর্মকে সুরক্ষা দিয়ে, একাধারে ধর্মের মৌলবাদী ছোবল থেকে নিজেদের গর্দানও বাঁচাতে যেমন সক্ষম হয়, তেমনি বিজ্ঞানচর্চার নামে তারা নিজেদেরকে আধুনিক একবিংশ শতকের মানুষ হিসেবে তুলে ধরতে পারে। এরা নাস্তিকতা ঠিক পছন্দ করে না। ধর্ম ব্যবসায়ীরা যেমন বিজ্ঞানী-বিজ্ঞানলেখক-নাস্তিকদের এক কথায় বিজ্ঞানমনস্কদের সহ্য করতে পারে না তার ব্যবসার ব্যঘাত ঘটাবে বলে, এই তথাকথিত-স্বঘোষিত বিজ্ঞানমনস্ক গোষ্ঠীও নাস্তিকদের সহ্য করতে পারে না কারণ তারা মনে করে নাস্তিকদের স্পষ্টবাদীতা তাদের ব্যবসায় ব্যঘাত ঘটাবে। কার্ল মার্কস ধর্মকে আফিম বলার পরেও এদেশের বামপন্থীরা যেভাবে নাস্তিকদের ঘৃণা করে ধর্মবাদের সাথে সঙ্গম করে, এরাও ঠিক ‘হাজার বছরের কুসংস্কার (ধর্ম শব্দটা এরা ব্যবহার করে না পূর্বেই বলেছি) হুট করেই দূর হবে না’- বলে নাস্তিকদের ঘৃণা কোরে ধর্মের প্রসঙ্গে শৈথিল্য ও সদ্ভাব বজায় রাখে। ব্যক্তিগতভাবে এই গোষ্ঠীটাকে আমি জঙ্গী সংগঠনগুলোর চেয়েও বেশি বিপদজনক মনে করি। কারণ মৌলবাদীদের অবস্থান স্পষ্ট, নাস্তিকদের যেমন, কিন্তু এরা বাতাস বুঝে কোন দিকে পাল তুলবে সেটা বলা মুসকিল এবং প্রতিক্রিয়া স্বরুপ কি ক্ষতি হবে সেটাও আগের থেকেই অনুমান করে সাবধানতা অবলম্বন করা যায় না। তাই এদের অনেকের সাথে মৌলবাদীদের সখ্য হয়। জিরো টু ইনফিনিটি এর সাথে মৌলবাদী ব্লগার ত্রিভূজের সম্পৃক্ত থাকা তারই একটা ভয়াবহ নজির হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।

ধর্মবিষয়ক লেখক ও বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক গোষ্ঠীর লেখার বিষয়ের পার্থক্যটা সংগাতেই স্পষ্ট, কিন্ত এদের ভেতরে চর্চাগত একটা মিলও দেখতে পাওয়া যায়, উপোরক্ত ছদ্ম-মধ্যপন্থী গোষ্ঠীর বিজ্ঞান-লেখকদের কারনে, যারা লেখে বিজ্ঞান বিষয়ে কিন্তু ধর্ম বিষয়ক লেখকদের মত তারাও মনস্তত্বে চর্চা করে মধ্যযুগীয়-ধর্মকে। ঠিক এ কারণের বারবার সততার প্রশ্ন উঠে আসে। অভিজিৎ রায় হত্যা পরবর্তী সময়ে বুয়েটের যে শিক্ষক আলোচনায় আসেন, আমি তার ফেসবুক প্রোফাইলে গিয়ে আঁতকে উঠি। ধর্ম এর জায়গায় লেখা মুসলিম-সুন্নী! তার অনেক ভক্ত-শিষ্যকে আমি চিনতাম, তাদের ঐ অস্পষ্ট চেতনার জগৎটা সম্পর্কেও আমার ধারণা ছিল, এরপরে একে একে তার বেশকিছু ভক্তবৃন্দের প্রোফাইল দেখলাম, তার সহধর্মিনীরটিও তার থেকে ভিন্ন নয়। এই ভদ্রমহিলা তার এক নাতিদীর্ঘ স্ট্যাটাসে অভিজিৎ রায়কে দাদা সম্বোধন করে একটি বাক্যতে লিখেছেন যে, তার দাদা যেখানেই থাকুন না কেন যেন তার ও তার হাজবেন্ড এর জন্য প্রার্থনা করেন যেন তারা সকল ভুল বোঝাবুঝি অবসান তারা করতে পারেন। একজন সদ্য প্রয়াত নিধার্মিক-নাস্তিক মানুষকে প্রার্থনা করাতে চাওয়ার মাধ্যমে এভাবে স্মরণ করা ভদ্রতা-সম্মানবোধের খাতিরে ঠিক কোন স্তরে পরে সেটা বোঝাই যায়। বুয়েটের শিক্ষক ভদ্র লোকটি অভিজিৎ রায় এর হত্যার পরে অনেকদিন মুখ খোলেন নি, পরবর্তীতে তিনি তার ভয়ের কথা জানিয়েছেন ও উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলা বিষয়ক পোস্ট দিয়েছেন। এ ধরণের ব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করে এই গোষ্ঠী নিয়ে ভাবি, ধর্মবিশ্বাস ও এই মানসিক স্থুলতায় তারা কিভাবে বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালেখি করার সাহস পান? উত্তরটা বেশ উপলব্ধি করা যায়, মৌলবাদীরা এদের নিয়ে সংকীত নয়, কারণ এরা ব্যক্তিচর্চা-চেতনা ও কাজে বিজ্ঞানমনস্ক নয় যে এদের অস্তিত্ব দেশে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরীতে ভূমিকা রাখবে। আর এরা ভিত, পরাজিত, এদেরকে নতুন করে ভয় দেখানোর দরকার পরে না মৌলবাদীদের বরং এদের সাহচর্যে মৌলবাদীরা চলাফেরা করে। অপরদিকে অভিজিৎ রায় এর বলিষ্ঠ ও স্পষ্ট উচ্চারণ আমার স্মৃতি-চেতনায় ভাস্মর হয়ে ওঠে, যার মূলে রয়েছে নিজের আদর্শ ও চেতনার প্রতি দায়বদ্ধতাজাত সততা, “যারা ভাবে বিনা রক্তে বিজয় অর্জিত হয়ে যাবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের মত জিনিস নিয়ে যখন থেকে আমরা লেখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালিখি করছি।”

বিজ্ঞানকে-নতুনকে-সত্যকে গ্রহনের মানদন্ড হতে হবে সততা ও শক্তি। বর্তমানে আমাদের দেশে এ দুটোরই বড় অভাব। তাইতো এদেশ হয়ে যাচ্ছে মৌলবাদীদের যারা জন-সাধারণের ভয়কে কব্জা করে টিকে আছে। এদেশ হয়ে যাচ্ছে সেই সব সুবিধাবাদী-স্ববিরোধী-ছদ্মমধ্যপন্থী-ভন্ড গোষ্ঠীর যারা দুর্নীতিপরায়ন এই দেশেকে নিজেদের অসততা চাষ করার উর্বর ক্ষেত্র বানিয়েছে। যখন এরা ঘোষণা দিয়ে এক হবে, সেদিন না থাকবে বিজ্ঞান, না থাকবে দেশপ্রেম, না থাকবে দেশ। বাংলাদেশ হবে বাংলাস্তান।

তাই আমাদের ঠিক করতে হবে আমরা ছদ্ম-বিজ্ঞানমনস্ক হবো, নাকি প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্ক। আমাদের এখনই ঠিক করতে হবে আমরা কোন পথে হাটব, কোন পথের সাথে আমার বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দেবো, আমাদের এখনই বাছাই করতে হবে সে পথ, যে পথ হবে স্ববিরোধী ভন্ডদের দেখিয়ে দেয়া পথ নাকি একজন সৎ ও সাহসী অভিজিৎ রায় এর বিনির্মিত পথ, যে পথে হেটে তিনি মৃত্যুকে পর্যন্ত জয় করে আমাদের চেতনায় ভাস্মর থাকবেন ঠিক ততদিন যতদিন এদেশে মুক্তমনের চর্চা থাকবে। আসুন, আমরা অভিজিৎ অভিমুখে অভিযাত্রী হই।