লিখেছেন: আব্দুর রউফ চৌধুরী
প্রবেশিকা
আমাদের জাতীয় কবি
বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং অবিভক্ত বাংলার সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, অগ্রণী বাঙালি কবি, অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী, সঙ্গীতজ্ঞ, সঙ্গীতস্রষ্টা, দার্শনিক এবং বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকার প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার বিচিত্র প্রকাশ। তাঁর কবিতা ও গান ভারতবর্ষে সমভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে ‘বিদ্রোহী কবি’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে নজরুলের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়। ‘অগ্নিবীণা’ তাঁর প্রবেশ, ‘ধূমকেতু’ তাঁর প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের অনুকরণমুক্ত কবিতা রচনায় তাঁর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই ‘ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা’র সৃষ্টি সহজতর হয়।
নজরুল সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবিভক্ত ভারতবর্ষের পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশি-বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এ কারণে ইংরেজ সরকার তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে এবং তাঁকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। নজরুলও আদালতে লিখিত রাজবন্দীর জবানবন্দী দিয়ে এবং প্রায় চল্লিশ দিন একটানা অনশন করে ইংরেজ সরকারের জেল-জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন এবং এর সমর্থনে নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে গ্রন্থ উৎসর্গ করে শ্রদ্ধা জানান। তিনি আধুনিক ভারতবর্ষীয় সঙ্গীতে ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত। মানুষ তাঁর নামের সঙ্গে এক-এক সময় এক-একটি তকমা জুড়ে দিয়ে তাঁকে খণ্ডিতরূপে পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করে, তাঁর সঠিক মূল্যায়ন থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে, সম্ভবত সমালোচকদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে এমনটি ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে বিরূপ সমালোচনার শিকার হন তিনি, এ অবস্থার বর্ণনায় নজরুল নিজেই বলেন―
‘হিন্দুরা ভাবে, ফার্শী শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে।
মৌ-লোভী যত মৌলভী আর মোল-লারা কন হাত নেড়ে―
দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম―কাফের কাজী ও
যদিও শহীদ হইতে রাজীও।’
কাজেই যারা হিন্দুধর্মকে আচার সর্বস্ব করে এবং যারা ইসলামধর্মকে করে ফতোয়া সর্বস্ব তাদের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান, দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন―
‘আদি শৃঙ্খল সনাতন শাস্ত্র-আচার
মূল সর্বনার্শের এরে ভাঙিব এবার।’
শুধু কী নজরুল এ-ধরনের পরিবেশ সৃষ্টির বিরুদ্ধে ছিলেন? না, সু-সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতাবা আলীও ছিলেন; তিনি বলেন, ‘সমাজে ব্যক্তির সুষ্ঠু জীবন যাপনের সুবিধার্থেই ধর্মের প্রয়োজন। অন্যথায় ফতোয়ার সমষ্টি মাত্র যে কেতাব দরদহীন নীতি সর্বস্ব সেটা কুমড়ো কাটা করলে মানবকুলের কোন ক্ষতি হবে না―এ নিশ্চিত।’ নজরুল আরো বিশ্বাস করেন, ‘ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য ধর্ম।’ তিনি বিশ্বাস করেন মানুষ আত্মবুদ্ধিতে যা ভাল বুঝে, যা ভাল বলে অনুসরণ করে, তাকে তা করার সুযোগ দেওয়া উচিত; যেকোনো প্রকার সংস্কার দিয়ে, প্রাধিকারের শাসন দিয়ে, বাহ্যশক্তির চাপ সৃষ্টি করে মানুষের স্বাভাবিক বোধ ও বুদ্ধিকে খর্ব করা অন্যায়। এ-উপলব্ধির সঙ্গে তিনি যখন দেখেন ধর্মের ধ্বজাধারীদের সৃষ্ট বাঁধা-নিষেধের ডোরে বাঁধা সমাজে মানুষের বিকাশের পথ অনেকাংশে রুদ্ধ তখন তিনি গর্জে উঠেন―
আমি দুর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দলে যাই যত বন্ধন, নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
নজরুল একসময় মসজিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, ধর্ম-ব্যবসায়ীদের লীলাখেলা তখনই তিনি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান; দেখেন ভজনালয়ে দলাদলি, স্বার্থের হানাহানি। এ দেখে তিনি বলে উঠেন―
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী।
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি।
কোথা চেঙ্গিস, গজনীমাসুদ, কোথায় কালা-পাহাড়?
ভেঙ্গে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা দেওয়া দ্বার।
মানবতা শিক্ষাদানের জন্য তিনি গেয়ে উঠেন―
মসজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে ব’সে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
এই রণ-ভূমে বাঁশীর কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা,
এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা।
এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্য মুনি,
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহাবেদনার ডাক শুনি।
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহ্বান,
এইখানে বসি গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান।
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।
মানব হৃদয়ের অমন জয়গান শুনে মোল্লাদল আঙুল কানে দেয়। ধণ্না দিতে শুরু করে কবি গোলাম মোস্তফা সাহেবের দ্বারে। তিনি কবিতা লিখেন নজরুলকে কশাঘাত করে।
লাঞ্ছিত নিস্পেষিতদের কী করুণ আর্তনাদ তাঁর সৃষ্টিকর্মে ধরা পড়ে! হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষ, জাতিভেদ প্রথা, ধর্মের নামে মারামারি-হানাহানি তিনি আদৌ বরদাস্ত করেননি; বরং এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে কিভাবে মিলন ঘটানো যায় তাই ছিল তাঁর সারা জীবনের স্বপ্ন। চণ্ডীদাস গেয়েছিলেন, ‘শুনহ মানুষ ভাই,/ সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই।’ এ যুগের চণ্ডীদাস রূপে নজরুল কণ্ঠেও তা প্রতিধ্বনিত হয়―
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
‘ব্যাটা বলে কী?’ গোস্সায় মোল্লারা কামড়ে ধরেন নিজেদের গোশ্ত। বোঝার ভুলে রাগ বাড়ে―‘আল্লাহকে আরশচ্যুত করে বসায়েছে মানুষকে। শিরক নির্ঘাত। কাফের নিশ্চয়।’ আমাদের নজরুলও কম যান না―
কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা,
ধ্বংস করেছি ধর্ম যাজকী পেশা।
ভাঙ্গি মন্দির, ভাঙ্গি মসজিদ
ভাঙ্গিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত―
এক মানবের একই রক্ত মেশা
কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।
অবশেষে বাকহীন নজরুলকে টুপি পরিয়ে তাঁর লিখিত গজল সংকলন প্রকাশ করে তাঁকে একজন মৌলবাদী রূপে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তাঁর প্রগতিবাদী চিন্তাধারার প্রভাবের আশঙ্কায় বেচাইন একদল ধর্মব্যবসায়ী।
কবি ও সাহিত্যিকের মুখ্য কর্তব্য মানুষকে তার মনুষ্যত্ব বিকাশে উদ্বুদ্ধ করা। তজ্জন্য বিচারশক্তি, কল্পনাশক্তি এবং ধারণাশক্তি অপরিহার্য; কিন্তু মৌলবাদীর আছে শুধু ধারণ শক্তি, অপর তিনটির অভাব আবশ্যিক শর্ত। উক্ত মনুষ্যত্ব বোধ জাগ্রত হলে সমাজের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয় মানুষ। মৌলবাদ সৃষ্ট সমাজের রূপ তুলে ধরেন নজরুল―
জনগণে যারা জোঁক-সম শোষে তারে মহাজন কয়,
সন্তান-সম পালে যারা জমি, তারা জমিদার নয়।
মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ
মাটির মালিক তাহারাই হন।
নিশ্চয়ই মানুষের ভ্রাতৃত্ব এক। কাজেই প্রকৃতি সর্বাবস্থায় সাম্য ও মৈত্রীর রূপায়ণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলেন, ‘যাতে সর্বাবস্থায় সমান অংশে দুনিয়ার সম্পদ মানুষ ভোগ করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই মানব সমাজকে সংঘ চেতনার পথে এগিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ একথাই অনেক আগে নজরুল বলেন―
তোমার দেওয়া এ বিপুল পৃথ্বী সকলে করিব ভোগ,
এই পৃথিবীর নাড়ী সঙ্গে আছে সৃজন-দিনের যোগ।
অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ আরো উল্লেখ করেছেন, ‘[…] জমি নগদ লগ্নি বা ভাগে দেওয়া না-যায়েজ এবং জমিদারী প্রথা কোন অবস্থায়ই জায়েয নয়।’ ক’জন মুসলিম আলেম এমন কথা প্রকাশ করতে সাহস করেন? তারাই তো উপরতলার মানুষের ছত্র ছায়াতলে মেলা বসান, কিন্তু আমাদের নজরুল না-যায়েজ শোষকগোষ্ঠীর জাঁতাকলে নিষ্পেষিত মানুষের জয়গান সুকণ্ঠে প্রকাশ করেন―
কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি?
হয়তো উহার বুকে ভগবান জাগিছেন দিবারাতি।
অথবা হয়তো কিছুই নহে, সে মহান উচ্চ নহে,
আছে ক্লেদাক্ত ক্ষত-বিক্ষত পড়িয়া দুঃখ-দহে।
তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ ভজনালয়
ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়।
বাস্তবিকই নজরুল ছিলেন সত্যিকারের মানব-দরদী একজন মহাকবি। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে এত বিশাল আকারের কবি ক’জনই-বা আবির্ভূত হয়েছেন? এক শ্রেণীর মুসলিম আলেমদের চালচলনে, স্বার্থসিদ্ধির কলাকৌশল অবলোকনে মনে হয় নজরুলের মনে এ-ধরনের একটি ধারণা জন্মে ছিল হয়তো-বা; মানুষের অজ্ঞানতাপ্রসূত ভীতি, এবং এই ভীতিজাত কুসংস্কারই ধর্মবিশ্বাসের মূলে রয়েছে। এর কারণ এও হতে পারে যে, স্রষ্টাকে সাধারণত শক্তিশালী শাস্তিদাতা রূপে চিত্রিত করা হয় সাধারণ্যে, তাই নজরুল হেঁকে উঠেন―
হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়। […]
পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল―মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ কেতাব―গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
সংসারে দুঃখদারিদ্র্যে জর্জরিত মানবকুলের প্রতি অবিচার, অত্যাচার লক্ষ্য করে কবিচিত্ত অস্থির―
গাহি গান, গাঁথি মালা, কণ্ঠ করে জ্বালা,
দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ-নাগবালা।
যেখানে মানবতার অবমাননা সেখানে নজরুলের ‘উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার।’ নজরুল তাঁর কবিতায় ব্যতিক্রমী এমন সব বিষয় ও শব্দ ব্যবহার করেন, যা আগে কখনও ব্যবহূত হয়নি। কবিতায় তিনি সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক যন্ত্রণাকে ধারণ করায় অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তবে মানব-সভ্যতার কয়েকটি মৌলিক সমস্যাও ছিল তাঁর কবিতার উপজীব্য। নজরুল তাঁর কাব্য-সৃষ্টি-কর্মে হিন্দু-মুসলিম মিশ্র ঐতিহ্যের পরিচর্যা করেন। কবিতা ও গানে তিনি এ মিশ্র ঐতিহ্যচেতনাবশত প্রচলিত বাংলা ছন্দোরীতি ছাড়াও অনেক সংস্কৃত ও আরবি ছন্দ ব্যবহার করেন। নজরুলের ইতিহাস-চেতনায় ছিল সমকালীন এবং দূর ও নিকট অতীতের ইতিহাস, সমভাবে স্বদেশ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নজরুলের কবিতা ও গান আমাদের প্রেরণা যুগিয়েছে পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামে―
নব ধ্যান ধারণায় জাগো
নব প্রাণ নব প্রেরণায় জাগো।
সকল কালের উচ্চে তোল গো শির,
সব বন্ধন মুক্ত জাগো হে বীর।
আর
নবীন রুদ্র আমাদের তনু মনে জাগে
সে প্রলয় শিখা রক্ত উদয়ারুণ রাগে।
আর
এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল,
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিফল।
আর
আবার যদি না জন্মাত মৃত্যুতে সে হাসত না,
আসবে আবার―নৈলে ধরায় এমন ভালোবাসত না।
এমনিভাবে চিরদিন নজরুল প্রেরণা যোগাবেন বাঙালির জাতীয় জীবনে। নজরুলের সৃষ্টি মানুষের জীবনের সঙ্গে এক নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করে। মানুষের জীবনে আনন্দ, বেদনা, হাসি, কান্না সবই তাঁর কবিতার মাঝে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। জীবনকে সৌন্দর্য-সড়বাত করে তুলতে সমাজে নজরুলের কবিতা, কাব্য ও সাহিত্যের দান অপরিসীম। ঠিক তেমনি বলা যায় যে, নজরুলে সৃষ্টি সৌন্দর্যের সহায়কও বটে। তাঁর সৃষ্টি জীবনের বিচিত্র অভিব্যক্তিরূপে মানুষের অন্তরকে অনন্তের সন্ধান দেয়। এসবে নজরুলকে বিভিন্নরূপে আত্মপ্রকাশ করে; বক্তব্যে যেমনি আছে ভিন্নতা, তেমনি প্রকাশ ভঙ্গিমায় বৈচিত্র্যতা রয়েছে। তাই হিন্দু-মুসলিম, ধর্ম নির্বিশেষে, প্রতিটি বাঙালি মনে-প্রাণে তাঁকে গভীরভাবে ভালোবাসেন। তাঁরা সবাই তার কাব্যের সৌন্দর্যবোধ, রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতায় মুগ্ধ হন!
শৈশবে রুটির দোকানে চাকরি জীবনে ময়দা মাখতে মাখতে হয়তো তাঁর মনে উদয় হয়, দুনিয়াটকে দলেমলে মনের মতো করে গড়বেন। যত অনাচার, যত অন্ধ শাস্ত্রাচার সবারি মূল উৎপাদন করবেন। সর্বহারার গান গেয়ে সর্বজয়ী হবেন। এ বিশ্বাস শৈশব থেকে তাঁর মনে ঠাঁই নিয়েছিল, তাই তিনি পুরাতনকে বরদাশত করতে পারেননি। তাই সৃষ্টির নেশায় মেতে ছিলেন তিনি―
আজ সৃষ্টি সূখের উল্লাসে―
মোর মুখ হাসে, মোর চোখ হাসে।
মোর টগ্বগিয়ে খুন হাসে।
যেদিন প্রথম প্রকাশিত হল―
বল বীর―
বল, চির উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি
নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির।
সেদিন বঙ্গ সহিত্যাকাশের দিকে সাড়া পড়ে যায়―‘কে এই মহা-বিদ্রোহী বীর?’ আবারও বলা আবশ্যক যে, নজরুলের বিদ্রোহ ছিল উৎপীড়ক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, সংকীর্ণ ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে; অর্থাৎ মানুষের সর্বাঙ্গীন বিকাশের পথে যত সব পথের কাঁটা তাদের বিরুদ্ধে। পুঁতিগন্ধময় প্রাচীনকে ভেঙে নূতনের বন্যা আনার জন্যই নজরুলের সক্রিয় সংগ্রাম। যেখানে অসাম্য, শোষণ ও অত্যাচার সেখানেই তিনি বিদ্রোহী। শুধু এসবই নয়, আসলে তিনি বিদ্রোহী হয়ে উঠেন স্বয়ং বাংলা-সাহিত্যের মূল ধারা ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধেই। এর অজস্র প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর সৃষ্টি-জগতের বৈচিত্রে। কিন্তু তিনি শুধুমাত্র বিপ্লবী কবি ছিলেন না। তিনি গান রচনা করেছেন তিন হাজারেরও বেশি। বাংলা-সঙ্গীতের প্রায় সবকটি ধারার পরিচর্যা ও পরিপুষ্টি, বাংলা-সঙ্গীতকে উত্তর ভারতবর্ষের রাগসঙ্গীতের দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন এবং লোকসঙ্গীতাশ্রয়ী বাংলা সঙ্গীতকে মার্গসঙ্গীতের ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্তি নজরুলের মৌলিক সঙ্গীত-প্রতিভার পরিচায়ক। নজরুল-সঙ্গীত ভারতবর্ষের সঙ্গীতের অণুবিশ্ব, তদুপরি উত্তর ভারতবর্ষের রাগসঙ্গীতের বঙ্গীয় সংস্করণ। বাণী ও সুরের বৈচিত্র্যে নজরুল ভারতবর্ষের সঙ্গীতকে যথার্থ আধুনিক সঙ্গীতে রূপান্তরিত করেন। তাঁর প্রেমগীতি উচ্চ প্রশংসিত, বিশ্বসাহিত্যে স্থান পাওয়ার উপযুক্ত, যেমন―
নয়ন ভরা জল গো তোমার আঁচল ভরা ফুল,
ফুল নেব না অশ্রু নেব ভেবে হই আকুল।
সর্বোপরি নজরুল একজন প্রেমিকও বটে,
তুমি আমায় ভালোবাসো তাই তো আমি কবি।
আমার এ রূপ―সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি।
বাংলার পথে-প্রান্তরে, কৃষকের মুখে মুখে, পথিকের বাঁশের বাঁশিতে, নজরুলের গান ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। উদাস বনের ধারে, উথাল-পাথাল নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে নজরুলের সুর ভেসে বেড়ায়। তিনি হাফিজ ও ওমর খৈয়ামের গজল অনুবাদ করে বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসে এক নূতন ধারার সুচনা করেন। নূতন নূতন গজল লিখে তিনি বাংলা ভাষাকে চমৎকৃত করেন। ভাটিয়ালী, কীর্তন, বাউল, শ্যামা, ঝুমুর, জারীগানসহ অজস্র সঙ্গীত তাঁর কলম থেকে সৃষ্টি হয়। নজরুলই ভারতবর্ষের আধুনিক গানের জনক ও প্রথম পথ প্রদর্শক। সারা জীবন তিনি দুঃখ-দূর্দশা ও কঠোর সংগ্রামের মধ্য-দিয়ে কাটিয়েছেন বলেই দারিদ্রই তার একমাত্র বন্ধু―
হে দারিদ্র্য তুমি মোরে
করেছ মহান,
তুমি মোরে দানিয়াছ
খ্রিস্টের সম্মান।
এজন্যেই তিনি দৃপ্তকণ্ঠে গেয়ে উঠেন―
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া
হাসি পুস্পের হাসি।
নজরুল জীবনে রাজনীতির প্রভাব আরম্ভ হয় প্রথম মহাযুদ্ধের সর্বনাশী প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে। স্বাধীনতার প্রশ্নে বাংলাঞ্চলে তুমুল আন্দোলন দেখা দেয়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ছিলেন এ আন্দোলনে পুরোভাগে। বীর নজরুল অগ্নি পুরুষের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ধ্বনি তুলে, ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’ । ‘ধুমকেতু’-নাম দিয়ে অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে সাহিত্যাঙ্গনে এক নূতনরূপে আত্মপ্রকাশ করেন। ‘ধুমকেতু’ দৃপ্তকণ্ঠে প্রকাশ করে―‘স্বরাজ টরাজ বুঝিনে। ভারতবর্ষের এক কণা পরিমাণ অংশও বিদেশীদের হাতে থাকবে না। এ দেশের রাষ্ট্র চালনার দায়িত্ব―সম্পূর্ণ শাসনভার―সমস্তই থাকবে এ দেশীয়দের হাতে।’ ধুমকেতুর অগ্নিময়বাণী ব্রিটিশ সরকারকে অতিষ্ঠ করে তুলে। তারা তাঁকে কারাগারে পুরেন। কিন্তু সেখানে গিয়েও নিস্তার নেই―
এ শিকল পরা ছল,
মোদের এ শিকল পরা ছল
এ শিকল পরেই শিকল তোদের
করবর বিকল।
গান গেয়ে গেয়ে তিনি জেলখানার কয়েদীদেরও জাগিয়ে তুলেন। কারাগারের লোহার গরাদ ধরে ফুলের মতো আলিঙ্গন করেন। তারপর শুরু করেন জেলখানার মধ্যেই অনশন ধর্মঘট। সারাদেশ ব্যাকুল হয়ে ওঠে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও শঙ্কিত হন। তিনি অনশন ধর্মঘটের খবর পেয়ে তার-যোগে জানান, ‘Give up Hunger stricke, our literature claims you.’ এ থেকে সহজেই অনুমেয় নজরুল রবীন্দ্রনাথের অন্তরে কতটুকু স্থান জুড়ে অবস্থান করতেন। অবশ্য অবশেষে সরকার জেল থেকে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
শিশুসাহিত্যেও নজরুলের অবদান কম নয়। শিশুহৃদয়ের যে-ছবি তিনি এঁকে গিয়েছেন তাও যেন শিশুর মতোই সহজ, সরল ও প্রাণবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। কোনো কৃত্রিমতা নেই, আড়ম্বর নেই, ছেলেমানুষের মতোই তিনি শিশুদের সঙ্গে একান্ত হয়ে যান! বাল্যকালে দুরন্তপনা করেই যার দিন কাটতো, পাখীর বাসা, খেতের ফসল, পুকুরের মাছ সন্ধানে যিনি সকাল-বিকাল র্ঘু র্ঘু করে ঘুরেন―সাধে কি তাঁর ‘কাঠ বেড়ালী’, ‘লিচু চোর’―এ যুগের শিশুদের মন জয় করেছে? ‘লিচু চোর’ কবিতাটি আজকালের ছেলেদের মন ষোলআনা জয় করেছে। ‘কাঠ বেড়ালী, তুমি মর, তুমি কচু খাও।’ কবিতায় ‘ঝগড়া’, ‘অভিমান’ এসব যেন সত্যিকারের শিশু-জগতের বাস্তব ঝগড়ার প্রতিচ্ছবি। শিশু মন না হলে এমন কাব্য সৃষ্টি করা সম্ভব হত না! এক কথায়, তিনি ছোটদের জন্য যা লিখেছেন তাও অনবদ্য। সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগে ওঠে শিশুরা শুনতে পায় পাখির কিচির-মিচির শব্দ―এ দেখে কার না আকাশে উড়তে মনে ইচ্ছে জাগে? কবির ভাষায়―
আমি হব সকাল বেলার পাখী
সবার আগে কুসুম বাগে,
উঠব আমি জাগি
বা
ভোর হলো দোর খোলে
খুকুমণি উঠরে
ঐ ডাকে জুঁই শাখে
ফুল খুকী ছোটরে
খুকুমণি উঠরে।
নজরুলকে ‘গানের পাখি’ বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তিনি সবাইকে গান শুনিয়ে, শিখিয়ে, পড়িয়ে অবশেষে শেষ জীবনে ‘গানের পাখি’ নিজেই যেন গান ভুলে গেলেন! নজরুলের কণ্ঠ হয়ে যায় চীর স্তব্ধ! রবীন্দ্রনাথ একবার লেখেন―
স্ফুলিঙ্গ তার পাখায় পেল
ক্ষণকালের ছন্দ,
উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেল
সেই তারি আনন্দ।
নজরুলও ছিলেন এ ধরনের এক ‘স্ফুলিঙ্গ’। তবে ক্ষণকালের ছন্দ ও আনন্দ দান করেই ‘স্ফুলিঙ্গ’-এর ইতিকর্তব্য ফুরিয়ে যায়নি। পৃথিবীর ইতিহাসে যে ক’জনা চিরকালের কবি-সাহিত্যিক যুগান্তর সৃষ্টির প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন, নিঃসন্দেহে নজরুল তাঁদের অন্যতম।
নজরুলের ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধগুলোও বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এই মহান কবিকে কর্মক্ষম অবস্থায় পাইনি; তাঁর জীবনের শেষ দিকে, তবু তিনি জাতিকে যা দিয়েছেন তা যেন শ্রদ্ধার সঙ্গে আমরা মনের মণিকোঠায় সঞ্চয় করে রাখি এবং কবির কামনা সফল করার জন্যে সচেষ্ট হই―
জয় নিপীড়িত জনগণ জয়! জয় নব উত্থান।
জয় নিপীড়িত প্রাণ!
জয় নব অভিযান!
জয় সব উত্থান!
মহাকবির মহাবাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা যেন তাঁর সুরে সুর মিলিয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই―
আমি সেইদিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খক্ষ কৃপান ভীম রণ-ভূমে রণিবে না―
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত।
আমাদের মুক্তস্বাধীনচেতনা বৃদ্ধি করতে নজরুলচর্চা করতেই হবে। সত্যের অনুসন্ধান ও ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ‘আমি’ শব্দটির সৃষ্টির ব্যাপক রহস্য উদ্ধার করতে হবে। বিদ্বেষ জর্জরিত কুৎসিত কলুষিত অসুন্দর নিপীড়িত পৃথিবীকে সুন্দর-সাম্য-অভেদ-শান্তি-আনন্দময় করার প্রেরণা যোগাতে; এবং মানুষের, মানবতার ও মনুষ্যত্বের জাগরণ-কল্যাণ-মঙ্গলের জন্যে নজরুলকে অবশ্যি চর্চা করা আবশ্যক, এছাড়া অন্যকোনো পথ বা পন্থা নেই। অজ্ঞানতা ও জাতিবর্ণধর্মের বৈষম্যের জঞ্জাল চূর্ণবিচূর্ণ করে সত্যের প্রকাশ ও বিকাশের পথোন্মুক্ত করতে নজরুলই হচ্ছেন আমাদের প্রতীক।
জীবনী
২৪শে মে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে, ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দে, পশ্চিম-বাংলার বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নজরুল। চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া অংশে অবস্থিত। পিতামহ কাজী আমিন উল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয় পত্নী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠসন্তান ছিলেন নজরুল। তার পিতা ছিলেন স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম। নজরুলের ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। তিনি স্থানীয় মক্তবে কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন।
১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে, নজরুলের পিতার মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র নয় বৎসর। পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তাঁর শিক্ষাজীবন বাঁধাগ্রস্থ হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে তাঁকে জীবিকা অর্জ্জনে অগ্রসর হতে হয়। এই সময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য হাজী পালোয়ানের মাযারের সেবক এবং মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। শৈশবের এই শিক্ষা ও শিক্ষকতার মধ্য-দিয়ে নজরুল অল্পবয়সেই ইসলাম-ধর্মের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠান―পবিত্র কুরআন পাঠ, নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত প্রভৃতি―বিষয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেন; যা পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে ইসলামি ঐতিহ্যের রূপায়ণে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে ।
মক্তব, মাজার ও মসজিদ-জীবনের পর, লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নজরুল রাঢ় বাংলার―পশ্চিম-বাংলার বর্ধমান-বীরভূম অঞ্চলের কবিতা, গান আর নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক ভ্রাম্যমান লোকনাট্য লেটোদলে যোগদান করেন। তাঁর পিতৃব্য কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় তাঁর দখল ছিল। এছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। বজলে করিমের প্রভাবেই নজরুল লেটোদলে যোগ দেন। এছাড়া এই অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটোদলের কবি শেখ চকোর (গোদা কবি) এবং কবিয়া বাসুদেবের লেটোদল ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। লোকনাট্য লেটোদলে বালক নজরুল ছিলেন একাধারে পালাগান রচয়িতা ও অভিনেতা। নজরুলের কবি ও শিল্পী জীবনের শুরু এই লেটোদল থেকেই। হিন্দু-পুরাণের সঙ্গে নজরুলের পরিচয়ও ঘটে এই লেটোদল থেকে। তাৎক্ষণিকভাবে কবিতা ও গান রচনার কৌশল নজরুল লেটো বা কবিগানের দলেই রপ্ত করেন। এই সময় লেটোদলের জন্য কিশোর কবি নজরুলের সৃষ্টি ‘চাষার সঙ’, ‘শকুনিবধ’, ‘রাজা যুধি‘িরের সঙ’, ‘দাতা কর্ণ’, ‘আকবর বাদশাহ’, ‘কবি কালিদাস’, ‘বিদ্যাভূতুম’, ‘রাজপুত্রের সঙ’, ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’, ‘মেঘনাদ বধ’ প্রভৃতি।
১৯১০ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল পুনরায় ছাত্রজীবনে ফিরে যান। প্রথমে তিনি রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ স্কুল এবং পরে মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে (পরবর্তীতে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন) ভর্তি হন। মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলের হেড-মাস্টার ছিলেন কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিক; তাঁর সান্নিধ্য নজরুলের অনুপ্রেরণার একটি উৎস। কুমুদ রঞ্জন মল্লিক নজরুল-স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ‘ছোট সুন্দর ছনমনে ছেলেটি, আমি ক্লাশ পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত। আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম। সে বড় লাজুক ছিল।’ দুর্ভাগ্যক্রমে আর্থিক অনটনের কারণে ষষ্ঠ শ্রেণীর পর নজরুলের ছাত্রজীবনে আবার শিক্ষাক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটে। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে, মাথরুন স্কুল ছেড়ে তিনি প্রথমে বাসুদেবের কবিদলে, ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে, এক খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা পদে এবং শেষে আসানসোলে চা-রুটির দোকানে কাজ নেন। এভাবে কিশোর শ্রমিক নজরুল তাঁর বাল্যজীবনেই রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে সম্যকভাবে পরিচিত হন।
চা-রুটির দোকানে চাকরি করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয় এবং তাঁর সুবাদেই নজরুল, ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে, ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে, তিনি পুনরায় নিজের গ্রামে ফিরে আসেন এবং ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দেই রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজস্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। প্রিটেস্ট পরীক্ষার সময়, ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে, নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ছাত্রজীবনে নজরুল সিয়ারসোল স্কুলের চারজন শিক্ষক দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হন। তাঁরা হলেন উচ্চাঙ্গ-সঙ্গীতে সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী ভাবধারায় নিবারণ চন্দ্র ঘটক, ফারসি সাহিত্যে হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্যচর্চায় নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯১৭ (শেষদিক) থেকে ১৯২০ (এপ্রিল) খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নজরুলের ছিল সৈনিক জীবন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। প্রায় আড়াই বছর, তিনি ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টের একজন সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল , ব্যাটেলিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদা প্রভৃতি ছিলেন। রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলবির নিকট তিনি ফারসি ভাষা শেখেন, সঙ্গীতানুরাগী সহসৈনিকদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতচর্চা করেন। একই সঙ্গে গদ্যে-পদ্যে সাহিত্যচর্চা করেন। করাচি সেনানিবাসে বসে নজরুল যে রচনাগুলো সম্পন্ন করেন এবং কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তার মধ্যে রয়েছে, প্রথম গদ্য রচনা ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ (‘সওগাত’, মে ১৯১৯), প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’ (‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’, জুলাই ১৯১৯); গল্প: ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’, ‘ঘুমের ঘোরে’; কবিতা: ‘আশায়’ ‘সমাধি’ ইত্যাদি। উল্লেখযোগ্য যে, করাচি সেনানিবাসে থেকেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা―‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘ভারতী’, ‘মানসী’, ‘মর্মবাণী’, ‘সবুজপত্র’, ‘সওগাত’ ও ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’র গ্রাহক ছিলেন। তাছাড়া তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং ফারসি কবি হাফিজের কিছু গ্রন্থ ছিল। প্রকৃতপক্ষে, নজরুলের সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি এই করাচি সেনানিবাসেই। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এই সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় তাঁর আর যাওয়া হয়নি। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে, প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়। মার্চ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন। এখানেই শুরু হয় তাঁর সাহিত্যিক-সাংবাদিক জীবন। কলকাতায় তাঁর প্রথম আশ্রয় ছিল ৩২নং কলেজ স্ট্রীটে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র অফিসে, অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে। প্রথম দিকেই ‘মোসলেম ভারত’, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’, ‘উপাসনা’ প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস ‘বাঁধন হারা’ এবং কবিতা ‘বোধন’, ‘শাত-ইল-আরব’, ‘বাদল প্রাতের শরাব’, ‘আগমনী’, খেয়া-পারের তরণী’, ‘কোরবানী’, ‘মোহররম’, ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজ্দম্’। এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। এর প্রেক্ষিতে কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার ‘মোসলেম ভারত পত্রিকা’য় প্রকাশিত এক পত্রের মাধ্যমে নজরুলে ‘খেয়া-পারের তরণী’ এবং ‘বাদল প্রাতের শরাব’ কবিতা-দুটোর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে একটি সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেন। এ থেকেই দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচকদের সঙ্গে নজরুলের ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়।
নজরুল ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র অফিসে মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, আফজালুল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ সমকালীন মুসলমান সাহিত্যিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। অন্যদিকে, কলকাতার তৎকালীন জমজমাট দুটো সাহিত্যিক আসর ‘গজেনদার আড্ডা’ ও ‘ভারতীয় আড্ডা’য় অতুলপ্রসাদ সেন, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বাংলার সমকালীন শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত ও নাট্যজগতের দিকপালদের সঙ্গে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পান। অক্টোবর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন; তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত (১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ) তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক, যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা অক্ষুণ্ন থাকে।
১২ই জুলাই ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে, ‘নবযুগ’ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। অসহযোগ ও খিলাফৎ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুলের সাংবাদিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। নজরুলের লেখা ‘মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে?’ প্রবন্ধের জন্য এই বছরেরই আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত হয় এবং নজরুলের উপর পুলিশের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। ‘নবযুগ’ পত্রিকার সাংবাদিকরূপে নজরুল যেমন একদিকে স্বদেশ ও আন্তর্জাতিক জগতের রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থা নিয়ে লিখেতে শুরু করেন, তেমনি মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে উপস্থিত থেকে সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পান। একাধারে বিভিন্ন ঘরোয়া আসর ও অনুষ্ঠানে যোগদান এবং সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য-দিয়ে নজরুলের সংস্কৃতিচর্চাও অগ্রসর হতে থাকে। বিভিন্ন ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিতা ও সঙ্গীতের চর্চাও চলছিল ।
নজরুল তখনও স্বরচিত গানে সুরারোপ করতে শুরু করেননি, তবে তাঁর কয়েকটি কবিতায় সুরারোপ করে স্বরলিপিসহ পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করেন ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীতজ্ঞ মোহিনী সেনগুপ্তা, উদাহরণস্বর, ‘হয়তো তোমার পাব দেখা’, ‘ওরে এ কোন্ স্নেহ-সুরধুনী’ প্রভৃতি। বৈশাখ ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দে, নজরুলের গান ‘বাজাও প্রভু বাজাও ঘন’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘সওগাত’ পত্রিকায়।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দে নজরুল ‘মুসলিম সাহিত্য সমিতি’র অফিসে পরিচিত হন প্রকাশক আলী আকবর খানের সঙ্গে এবং তাঁর সঙ্গেই নজরুল প্রথম কুমিল্লায় বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। এখানে তিনি আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসার খানম ও প্রমীলার সঙ্গে পরিচিত হন। নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় নার্গিস আসার খানমের সঙ্গে, তবে ‘ঘর জামাই’ থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ‘ঘর জামাই’ থাকতে অস্বীকার করেন এবং বিয়ের অনুষ্ঠান ত্যাগ করে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়ি চলে আসেন। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন; এই পরিচয়ের সূত্র ধরেই পরবর্তীতে তাঁরা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। সেই সময় অসহযোগ আন্দোলনে কুমিল্লা উদ্বেলিত। একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নজরুল বিভিন্ন শোভাযাত্রা ও সভায় যোগ দেন। তাঁর মূল কাজ ছিল শোভাযাত্রা ও সভায় যোগ দিয়ে গান গাওয়া। সেই সময়ের তাঁর রচিত ও সুরারোপিত স্বদেশী গানগুলো হচ্ছে, ‘এ কোনো পাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মার আঙ্গিনায়’, ‘আজি রক্ত-নিশি ভোরে/ একি এ শুনি ওরে/ মুক্তি-কোলাহল বন্দী-শৃঙ্খলে’ প্রভৃতি। এভাবেই কলকাতার সৌখিন গীতিকার ও গায়ক নজরুল কুমিল্লায় অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান এবং পরাধীনতার বিরুদ্ধে জাগরণী গান রচনা ও পরিবেশনার মধ্য দিয়ে স্বদেশী গান রচয়িতা ও রাজনৈতিক কর্মীতে পরিণত হন। এখানে ১৭ দিন থেকে তিনি স্থান পরিবর্তন করেন। নভেম্বর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল আবার কুমিল্লা আসেন। ২১শে নভেম্বর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে, ভারতব্যাপী হরতাল অনুষ্ঠিত হয়। নজরুল পুনরায় রাজপথে নেমে আসেন এবং অসহযোগ মিছিলের সঙ্গে শহর প্রদক্ষিণ করেন। তখন তিনি পরিবেশন করেন ‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী’ গানটি। নজরুলের এই সময়ের কবিতা, গান ও প্রবন্ধের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব প্রকাশিত হয়। এই সময় তুরস্কে মধ্যযুগীয় সামন্ত-শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতবর্ষের মুসলমানরা খিলাফৎ আন্দোলন করে। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আর মওলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর নেতৃত্বে খিলাফৎ আন্দোলনের দর্শনে নজরুল আস্থাশীল না থাকলেও স্বদেশে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বরাজ বা স্বাধীনতা অর্জন আর মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কের সালতানাত উচ্ছেদকারী নব্য-তুর্কি আন্দোলনের প্রতি নজরুলের সমথনে ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্মিলিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের জন্যই তিনি এই দুটো আন্দোলনে যোগদান করেন।
ডিসেম্বর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে, কুমিল্লা থেকে কলকাতা এসে নজরুল তাঁর দুটো ঐতিহাসিক ও বৈপ্লবিক সৃষ্টিকর্ম রচনা করেন। একটি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা, আর অন্যটি ‘ভাঙার গান’ সঙ্গীত। এই দুটো রচনা বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য নজরুল ভারতবর্ষের সাহিত্য সমাজে খ্যাতিলাভ ও জনপিয়তা অর্জন করেন।
১৯২১ সালের শেষদিকে নজরুল আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা’ রচনা করেন, যার মাধ্যমে তাঁর সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনা এবং ভারতবর্ষের মুসলমানদের খিলাফৎ আন্দোলনের অসারতার পরিচয় পাওয়া যায়। নজরুল তাঁর রাষ্ট্রীয় ধ্যান-ধারণাযয় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হন মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্ব দ্বারা, কারণ তিনি সামন্ততান্ত্রিক খিলাফৎ বা তুরস্কের সুলতানকে উচ্ছেদ করে তুরস্ককে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করেছিলেন। তুরস্কের সমাজ-জীবন থেকে মোস্তফা কামাল যে মৌলবাদ ও পর্দাপ্রথা দূর করেন, তা নজরুলকে বেশি অনুপ্রাণিত করে। তিনি মনে করেন যে, তুরস্কে যা সম্ভব, ভারতবর্ষেও তা সম্ভবপর নয় কেন? বস্তুত, গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও আচার সর্বস্বতা থেকে দেশবাসীর মুক্তির জন্য নজরুল আজীবন সংগ্রাম করেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবও নজরুলকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। নজরুলের ‘লাঙল’ ও ‘গণবাণী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সাম্যবাদী’ ও ‘সর্বহারা’ কবিতাগুচ্ছ এবং ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’-এর অনুবাদ ‘জাগ অনশন বন্দী ওঠ রে যত’ এবং ‘রেড ফ্লাগ’ অবলম্বনে রক্তপতাকার গান এর প্রমাণ।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দে নজরুলের যেসব সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয় সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে গল্প-সংকলন ‘ব্যথার দান’, কবিতা-সংকলন ‘অগ্নিবীণা’ ও প্রবন্ধ-সংকলন ‘যুগবাণী’। ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যায় এবং পরপর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়; কারণ এ কাব্যে নজরুলের ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’, ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যে সাড়া জাগানো এবং বাংলা কবিতার মোড় ফেরানো কবিতা সংকলিত হয়।
১২ই আগস্ট১৯২২ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের আবির্ভাব ঘটে তাতে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল। এ পত্রিকা হয়ে ওঠে সশস্ত্র বিপ্লবীদের মুখপত্র। পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু। আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এ দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন’―রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আশীর্বাণী শীর্ষে ধারণ করে। ‘ধূমকেতু’র ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের সংখ্যায় নজরুলের প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশিত হয়। ৮ই নভেম্বর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে, পত্রিকার এই সংখ্যাটি নিষিদ্ধ করা হয়। ২৩শে নভেম্বর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে, নজরুলের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘যুগবাণী’ বাজেয়াপ্ত হয় । একই দিনে নজরুলকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে কলকাতায় আনা হয়। ৭ জানুয়ারি ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে, বিচারাধীন বন্দি হিসেবে নজরুল আত্মপক্ষ সমর্থন করে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে জবানবন্দি প্রদান করেন। এই জবানবন্দি, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে সাহিত্য-মর্যাদা পায়। ১৬ জানুয়ারি ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে, বিচারের রায়ে নজরুল এক বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
নজরুল যখন আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বসন্ত গীতিনাট্য তাঁকে উৎসর্গ করেন (২২শে জানুয়ারি ১৯২৩)। এ ঘটনায় উল্লসিত নজরুল জেলখানায় বসে তাঁর অনুপম কবিতা ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ রচনা করেন।
১৪ই এপ্রিল ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে, নজরুলকে হুগলি জেলে স্থানান্তর করা হয়। রাজবন্দিদের প্রতি ইংরেজ জেল-সুপারের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে সেই দিন থেকেই তিনি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ জানিয়ে নজরুলকে টেলিগ্রাম করেন। অবশ্য জেল কর্তৃপক্ষের বিরূপ মনোভাবের কারণে নজরুল টেলিগ্রামটি পাননি। এদিকে ২২ মে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে, জনমতের চাপে জেল-পরিদর্শক আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী হুগলি জেল পরিদর্শন করেন এবং তাঁর আশ্বাস ও অনুরোধে সেই দিনই নজরুল চল্লিশ দিনের অনশন ভঙ্গ করেন। ১৮ই জুন ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ, নজরুলকে বহরমপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। ১৫ই ডিসেম্বর ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে, নজরুলকে মুক্তি দেওয়া হয়। হুগলি জেলে বসে নজরুল রচনা করেন ‘এই শিকল-পরা ছল মোদের, এ শিকল-পরা ছল’, আর বহরমপুর জেলে ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলেছ জুয়া’ এ বিখ্যাত গান-দুটো।
অক্টোবর ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে, নজরুলের প্রেম ও প্রকৃতির কবিতার প্রথম সংকলন ‘দোলন-চাঁপা’ প্রকাশিত হয় । এতে সংকলিত দীর্ঘ কবিতা ‘পূজারিণী’তে নজরুলের রোমান্টিক প্রেম-চেতনার বহুমাত্রিক স্বরূপ প্রকাশ পায়।
২৫শে এপ্রিল ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে, কলকাতায় নজরুল ও ব্রাহ্মসমাজভুক্ত প্রমীলার বিয়ে সম্পন্ন হয়। তাঁর মা গিরিবালা দেবী ছাড়া পরিবারের অন্যরা এই বিয়েকে সমর্থন করেননি। নজরুলও আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। হুগলির মহীয়সী মহিলা মিসেস মাসুমা রহমান এই বিয়েতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। নজরুল হুগলিতেই সংসার-জীবন শুরু করেন।
আগস্ট ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে নজরুলের গান ও কবিতা সংকলন ‘বিষের বাঁশী’ ও ‘ভাঙার গান’ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থ-দুটোই একই বছর অক্টোবর ও নভেম্বরে সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়।
১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল-সঙ্গীতের প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয় হিজ মাস্টার্স ভয়েস (এইচ.এম.ভি) কোম্পানি থেকে। শিল্পী হরেন্দ্রনাথ দত্তের কণ্ঠে ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলেছ জুয়া’ ও ‘যাক পুড়ে যাক বিধির বিধান সত্য হোক’ গান-দুটো রেকর্ড করা হয়। এই সময় নজরুল বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে যোগ দিতে থাকেন এবং স্বরচিত স্বদেশী গান পরিবেশন করে পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। মে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল তাঁর একটি জনপ্রিয় স্বদেশী গান ‘ঘোর্ রে ঘোর্ রে আমার সাধের চর্কা ঘোর’ ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উপস্থিতিতে পরিবেশন করেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগদান করেন। তিনি কুমিল্লা, মেদিনীপুর, হুগলি, ফরিদপুর, বাঁকুড়া এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ করেন। নজরুল এ সময় বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সদস্য হওয়া ছাড়াও শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের জন্য ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দল’ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। রাজনীতিক নজরুলের একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ছিল সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ পত্রিকা প্রকাশ। তিনি এ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন। এর প্রথম সংখ্যাতেই নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ কবিতাসমষ্টি মুদ্রিত হয়। ‘লাঙল’ ছিল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম শ্রেণী-সচেতন সাপ্তাহিক পত্রিকা। এতে প্রকাশিত ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দল’-এর ম্যানিফেস্টোতে প্রথম ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপিত হয়। এই সময় নজরুল পেশাজীবী শ্রমিক-কৃষক সংগঠনের উপযোগী সাম্যবাদী ও সর্বহারা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে, নজরুলের গল্প-সংকলন ‘রিক্তের বেদন’, কবিতা ও গানের সংকলন ‘চিত্তনামা’, ‘ছায়ানট’, ‘সাম্যবাদী’ ও ‘পূবের হাওয়া’ প্রকাশিত হয়। হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের অগ্রদূত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অকাল মৃত্যুতে (১৬ই জুন ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে) শোকাহত নজরুল কর্তৃক রচিত গান ও কবিতা নিয়ে ‘চিত্তনামা’ গ্রন্থটি সংকলিত হয়।
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল কৃষ্ণনগরে বসবাস শুরু করেন। ১১ই ও ১২ই মার্চ ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল বঙ্গীয় ও আসাম প্রদেশীয় মৎসজীবী সম্মেলনে (মাদীরীপুর) যোগদান করেন। এই সম্মেলনের উদ্বোধনী সঙ্গীত ছিল নজরুলের ‘জেলেদের গান’টি। নজরুল বাংলা গানে এক নতুন ধারার সংযোজন করেন। তিনি স্বদেশী গানকে স্বাধীনতা ও দেশাত্মবোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সর্বহারা শ্রেণীর গণসঙ্গীতে রূপান্তরিত করেন। এপ্রিল ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল কলকাতার প্রথম বামপন্থী সাপ্তাহিক ‘গণবাণী’ র জন্য রচনা করেন ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’ ও ‘রেড ফ্লাগ’ অবলম্বনে ‘জাগো অনশন বন্দী’, ‘রক্তপতাকার গান’ ইত্যাদি।
অক্টোবর ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে, হরেন্দ্রকুমার চৌধুরীর আমন্ত্রণে সিলেট ভ্রমণ করেন। নভেম্বর ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে, অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় আইনসভার উচ্চ পরিষদের সদস্যপদের জন্য পূর্ব-বঙ্গ থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা নজরুলের রাজনৈতিক জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ উপলক্ষে তিনি পূর্ব-বঙ্গে, বিশেষ করে ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল ও ময়মনসিংহে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেন। স্কুলজীবনে ত্রিশাল-দরিরামপুরে থাকাকালে এ অঞ্চল সম্পর্কে তাঁর যে অভিজ্ঞতার সূত্রপাত হয়, রাজনৈতিক ও বৈবাহিক কারণে তা আরো গভীর হয়।
নজরুল ছিলেন বাংলা গজল গানের স্রষ্টা। গণসঙ্গীত ও গজলে যৌবনের দুটো বিশিষ্ট দিক সংগ্রাম ও প্রেমের পরিচর্যাই ছিল মুখ্য। নজরুল গজল আঙ্গিক সংযোজনের মাধ্যমে বাংলা গানের প্রচলিত ধারায় বৈচিত্র্য আনয়ন করেন। তাঁর অধিকাংশ গজলের বাণীই উৎকৃষ্ট কবিতা এবং তার সুর রাগভিত্তিক। আঙ্গিকের দিক থেকে সেগুলি উর্দু গজলের মতো তালযুক্ত ও তালছাড়া গীত। নজরুলের বাংলা গজল গানের জনপ্রিয়তা সমকালীন বাংলা গানের ইতিহাসে ছিল তুলনাহীন। ১৯২৬-১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে, কৃষ্ণনগর জীবনে নজরুল উভয় ধারায় বহুসংখ্যক গান রচনা করেন। এই সময়ে তিনি স্বরচিত গানের স্বরলিপি প্রকাশ করতে থাকেন। নজরুলের সৃজনশীল মৌলিক সঙ্গীত প্রতিভার প্রথম স্ফুরণ ঘটে ১৯২৬-১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে, কৃষ্ণনগরে; অথচ নজরুলের কৃষ্ণনগর জীবন ছিল অভাব-অনটন, রোগ-শোক ও দুঃখ-দারিদ্র্যক্লিষ্ট। তখনও পর্যন্ত নজরুল কোনো প্রচার মাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হননি, তবে দিলীপকুমার রায় ও সাহানা দেবীর মতো বড় মাপের শিল্পী ও সঙ্গীতজ্ঞ নজরুলের গানকে বিভিন্ন আসরে ও অনুষ্ঠানে পরিবেশন করে জনপ্রিয় করে তুলেন।
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে, একদিকে, সাপ্তাহিক ‘শনিবারের চিঠি’তে রক্ষণশীল হিন্দু বিশেষত ব্রাহ্মণসমাজের একটি অংশ থেকে, অন্যদিকে, মৌলবাদী মুসলমান সমাজের ‘ইসলাম দর্শন’, ‘মোসলেম দর্পণ’ প্রভৃতি পত্রিকায় নজরুল-সাহিত্যের বিরূপ সমালোচনার ঝড় ওঠে। ‘শনিবারের চিঠি’তে নজরুলের বিভিন্ন রচনার প্যারডি প্রকাশিত হতে থাকে। তবে নজরুলের সমর্থনে ‘কল্লোল’, ‘কালি-কলম’ প্রভৃতি প্রগতিশীল পত্রিকা এগিয়ে আসে। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে, নজরুলের কবিতা ও গানের সংকলন ‘ফণি-মনসা’ এবং পত্রোপন্যাস ‘বাঁধন হারা’ প্রকাশিত হয়।
২৮শে ফেব্রুয়ারি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের উদ্যোক্তা ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান করেন। ফেব্রুয়ারি ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে, দ্বিতীয় সপ্তাহে নজরুল ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য পুনরায় ঢাকা আসেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, ছাত্র বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত এবং গণিতের ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে পরিচিয় হন। একই বছর জুন মাসে পুনরায় ঢাকা এলে সঙ্গীত চর্চাকেন্দ্রের রানু সোম (প্রতিভা বসু) ও উমা মৈত্রের (লোটন) সঙ্গে কবির ঘনিষ্ঠতা হয়। অর্থাৎ এ সময় পরপর তিনবার ঢাকায় এসে নজরুল ঢাকার প্রগতিশীল অধ্যাপক, ছাত্র ও শিল্পীদের সঙ্গে পরিচিত হন।
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল আবার সিলেট ভ্রমণে আসেন। একই সালে, কলকাতায় আকরম খাঁ-র মাসিক ‘মোহাম্মদী পত্রিকা’য় নজরুল-বিরোধিতা শুরু হয়, কিন্তু মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের ‘সওগাত’ পত্রিকা বলিষ্ঠভাবে নজরুলকে সমর্থন করে। নজরুল ‘সওগাত’-এ যোগদান করে একটি রম্য বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ‘সওগাত’-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে আবুল কালাম শামসুদ্দীন নজরুলকে যুগপ্রবর্তক কবি ও বাংলার জাতীয় কবি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল উত্তর-বঙ্গ ভ্রমণ করেন। ২১শে ও ২২শে ডিসেম্বর ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল ‘নিখিল ভারত কৃষক ও শ্রমিক দল’-এর সম্মেলনে যোগদান করেন। ২৮শে ডিসেম্বর ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল ‘নিখিল ভারত সোসিয়ালিস্ট যুবক কংগ্রেস’-এর অধিবেশনে উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে, নজরুল কৃষ্ণনগরের বাড়ি ছেড়ে সপরিবারে কলকাতা চলে আসেন।
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে, ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে বেতার ও মঞ্চের সঙ্গে এবং ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯২৮-১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল ‘এইচ.এম.ভি’ গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে সঙ্গীত-রচয়িতা ও প্রশিক্ষক রূপে সংযুক্ত হন। ‘এইচ.এম.ভি’ গ্রামোফোন কোম্পানিতে নজরুলের প্রশিক্ষণে প্রথম রেকর্ডকৃত তাঁর দুটো গান ‘ভুলি কেমনে’ ও ‘এত জল ও কাজল চোখে’ প্ররিবেশন করেন আঙ্গুরবালা। নজরুলের নিজের প্রথম রেকর্ড ছিল স্বরচিত ‘নারী’ কবিতার আবৃত্তি। ১২ নভেম্বর ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল কলকাতা বেতার কেন্দ্র সান্ধ্য অধিবেশনে থেকে প্রথম অনুষ্ঠান প্রচার করেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে, ‘মনোমোহন থিয়েটার’-এ প্রথম মঞ্চস্থ শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের রক্তকমল নাটকের জন্য নজরুল গান রচনা ও সুর সংযোজনা করেন। শচীন্দ্রনাথ ওই নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে, মঞ্চস্থ মন্মথ রায়ের চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী নাটক ‘কারাগার’-এ নজরুলের আটটি গান ছিল, নাটকটি একটানা ১৮ রজনী মঞ্চস্থ হওয়ার পর সরকার নিষিদ্ধ করে।
জানুয়ারি ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে নজরুল দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, চট্টগ্রাম এবং মার্চ ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কুষ্টিয়া ও বগুড়া ভ্রমণ করেন। নজরুল চট্টগ্রাম ভ্রমণকালে হবীবুল্লাহ বাহার ও শামসুন্নাহার ভাইবোনের আতিথ্য গ্রহণ করেন; বন্ধু কমরেড মুজফ্ফর আহমদের জন্মস্থান সনদ্বীপও ভ্রমণ করেন। ১৯২৮-১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে, নজরুলের কবিতা ও গানের সংকলন ‘সিন্ধু-হিন্দোল’ (১৯২৮), ‘সঞ্চিতা’ (১৯২৮); ‘বুলবুল’ (১৯২৮), ‘জিঞ্জীর’ (১৯২৮) ও ‘চক্রবাক’ (১৯২৯) প্রকাশিত। ১৯২৯ সালে কবির তৃতীয় পুত্র কাজী সব্যসাচীর জন্ম হয়, আর মে মাসে চার বছরের প্রিয়পুত্র বুলবুল বসন্ত রোগে মারা যায়। কবি এতে প্রচন্ড আঘাত পান। অনেকে বলেন এ মৃত্যু নজরুলের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি ক্রমশ অন্তর্মুখী হয়ে উঠেন এবং আধ্যাত্মিক সাধনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। বুলবুলের রোগশয্যায় বসে নজরুল হাফিজের ‘রুবাইয়াৎ’ অনুবাদ করেন, যা পরে ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ নামে প্রকাশিত হয়।
১০ই ডিসেম্বর ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে, কলকাতার এলবার্ট হলে বাঙালিদের পক্ষ থেকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে এক বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, অভিনন্দন-পত্র পাঠ করেন ব্যারিস্টার এস ওয়াজেদ আলি, শুভেচ্ছা ভাষণ দেন বিশিষ্ট রাজনীতিক সুভাষচন্দ্র বসু (নেতাজী) এবং রায়বাহাদুর জলধর সেন। কবিকে সোনার দোয়াত-কলম উপহার দেওয়া হয়। এ সংবর্ধনা সভায় প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, নজরুল ইসলামের কবিতা পাঠে আমাদের ভাবী বংশধরেরা এক একটি অতি মানুষে পরিণত হইবে।’ সুভাষচন্দ্র বসু বলেন, ‘আমরা যখন যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাব তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে! আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তাঁর গান গাইব।’
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে, প্রকাশিত হয় নজরুলের রাজনৈতিক উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’, গানের সংকলন ‘নজরুল-গীতিকা’, নাটিকা ‘ঝিলিমিলি’ এবং কবিতা ও গানের সংকলন ‘প্রলয়-শিখা’ ও ‘চন্দ্রবিন্দু’। ‘চন্দ্রবিন্দু’ গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত এবং ‘প্রলয়-শিখা’র জন্য নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে, প্রকাশিত আদালতের রায়ে নজরুলের ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়, নজরুল হাইকোর্টে আপিল ও জামিন লাভ করেন। ইতোমধ্যে ‘গান্ধী-আরউইন চুক্তি’র ফলে হাইকোর্ট কর্তৃক নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা খারিজের আদেশ দেওয়া হয়, ফলে নজরুলকে দ্বিতীয়বার কারাবাস করতে হয়নি।
জুন-জুলাই ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল দার্জিলিং ভ্রমণ করেন। রবীন্দ্রনাথও তখন দার্জিলিং-এ ছিলেন। তাঁর সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎ হয়। এ বছর প্রকাশিত হয় নজরুলের উপন্যাস ‘কুহেলিকা’, গল্প-সংকলন ‘শিউলিমালা’, গানের স্বরলিপি ‘নজরুল-স্বরলিপি’ এবং গীতিনাট্য ‘আলেয়া’। ৩রা পৌষ ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে, নজরুলের নাটক ‘আলেয়া’ কলকাতার নাট্যনিকেতনে প্রথম মঞ্চস্থ হয়। এতে গানের সংখ্যা ছিল ২৮টি। এই বছর নজরুল আরো নাটকের জন্য গান রচনা ও সুরারোপ করেন, যেমন―যতীন্দ্রমোহন সিংহের ‘ধ্রুবতারা’ উপন্যাসের নাট্যরূপের চারটি গান (সুরারোপ), মন্মথ রায়ের ‘সাবিত্রী’ নাটকের ১৩টি গান (রচনা ও সুরারোপ)। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে, কলকাতা বেতার থেকে প্রচারিত মন্মথ রায়ের ‘মহুয়া’ নাটকের গানগুলোর রচয়িতা ছিলেন নজরুলই।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল রাউজানে (চট্টগ্রাম) এক সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান করেন। ৫ই ও ৬ই নভেম্বর ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল সিরাজগঞ্জে ‘বঙ্গীয় মুসলমান তরুণ’ সম্মেলনে যোগদান করেন। ২৫-২৬ ডিসেম্বর ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে, কলকাতা এলবার্ট হলে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য’ সম্মেলনে যোগদান করেন। সম্মেলনের সভাপতি কবি কায়কোবাদ নজরুলকে মাল্যভূষিত করেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে, নজরুলের প্রকাশনার মধ্যে সবগুলোই ছিল গীতিসংকলন, যথা―‘সুর-সাকী’, ‘জুলফিকার’ ও ‘বন-গীতি’।
১৯৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল ‘এইচ.এম.ভি’ ছেড়ে ‘মেগাফোন’ রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন। এই কোম্পানির রেকর্ড করা প্রথম দুটো নজরুল-সঙ্গীত ছিল ধীরেণ দাসের গাওয়া ‘জয় বাণী বিদ্যাদায়িনী’ ও ‘লক্ষ্মী মা তুই’। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল এক্সক্লুসিভ কম্পোজাররূপে ‘এইচ.এম.ভি’-তে পুনরায় যোগদান করেন। এই সময় তাঁর অনেক গান রেকর্ড হয়। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল তিনটি মূল্যবান অনুবাদ-কর্ম সমাপ্ত করেন; যথা―‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’, ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’ এবং ‘কাব্য আমপারা’।
রেকর্ড, বেতার ও মঞ্চের পর নজরুল, ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে, চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি প্রথমে যে ছায়াছবির জন্য কাজ করেন সেটি ছিল গিরিশচন্দ্র ঘোষের কাহিনী ‘ভক্ত ধ্রুব’ (১৯৩৪)। এ ছায়াছবির পরিচালনা, সঙ্গীত রচনা, সুর সংযোজনা ও পরিচালনা এবং নারদের ভূমিকায় অভিনয় ও নারদের চারটি গানের প্লেব্যাক নজরুল নিজেই করেন। ছবির আঠারোটি গানের মধ্যে সতেরোটির রচয়িতা ও সুরকার ছিলেন নজরুল। এছাড়া তিনি আর যেসব চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন সেগুলো হচ্ছে―‘পাতালপুরী’ (১৯৩৫), ‘গ্রহের ফের’ (১৯৩৭), ‘বিদ্যাপতি’ (বাংলা ও হিন্দি ১৯৩৮), ‘গোরা’ (১৯৩৮), ‘নন্দিনী’ (১৯৪৫) এবং ‘অভিনয় নয়’ (১৯৪৫)। বিভিন্ন ছায়াছবিতে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ব্যবহৃত নজরুল-সঙ্গীতের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। চলচ্চিত্রের মতো মঞ্চ-নাটকের সঙ্গেও নজরুল ত্রিশের দশকে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯২৯-১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে, কলকাতার বিভিন্ন মঞ্চে স্বরচিত দুটো নাটক ‘আলেয়া’ ও ‘মধুমালা’ সহ প্রায় ২০টি মঞ্চ-নাটকের সঙ্গে তিনি সংযুক্ত ছিলেন। ‘রক্তকমল’, ‘মহুয়া’, ‘জাহাঙ্গীর’, ‘কারাগার’, ‘সাবিত্রী’, ‘আলেয়া’, ‘সর্বহারা’, ‘সতী’, ‘সিরাজদ্দৌলা’, ‘দেবীদুর্গা’, ‘মধুমালা’, ‘অন্নপূর্ণা’, ‘নন্দিনী’, ‘হরপার্বতী’, ‘অর্জুন-বিজয়’, ‘ব্ল্যাক আউট’ ইত্যাদি নাটকে ১৮২টি নজরুল-সঙ্গীত অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল-প্রকাশনার সবই ছিল সঙ্গীত-বিষয়ক; যথা―‘গীতি-শতদল’, ‘গানের মালা’ ‘সুরলিপি’, ‘সুরমুকুর’ ইত্যাদি।
অক্টোবর ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল কলকাতা বেতারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সংযুক্ত হন। তাঁর তত্ত্বাবধানে সঙ্গীতানুষ্ঠান প্রচারিত হয়; যথা―‘হারামণি’, ‘মেল-মিলন’ ও ‘নব-রাগ-মালিকা’। ১৯৩৯-১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর সহযোগিতায় কলকাতা বেতার থেকে রাগভিত্তিক ব্যতিক্রমধর্মী সঙ্গীতানুষ্ঠান পরিবেশন করেন, যা ছিল নজরুলের সঙ্গীত-জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পর্ব। ১৯৩৯-১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে, ‘এইচ.এম.ভি’ (৫৬৭টি), ‘মেগাফোন’ (৯১টি), ‘টুইন’ (২৮০টি), ‘কলম্বিয়া’ (৪৪টি), ‘হিন্দুস্থান’ (১৫টি), ‘সেনোলা’ (১৩টি), ‘পাইওনিয়ার’ (২টি), ‘ভিয়েলোফোন’ (২টি), ‘রিগ্যান’ (১টি) প্রভৃতি থেকে প্রায় এক হাজার নজরুল-সঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয়।
৭ই আগস্ট ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে, ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে শোকাহত নজরুল তাৎক্ষণিকভাবে রচনা করেন ‘রবিহারা’ ও ‘সালাম অস্তরবি’ কবিতা-দুটো এবং ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’ শোকসঙ্গীত। ‘রবিহারা’ কবিতাা নজরুল স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করেন কলকাতা বেতারে, গ্রামোফোন রেকর্ডে। ‘ঘুমাইতে দাও’ গানটিও কয়েকজন শিল্পীকে নিয়ে স্বকণ্ঠে প্ররিবেশন করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল অসুস্থ এবং ক্রমশ নির্বাক ও সম্বিতহারা হয়ে যান। দেশে ও বিদেশে কবির চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়, তবে কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। ১৯৪২ (জুলাই)―১৯৭৬ (আগস্ট) খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, দীর্ঘ ৩৪টি বছর নজরুলের এই অসহনীয় নির্বাক জীবনকাল অতিবাহিত হয়। ২৪শে মে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে, ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে নজরুলকে সপরিবারে স্বাধীন বাংলাদেশে আনা হয়। ৯ই ডিসেম্বর ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নজরুলের অবদানের স্বীকৃতি-স্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তনে তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। জানুয়ারি ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে, নজরুলকে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত করে। ২৯শে আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে, ১২ই ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে, ঢাকার পিজি হাসপাতালে নজরুল শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের উত্তর পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় কবি, বাঙালির জাতীয় কবি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে।
বন্ধু-গো আর বলিতে পারি না,
বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে।
দারুন
মুক্তমনা-র উপস্থাপনা চমৎকার। কাজী নজরুল আমাদের সমাজের পতিতাদের নিয়ে ‘বারাঙ্গনা’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। সেই কবিতাটি আপনাদের কাছে থাকলে আমাকে পাঠালে সবিশেষ উপকৃত হবো। কাছে না থাকলে কবিতা টি নজরুল ইসলামের কোন গ্রন্থ’য়ে রয়েছে ,জানা থাকলে আমাকে জানালে উপকৃত হবো। আন্তরিক শুভেচ্ছা রইলো।
আব্দুর রউফ চৌধুরী নামটা দেখে আমার প্রিয় একজন লেখক আব্দুর রউফ চৌধুরী (মার্চ ১, ১৯২৯ – ফেব্রুয়ারি ২৩, ১৯৯৬) কথা মনে পড়ে গেল। এটি কী ওনার প্রবন্ধ কিনা জানি না। “নজরুলের সঙ্গীতের জগৎ” নামে একটা প্রবন্ধ আছে (পড়া হয় নাই)।
https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%86%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B0_%E0%A6%B0%E0%A6%89%E0%A6%AB_%E0%A6%9A%E0%A7%8C%E0%A6%A7%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%80
সত্যিই অসাধারণ এক নজরুল বিশ্লেষণ। প্রশংসার দাবি রাখে আপনার প্রবন্ধটি। আসলে নজরুল কে বিভিন্ন সময় মোল্লা মুলভিরা পুরহিত গোস্টি নাস্তিক আখ্যা দিয়েছন কিন্তু আজকে উনাকে মুসলিমরা নিজেদের সম্পদ করে নিয়েছে আরেকদিকে সনাতন বাদিরা নজরুল কে বর্জন করেছে। যা খুব আপসোসের।
অনেক informative লেখা।। নজরুল একটা সময়ে শাক্ত পথে ধরে ব্ল্যাক ম্যাজিকে ঝুকে পরেছিল তার পুত্রের মৃত্যুর পরে। সেই ব্যপারটা উল্লেখ থাকলে আরো ভালো হতো মনে হয়।
মুক্তমনায় স্বাগতম।