“ব্যধিই সংক্রামক, সাস্থ্য নহে।” কথাটা আবারো মনে পড়লো ফরহাদ মজহারের নতুন একটা লেখায় চোখ আটকে যাওয়ায়।
বিজ্ঞানমনস্ক মুক্তমনা যুক্তিবোধসম্পন্ন লেখক, সংগঠক অভিজিৎ রায়ের মৃত্যর পর নানাদিক থেকে নানা মহল বহু বর্ণের বহু ছন্দের ও বহুমাত্রার অদ্ভুত সমস্ত বিশ্লেষণ নিয়ে হাজির হচ্ছেন।
যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক লেখালেখির বিপ্রতীপ সেই প্রবন্ধগুলো পড়লে সরাসরি না হলেও প্রচ্ছন্ন বিদ্বেষ আর যুক্তিহীনতার মিশেল পাঠক ঠিকই অনুভব করতে পারে। আর অভিদা’র মৃত্যু পরবর্তী সময়ে হঠাৎ করে এই বিষয়ক লেখার স্পৃহা জাগ্রত হবার কারণটিও স্পষ্ট বলেই প্রতিভাত হয়।
ভিন্নমত থাকতেই পারে। বহুমত্রিক সমাজে ভিন্নমতের চর্চা একট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও বটে। কিন্তু যে ভিন্নমত শুধুমাত্র একজন মৃত বিপ্লবীর বিপ্লবের সারবস্তুকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যই প্রদর্শিত হয়, তাঁর সারা জীবনের অর্জন এবং বিশ্বাসকে অবনমিত করার উদ্দেশ্যেই প্রচারিত হয়, সেটি ভিন্নমতের থেকেও ভয়ার্ত আর্তচিৎকার বলেই ভ্রম হয়। মনোহরণকারী বাক্য আর মানুষের আবেগকে পুঁজি করে লিখলেও অপযুক্তি আর বুদ্ধিবৃত্তিক কপটতা শেষ পর্যন্ত ভণ্ডামিরই নামান্তর।অভিজিৎ মৃত, শারীরিকভাবে, কিন্তু তাঁর চর্চাকৃত যুক্তি বুদ্ধি আর বিজ্ঞানভিত্তিক মুক্তচিন্তার আন্দোলন ও যে এত বিশাল ভীতিজাগানিয়া, যে বিজ্ঞানবাদিতা নামক এক জুজুবুড়িকে আমদানি করে তার সাথে যুঝতে হবে, এই চিন্তা একইসাথে কৌতুকপ্রদ অথচ নির্মম।
ফরহাদ মজহার তথা বরবাদ মগবাজারের মতো নীচ, সুবিধাবাদী,জামাত তোষণকারী, হেফাজতের ভাবগুরু, পতিত, সর্বার্থে ভণ্ড, হাওয়া বুঝে পাল তোলা কলমজীবীর লেখা নিয়ে সময় নষ্ট করার মানে হয়না। কিন্তু অভিদা’র মৃত্যুর পর এই লোকটির বুদ্ধিবৃত্তিক দ্বিচারিতা আর ভণ্ডামির একটি নমুনা দেখে আক্ষরিক অর্থেই বাক্রহিত হয়ে গেছি।
বিজ্ঞানমনস্কতার বিরুদ্ধে এইভাবে খড়্গহস্ত হওয়া থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, অভিজিৎরায় আর তার সমমনা মুক্তমনাদের কী ভীষণ বেশি প্রয়োজন এই দেশে। লেখাটির প্রতিটি পরিচ্ছদ স্ববিরোধিতায় পরিপূর্ণ, মাঝে মাঝে মনে হয়, হি ওয়াজ অন সাম সর্ট অফ ড্রাগস যখন এটা লিখছিলেন। “বিজ্ঞানমনস্কতা” র বিপরীতে “বিজ্ঞানবাদিতা” শব্দগুচ্ছ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে এটিকে মার্ক্সবাদ বা অন্য কোনো বাদ বা ইজম এর সাথে তুলনা করতে গিয়ে ল্যাজেগোবরে করেছেন, “সূর্য না, বরং পৃথিবীটাই সূর্যের চারদিকে ঘোরে-বিজ্ঞানের এই সত্য আধুনিক মানুষের দাপট, আধিপত্য ও সাফল্যের কারণে সিধা সরল সাধারণ মানুষ মেনে নেয়” এই জাতীয় মিথ্যা সগৌরবে প্রচার করেছেন এবং তার মাধ্যমে “সিধা সরল সাধারণ মানুষ”রা পুরাণের সূর্যদেবের মাহাত্ম্য না বুঝতে পেরে কী ভীষণ দার্শনিকতা মিস্ করছেন জীবনের সত্যে আর বিজ্ঞানের সত্যে একটা বিশাল ফারাক তৈরী হওয়ায়-সে দুঃখে তিনি কাতর।
আরেকটু এগিয়ে গিয়ে আরও ভয়ঙ্কর কথা বলেছেনঃ “কতো সহজে আমাদের কৈশোর বিজ্ঞানের হাতে নিহত হয়েছে। কতো কিশোর কিশোরী বিজ্ঞানের নামে শহিদ হচ্ছে প্রতিদিন কে তার খবর রাখে? তারপর সমাজে যখন এই হতাহতের ঘটনা ভিন্ন এক ব্যাধি হিসাবে ধরা পড়ে ততোদিনে দেরি হয়ে যায়।” চারপাশে তো ধর্মান্ধতার নামেই এখন পর্যন্ত সবগুলো খুন হতে দেখলাম। কোথায় সেসব অগুনতি কিশোরদল যারা বিজ্ঞানের পদতলে নিহত হল, আহ্ চুক্চুক্! লেখাটা পড়লে মনে হয় ক্লাস টেনের কোনো স্ট্রিট-স্মার্ট জামাতি স্কুলবালক “বিজ্ঞান আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ” এই রচনা লিখতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে হাবুডুবু খাচ্ছে, কোন্টা লিখলে ভালো নম্বর পাবে সেই দুশ্চিন্তায় একেক বার একেক কথা বিড়বিড় করছে।
বিজ্ঞানের সমস্ত অর্জনকে স্বীকার করতে বাধ্য হলেও ইনিয়ে বিনিয়ে বারবার বলতে চেয়েছেনঃ“বিজ্ঞানের এই সন্ত্রাস ভয়ানক। বিজ্ঞানের সম্ভাবনা বা অর্জন এখানে তর্কের বিষয় নয়।” ইসলামিক মৌলবাদীরা থাবা বিস্তার করেছে দেশের আনাচে কানাচে। মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা স্বভাবতঃই কোণঠাসা। যুক্তি,বুদ্ধি, চিন্তার মুক্তি যেখানে অত্যাবশ্যকীয় সেখানে বরবাদ মশাই “সন্ত্রাস” খুঁজে পেয়েছেনশুধুমাত্র বিজ্ঞানে। কি চমৎকার!! নানা অং বং চং আউড়ে শেষাবধি যেখানে স্থিত হয়েছেন এই সং সেটা হলোঃ“বুদ্ধি চাই, কিন্তু বুদ্ধিসর্বস্বতা নয়, কারণ অতি বুদ্ধি আমাদের বুদ্ধিমান নয়, আহাম্মকে পরিণত করে।অতি বুদ্ধির গলায় দড়ি কথাটা বোধ হয় এ কারণেই আমরা বলি।” হায়, অতিবুদ্ধি যে তার নিজেকেই সবচাইতে বড় আহাম্মকে পরিণত করেছে এ কথাটা কেউ তাকে বলার অবকাশ পাননি বোধহয়।
মাত্র ক’দিন আগেই এক অর্বাচীন তার ফেইসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলো “বিবর্তনবাদ মানে আমরা সবাই বাঁদর ছিলাম, বাঁদর কেন এখনো আছে?” এই জাতীয় কিছু গর্দভ বাক্য দেখে অনেকে তাকে রগড়েছেন, খুব সংগতভাবেই। বরবাদের মতো নয়া কৃষি আন্দোলনের প্রবক্তা, আমাদের দেশের চাষীদের নিয়ে প্রাণপাত করা, আমাদের “সরল সিধা মানুষ”দের দাবার গুটি বানিয়ে চরম অবৈজ্ঞানিক এবং মধ্যযুগে পা বাড়ানো জ্ঞানপাপী দানবকে কে রগড়াবে? অভিজিৎ রায়দের এতোদিনের লেখালেখি, অর্জন এবং যার জন্য অভিদা কাজ করে গেছে, সেই বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচারের আর প্রসারের মানুষগুলোর সরাসরি এগিয়ে এসে এই লোককে তত্ত্বগতভাবে একটু “শহীদ” করা দরকার। আশা করি বিজ্ঞানের পদতলে এভাবে “শহীদ” হতে ফরহাদের মতো অন্য মুক্তচিন্তার সভ্য মানুষদের আপত্তি হবেনা।
#IamAvijit #WordsCannotBeKilled
লোভ সামলাতে পারলাম না, তাই ….
আসলে এটা তো কিছুই না, ফরহাদ মজহার আর অন্যান্য সমস্ত লোকেদের যে পরিমাণ কুৎসিত ভণ্ডামি দেখছি অভিদা এবং তার পরের খুনগুলোতে- আমি এদের সম্পর্কে লেখার আগ্রহই পুরো হারিয়ে ফেলেছি। আরও আশ্চর্য, হেফাজতের ভাবগুরু হয়ে এই লোকটি বিবি খাদিজা সমপর্কে যৌনগন্ধী এবাদতনামা লিখতে পারেন, কিন্তু “ইসলামবিদ্বেষ” এর ফলে খুন হতে হয় অভিজিৎ রায়কে। কী প্যারাডক্স!
সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে কেউ মেইনস্ট্রীম হাত ছাড়া করতে চায় না।
তা আর বলতে।
ফরহাদ মাজহারের আদা খেঁচড়া লেখার ছোট্ট একটি প্রতিক্রিয়া যুগান্তরে পাঠিয়েছিলাম। যেটি ১১ তারিখ কিছুটা সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশিত হয়। লিংক এখানে ।
লিঙ্কটা কেন যেন কাজ করছে না তাই পড়তে পারলাম না, দয়া করে লেখালেখি জারি রাখুন। চিন্তা ডট কম এও প্রতিবাদ করতে পারেন, ওরা ছাপবে কী’না তা অবশ্য জানিনা। বিডিনিউজ ২৪ এ দেখলাম সেজান মাহমুদ নামে একজন লিখেছেন একটি প্রতিক্রিয়া, কিন্তু সেটিও ততোটা সরাসরি আঘাত করেনা। অন্তত অভিদা’র সমমনস্ক লোকজনদের এগুলোর বিরুদ্ধে যুতসই জবাব দেওয়া উচিত। যুক্তিশীলভাবে জবাব দেবার বহু উপায় আছে, ফরহাদের নিজের লেখার দুর্বল দিকগুলো এতোটাই প্রকট।
আমার পিসি’তে ঠিক কাজ করছে লিঙ্কটা। পুনরায় দেখবেন? অথবা এগারো মার্চ তারিখের যুগান্তর দেখুন আর্কাইভ থেকে।
ধন্যবাদ।
বিজ্ঞানবাদিতা কি এবং কেন-তাই নিয়ে ২০০৫ সালে মুক্তমনাতে লিখেছিলাম দীর্ঘ প্রবন্ধ। সেটা
এই লিংকে আছে।
এই প্রবন্ধ নিয়ে অভিজিত, বন্যা, জাহেদ সহ সব মুক্তমনা সদস্যদের সাথে হয়েছিল দীর্ঘ দুমাস ধরে বিতর্ক।
অনেক ক্ষেত্রেই আমরা একমত না হলেও বিজ্ঞানবাদ বা ন্যাচারালিজমের পরিধি কতটা হতে পারে তাই নিয়ে আমরা সবাই ভেবে ছিলাম।
এই প্রবন্ধটা দেখে বুকটা হাও হাও করে উঠলো। ইহাহু গ্রুপে সার্চ চালিয়ে দেখলাম, আমি, অভিজিত, বন্যা সবাই কত বিতর্ক করেছি এই নিয়ে। আজ আমরা সবাই আছি-ও নেই ।শুধু ওর লেখা মেইল গুলো পোষ্টগুলো আছে।
আজকাল মুক্তমনাতে কোন টপিক দেখলেই শুধু ওর কথা মনে পড়ছে।
হ্যাঁ অভিদার স্মৃতি ভীষণভাবে সজীব, সবখানেই। আর ফরহাদ মজহারের লেখায় তিনি কিন্তু বিজ্ঞানবাদ নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ করেননি, শুধু মাত্র তার “সন্ত্রাস” নিয়ে আতঙ্ক জাগানোর বা ইংরেজিতে বলা যায় “spewing hate” এর কাজটা করে গেছেন। অবিশ্বাস্য তার কপটতা।
বরবাদের কথার কোনো মূল্য নাই। সে প্রলাপ বকে।
*অঞ্জন রায়
যে ভেতর থেকে সৎ নয়, তার অসততা-স্ববিরোধীতা-ভন্ডামী-ভিমরতী এক সময় প্রকাশ পায়-ই। বরবাদ মজহার, রঞ্জন রায় ও প্রবীর ঘোষেরা এরই উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
লিংকে গিয়ে পুরোটা পড়াটা আসলেই ধৈর্য্য সাপেক্ষ বিষয়। কারণ আপনি আপনার লেখাতেই উল্লেখ করেছেন- ‘নীচ, সুবিধাবাদী,জামাত তোষণকারী, হেফাজতের ভাবগুরু, পতিত, সর্বার্থে ভণ্ড, হাওয়া বুঝে পাল তোলা কলমজীবী’ সে। মধ্যযুগের অন্ধকারে দেশকে নিতে চাওয়া বিজ্ঞান-বিরোধী ধর্মের ঝান্ডাবাহী হেফাজতীদের ভাবগুরু আদৌ বিজ্ঞান বিষয়ে সত্য কিছু লিখতে পারেন না, কারণ সে ইচ্ছে ও নৈতিক অধিকারও তার থাকতে পারে না। এসব ভন্ডদের লেখা-মিথ্যেচার-ফতোয়া-হোয়াক্স এর যৌক্তিক ও প্রমাণভিত্তিক সমালোচনা-বিরোধীতা ও প্রতিবাদ করে বিজ্ঞানকে সবার সামনে তুলে ধরতে হবে, যা অভিজিৎ রায় করে দেখিয়েছেন।
এই পাঠ-প্রতিক্রিয়াটি বস্তুনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করার জন্য- লেখার জন্য ধন্যবান। শুভ কামনা।
#IamAvijit #WordsCannotBeKilled
ধন্যবাদ আপনাকে।