সতের শতকে (১৭৩৯-৪০) চিত্রশিল্পী রেনি ” হেড অব ক্রাইস্ট” নামের একটি ছবি এঁকেছিলেন। ছবিটিতে দেখা যায় যীশুর মাথায় কাঁটার মুকুট পড়ানো এবং যীশুর গা বেয়ে রক্ত ঝরছে। যীশুর মুখে তীব্র যন্ত্রণার ছাপ। সেই সময় ছবিটি হয়ে উঠেছিল ব্যাপক জনপ্রিয়। সেই জনপ্রিয়তা এখনো বিদ্যমান। সেই সময় থেকে এখন অব্দি অনেক শিল্পী এই ছবিটি এঁকেছেন এবং ব্যাপক চাহিদা থাকার কারনে এখনো আঁকা ও ছাপা হচ্ছে। ছবিটি সেই সময় থেকে হয়ে উঠেছিল যীশুর অন্যতম প্রধান ও জনপ্রিয় ছবি।
যীশুকে নিয়ে যত ছবি আঁকা হয়েছে তা মনে হয় অন্য কোন ধর্মের নবী, পয়গম্বর, দেব দেবী অথবা ঈশ্বর নিয়ে আঁকা হয় নাই। যীশুর সেই “হেড অব ক্রাইস্ট” ছবিটি সেই সময় স্থান পেতো গির্জা থেকে শুরু করে কৃষকের ঘর পর্যন্ত। যীশুর সেই ছবিতে যন্ত্রণাকাতর মুখ খুব সহজেই মানুষের মনে শক্ত স্থান গড়ে নিয়েছিল, পেয়েছিল মানুষের সহানুভূতি ও সম্মান। মানুষ প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বাইরে বের হতো। তাদের মনে একটা সহানুভূতি চিন্তা কাজ করতো, আহা যীশু আমাদের জন্য কি নিদারুণ কষ্টই না সহ্য করেছিলেন। পাপ থেকে তিনি আমাদের মুক্তি দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আমাদের পরিত্রান দাতা। কিন্তু দিন শেষ দেখা যেতো সেই মানুষগুলো পাপের বোঝা পূর্ণ করে তবে ঘরে প্রবেশ করতো।
সেই একি বিষয়বন্তু নিয়ে আরও একটি ছবি আঁকা হয়েছিল মধ্য যুগে। শিল্পির নাম তুসকান মাস্টার, সাল ১১৭৫-১২২৫। ছবিটির বিষয় বস্তু প্রায় এক থাকলেও সেখানে যীশুর অভিব্যক্তি ছিল আলাদা। সেখানে যীশুকে দেখা যাচ্ছিল প্রচণ্ড বিষণ্ণ মনে একজন মানুষ হিসেবে। সেখানে বেদনার ভাষা প্রকাশ ছিল ভিন্ন। যেন যীশু মানুষের প্রতি মহাবিরক্ত। অভিব্যাক্তি ছিল এমন, আমি যাদের জন্য এতো ত্যাগ স্বীকার করলাম তারা আজ বিপথে চালিত মূর্খ অসভ্য জনগণ। মজার ব্যাপার হল, সেই সময় এমনকি পরবর্তীতে কখনোই সেই ছবিটি মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। মানুষ কাঁচের আয়নায় নিজের কুৎসিত মুখ দেখতে নারাজ। কে চাইবে এই সত্যকে স্বীকার করতে? কোন ধার্মিক ই না।
ছবি দুটোর শিল্পগুন বিবেচনায় বিখ্যাত হলেও জনপ্রিয় হয়েছিল রেনির আঁকা ছবিটি। মানুষ নিজের কুৎসিত দিক কখনো প্রকাশ করতে ও দেখতে চান না। প্রায় সকল ধার্মিক মানুষ প্রকাশ্যে নিজেকে ধার্মিক প্রতিপন্ন করলেও আড়ালে আবডালে করে চলে অধর্মের কাজ। আর সেই অপকর্ম প্রকাশিত হলে অথবা ধর্মের কু দিক প্রকাশিত হলে ধার্মিক মানুষ রাগান্বিত হয়ে ওঠেন। যেমন লালন, আরজ আলী মাতুব্বর থেকে অভিজিৎ দা যারা ধর্মের কু দিক ও ধার্মিকদের অধর্মের কর্মকাণ্ড প্রকাশ করেছেন, সবাই হয়ে উঠেছিলেন ধার্মিকদের চোখের বিষ। লালন ও হুমাউন আজাদ হামলার শিকার হয়েছিলেন আর অভিজিৎ দা ধর্মীয় উগ্রবাদীদের আক্রমনে প্রান হারিয়েছেন। তাদের কথা কখনো ধার্মিক মানুষদের ভাল লাগেনি। তাদের সত্য কথন মানুষের মিথ্যা বিশ্বাসে আঘাত করেছে তীব্র ভাবে, যাকে ধার্মিকরা “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত” হিসেবে উল্লেখ করেন। দীর্ঘ দিনের অন্ধবিশ্বাস মানুষ হঠাৎ করে ভাঙতে পারে না অথবা চায় না। আর সেই বিশ্বাসে বিপরীতে যখন চরম সত্য তুলে ধরা হয় তখন তা হয় আঘাতের শামিল। এ হল মানুষের ইচ্ছেকৃত অন্ধত্ব।
এই প্রসঙ্গে আরও একটি ছবির কথা বলা যায়। ছবিটি উনিশ শতকের একটি ঘোড়দৌড়ের ছবি। গ্যারিকাল্টে আঁকা ছবিটির নাম “হর্স রেসিং অ্যাট ইপসন”। ছবিটিতে শিল্পী যেভাবে ঘোড়দৌড় এঁকেছিলেন তাতে বাধার সৃষ্টি করলো ফটোগ্রাফির আবিষ্কার এবং তা যখন দ্রুতগামী অবয়ব ধারন করতে সক্ষম হল। তখন দেখা গেল শিল্পীর আঁকা ছবিটিতে সম্পূর্ণ ভূল ভাবে ঘোড়দৌড়ের চিত্র ফুটে উঠেছে। বাস্তবের সাথে যার তেমন কোন মিল নেই। কিন্তু ততদিনে সেই ছবি হয়ে উঠেছে জন প্রসিদ্ধ। মানুষ কোন ভাবে মানতে চাইল না গ্যারিকাল্টের আঁকা ছবিটি মিথ্যা ঘোড়দৌড়। তাদের দৃয় বিশ্বাসের কারনে তারা ফটোগ্রাফিকে মিথ্যা বলেন। সত্য হিসেবে মস্তিষ্কে চেপে রাখলেন গ্যারিকাল্টের “হর্স রেসিং অ্যাট ইপসন” কে। কিন্তু আজ আমারা জানি ঘোড়া কি করে দৌড়ায় ও তা দেখতে কেমন। সত্য চাপা থাকেনি, কালের পথে বেড়িয়ে এসেছে আজ। ভূল প্রমানিত হয়েছে গ্যারিকাল্টের মিথ্যে ঘোড়দৌড়ের ছবি। ঠিক তেমনি একদিন মানুষ বুঝতে শিখবে অভিজিৎ রায়ের লেখনীর শক্তি ও সত্যকে।
”হেড অব ক্রাইস্ট” ছবিটি জন্মের পর থেকে আমার পড়ার ঘরে দেখছি। ওটা কার আকা সেটা জানতাম না।
আমিও একমত। একদিন ঠিক ওরা বুঝবে।লেখাটা দারুণ হয়েছে।
আমিই অভিজিৎ……।
হয়তো তারা একদিন বুঝবে। সেই দিন হয়তো আমারা দেখে যেতে পারবো না। ধন্যবাদ আপনাকে।
অসাধারণ লেখা শুভ ভাই।
ধন্যবাদ আপনাকে।
কত লক্ষ জনম ঘুরে ঘুরে আমরা পেয়েছিলাম একজন অভিজিৎ রায়, একজন হুমায়ূন আজাদকে!! এমন মানুষ চলে গেলেন, যার স্থান পূরণ করা আদৌ সম্ভব কিনা আমি সন্দিহান। শুধু এটুকু জানি, তার দেখানো পথে’আমরা সবাই আলো হাতে চলা আঁধারের যাত্রী’। যে যুদ্ধে নেমেছি সেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব নয়।
কলম চলবে। ভাল লিখেছো শুভ। আমরাই অভিজিৎ।
অভিজিৎ দাদারা আর আসবে না।