ছবিটা এভাবে পোস্ট করতে হবে, কখনো ভাবি নাই। অভির সাথে যখনই ফোনে কথা হতো, বলতাম, ‘আমার কাছে তোমার ছবি সেভ করা আছে। তুমি যেদিন অনেক বড় পুরুস্কার পাবা, সেদিন ওটা প্রকাশ করবো। বলবো যে দেখো বিখ্যাত অভিজিৎ রায়ের সাথে আমার ছবি আছে।‘ ও হেসে গড়িয়ে যেতো। একই কথা বলতো সব সময়, ‘কী যে বলেন না আন্না আপা।‘
আজ ওর ছবিটা দেখছি আর ভাবছি, আরো কেনো বেশি সময় ওর সাথে কাটাই নি, আরো কেনো বেশি বেশি কথা বলি নি ওর সাথে। আমি কখনো লেখালেখি করি নাই। আমি মূলত একজন নীরব শ্রোতা, নীরব পাঠক। মিলটন যখন অভির কিংবা বন্যার সাথে কথা বলতো, ও সব সময় স্পিকার অন করে কথা বলতো, যেনো আমি সব শুনতে পাই। সেই বদৌলতে ওর জ্ঞানগর্ভ কথাগুলো শুনতে পারতাম আমি। শুনতে পারতাম ওর রসিকতা, ওর প্রাণ খুলে হাসা হাসির শব্দ। ওর আর বন্যার উৎসাহে মিলটন ওর সাথে তার প্রথম বই ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার সন্ধানে’ লিখলো।
একেবারেই ঘরোয়া পোশাকের ছবি। সাধারণ হয়েও অসাধারণ।
আমরা মায়ামিতে থাকার সময়ে অভির সাথে আমাদের প্রথম সামনাসামনি দেখা। আমাদের বাসায় এক রাত একদিন ছিলো সে। স্বল্পভাষী, অমায়িক এবং অত্যন্ত বিনয়ী এই ছেলেটার সাথে পরিচিত হতে পেরে নিজেকে অনেক গর্বিত মনে করতাম। প্রথম দেখায় ভেবেছিলাম এরকম সহজ, সরল একটা ছেলের মাথায় এতো বুদ্ধি ঘুরপাক করে কীভাবে? কীভাবে ও বিজ্ঞানের এতো সব জটিল বিষয় নিয়ে লেখে, কীভাবে সে একই সাথে সাহিত্য নিয়ে কাজ করে, কীভাবে সে ধর্ম সম্পর্কে এতো কিছু জানে? এখন আজ এই সময়ে বসে ভাবছি, অভির মতো এমন প্রতিভাবান ছেলেদের অকালে কেনো চলে যেতে হয়? তাও এইভাবে? এদের মতো ছেলেদের তো অনেক যত্নে রাখতে হয়, এরা যা সৃষ্টি করে যাবে, তাই হবে আগামী দিনের সম্পদ।
অভি জীবন দিয়ে আমাকে কলম তুলতে শেখালো। দুঃখ হয় এই ভেবে যে, অভি তো জানতে পারলো না, অকে আমি বা আমরা কতোটা উঁচু দরের মানুষের তালিকায় রেখে ছিলাম। এ কারণে, আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, এখন থেকে যা ভাবি, যা করতে চাই, যা বলতে চাই, তা আর সময়ের অপেক্ষায় ফেলে রেখে দেবো না।
কবে আমাদের দেশ ও দেশের মানুষ বুঝবে যে অভিদের বাঁচিয়ে রাখতে হয়, হত্যা করতে হয় না এমন নিষ্ঠুরভাবে।
অভি, তুমি ছিলে, তুমি আছো, তুমি থাকবে আজীবন আমাদের হৃদয়ে।
আমার মনের কথাটা বলেছেন।
চুপ করে আর থাকব না। যা মনে করি, যেমন ভাবে মনে করি স্পষ্ট করে জানিয়ে দেব। অন্তত নিজের বিবেকের কাছে পরিস্কার থাকা যাবে অতি ক্ষুদ্র মাত্রায় হলেও আমি চেষ্টা করেছিলাম।
সময় এমনই চীজ যে বোবার মুখ দিয়েও কথা বের করে আনে।
আশাকরি আন্না ভাবি এখন থেকে নিয়মিত লিখবেন।
এ ছয়টি চোখে পৃথিবীর সব সরলতা | অভূতপূর্ব | বোন আন্নার লেখাটি কিছুটা হলেও আমার অন্তর স্পর্শ করেছে | আমি নিজে কখনই অদৃষ্টবাদী নই | আমি নই বিশ্বাসী | তবুও বলছি এ তিন চেহারার এক অদ্ভূত মিল | এদের সবার চোখেই স্বপ্ন, এদের সবার মন জুড়ে আর্তনাদ করে মহাপরিবর্তনের এক সীমাহীন আকাংখা | এদের সবার বুকেই মহা সমুদ্রের গর্জন | তাই বোধ হয় এদের সবার মন ও মনন গ্রথিত হয়েছিল একই সুতায় | বোন আন্না, তুমি যখন কলমটি ধরলেই – একে আর ছেড়ে দিও না | অন্তত শুন্য স্থানটি পূর্ণ করো |
অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু আমাদের সবার জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। আমি ওনাকে সামনাসামনি দেখিনি, ওনার সাথে কথাও হয়নি কখনও; কেবল মুক্তমনাতেই হাতেগোনা কিছু মন্তব্য বিনিময়ের মধ্যে আমাদের যোগাযোগ সীমাবদ্ধ ছিল। এরপরও তাঁর লেখা/মন্তব্য পড়তে পড়তে কখন যে তাঁকে কাছের চেনা মানুষ হিসাবে ভাবতে শুরু করেছি তা নিজেও বুঝতে পারি নি। চেনা মানুষদের মধ্যে আর কাউকে এমন নৃশংসতার শিকার হয়ে না ফেরার দেশে চলে যেতে দেখিনি বলেই হয়তো এই মৃত্যু আমাকে এতো আলোড়িত করেছে।
আরও অনেকের মতো আমিও অভিজিৎ রায়ের লেখার নীরব পাঠক ছিলাম। প্রফেসর অজয় রায়কে নিয়ে তাঁর লেখাটা আমার অন্যতম প্রিয় লেখাগুলোর একটি ; বাবার জন্য অনেক ভালবাসা আর শ্রদ্ধায় ভেজা লেখাটি খুব কাছের, বড্ড চেনা। মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কে সাম্প্রতিক ধারনাগুলোকে জানার হাতেখড়ি হয়েছে তাঁর লেখা পড়েই। খোলা মনে তাঁর ধর্ম আর কুসংস্কার নিয়ে লেখাগুলো পড়লে যুক্তির তীক্ষ্ণতা, ইতিহাস-নির্ভরতা আর নির্মোহ বিশ্লেষণের ক্ষমতা চোখে পড়বে যে কারও। কখনও কখনও কিছু বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও তাঁর লেখার মূলভাবের সাথে প্রায় সবসময়েই একমত হয়েছি; অনেক কিছু জেনেছি, শিখেছি তাঁর লেখা পড়ে।
আমার মতে অভিজিৎ রায়ের সবচেয়ে বড় অবদান মুক্তমনার মত একটি প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টি। তিনি এবং তাঁর সমমনারা মিলে নিরপেক্ষ মত প্রকাশের যে জায়গা করে দিয়েছেন, জ্ঞানের আদান-প্রদানে ভূমিকা রাখছেন, অজ্ঞানতা, কুসংস্কার আর অবিচারের বিরুদ্ধে লড়ছেন এবং ব্লগ সাইটটির উঁচু মান ধরে রেখেছেন এজন্য বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। মুক্তমনার চলমান ধারাটি অক্ষুণ্ণ রেখে একে আরও সমৃদ্ধ করাই হবে তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানোর সেরা উপায়।
@মনজুর মুরশেদ,
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এ জন্য যে আমরা যারা মুক্তমনা ব্লগ এর সাথে নানা ভাবে যুক্ত আপনি ঠিক তাদের মনের কথাটিই জানিয়েছেন ।
অভিজিৎ আর আমাদের মাঝে নেই ,এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্ল্যাটফর্ম এর সর্বউচ্চ ব্যবহারই হতে পারে এর উপযুক্ত জবাব ।
এ ক’দিন শুধু এক একটা ছবি দেখে যাচ্ছি আর ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে। রাতে ঘুমাতে পারি না। আরো ঘুমাতে পারি না যখন দেখি অভিজিৎ রায় একবার নয়, বার বার হত্যা হচ্ছে। তবু অপেক্ষা করতেই থাকি, একদিন হয়তো এ দেশ বুঝবে!